ভোরে উঠে ঘরের মধ্যে চা পর্ব সারার পরে প্লাস্টিকের গ্লাসের সাথে মিতালি করার জন্য গিয়ে ঢুকলাম বাথরুমে। এক্কেবারে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে বেরুলাম অর্ধাঙ্গিনী র জন্য খালি করে দিয়ে। (যাঁরা প্লাস্টিক গ্লাসের ব্যাপারটা জানতে চান আগের খণ্ড গুলো পড়ুন।) অতঃপর ব্রেকফাস্ট। সাহেবদের দেশে নিয়মানুবর্তিতা দেখে শেখার মত। যা সময় বলেছে ব্রেকফাস্টের একদম তার 5 মিনিট আগেই সব তৈরি। আমাদের অনেকসময় আশ্চর্য লাগছিলো যে এরা যন্ত্রের মতো কাজ করে ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে অথচ মুখের হাসিটুকু অমলিন।
আমাদের গ্রূপে ৪ জোড়া কপোত কপোতী ছিল যারা ব্রেকফাস্ট লঞ্চ ডিনার মার্কেটিং বাসে চড়া সবকিছুতেই আমাদের কে ফার্স্ট করে দিচ্ছিলো। ফলশ্রুতি, ইরানিজির হাসিমুখে ইংরেজি আর হিন্দিতে রসিকতা, আর আমাদের হাসিমুখে রসিকতা। কিন্তু ওরা পুরো ব্যাপারটাই খুব স্পোর্টিংলি নিচ্ছিল আর বলছিল আমাদের বয়স তো আপনাদেরও ছিল একদিন। সে যাকগে ৭ঃ৪৫ এর সময় বাস ছাড়ার কথা, কিন্তু বাস চালাবে সাহেব ড্রাইভার, কিন্তু চড়বে তো ইন্ডিয়ান রা, তাই যথারীতি ৮ঃ১৫ হয়ে গেল। থুড়ি ওখানে ড্রাইভার বলেনা , বলে ক্যাপ্টেন। আর বলবে নাই বা কেন? বাস টাতো মিনি প্লেন , শুধু আকাশে ওড়ে না। হুঁ হুঁ বাবা পৌনে দু কোটি টাকার বাস তা ক্যাপ্টেন চালাবে নাতো কি গোবিন্দ ড্রাইভার চালাবে।
আমস্টারডাম কে বাই বাই করে আমরা আবার রওয়ানা দিলাম ব্রাসেলস এর পথে। ব্রাসেলস বেলজিয়ামের রাজধানী, ৩০৫২৮ স্কোয়ার কিমি আয়তনের দেশে জনসংখ্যা মাত্র ১.২ কোটি। যা শুনে আমাদের মেট্রো শহরের অনেকেই হেসে ফেলবে। আমস্টারডাম থেকে দূরত্ব ২৬০ কিমি। সাড়ে তিনঘন্টা সময় নিলো মাঝখানে ৩০ মিনিট এর ব্রেক নিয়ে। কারণ ওখানকার নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক আড়াই ঘণ্টা পর ক্যাপ্টেনের ব্রেক নিতে হবে। বাস টা জি,পি,এস নিয়ন্ত্রিত। তাই সুদূর কোনো দেশের কন্ট্রোল রুমে রেকর্ড হচ্ছে আমাদের গতিবিধি। শিডিউল্ড টাইমের আগে বা পরে বাস স্টার্ট হবেনা। কন্ট্রোল রুমে ফোনে করে রিলিজ করতে হত সিস্টেম।আমাদের বেশ কয়েকবারই এটা ফেস করতে হয়েছে, কারন ? সেই চার জোড়া কপোত কপোতী ।
কিন্তু এইটুকু দেশ হলেও যেমন রাস্তা তোমনি মনোমুগ্ধকর কান্ট্রি সাইড। যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। চাষ করেছে বিভিন্ন ফসলের। আমি গম , সর্ষে আর কিছু শাক সবজি চিনতে পারলাম বাকি গুলো বুঝতে পারলাম না বাস থেকে বসে। মাঝে মাঝে অলস গতিতে ঘুরে চলেছে আধুনিক উইন্ডমিল এর ব্লেড। এতটুকু বোর হবার উপায় নেই। মাঝখানে ব্রেক নেবার সময় আবার সেই ওয়াশরুম এর কান্ড। মানে দুইজনের জন্য ১০০ টাকার উপর খরচ করে হালকা হওয়া। কফি খেলাম, ব্ল্যাক কফি । অদ্ভুত রকমের ভালো। ওরা মনে হয় খাবারে ভেজাল দিতে শেখেই নি। কয়েকটা পাবলিক কে আমরা এক্সপোর্ট করে দিতে পারি ওদেরকে কে ভেজালের ব্যাপারে শিক্ষিত করে তুলতে।
অবশেষে পৌঁছুলাম ব্রাসেলস এ। অনেক পুরোনো শহর ইউরোপের। আধুনিক বাড়ি গুলোর মধ্যেও কেমন পুরোনো ঐতিহ্যের ছাপ। একটা স্কোয়ারের মধ্যে নিয়ে গেল ইরানিজি মানে ট্যুর ম্যানেজার। চারিদিকে ৩০০-৪০০ বছরের পুরনো অট্টালিকা সব। বিশাল বিশাল ঘোড়ায় টানা গাড়ি দেখলাম। সবাই অলস ভাবে ভিড়ের মধ্যে ঘোড়া গাড়ি করে চলেছে পরিবারের সবাইকে নিয়ে। যে কোচোয়ান তাকে দিব্বি ওয়েস্টার্ন ফিল্মে হিরো বানিয়ে দেওয়া যায়।
ব্রাসেলস এর চকোলেট পৃথিবী বিখ্যাত। আমি চকোলেট প্রেমী না হলেও হরিদ্বার এ গিয়ে গঙ্গাতে স্নান করার মতো ব্রাসেলসে গিয়ে চকোলেটের দোকানে ঢুকলাম। ওই বাপ, কত্ত ধরণের চকোলেট। আর আমাদের বিগ বাজারের মতো অফার ও আছে। তবে অফার সহ দাম আমার Accountant মাথা হিসাব করে ফেললো টাকাতে। যে সংখ্যাটা এলো ব্লাড প্রেসার বাড়াবার জন্য প্রয়োজনাতিরিক্ত। গম্ভীরভাবে গিন্নিকে বললাম বাচ্চাদের জন্য কিছু চকোলেট নেওয়া যাক কিন্তু খবরদার টাকাতে হিসাব করবে না। ইউরোপে আছি ইউরো তে হিসাব হবে। নেওয়া হলো। তারপর দেখতে চললাম ম্যানিকিন পিস দেখতে। একটা বাচ্চা মানুষের স্ট্যাচু লাগাতার মূত্রত্যাগ করে চলেছে। দিনে বেশ কয়েকবার নাকি তার পোশাক বদল হয়। একটা গল্পও আছে ইরানিজি বললেন। আমি এখানে দিলাম না। অনেকে অনেক ছোট ছোট জিনিস কিনলেন স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে। আমরাও টুকটাক কিনলাম।
লাঞ্চ নিজেদের, তাই জঠরাগ্নি নেভাতে পছন্দসই একটা দোকানে ঢুকে পড়লাম। ট্রে নিয়ে নিজের পছন্দমতো খাবার তুলে নিয়ে কাউন্টারে দাঁড়াতেই কর্মচারী টি দাম হিসেব করে নিলেন। খেয়ে নিয়ে কল টাইম অনুযায়ী আবার বাসে। এবার যাবো প্যারিস, স্বপ্নের প্যারিস। শিল্প সাহিত্যের শহর প্যারিস। একটা চাপা উত্তেজনা হচ্ছিল মিথ্যে বলবো না। ভাবছিলাম যেরকম বইয়ে পড়েছি সেরকমই দেখবো না আশাহত হবো। সাথে ইরানিজির সতর্কবাণী লাগাতার। যতই শিল্প সাহিত্যের শহর হোক, চোর গুন্ডা পকেটমার আর কেপমারে ভর্তি। তাই পাসপোর্ট আর টাকা পয়সা ভীষণ সাবধানে রাখতে হবে। এবারের দুরত্ব মাত্র ৪৩০ কিমি। ঘড়িতে ৬ঃ৩০ কিন্তু সূর্যদেব রং ও পাল্টান নি। জ্বলজ্বল করছেন আকাশে। ইরানিজির সেই ঘোষনা বাসের মধ্যে অডিও সিস্টেমে জলদমন্দ্র স্বরে ডিনারের জন্য এখনও কানে ভাসছে। হ্যাঁ, আমরা রাস্তাতে চলতে চলতে সিনেমা দেখলাম 3 Idiots.
ডিনার আমাদের প্রত্যেকদিন ছিলো ইন্ডিয়ান রেঁস্তোরাতে। সারাদিনের ক্লান্তি , সামনে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা দেশি খাবার সাথে তন্দুরি রুটি আর বাটার দেওয়া নান। সবাই বেশ তৃপ্তি করে খেলাম। তারপর যথারীতি আবার হোটেলে। আমরা নিজেরা পরের ফ্রি দিনে ভার্সাই প্যালেস আর ল্যুভর মিউজিয়াম দেখবো বলে অনলাইনে টিকেট কেটে নিলাম। তারপর সেই দেড় ফুটিয়া গদি আর বডি থ্রো। একটু একটু ফেসবুক, Whatsapp, বাড়িতে কথা বলা, আলো নেভানো আর শয়নে পদ্মনাভঞ্চ বলে ঘুম।
কিছু ছবি দিলাম। আবার দেখা হবে পরের অংশে।
সমস্ত ছবি লেখকের নিজের তোলা
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post