ভোলার দার্জিলিং ভ্রমণ
ভোলা তখন
সপ্তম শ্রেনীতে পড়ছে। গোধূলি থেকেই ভোলার কোন খবর নেই। কিছু সময় পরেই গৃহশিক্ষক
আসবে কিন্তু ভোলার কোন সংবাদ কেউ বলতে পারছে না। বড়বৌদি, বড়দাকে জানায় ভোলার নিখোঁজ সংবাদ। “ এ ছেলেকে দিয়ে কিছু হবে না। এ ছেলে একেবারেই কান্ডজ্ঞানহীন“ বড়দার উস্মা প্রকাশ। বাবার কানে এতক্ষণে খবর পৌঁছে গেছে।
শান্তি, সুধা ও চিনু, ভোলার ছোট দুই ভাই ও বোনের ডাক পড়ল। প্রথমে সবাই নিরুত্তর।
অনেক বকাঝকার পর শান্তি জানায় “বিদ্যালয় থেকে টিফিনের সময় ছোড়দা চলে আসে। তবে ভগবান ও
বিশুদা বলছিল, তাঁরা ছোড়দাকে বিদ্যালয় থেকে বাড়িতে এসে সব্জি ক্ষেতের দিকে
যেতে দেখেছিল।“ যথারীতি ভগবান ও বিশুর ডাক পড়ল।
ওড়িসা নিবাসী বিস্বস্ত কাজের মানুষ, ভগবান, বাজার ঘাট করা, দোকানে দোকানে সবার খাবার পৌঁচ্ছে দেওয়ার মত কাজকর্ম
সামলায়। বিশু গোয়াল ঘর সামলায়। ওরা জানায়, দারোগা বাবুর ছেলের সাথে ভোলা সব্জি ক্ষেতের দিকে বইয়ের
ব্যাগ নিয়ে যায় কিন্তু খালি হাতে ফিরে বাড়ি থেকে অন্য কোথাও চলে যায়। মেজদা, ন’দা লন্ঠন ও টর্চ নিয়ে ভগবানদের সাথে সব্জি ক্ষেতে যায়।
সব্জি ক্ষেতের আলের একদিকে মাটির মধ্যে ভোলার বইয়ের ব্যাগ পাওয়া যায়। দারোগা বাবুর
পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হ’লে জানা যায় তাঁদের বড় ছেলে, বিপ্লব, মাসির বাড়ি গেছে।
বাড়িতে অন্তত এটাই বিপ্লব জানিয়েছে।
দারগাবাবুর
বড়ছেলে বিপ্লবের সাথে ভোলা ততক্ষণে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে দার্জিলিং এর পথে। দশ
ভাই – বোনের মধ্যে ভোলা সপ্তম। ছোট বেলা
থেকেই ভোলার মনটা বাইরে বাইরে। পৈতৃক ব্যবসায় বড় ভাইয়েরা দেখাশোনা করে। বাড়িতে ধান খেত, সব্জি খেত, পুকুর, কলা বাগান, গোয়াল ভর্তি গরু। কয়লা, চুন, বালি, লোহা, মুদির
দোকান, কাঠের আসবাবপ্ত্রের পৈতৃক ব্যবসা। এছাড়াও শহরের নানান জায়গায় বহু দোকান ঘর
রয়েছে ভাড়ায়। শহরের বিখ্যাত সিনেমা হলে ভোলার বাবা বড়-অংশের ভাগীদার। কোথাও পুকুর সমেত বিশাল জমি দেখভাল করছে
বিহারি খুড়ি কারিগর। দোকান - বাড়িতে প্রচুর কাজের লোক। সংখ্যায় ওড়িয়া ঠাকুর ও
কাজের লোকই বেশি। এরা সারাদিন কাজের শেষে বাড়ির অফিস ঘরেতেই বিশ্রাম নেয় বা
রাত্রিবাস করে। বৎসরে এক আধবার দেশের বাড়ি ঘুরে আসে।
জন্মের পর
থেকেই তাঁর মা নানান কারনে ভোলার বিশেষ খেয়াল রাখতে পারেননি। বিধবা জ্যাঠাইমার
প্রিয় পাত্র ছিল গৌরবর্ণ ও গোলগাল ভোলা। বাবাও ব্যবসায়ের কারনে বিশেষ নজর দিতে
পারেননি। মেজদার সাথে বেশ ভালো জমত তাঁর। কাজের লোকেদের সাথে তাঁর বেশ ভাব। সবাই ভোলাবাবু
বলতে অজ্ঞান। গরুর কাঁচা দুধ বালতি থেকে পেতলের ঘটি ক’রে খেতেই সে অভ্যস্ত। সারাদিন বাড়ির বাগানে, দোকানে ঘুরে ঘুরেই তাঁর সময় কেটে যেত। পুকুরে মাছ ধরা ছিল
তাঁর ভীষণই প্রিয়। পড়াশুনায় মন তাঁর বিশেষ ছিল না। বাবা ছিলেন শহরের বড় বিদ্যালয়ের
পরিচালন পর্ষদের নামকরা সদস্য। বিদ্যালয়ে হাজিরা অনিয়মিত হলেও শিক্ষকরা ভোলার
প্রতি বিশেষ বিরূপ ছিলেন না।
ভোলার মনে
প্রভাব বিস্তার করেছে হিন্দি ও বাংলা সিনেমার গান। বিনা টিকিটে যখন তখন নিজেদেরই সিনেমাহলে
চলে যেত। হৃদয় জুড়ে একদিকে যেমন মুকেশ, মান্না, রফি, হেমন্ত, কিশোর অন্যদিকে তেমনই শাম্মিকাপুর, ধর্মেন্দ্র, দেবানন্দ, রাজকুমার, উত্তমকুমার, বিশ্বজিৎ। যেখানে সারারাত ব্যাপী মুকেশ, মান্না, রফি, হেমন্তের গান, সেখানে ভোলা যাবেই। কিন্তু বাবা ও বড়দা, এক্কেবারেই ব্যবসায় কেন্দ্রিক। ভোলার এই গান প্রীতি মেজদা
ছাড়া কেউ মেনে নেয়নি।
বিপ্লব ভাল
মাউথ অর্গান বাজাতে পারত। মাউথ অর্গানে গাইত চলতি বিখ্যাত হিন্দি ও বাংলা গান। প্রধানত
গানই বিপ্লব ও ভোলাকে একসূত্রে বাঁধতে অনুঘটকের কাজ করে। হিন্দি ছায়াছবিতে রাজেশ খান্না – শর্মিলা ঠাকুর জুটির দার্জিলিং-এর টয়-ট্রেন, পাহাড়ি রাস্তা ও গান বিপ্লবদের এতই আকর্ষণ করে যে দার্জিলিং
তাদের কাছে এক মায়াময় গন্তব্য হয়ে ওঠে। কিশোর বিপ্লব ও ভোলা পরিকল্পনা করে
দার্জিলিং যাওয়ার। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যালয় থেকে বাড়িতে বই রেখে সোজা
শিয়ালদহ।বাড়ি থেকে অনুমতি পাওয়া এক প্রকার দুঃসাধ্য, অগত্যা বিনা অনুমতিতে যাওয়াই
শ্রেয় বলে মনে হয় তাদের।
ফারাক্কা
ব্রিজ তৈরী তখনও সম্পূর্ণ হয়নি। শিয়ালদহ থেকে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস গঙ্গার পাশে
এসে থামে। সেখান থেকে নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে স্টিম লঞ্চে চেপে খেজুরিয়া ঘাট। খেজুরিয়া
ঘাট থেকে পুনরায় হেঁটে স্টেশান। মিটার গেজ লাইনে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে নিউ
জলপাইগুড়ি। বিপ্লব তাড়াতাড়ি স্টিম লঞ্চ থেকে নেমে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে উঠে
জায়গা নিয়ে নেয়। ভোলার কোন খবর নেই।
এমতাবস্থায় বিপ্লব মাউথ অর্গানে হিন্দি ছায়াছবি দোস্তির গান গাইতে থাকে
“...মেরা দোস্তি মেরা প্যার......, যানে আলো জারা মুড়কে দেখো.........”। “ বাবা, তোমার কি খুব কষ্ট? খাওয়া-দাওয়া করেছ?
পয়সা দেব?” গান শুনে এক ভিখারিনী জিজ্ঞাসা
করে বিপ্লবকে। বিপ্লব জানায় ভোলাকে বার্তা প্রেরনের জন্যই সে মাউথ অর্গান
বাজাচ্ছে। যে আগে পারবে মিটার গেজ লাইনের নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে উঠে যায়গা রাখবে। স্টিম লঞ্চে ওঠার আগে বিপ্লবদের এরকমই কথা হয়। হাড়িয়ে গেলে
যে যার মত গান গাইবে। ভোলাকে সূত্র দেওয়ার জন্যই বিপ্লবের এই গান। সূত্র ধরে ভোলাও
হাজির ট্রেন ছাড়বার আগেই। শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের ট্রেন যাত্রা নিউ জলপাইগুড়ি
পর্যন্ত।
তারপর শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে
যাত্রা। দার্জিলিঙে বিপ্লবের মাসতুত দাদার পুলিশ কোয়ার্টারে ওঠে ওরা । রাস্তার পাশ
দিয়ে টয় ট্রেন, বাতাসিয়া লুপ, কাঞ্চনজঙ্ঘা, চা বাগান সব মিলিয়ে দুই কিশোরের প্রথম
দার্জিলিং ভ্রমণ এক অবিস্মরনীয় স্মৃতি হয়ে থাকল। প্রায় পাঁচ দিন দার্জিলিং ভ্রমণের
পর বাড়ি ফেরে ভোলা। মেজদা সহায় ভোলার
বিশেষ চিন্তা ছিল না।
“...মেরা
দোস্তি মেরা প্যার......”
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post