বৃহন্নলা
Image Courtesy: Google |
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে জেগে ওঠে দুজনেই। আজ কি একটু
বেশিই মায়াবী, স্নিগ্ধতায়
ভরা প্রভাত-কিরণ!
দিনের আলোয় যেন চোখে লাগে ছটা, উগ্ৰতা নেই, আছে কেবলই উষ্ণতার ছোঁয়া।
বিহ্বল দুটি চিত্তে রয়েছে বেদনা, রয়েছে
আনন্দ-ঘন অনুভূতি কিন্তু আজ! আজকের দিনটা
যে এক্বেবারে আলাদা-জন্ম হবে
নতুন পরিচিতি। উৎকণ্ঠা, অসম্ভবের সম্ভাবনায় রিয়া আর রাঘবের বর্হি আচরণ চঞ্চল, খুশীর জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দুই শরীর এক প্রাণকে।
সময়ের অনেক
আগেই দুজনে চলে এসেছে প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে। বারংবার তাই নিয়েই ব্যস্ত দুজনে। ওটা নিয়েছো? এটা, সেটা কোনো ভুল হয়নি তো! হ্যাঁ, ওদের দু-চারজন বন্ধু তারাও আসছে এক এক করে। কিভাবে যে ওরা
পরম হিতাকাঙ্খীতে রূপান্তরিত
! আশ্চর্য ! নির্দিষ্ট সময়ে হোমের অফিস ঘর খুললো। একটু পরেই ওদের ডাক এলো, যে ডাকের
অপেক্ষায় প্রতিটি পল, পা দুটো যেন
পাথরে বাঁধা-মন চাইছে
ছুটে যেতে ; দুজনে আস্তে
ধীরে প্রবেশ করলো ঘরে।
”গুড-মর্নিং মি. এন্ড মিসেস দাস ।“
“নমস্কার ম্যাডাম।“
“আসুন, বসুন।“
“ও হ্যা, গুড- মর্নিং
ম্যাডাম।“
“বসুন, বসুন।“
বেল বাজিয়ে একজনকে ডেকে
ওদের জন্য চায়ের কথা বলতেই দুজনে একসাথে বলে উঠলো " না,না এখন চা খাবো না " ।
“ওকে, দু-গ্লাস জল
দিয়ে যাও আর মায়াকে বলো আসতে।“
“আচ্ছা, আপনারা সব
ডকুমেন্ট নির্দেশমতো এনেছেন তো ?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ সব। এই যে, দেখে নিন
আপনি।“
“টেবিলে বিছিয়ে দেওয়া কাগজে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে
আবার বেল বাজান মহিলা” সুপারিনটেনডেন্ট।-আচ্ছা, আমাদের বন্ধুদের ডাকতে পারি?
“উউউ, কয়জন?”
“তিন-চারজন।“
“ডাকুন।“
রাঘব বেরিয়ে ওদের ডাকতেই একটু সঙ্কোচের সাথে ওরা
আসে। যাঁরা সশব্দে হাসি-কথাতে
বিরক্তির কারণ হয় তাঁরাও আশ্চর্য রকম চুপ!
“মি. এন্ড মিসেস দাস এই জায়গাগুলোতে সাইন করুন।“
“হ্যাঁ ,হ্যাঁ”
উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায় দুজনেই। একজন মহিলা প্রবেশ
করছেন কোলে সুন্দর করে জড়ানো এক
শিশুকে নিয়ে।
“দুজনের সাইন ই লাগবে।“
কম্পিত হস্তাক্ষরে নির্দিষ্ট জায়গায় দুজনে সাইন করে
এগিয়ে দেয়।
“ওকে, ঠিক আছে।
দেখুন আপনাদের দেওয়া জামা- প্যান্ট পরে কি সুন্দর দেখাচ্ছে!” শকুন্তলা-“আজ তোমার বড় আনন্দের দিন জানো কি!” বলতে বলতে মহিলা উঠে আলতো করে কপালে স্নেহের পরশ আঁকেন। “এবার আপনাদের পছন্দ মতো নাম রাখুন, নিন, কোলে নিন !”
থরথর করে কাঁপছে দুজনে, অজান্তেই
সবার অশ্রুসজল চোখ। এগিয়ে বাচ্চা নেওয়া যাঁদের বাঁ
হাতের খেল্, তাঁরাও কেমন
স্থির ! এগোতে পারছে না তাঁরাও।
”কই, আসুন। মায়া
সাবধানে, দাও ওদের
কাছে। সম্বিৎ ফিরে পেতে রাঘব- রিয়া পরস্পর পরস্পরের
সঙ্গে যেন চোখের ভাষায় কথোপকথন সারে, ত্রস্ত
পায়ে ভয়ে ভয়ে রিয়া
বাড়িয়ে দেয় হাত। ভদ্রমহিলা আলতো চুমু খেয়ে মেয়েকে তুলে দেয় রিয়ার হাতে। সজোরে বুকে চেপে ধরে রিয়া, রাঘবও দুহাতে ঘিরে রাখে একরত্তি প্রাণটুকুকে, যদি পড়ে যায় !
“আমাদের ছেড়ে দিতে কষ্ট হয় তবু সুস্থ সুন্দর পরিবারের অংশ
হিসেবে আদরে ভালোবাসায়
ভরে উঠবে একটা জীবন আর সম্ভবও না সবাইকে যথাযথ ব্যবস্থা করে যে রাখবো। অনুরোধ, আজ, ও যেমন মা-বাবা পেলো তেমনি
আপনাদেরও পরিচিতি অন্য মাত্রা পেলো। প্রসব না
করেও যে মা-বাবার স্থান নেওয়া যায় দেখান্ পৃথিবীকে। আশীর্বাদ করি আপনাদের সন্তান মানুষ হয়ে আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করুক।
অভিনন্দন জানাই, বেশির
ভাগেরই চাহিদা
পুত্র, সেকারণেও
আপনারা ব্যতিক্রম। কন্যা চেয়েছেন, সেকারণে
অপেক্ষা করতেও দ্বিধা
করেননি। আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানবেন।“
কান্নায় ভেঙ্গে পড়া রাঘব-রিয়া কোনরকমে প্রত্যুত্তর
দেয়। চোখের জলে স্নাত স্নিগ্ধ কন্যার
মুখখানি যেন পটে আঁকা ছবি, বিশ্বাস হয়
না যে !
অসহ্য শারীরিক মানসিক যন্ত্রণার দিনগুলোর কথা মনে পড়লে দুজনেরই মনে হয় যদি মুছে ফেলা যেতো! সম্পূর্ণ দুই অচেনা
পরিবারের মানব-সন্তান, আর পাঁচটা স্বাভাবিক সন্তানের মতো নয়, আচরণগত ত্রুটি তাদের সমাজ থেকে ব্রাত্য করতে শুরু করেছিল, সমগোত্রীয়, তাঁদের নজরেও পড়ে ছিল কিন্তু দুজনেরই মিল একজায়গায়, পড়াশোনা শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। অনাদর উপেক্ষা করে লক্ষ্যে অবিচল থেকেছে। "মেয়েলিপনা" ,ব্যাটাছেলে মার্কা"-এসব
শব্দবন্ধনীকে অবহেলায় উপেক্ষা করতে
পেরেছিল যাঁর আন্তরিক
সহযোগিতায় আজ বড়ো তাঁর কথা মনে পড়ছে। না, তিনি নেই আর। উচ্চ মাধ্যমিক অবধি বাবা মা শত সমস্যা সামলে সাথে
থেকেছিলেন। একই প্রতিষ্ঠানে বিউটিশিয়ান
আর কম্পিউটার কোর্স করতে গিয়ে ক্রমশঃ অবাক। বিস্মিত দুজনেই। সেখানেও তারা হাসির খোরাক আর আড়ালে আবডালে নিজেকে সরিয়ে নিতে
গিয়ে পরস্পর বিরোধী শরীর-মন সম্পন্ন
দুজনে দুজনের মাঝে খুঁজে পায় আশ্রয়। ওদের বন্ধুত্ব সেটাও যেন মজার ব্যাপার! ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার পথে যে কঠিন আঘাত সহ্য করতে
করতে আসা যে এখন আর এগুলো কষ্ট
দেয় না। কঠিন আবরণে মুড়ে নেওয়া দুটি মন বাকী সমাজকেও ব্রাত্য করেই রাখে।
নিজ বাড়ি
পরিবেশই সহযোগিতা করে না। আড়ালে রাখতেই তো চেয়েছিল। নিজস্ব তাগিদ দিয়েছে আলোকিত পথের সন্ধান। একই
প্রতিষ্ঠানে দুই অমৃত সন্তানের
মিলন! "মেলালেন, তিনি
মেলালেন "। যিনি চেনালেন বাইরের জগৎকে, চেনালেন রবি-সহ আরো অনেককে, একদিন তিনিই
নিয়ে গিয়েছিলেন দেখাতে "চিত্রাঙ্গদা" । দেখে বেড়িয়ে আসার পর বোঝালেন, কত কিছু
বললেন। দুজনের মনে একই প্রশ্ন- হয়না ! হতে
তো পারে!
দুজনেই স্বপ্নজালে বন্দি। দুজনে কোন কথা বলতে পারছিল না, আশা আকাঙ্ক্ষা বেগবতী-সম
বয়ে যাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছিল দুইমনাকে, একই
বিশ্বাসে। আজকাল তো খবরে আসে, এতো অবাস্তব কল্পনা নয়। সিদ্ধান্ত নিলে প্রতিবন্ধকতা এসেছে, অর্থ একটা বিশাল ভূমিকায়
রয়েছে। শুরু হয় নতুন করে শারীরিক মানসিক লড়াই। অসহ্য যন্ত্রণা। দীর্ঘ সময় আর অর্থ, দুই
প্রয়োজন। সহৃদয় এক তরুণ ডাক্তারের সহযোগিতায় একটি এন জি ও র দৌলতে সম্ভব
হলো। ক্রমে রূপান্তরিত রূপে রিয়া-রাঘব জন্ম নিলো ধূলোমাটির অঙ্গনে। দুই পরিবারেও তো ছিল চিন্তা, পারস্পরিক
সম্পর্ক তৈরি করে ওরা যদি ভালো থাকে সেই ভাবনা উজাড়
করে দিলো তাদের সহযোগিতা। ডাক্তারবাবুরা বলেছিলেন আপনাদের সাহচর্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, এগিয়ে আসুন, সুস্থ সুন্দর জীবন দিন ওদের। তাঁদের স্নেহের পরশে রূপান্তরিত দুই শরীর নতুন পরিচয়ে আত্মীয় স্বজনের
কাছেও পায় সহমর্মিতা। অদ্ভুত।
দু-চারজন বিভিন্ন বয়সী যাঁরা একই কারণে এক নির্দিষ্ট পেশার মধ্যে আবদ্ধ তাঁরা যেন কি করে ওদের সাথে জুড়ে গিয়ে এক সুমধুর সম্পর্ক
স্থাপন করে ফেলেছে। ওদের আনন্দে ওরাও
আনন্দিত। একেবারেই অনাড়ম্বর ভাবে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয় রাঘব- রিয়া।
শুরু আর এক সমস্যা- রিয়া মা
হতে চায়। আবারও চলে নানাবিধ হাজারো সমস্যার সমাধান করতে করতে এগোনো। আজো প্রতিকূলতায় হাত বাড়িয়ে
দেয় নিত্য যাঁরা বাচ্চার মঙ্গল
কামনার নামে "অত্যাচার" করে তাঁরা। একে কি বলা যায় ! অনাস্বাদিত স্বাদ পাওয়ার ইচ্ছে পূরণ হয় ওদের, ছোট্ট
একরত্তিটা আজ ওদের কোলে কোলে ঘোরে। আদরে ভালোবাসায়
ভরে দেয় ওর না-পাওয়া টুকুকে। স্বর্গীয় তো এটাই।
হৃদয়াসনে মিলিত মনের অনেক অপূর্ণতা পূরণ করে জয় করে
নেয় ছোট্ট অবহেলিত ডাস্টবিনের
পাশে পড়ে থাকা কন্যাসন্তান-মাধুরী।
খুব খুব বাস্তব কথা লিখেছ তুমি। কোথাও গিয়ে একটা মানুষের জন্য চোখে জল এলো, সেই ঋতুরাজ ।
ReplyDelete