ইউরোপ ভ্রমণ -পর্ব ২
স্বরূপ কৃষ্ণ চক্রবর্তী
আবুধাবি তে পৌঁছে তো বেশ লাগছিলো যে UAE র এত্ত নাম শুনেছি. এখন সেখানে পৌঁছে গেছি। কিন্তু একি আকাশযান মাটিতে নামবার পরেও তো আমাদের নামতে দিচ্ছে না প্লেন থেকে। দেখি প্লেন মোটর গাড়ির মত ট্যাক্সিইং করেই চলেছে। কত্ত বড় এয়ারপোর্ট রে বাবা! দেশের মোটামুটি সব বড় এয়ারপোর্ট সাথে কিছু ছোট এয়ারপোর্ট ও ঘোরা হয়ে গেছে কিন্তু মাটি ছোঁয়ার পরেও এতক্ষন লাগেনি প্লেন থেকে বের হতে। সে যাকগে, শেষে নামলাম। যেহেতু আমাদের আবার ফ্লাইট সেখান থেকে আমস্টারডাম এর জন্য, একই এয়ারলাইন্স, ইতিহাদ, তাই বাইরে বের হবার কোন দরকারও ছিলোনা আর ইচ্ছাও ছিলোনা। এয়ারপোর্ট তো নয় যেন স্বপ্নরাজ্য। ডিউটি ফ্রি শপে ভর্তি। চারিদিকে সুন্দরীরা ও রয়াল শেখ রা চিরাচরিত ও আধুনিক দুই রকম পোশাকেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
তারপর বাঙালি বলে কথা , ফ্রেশ হতে হবে তো বাঙালি স্টাইলে। একে একে দুজনেই ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে ভাবলাম চাড্ডি মুখে কিছু দেওয়া যাক। আমার হাইকমান্ড আবার চায়ের ভক্তিনি, আর আমি কালো কড়া কফির। চা কফির সাথে কিছু হালকা খাবারের দাম দেখে যা বুঝলাম তা আর কহতব্য নয়। বাঙালি পিলে প্যালারামের মত চমকে যাবে। আমি সামলাবার চেষ্টা করলাম, আগে থেকে অর্জিত জ্ঞান কে মনে করে। সাথে কিছু ইউ এস ডলার, কিছু ইউরো আর ফরেক্স প্রিপেড কার্ড ছিল। প্রেমসে অর্ডার দিয়ে স্মার্টলি কার্ড পেমেন্ট করে গিন্নির চোখে হিরো হবার বাসনা থেকে মুক্ত হতে পারলাম না। তাই কেস খেয়েই গেলাম আর আমার কার্ডের তাপমাত্রা বেশ কিছুটা কমে গেল। দেশের বাইরে প্রথম ফরেক্স কার্ড পেমেন্ট করে নিজেকে বেশ শেখ শেখ লাগছিলো। অবাক হয়ে এয়ারপোর্ট দেখছিলাম আর ভাবছিলাম যে ধু ধু মাঠের মধ্যে এতবড় কর্মকান্ড এরা কি সুন্দর ভাবে করে এত আধুনিক একটা এয়ারপোর্ট তৈরি করেছে।
পৌঁছেছি সকাল 6 টায় আর পরের ফ্লাইট সকাল সাড়ে নয়টায়। সোজা আবুধাবি থেকে আমস্টারডাম। সাত ঘন্টার উপর লাগাতার জার্নি। মজার কথা এই যাত্রাতেও কিন্তু 2 ঘন্টা উপরি পরমায়ু লাভ করলাম। কারণ UAE থেকে ইউরোপের সময় দুই ঘন্টা পিছিয়ে। অবশেষে আকাশসুন্দরী দের আদর যত্ন নিতে নিতে রেড wine এর সাথে জম্পেশ করে লাঞ্চ করে সাত ঘন্টার উপর সময় কাটাবার ফন্দি বের করলাম, মোবাইলে বই পড়া। কিন্তু তার কি আর জো আছে? পাশের জনকে এটা সেটার উত্তর দিতে আমি বাধ্য, তাই দিচ্ছিলাম। রাগবার তো উপায় ছিলোনা, তাই চোখ বন্ধ করে নিদসুন্দরী কে আবাহন করতে করতেই দেখি একটা মাথা আমার কাঁধে আর প্রশ্নের তোড় থেমে গেছে। বুঝলাম ভরা পেটে বাঙালিয়ানা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সিয়েস্তার জন্য। আমার অবশ্য বেশ ভালোই লাগছিলো। সেই কবেকার বিস্মৃতপ্রায় স্মৃতি ফিরে আসছিল মনের মধ্যে।
এবার একটা জরুরি কথা। ডিরেক্ট ফ্লাইট ইউরোপের জন্য আমাদের দেশ থেকে অনেক আছে, কিন্তু ভেঙে ভেঙে গেলে খরচ অনেক ই কম পড়ে। তাই লেওভার এর সময়টুকু ধর্তব্যের মধ্যে না নিলে ভেঙে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। অনেক টাকা বাঁচবে। সেটা দিয়ে মার্কেটিং বা আরো কয়েকদিন বেশি ঘোরা যায়।
আমস্টারডাম। সুন্দর সব ল্যান্ডস্কেপ উপর থেকে দেখতে দেখতে বিশাল প্লেন যার এক রো তে দশ জন করে বসে, মাটি ছুঁলো নিরাপদে। নেমে পড়লাম। লাগেজ মুম্বাইতে বুক করেছিলাম আমস্টারডাম এ নেব বলে। কিন্তু আগে তো ইমিগ্রেশন এর ছাপ্পা নিতে হবে পাসপোর্টে। দিলাম লাইন । কত দেশের নাগরিক একসাথে পাসপোর্ট কন্ট্রোল অফিসের লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কত সব ভাষায় কলকলানি শুনতে পাচ্ছি। এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। নিজেরাও সেই ভিড়ের একটা অংশ হয়ে ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম বিদেশি অফিসারের কাউন্টারের দিকে।
আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী ট্যুর ম্যানেজার ইমিগ্রেশন কাউন্টারের বাইরে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। তাই একদিক থেকে নিশ্চিন্ত ছিলাম আর চোখ দিয়ে দলের লোকদের খুঁজছিলাম । পেয়েও গেলাম ,পরিচয় ও হলো।
ব্যাগ কালেক্ট করার সময় দেখি আমাদের বেল্ট থেকে সব ব্যাগ নীচে নামিয়ে দিয়েছে আর অন্য একটা ফ্লাইট এর ব্যাগ রা দল বেঁধে ঘুরে চলেছে। কারণ আমাদের ইমিগ্রেশন এ অনেক সময় লেগেছিল , লোক ও অনেক ছিল। আমার সুটকেস আমার জন্য অপেক্ষা করছিল খপ করে হ্যান্ডেল ধরে নেওয়াতে ধড়ে প্রাণ এলো। এ মা, একি কান্ড! তেনার টা কই? শেষে যারা বেল্টে ঘুরেই চলছিল তাদের মধ্যে থেকে উদ্ধার করলাম তেনার সুটকেস কে, বেচারি হংস মধ্যে বক যথা হয়ে অন্যদলের সুটকেশদের সাথে ঘুরেই চলছিল।
বাইরে বেরিয়ে পেলাম ট্যুর ম্যানেজার কে অনেক লোক কে পাশে নিয়ে। অনেকে আমাদের ফ্লাইট এই এলো অনেকে একটু আগে পরে। সবাইকে নিয়ে রোলকল এর মত নাম ধরে ডেকে ট্যুর ম্যানেজার, যে নাকি আবার ঘটনা চক্রে বোমান ইরানির কাজিন ভাই, কয়েকটা হিন্দি ফিল্মেও অভিনয় করেছেন ক্যারেক্টার রোল এ, নাম আসপি স্যাম ইরানি, নিয়ে চললেন আমাদের কে হোটেলে একটা দারুন বাস চড়িয়ে। খবর নিলাম বাসটার, INR এ দাম পৌনে দু কোটি মাত্র। ডিসক্লেইমার: কারও মাথা ঘুরলে আমি দায়ী নই।
বাস তো নয়, ছোটখাটো প্লেন একটা। কি নেই তার মধ্যে।
সবকিছু করে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আমাদের সূর্যের আলো থাকতে থাকতেই ডিনার করিয়ে দিলেন কারণ ওখানে সন্ধে হয় রাত পৌনে দশটায়। বেশ মজাই লাগছিলো দিনের বেলা ডিনার করতে। সবাই ক্লান্ত ছিল তবে ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ হবার জন্য দেশি খাবার পেয়ে যারপরনাই খুশি ছিলাম আমরা সবাই। তারপরে হোটেল, খুব সুন্দর হোটেল তেমনি সুন্দর ঘর। তিন রাত থাকবো ওখানে। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে গিয়ে রাম ফ্যাসাদে পড়লাম। ব্যাটারা শুধু কাগজ ব্যবহার করে আর আমাদের জল মাস্ট। এমনকি পাশের কলটাও নেই। কি করি ? লাগালাম বাঙালি বুদ্ধি।
তথ্য চুপিচুপি: যারা যাবেন ওই সব দেশে অবশ্যই একটা ছোট মগ বা খালি বোতল বা ঐরকম কিছু নিয়ে যেতে ভুলবেন না, অবশ্য যদি কাগজেই অভ্যস্ত আমার কিছু বলার নেই।
সুটকেস খুলে বড় সাইজের প্লাস্টিক গ্লাস যেটা নাকি তিনি নিয়েছিলেন ইলেক্ট্রিক কেটলির সাথে, চা খাবে বলে, উৎসর্গ করলাম যথাবিহিত সাংসারিক পুজোর মন্ত্রের সাথে ওই কাজের জন্য। তারপর আঃ কি আরাম। গ্লাস টা আমাকে শেষ দিন অবধি সার্ভিস দিয়ে গেছে কাগজের সাথে পাল্লা দিয়ে। বেঁচে থাকো সোনা, দেহত্যাগ কোরোনা। একটা গ্লাস সেও প্লাস্টিকের যে এত উপকার দেবে স্বপ্নেও ভাবিনি। গোপাল ভাঁড়ের গল্প মনে পড়ে গেলো। সিরাজদৌল্লার মত আয়েশি হয়ে দেড় ফুটিয়া গদির উপরে বডি ফেলে শয়নে পদ্মনাভনচ বলে প্রথম বিদেশে রাত কাটাবার জন্য ঘরের আলো বন্ধ করে দিলাম।
আজ এই পর্যন্ত। আবার আসছি, কালকে ব্রেকফাস্ট করতে হবে তো। রাত টা কাটুক।
সমস্ত ছবি লেখকের নিজের তোলা
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post