বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না
ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগের। ১৯০০ সালে তৎকালীন ইংরেজ সরকার
বারাকপুরের কাছাকাছি ইছাপুরে দুটি অর্ডন্যন্স্ ফ্যাক্ট্রি পত্তন করেন। আমাদের
আদিবাড়ী ঢাকা বিক্রমপুরে তৎকালীন পূর্ববাংলায়। আমাদের বাবা জ্যাঠারা চার ভাই
১৯২০-২২ নাগাদ ইছাপুরে রাইফেল ফ্যাক্ট্রিতে চাকরি সূত্রে যোগদান করেন। তখন খাশ
ইংরেজ রাজত্ব, ফ্যাক্ট্রিতেও তাদেরই একছত্র আধিপত্য। তবে তারা গুণের কদর জানতেন
এবং তাদের যথাযথ প্রতিষ্ঠাও দিতেন। তেমন একজন ছিলেন আমার স্বর্গত জ্যাঠামশাই
শ্রীকরুণাকান্ত চক্রবর্তী। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ তে অঙ্কশাস্ত্রে ১ম স্থানাধিকারী ছিলেন
এবং পাশ করার পরই রাইফেল ফ্যাক্ট্রিতে আডমিনিস্ট্রেটিভ্ অফিসার পদে যোগদান করেন।
তাঁর ইংরেজিতেও অসামান্য দক্ষতার কারণে তৎকালীন ইংরেজ সরকার তাকে সরাসরি এই পদে
নিয়োগ করেন যা সেইসময় একটা ব্যাতিক্রমি ঘটনা। সারা ফ্যাক্ট্রিতে তখন ভারতীয় অফিসার
ছিলেন ৩/৪ জন। জ্যাঠামশাই পরবর্তী কালে এমপ্লয়মেন্ট ম্যানেজার হন এবং
ফ্যাক্ট্রিতেও ১৯৩০/৪০-র দশকে শতকরা আশিভাগ স্থানীয় মানুষের চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।
তিনি ইছাপুর অর্ডন্যন্স্ ক্লাব, কুঅপরেটিভ স্টোর, স্কুল ইত্যাদি নিজের উদ্যোগে
প্রতিষ্ঠা করেন।
যাইহোক এবার বলছি আমাদের
ফ্যাক্ট্রি এস্টেটের কোয়ার্টারের কথা। যা এককথায় একটুকরো স্বর্গরাজ্য। চারিদিকে
বিশাল পাঁচিল ঘেরা প্রায় ১৫০-টি বাংলো আকারের কোয়ার্টার ছিল
অফিসারদের বাসস্থান। কোয়ার্টারের সামনে পেছনে বিশাল বাগান এবং তাও পাঁচিল
ঘেরা। এস্টেট এর মাঝে ছিল এক বিশাল খেলার
মাঠ।।
আমার জ্যাঠা-বাবা মিলিত ভাবে
পাশাপাশি দুটো কোয়ার্টারের দখল নেন যা ছিল দুটো দোতলা বাড়ি, নিচে সংযোগ করা। আমরা
ভাইবোনেরা প্রায় সকলেই এখানেই জন্মগ্রহণ করি। স্বভাবতই আমাদের ছিল এক বিশাল
পরিবার।
এবার আসল ঘটনার কথায় আসি। সেই
সময়ে (প্রায় ৭৫ বছর আগে) আমার এক জ্যাঠতুতো ভাইয়ের জন্ম হয়। জন্মাবধি সে ছিল
কিছুটা রুগ্ন ও যেন কেমন এক অশরীরী অস্তিত্বের শিকার যা কেউ দেখতে পেত না কিন্তু
প্রায়শঃই অনুভব করত। আমার জ্যাঠাইমা সন্তান জন্মের পর অসুস্থ হয়ে পড়েন, ফলে
বাচ্চার দেখাশোনা প্রধানত আমার মাই করতেন। বাচ্চাটিও মার সান্নিধ্যে বেশী সুস্থ
থাকত।
সেদিন ছিল বৈশাখ মাসের এক কাল
বৈশাখীর সন্ধ্যা। বাচ্চাটার দুদিন যাবৎ সামান্য জ্বর ছিল। আমাদের শোবার ঘর ছিল
দোতলায়, আর রান্নাঘর, খাবারঘর, ভাড়ারঘর একতলায়। বাচ্চার জ্বর হওয়ায় সবাই পালা করে
তার দেখাশোনায় ব্যাস্ত ছিল। বিকেলে ডাক্তার দেখে গেছে। কিন্তু জ্বর ক্রমশঃ
উর্ধগামী। স্বভাবতই সকলেই উদ্বিগ্ন। আমার মা সারা সন্ধ্যে বাচ্চাটিকে আগলে রেখেছে।
এদিকে এতবড় সংসারের অনান্য কাজ বাড়ীর অনান্য কাকিমারা, কাজের লোক নীচতলায়
সামলাচ্ছে।
বাড়ীর পেছনদিকে আম, জাম, কাঠাল ইত্যাদি ফলের এবং একটি অতি বিশাল চাঁপা ফুলের
গাছ ছিল। আর একটি ঘোরানো লোহার সিড়ি ছিল যাতে বাড়ীর পেছনের বাথরুমে যাতায়াতের
ব্যবস্থা ছিল এবং যা কেবলমাত্র জামাদারেরাই বাথরুম পরিষ্কার করবার জন্য ব্যবহার
করত। আমাদের কারোরই ঐ সিঁড়িতে ওঠবার অনুমতি ছিলনা। কিন্তু দিনের বেলায় বাবারা
অফিসে বেরিয়ে গেলেই ঐ নিষেধ আর কে মানে। আমাদের ওই সিঁড়িতে ওঠনামা করা একটা প্রধান
খেলা ছিল।
ঘটনার দিন সন্ধ্যাবেলায় আমার কাকিমারা একতলায় রান্নাঘরে ব্যস্ত। হঠাৎ আমার সেজকাকিমা
লক্ষ্য করে আমার মা যার কিনা সর্বক্ষণ বাচ্চাটির পরিচর্্যায় থাকার কথা সে ঐ
মেথরের যাতায়াতের সিঁড়ি ধরে ঘুরে ঘুরে ওপরদিকে উঠছে, যা বাড়ীর বৌ ঝিদের পক্ষে
কল্পনাতীত। মাকে ঐ অবস্থায় দেখে কাকিমা রান্নাঘরের সিঁড়ির থেকে নেমে সেই ঘোরানো
সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকেন- “সেজদি আপনি কোথায় যাচ্ছেন, এই নোংরা
সিঁড়িতেই বা এই ভর সন্ধ্যাবেলায় উঠছেন কেন?” কিন্তু সাদা শাড়িপরা মা রূপী সেই
মহিলা তার দিকে ফিরে না তাকিয়ে উঠতেই থাকেন। ঝড়ের তান্ডবের মাঝে কাকীমা এবার
ঘোরানো সিঁড়ির নিচে এসে চিৎকার করে মাকে ডাকে। এবারে সেই মহিলা উপরের সিঁড়ি থেকে
নিচে ঘুরে কাকিমার দিকে দেখে। কাকিমা দেখে মার অবয়বে ফিরে তাকানো মহিলাটির এক
ভয়ংকর অপার্থিব, বীভৎস মুখ যা কোন মানুষের হতে পারে না, সঙ্গে কোটরগত জ্বলন্ত
দৃষ্টি। এই দৃশ্য দেখার পর কাকিমা এক বিকট চিৎকার করে সিঁড়ির নীচে আছড়ে পরে। এদিকে
তার চিৎকার শুনে বাড়ীর ওপরে নিচে যে যেখানে ছিল সবাই এসে নিচে তার কাছে জড় হয় ও
তার পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ
পর সকলের খেয়াল হয় ওপরে দোতলায় শিশুটা একলা ঘরে পড়ে আছে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে সকলে
ওপরে উঠে দেখে শিশুটি শুয়েই আছে কিন্তু সমস্ত শরীর আস্বাভাবিক রকম নীল হয়ে গেছে-
দেহে কোন প্রাণ নেই। সেই প্রথম আমাদের সংসারে মৃত্যুর করুণ অথচ নির্মম স্পর্শ
পেলাম। এর কিছুদিন পরেই আমরা এই বাসা ছেড়ে অন্য কোয়ার্টারে চলে যাই।
Swarup, thanks for adding the wonderful pics.
ReplyDelete