একটি মেধাবী ছাত্রের দুর্দশা ...
Picture Courtesy: Writer |
“বাবা, ৬৫ নম্বরকে এই প্যাকেটটি
একটু দিয়ে দেবে?” নীলা অত্যন্ত সঙ্কোচে সংশোধনাগারের পাহারায় রত
রক্ষীকে অনুরোধ করে।
অসন্তোষের সঙ্গে কারা রক্ষকের জিজ্ঞাসা, "এতে কি আছে? এত ভারী যে!"
“ঘরে বানানো মুড়ির মোয়া, নাড়কেল নাড়ু আর তিলের নাড়ু। আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। ছেলেটা ভীষণ ভালোবাসে ", প্রত্যুত্তরে জানায় নীলা।
অসন্তোষের সঙ্গে কারা রক্ষকের জিজ্ঞাসা, "এতে কি আছে? এত ভারী যে!"
“ঘরে বানানো মুড়ির মোয়া, নাড়কেল নাড়ু আর তিলের নাড়ু। আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। ছেলেটা ভীষণ ভালোবাসে ", প্রত্যুত্তরে জানায় নীলা।
নীলা এবং অমলের একমাত্র সন্তান মৃন্ময়। সরকারী চাকুরে
অমল অফিসে যাতায়াতের সুবিধের জন্য পাঁশকুড়ায় থাকত। দু’সপ্তাহে একবার বাড়িতে আসত।
অমলের বাড়িতে আসার অর্থ প্রচণ্ড ব্যস্ততা। ছেলের পড়াশুনার বিস্তারিত সংবাদ নেওয়া,
প্রয়োজনীয় সাহায্য করা, প্রয়োজনীয় সবকিছু সংগ্রহ করা, বিদ্যালয়ের টিফিনের বন্দোবস্ত
এবং দু’সপ্তাহে সংসারের প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করে সোমবার খুব সকালে পাঁশকুড়ার
উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়তো। মৃন্ময় তখন অষ্টম শ্রেনীতে। সেও খুব পিতৃভক্ত। মৃন্ময় এক
কথায় পিতা-মাতার বাধ্য সন্তান বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। এভাবেই বেশ চলছিল।
একদিন গভীর রাত্রে অমলের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে
দিশেহারা নীলা যখন অমলের কাছে পৌঁছায় ততক্ষণে সব শেষ। বিনা মেঘে বজ্রপাতে অসহায়
নীলা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে । আত্মীয় – পরিজনদের অভাবনীয়
সহায়তায় সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সক্ষম হয়। সরকারী অবসরকালীন ভাতাই এখন সংসারে একমাত্র উপার্জন। মৃন্ময় দ্বাদশ শ্রেনীতে বিজ্ঞান বিভাগের কৃতী ছাত্র।
পিতৃবিয়োগ সামলে সে অভাবনীয় মানসিক দৃঢ়তায় নিজেকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। পিতার অবিরাম একলা লড়াইয়ের
শিক্ষা বিফলে যায়নি।
মেধাবি মৃন্ময়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, তাঁর মা নীলা। এমন কোন কথা
নেই মৃন্ময়ের জীবনে, যেটা নীলার অজানা। মৃন্ময় ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষায় বেশ
ভালো ফল করে। কলিকাতা মেডিকেল কলেজে সুযোগ পায়। খুব কাছের কয়েকজন বন্ধু স্থির করে, শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশের আগে
সবাই মিলে একদিন করে প্রত্যেকের বাড়িতে মিলিত হয়ে মায়ের হাতের খাবারের আস্বাদ উপভোগ
করবে। প্রত্যেকের মা খুব খুশী হয়। আজকের দিনে এইরকম ভাবনাটাই অন্যরকম।
নীলার এখনও পরিষ্কার মনে পড়ে সেই শনিবার দিনটার কথা।
মৃন্ময়ের বাল্যবন্ধু সুখেনদের বাড়ি পাড়ার মধ্যেই কিন্ত একটু ভেতরে। মৃন্ময় রাত আটটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় তাপসের সাথে। নীলাকে জানায় সে রাত
দশটার মধ্যেই ফিরে আসবে। রাত গভীর হয় কিন্তু মৃন্ময়ের কোন খবর সে পায়
না। অস্থির মনে সমস্ত দুশ্চিন্তাকে দূরে সরিয়ে সকলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা
করতে থাকে। রাত তখন প্রায় সাড়ে-বারোটা, সে সুখেনের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়।
জানতে পারে সকলের সাথেই মৃন্ময় প্রায় রাত পৌনে-দশটা নাগাদ সুখেনদের বাড়ি থেকে
বেড়িয়ে গেছে। তারপর কেউ কোনরকম খবর দেয়নি। সুখেনের মুঠোফোনটি বিদ্যুৎ পুনঃপুরনের
প্রয়োজনে বন্ধ থাকায় কারুর সাথেই সে যোগাযোগ করতে পারেনি।
তখন প্রায় রাত পৌনে একটা। সুখেন, তাঁর কাকা ও দাদাকে নিয়ে
আসে। অন্যান্য বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। সকলেই জানায়, সুখেনের বাড়ি থেকেই সবাই
নিজ নিজ বাড়ির পথে চলে যায়। পাড়ার প্রতিবেশীরা নীলার কাছে নানা প্রশ্নের উত্তর
জানতে চায়। নীলা অস্থির বোধ করতে করতে চেতনা হারায়। সকালে যখন চেতনা ফিরে আসে তখন জানতে পারে
মৃন্ময় স্থানীয় থানার হাজতে। রাতে মৃন্ময়কে পুলিস প্রচণ্ড মেরেছে। সে এখনও অচেতন অবস্থায় থানার হাজতে। আদালতে পাঠানো হবে পরবর্তী
পর্যায়ের বিচার ব্যবস্থার উদ্দেশ্যে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক, বন্ধু – বান্ধবরা সকলে বাড়িতে ভীড়
করেছে। সকলের একটাই প্রশ্ন কিন্তু উত্তর সকলের কাছেই
অজানা। যে মেধাবি ছাত্র ডাক্তারিতে সুযোগ পায়, সে কিভাবে রাতের অন্ধকারে থানার
হাজতে। সকলে মিলে চেষ্টা করে মৃন্ময়কে থানার হাজত থেকে ছাড়িয়ে আনতে। কিন্তু বৃথা চেষ্টা, পুলিস দেশ-বিদ্বেষী কার্যকলাপে
যুক্ত ধারাতে মোকদ্দমা নথিভুক্ত করেছে। সবকিছু বুঝেও মহামান্য ধর্মাবতার কিচ্ছু
করতে অপারগ ছিলেন।
আদালতে এখন পূজোর ছুটি। স্থানীয় থানার বড়বাবু ও
অন্যান্য আধিকারিকরা খুব বড় রকমের ভুল করে ফেলেছে।
তাঁদের কাছে পাকা খবর ছিল, দেশ-বিদ্বেষী কার্যকলাপে যুক্ত কয়েকটি ছেলে এপাড়াতে
ঘোরাঘুরি করছে। প্রশাসনিক চাপে,
তাড়াহুড়োতে একা মৃন্ময়কে অত রাতে দেখতে পেয়ে পুলিস তাঁকে গাড়ীতে তুলে নেয়। ন্যুনতম
সুযোগ মৃন্ময় পায়নি। আদালত থেকে সংশোধনাগারে নিয়ে যাওয়ার পরে স্থানীয় থানায় খবর আসে, তাঁরা ভুল করেছে। ততক্ষণে সব শেষ, মৃন্ময় হয়ে গেছে সংশোধনাগারের ৬৫
নম্বর কয়েদি।
বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মৃন্ময়কে বেশ স্নেহ করেন। বন্ধু –
বান্ধব, শিক্ষকরা সবাই একসাথে চেষ্টা করেন। স্থানীয় বিধায়ককে সবিস্তারে আবেদন
পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু থানার আধিকারিকরা এত দ্রুততার সাথে আদালত থেকে সংশোধনাগারে
পাঠানোর ব্যবস্থা করেন যে সব প্রচেষ্টা বৃথা যায়। পুলিস প্রশাসনের অতীব উচ্চাশার
ফলস্বরুপ মৃন্ময় আজ সংশোধনাগারে।
জানাজানির পর পুলিস প্রশাসনের পক্ষ থেকে বহুবার
নীলাকে বোঝানো হয়েছে যে, তাঁরা সবসময় নীলার পাশে থাকবে। পুলিস আধিকারিকরা অনুতপ্ত
ও অসহায়। পূজোর ছুটির পরেই আদালতের প্রথম দিনেই মৃন্ময়কে মুক্ত করে দেওয়ার জন্য
প্রশাসনিক চেষ্টা করা হবে। ডাক্তারি পড়াশুনায় যেন কোনরকম অসুবিধা না হয়
প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবরকম প্রচেষ্টা
থাকবে। সমগ্র প্রশাসনের কাছে নীলার আর্তি,
তাড়াহুড়োতে যেন আর কোন মৃন্ময়কে এহেন জটিল ও অত্যন্ত কষ্টদায়ক পরিস্থিতির
সন্মুখীন হতে না হয়। আশান্বিত নীলা প্রতিদিন নিয়মমাফিক সংশোধনাগারে যায় একমাত্র
সন্তানকে চাক্ষুষের অভিলাষে, যতদিন মৃন্ময়ের কারামুক্তি না হয়।
Eta ki kono satti ghotona obolombone lekha? Hole obak hobo na.
ReplyDeleteসত্য ঘটনা " ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া নিখোঁজ " অবলম্বনে লেখা। কাহিনী রচনা একান্তই লেখকের।
Delete