রাত্রে ঘুমোতে যাবার আগে তার ম্যানেজারের কল টাইম ব্রেকফাস্টের জন্য সকাল সাড়ে সাত টা, মাথায় ঢুকিয়ে ঘুমোতে গেছি আর ক্লান্ত থাকার জন্য বিন্দাস ঘুমিয়েছি। কিন্তু সকালে তো উঠেই আবার সেই প্লাস্টিক গ্লাসের খোঁজ শুরু করার আগেই বাঙালি পেটে একটু গরম তরল না পড়লে যে ঘটনা ঘটবে না তা বাঙালি মাত্রই জানে। অতএব ঘরের মধ্যেই চায়ের বন্দোবস্ত। সাথে ছিল টি ব্যাগ আর হোটেলেও দিয়েছিল। অবশ্য ইউরোপ এ সব হোটেল এ কিন্তু কেটলি আর চা রুমে দেয়না। আমরা সেটাতেও তৈরি ছিলাম। সাথে যাত্রা র দেয়া উপহার ইলেক্ট্রিক কেটলিও ছিল। একটা কথা। সাথে থাকলেও ইউরোপিয়ান দেশের প্লাগের জন্য এটাচমেন্ট না থাকলে সব ফক্কা। জানাবার জন্য বলি যে যদি কেটলি না থাকে বা হোটেল থেকে না দেয় ঘাবড়াবার কিস্সুটি নেই। পুরো ইউরোপে সবখানে জল এতটাই ভালো যে সবাই ডিরেক্ট ট্যাপ থেকেই জল খায়। তাই হট ওয়াটার ট্যাপ থেকে নিয়ে টি ব্যাগ দিলেই চা তৈরি।
চা খেয়েই সেই প্লাস্টিক গ্লাস বগলে নিয়ে ঢুকে পড়লাম আর একদম গরম জলে স্নান করে বাইরে বের হলাম একের পর এক। কারণ সাড়ে সাত টা। ব্রেকফাস্ট। সেজে গুজে সারাদিনের জন্য পিঠের রুকস্যাক ঝুলিয়ে খাবার হলে গিয়ে শুরু করলাম ডান হাতের কাজ। জম্পেশ করে ব্রেকফাস্ট করলাম। আরেকটু হলেই পা পিছলে যেত। আমি সসেজ খুব ভালোবাসি। ঢাকনা খুলেই চেহারা দেখে সন্দেহ হওয়াতে গোরি ডাচ ওয়েট্রেস কে জিজ্ঞেস করতেই বললো যে সেটা চিকেন সসেজ নয়। বিফ সসেজ। সেই তখন থেকে আমি ১০ দিন ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চের সময় সসেজ খাইনি।
ব্রেকফাস্ট টা জম্পেশ করে খাবার কারণ হচ্ছে যে লাঞ্চের খাবার গুলো ঠিক বাঙালি মুখে রোচে না। আর জায়গার ও ঠিক থাকেনা। বেশির ভাগ সময়েই অটো গ্রিল এ খেতে হতো। আর ডিনার সেই দিন মানে সন্ধে বেলা সাতটার সময় খেতে হবে ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয়। পুরো দিনের আলোয় আমরা ডিনার করতাম। রাত তো হবে পৌনে দশটায়।
গিয়ে বসলাম আমাদের প্লেনের মতো আমাদের বাসে। আজকে যাবো keukonhof বলে এক জায়গায়। টিউলিপ ফুলের বাগানে। তারপর আমস্টারডাম শহর এর দর্শনীয় জায়গা যেরকম Dam square, Rembrandt wooden shoe and cheese factory . তারপর শহরের মাঝখান দিয়ে ক্যানাল এর ভেতরে ক্রুজে সফর। অনেক পুরোনো শহর। সমুদ্রের সাথেও যুক্ত। ভীষণ পরিষ্কার। একটুকরো নোংরা নেই কোথাও। অসংখ্য ক্যানালে ভর্তি। সব একে অপরের সাথে যুক্ত।
গিয়ে পৌঁছুলাম keukonhof এ। কত লোকরে বাবা! পৃথিবীর কত্ত দেশ থেকে এসেছে সব। মেলার মতো ভিড়। মনে হচ্ছে এক ইডেন ভর্তি লোক সব হাজির হয়েছে। তবে দেখার মতোই টিউলিপ বাগান। অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
আমাদের ইরানি জি মানে ট্যুর ম্যানেজার সবাইকে নিয়ে সুসংবদ্ধ ভাবে টিকিট কেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বাসে ফেরার সময় ঘোষণা করে দিলেন। আর আমরা ছাড়া গরুর মতো ঢুকে পড়লাম ছবি তুলতে তুলতে। ছবি নীচে দিচ্ছি। ভেতরে ঢুকে যেদিকে তাকাই শুধু টিউলিপ আর টিউলিপ। কত ধরনের কত রঙের। কি বাহার আর ওদের ফুলের যত্ন কি! যেন ফুলগুলো মানুষের বাচ্চা।
ফুল দেখা ও ছবি তোলা শেষ হলো একসময়। মনে অসাধারণ খুশি নিয়ে বাসে গিয়ে নির্ধারিত সময়ে বসলাম।
"আহা কি দেখিলাম, জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না" এটা লেখার ইচ্ছা সংবরন করতে পারলাম না।
তারপর সেই সাবেক কালের উইন্ডমিল দেখতে চললাম। কি বিশাল আর কি অদ্ভুত বেসিক মেকানিজম। আমার দেখে তাক লেগে গেলো। ছবি তোলা হলো, নীচে দিলাম।
তারপর হাতে বানাবার চিজ ফ্যাক্টরি। দারুন ভাবে মেশিন দিয়ে হাতে করে চিজ বানিয়েছে। মেশিন দিয়ে হাতে করে মানে কিন্তু সোনার পাথরবাটি নয় । সত্যি বেশ মজার। মেশিনটা একদম সহজ মানে আগে যেভাবে ষোড়শ সপ্তদশ শতাব্দীতে বানানো হয় সেইভাবে মেশিনটা তৈরি করা। চিজ গুলো হাতে নিয়ে দেখলাম ইঁটের মতো শক্ত। বিনা ফ্রিজে বাইরে রাখা যায় মাসের পর মাস। শীতের দেশ তো, ট্রপিক্যাল দেশ হলে মজাটা টের পেতো। যে গরুর দুধ থেকে তৈরি হয় সেগুলোও দেখলাম। কি সব হৃষ্টপুষ্ট গরু একেকটা।
যথারীতি সব কিছু দেখবার পরে কিছু চিজ কেনা হলো আর সাথে কিছু স্মৃতি চিহ্ন। দাম দিলাম সেই ফরেক্স কার্ডে আর যথারীতি ওটার তাপমাত্রা কমতে থাকলো।
একটা কথা বলে দেই এখানে, যারা ধূমপায়ী তারা দেশ থেকেই সিগারেট কিনে নিয়ে যাবেন সীমার মধ্যে। কারণ ওখানে সিগারেটের দাম ইন্ডিয়ান টাকাতে অনেক বেশি। তবে বিদেশি সিগারেটের ইচ্ছে থাকলে ওখানেও কিনতে পারেন। আমাদের মতো অলিতে গলিতে কিন্তু দোকান পাবেন না। হয় টোব্যাকো শপ নতুবা সুপারমার্কেট।
আরেকটা কথা, অপ্রাসঙ্গিক কিনা জানিনা তবু সবার জন্য বলা কর্তব্য মনে করছি।এখানে পাবলিক ইউরিন্যাল খুব কম । যা আছে সব বড় দোকানে বা রেস্তোরাঁয়। কিন্তু যদি আপনি পাবলিক ইউরিন্যাল এ যান ৫০/৮০ ইউরোসেন্ট খরচ করতে হবে। যার ইন্ডিয়ান সমসাময়িক মূল্য প্রায় ৪৫ থেকে ৬৮ টাকার মধ্যে। এটা জন প্রতি খরচা। তবে ইউরিন্যাল বা টয়লেট গুলো অসাধারণ পরিষ্কার এবং স্বাস্থ্যসম্মত। সেজন্যই মনে হয় ইরানিজি আমাদের বলেছিলেন জল সিপ করতে ঢকঢক করে খেতে মানা করেছিলেন। তাও কয়েকবার দুজনে আমরা ১০০ টাকার উপরে খরচ করে ওয়াশরুমে গেছি। আরেকটা মজার ব্যাপার অটো-গ্রিল এর খাবার ওরকম হওয়া সত্ত্বেও আমরা যখন নামতাম , বাস ভর্তি লোক দৌড়িয়ে যেত ওয়াশ রুমের দিকে, কারণ ওটা ফ্রী। যাক এবার আলাদা কথা। মূল কাহিনীতে ফিরি।
তারপর চললাম ক্যানাল ক্রুজের জন্য। এত সুন্দর প্রফেশনাল ভাবে সব কিছু ম্যানেজড যে আমার ভারতীয় সত্তা হাঁকডাক না দেখে হাঁফিয়ে উঠছিল।
সত্যি, আমাদের এখনো ওদের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। জানি, আমাদের মূল সমস্যা জনসংখ্যা। তবুও রীতিনীতি আর নিয়মানুবর্তিতা বা অভ্যেস একটা জাতিকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে সেটা আমার এই ভ্রমণ চোখ খুলে দিয়েছে। যেদিকে দেখি সবুজ আর সবুজ। পরিষ্কার সবকিছু। রাস্তার পাশেও ধুলো নেই। সাইকেল আরোহীদের আলাদা লেন। আর সিগনাল যেন লক্ষনরেখা। সাইকেল আরোহিরাও মানে। জেব্রা ক্রসিং আর সিগনাল ছাড়া কেউ রাস্তা ক্রস করে না। আর চাষের জমি, আদিগন্ত হরিয়ালি। সব মেকানাইজড। পুরো জমিতে কোনো আল( জমির ভাগ চিহ্ন) নেই। কয়েকশ একরের পরে আবার আলাদা জমি। সব তারের জাল দিয়ে ঘেরা। যদিও কোনো ছাড়া পশু আমি দেখতে পাইনি । যেরকম দেখতে পাইনি রাস্তার কুকুর। কাক দেখবার জন্য প্রাণ আনচান করছিল। শেষে মাউন্ট টিটলিস এ গিয়ে দেখে আমার কি আনন্দ। গিন্নি বলেই ফেললেন যে জীবনে প্রথম কাক দেখলাম মনে হচ্ছে। সে আলাদা গল্প।
সুন্দর একটা ক্রুজে বসলাম বাসভর্তি সবাই। ক্যানাল দিয়ে চলেছি আর দেখছি সাথে ইরানিজি ছিলেন হিন্দি ও ইংরেজিতে বলে যাচ্ছিলেন কোনটা কি কবেকার ইত্যাদি ইত্যাদি। ষোড়শ, সপ্তদশ, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রাচীন বাড়ি গুলো দেখে অভিভূত হয়ে যাচ্ছিলাম। কি সুন্দর কত যত্নে ওগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। আজও ঝকঝকে তকতকে। এখনো সেগুলোতে মানুষ বসবাস করে। দেখলে মনে হয় কিছুদিন আগেই রং করা হয়েছে। অনেক ছবি তুললাম। কিছু ভিডিও করলাম, কিন্তু সব দেখতে পারছি না এখানে টেকনিক্যাল কারণে।
অবশ্য আমরা সেরকম করিনি কারণ yatra খুব ভালো ব্রিফ পাঠিয়েছিল , গুগল দাদা ও ইরানিজি ও খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিল। সব দেখা শেষ হলে ঘড়িতে সাত তা বাজবার উপক্রম হতে সূর্যের তোয়াক্কা না করে ডিনারের জন্য চললাম ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয়। সত্যি বলছি সূর্যের এতবড় হতছেদদা আমি দেখিনি, আকাশে আমাদের ২/৩ টের মতো সূর্য আকাশে জ্বলজ্বল করছে আর আমরা ডিনার করছি। কি আজব তাই না?
অবশেষে ডিনারান্তে সবাই হোটেল, দেড়ফুটিয়া গদি আর শয়নে পদ্মনাভঞ্চ করা আগামীকালের ভোরের জন্য।
আজ এই পর্যন্তই থাক। আবার আসছি দিন তিনেক পরে গ্রুপের নিয়ম মেনে।
ভালোলাগা বা মন্দলাগা জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। তাহলে আগামীতে সংকোচন বা বিবর্ধনের কথা ভেবে দেখবো।
ক্রমশঃ
সমস্ত ছবি লেখকের নিজের তোলা
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post