রয়ে যাই-ই
শম্পা সান্যাল
___চলে যাচ্ছেন? এতো তাড়াতাড়ি যে?
___শরীরটা ঠিক নেই, অভ্যাসে আসা আর কি! চলি, কেমন!
সান্ধ্যকালীন ভ্রমণে যারা নিয়মিত তারা লক্ষ্য করেন জুটি ভেঙ্গে গেছে তবু আসেন, বহুদিনের পরিচিত পার্কের কোণার কাঠের বেঞ্চে অলিখিত নোটিশ জারি ছিল যেন, ওদের জন্য। একা হয়েও সেখানেই নিয়মিত এসে বসেন। একাকী মানুষটি নিয়মিত ভ্রমণকারীদের আলোচনায় উঠেও আসেন। আনমনা, ব্যাথিত চিত্তে দিন কয়েক অনুপস্থিত শান্তি বসু যেদিন এলেন উৎসুক প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল সঙ্গী চলে গেছেন, অকস্মাৎ।
রোজ সম্ভব ছিল না, অবসরকালীন জীবনে এসেছিল সে সুযোগ। নিত্য আসতেন দুজনে, একটু আগে পরে ; বিশেষ আর কারো সাথে আলাপচারিতায় উৎসাহ ছিল না, এমনকি দুজনে যে অজস্র কথার জাল বুনতেন তাও নয়। যেন সবটুকু দিয়ে প্রকৃতির কোলে বসে পারস্পরিক সঙ্গ-সুখ আস্বাদন। আজো এসেছেন, একাকী শান্তি বসু। সামনের পুকুরের দিকে তাকিয়ে নির্দিষ্ট আসনে বসে থাকেন নিবিষ্ট মনে। পুকুরের জলে মৃদু বাতাসে, মাছেদের হুটোপুটিতে, পড়ন্ত বেলায় অস্তমিত রবিচ্ছায়ায় কত যে ছবি__ মনের গভীরেও বোধহয় একই সাথে আঁকা হতে থাকে পাল্টে পাল্টে যাওয়া জীবনের জলছবি ; অন্তর্দৃষ্টিতে অনুভব দর্শন চলে হয়তো! এভাবে খানিকটা সময় বসে আস্তে ধীরে একান্ত পরিচিত মুখের সামনে মৃদু হাসি উপহার দিয়ে চলে যান যেমন,আজোও...... হৈচৈ কোলাহলে শান্তি বসুর চিরতরে নিষ্ক্রান্ত সংবাদ আলোড়িত করে রাখলো পার্কের নতুন পুরোনো ভ্রমণকারীদের, ফিকেও হয়ে গেল। উঁহু, নির্দিষ্ট আসন তাঁর অবসানে শূন্য হয়েও হলো না, এলো পূর্ণতা। তবে এবার যে সমন জারি করা হয়েছে ঐ কাঠের বেঞ্চগুলোর উপর!! উচ্ছেদই হয়ে গেল।
কংক্রিটের বেঞ্চে ভেজা গামছা পেতে শুয়ে থাকে ভবঘুরে মানুষ, বিকেলে ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে মায়েরা, এভাবে যার যখন সময় ব্যবহৃত হতে থাকলো পরিবর্তিত বেঞ্চ। কাঠের বেঞ্চ__ কত রাগ-রাগিনী অন্তর্নিহিত তার হৃদয়ে!ভাঙ্গা-গড়ার সাক্ষী,নিরবে চলে যাওয়া, থেকে গেল হয়তো কিছু মানুষের স্মৃতিকোঠায়। চুলচেরা ফাটল দেখা দিয়েছে অতএব চিকিৎসা হলো, নান্দনিক রূপ পেলো নক্সিকাটা পাথরে পরিবর্তিত কংক্রিটের বেঞ্চ, পাথরের তলায় রয়ে গেল আরো কিছু রাগ-রাগিনী মিশ্রিত ধ্বনি।
___বেএশ্, তাতে হলোটা কি ?
___কি আর হবে!
___আচ্ছা, ঐ শান্তি না কান্তি সে পুরুষ না মহিলা ?
___তাই জেনেই বা কি হবে? কিন্তু না__হলোনা শেষ, জানার ছিল যে! তাই নটে গাছটি উপড়ে ফেলতে গিয়েও বাদ সাধলো ছোট্ট একটি ঘটনা__
সময় গড়িয়ে গেল তার আবর্তিত নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। পার্কের সামনে এক তরুণ গাড়ি থেকে ধরে ধরে নামালো বয়সের ভারে ন্যুজ একজনকে। শ্লথ গতি চলনে, দৃষ্টি বড়ো চঞ্চল। চারিদিকে আকুল চাহনি ___এখানেই তো! হ্যা, হ্যা ঢুকেই বা হাতে___ঐতো, ঐতো পুকুরটা। বাঃ, বাঁধানো হয়েছে, কিন্তু বেএএঞ্চটা___; এগিয়ে, পিছিয়ে অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল করে অস্ফুট স্বরে স্বগোতক্তি "এখানেই তো ছিল"!! সামান্য স্থান পরিবর্তিত নুতন বেঞ্চে বসা দুজনের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে।
___আপনি কিছু বলছেন?
___উনি মনে হয় কিছু খুঁজছেন। কিছু ফেলে গেছেন এখানে?
____এ্যা! হ্যা___ 'শান্তি-সুধা' ভেসে এলো অনাদিকালের আবহ সঙ্গীতের সুরে।
দুটি রক্ত-মাংসের প্রাণ আর পাঁচজনের মতোই তাদেরও ছিল স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ; রাগ অভিমান, হাসি আনন্দ ঘেরা জীবন। সময়ে তাদের অনুভূতি গুলো রূপান্তরিত হতে হতে মিলিয়ে গেছে তবে রেশটুকুতো রয়েই যায়, রয়ে গেছেও। হয়তো ঐ কাঠের বেঞ্চগুলো, ওরাও আর কারো অঙ্গে জুড়ে নতুন করে পেয়ে গেছে প্রাণ!
" জীর্ণ যা-কিছু যাহা-কিছু ক্ষীণ
নবীনের মাঝে হোক তা বিলীন"
তাই শেষ হয়েও গল্পটা শেষ হলো না, হবেও না। জীবনের কিছু ক্ষণ, কিছু মুহূর্ত নানা রঙে রঞ্জিত; থমকে যাওয়া সময়কে স্মৃতির আঁচলে চাপা রেখে দেখি, সুখ খুঁজি বারবার,ঐ ক্ষণে খসে পড়তে পারে তারা, সশব্দে জানান দিতে পারে নবাগত জাতক, কোথাও বা শ্বাস যাত্রা করে অন্তিমের পথে! সময় চরৈবেতি লক্ষ্য নিয়ে চলে ; কিছু সময় , কিছু মুহূর্ত প্রত্যেকের জীবনে থমকে আছে , তাই তো কবির লেখায় উঠে আসে "কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি"!! ঠিক।
" যে ফুল ঝড়ে সেই তো ঝড়ে
ফুল তো থাকে ফুটিতে" অনুভব অনুভূত, ক্যালেন্ডারের পাতা, ঘড়ির কাঁটা যাই-ই বলুক না কেন!" শূন্যতা, থেমে যাওয়া গল্প থেকেই জন্ম নেয় নতুন কাহিনী, এভাবেই" বহে নিরন্তর অনন্ত..." তাই তো?? কি বলেন আপনারা?
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post