কালাপানির দেশ আন্দামান (পর্ব- ৩)
তৃপ্তি মিত্র
সংখ্যা -২৪, (৬ ই আগস্ট , ২০১৮) |
আমাদের গাড়ি মাঝে মাঝে গতি কমিয়ে চলার চেষ্টা করছে যদি গাছের আড়ালে বা জঙ্গলের মধ্যে আবার কিছু জারোয়া দেখতে পাই সেই উদ্দেশ্যে ৷ কিন্তু আমাদের উৎসুক চোখের ক্ষমতা নেই দুশো আড়াইশো ফুট উদ্ধত গাছ কে উপেক্ষা করে তাদের খুঁজে বার করা ৷ আর সম্ভব ও না জারোয়াদের গায়ের রং আর জঙ্গলের ঘন অন্ধকার মিলেমিশে একাকার ৷ ওদিকে আইনের কড়াকড়ি যথেষ্ট ৷ গাড়ির গতি ৪০ কিলোমিটারের নিচে রাখা যাবে না ৷
চালক ভাইয়ার কাছে শুনলাম একসময় " হিউমেন সাফারি " নিয়ে দেশ বিদেশে প্রবল আপত্তির ফল স্বরুপ এই আইনের কড়াকড়ি ৷ সকাল ছটা থেকে তিন ঘন্টা পরপর অর্থাৎ ৬ , ৯ , ১২ , ৩ পুলিশি প্রহরায় গাড়ির কনভয় ছাড়া হয় ৷ এরপর আর কোন গাড়ি এখান থেকে যেতে দেওয়া হয় না ৷ এই পথটুকু যেতে যেতে চালক ভাইয়ার কাছে ওদের গল্পই শুনলাম ৷ জারোয়াদের একাংশ সভ্যতার ছোঁয়া পেয়েছে ৷ ওদের জন্য তৈরি হয়েছে স্কুল ৷ মোবাইল ব্যবহার শিখেছে ৷ হিন্দি , বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারে ৷ তবে উগ্র জারোয়ারা মনুষ্য সমাজে মেশে না বরং সভ্য মানুষদের ঘৃনা করে ৷ কিছু কিছু আবার জঙ্গল ছেড়ে হাইওয়েতে চলে আসে সভ্য মানুষদের থেকে নেশার বস্তু সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ৷
দিনদিন জারোয়াদের জনসংখ্যা তলানীতে ঠেকেছে ৷ এই আদিম মানুষগুলি কে টিকিয়ে রাখা এখন বড় চিন্তার ৷ তাই ওদের কল্যাণের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সভ্য মানুষের সংস্পর্শ থেকে ওদের দূরে রাখতে হবে ৷ না হলে এই জনজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ৷
নানান গল্প শুনতে শুনতে লোমহর্ষক পথ অতিক্রম করে আমরা পৌঁছে গেলাম নীলাম্বর " জেটি ঘাট ৷এখানে পারমিট করিয়ে নিয়ে গেল " নয়াডেরা " জেটি ঘাট ৷ এখানে প্রাতরাশ সারলাম তারপর রওনা দিলাম প্রকৃতির বিস্ময় " লাইম স্টোন কেভের " উদ্দেশ্যে ৷ আমাদের স্পীড বোট ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে মনের মধ্যে উৎসাহ ভয় দুটো মিলেমিশে একা কার ৷ একসময় স্পীড বোট এর গতি কমে গেল প্রায় দেড় কি . মি রাস্তা ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের মধ্যে ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছি ৷ এবার মনের মধ্যে অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ৷ এতো কুমিরের আঁতুড় ঘর ৷ এই না ঘাড়ে ঝাপিয়ে পড়ে ৷ বা লাফিয়ে বোটে উঠে যায় ৷
যেতে যেতে পেয়ে গেলাম বনদপ্তরের কাঠের তৈরি আলপথ ৷ বোট ছেড়ে উঠে পড়লাম কাঠের আলপথে ৷ ওরে বাব্বা এখানেও নিস্তার নেই , দুপাশে ঘন জঙ্গল ৷ এতক্ষণ কুমিরের ভয়ে কুঁকড়ে ছিলাম এবার যদি চিতা বাঘ বাবাজী উদয় হয় পালাবার কোন রাস্তাই নেই ৷
আর সবুজ সাপ , কেউটে , ময়াল কি কি আছে জানিনা ৷ অগত্যা প্রাণ হাতে নিয়ে গাইড কে অনুসরণ করলাম ৷ মাঝে মাঝে গাইড কে জিজ্ঞাসা করছি আর কতদূর যেতে হবে ভাই ৷ আলপথ শেষ করে এবার সমতল পথ হাঁটছি আর হাঁটছি ৷ বেশ মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠা ছোট্ট একটা গ্রাম ৷ সমতলে যে সব গাছগাছালি হয় সবই আছে ৷ জমিতে নতুন ধান চারা মাথা দোলাচ্ছে মহা আনন্দে ৷ চরে বেড়াছে মুরগি , ডোবায় হাঁসের ঝাঁক , মাঠে গরু , বাছুর ৷ বড় বড় সাইজের নারকেল পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে কোনটা ওখানেই গজ বেরিয়ে পড়ে আছে ৷ গাইডকে অনুসরণ করতে করতে অবশেষে পৌছে গেলাম প্রকৃতির বিস্ময় " লাইম স্টোন কেভ " ৷ এটি মুলত প্রাকৃতিক চুনাপাথরের সঙ্গে বৃষ্টির জলের বিক্রিয়ায় সৃষ্ট যা কিনা বিভিন্ন শেপ তৈরি করেছে , কোনটা দেখে মনে হচ্ছে স্বয়ং শিব ঠাকুর বসে আছে , তো কোন টা হাতি লম্বা শুঁড় তুলে দাঁড়িয়ে আছে যা দেখে এতক্ষণের কষ্ট উৎকন্ঠা সব দূর হয়ে গেল ৷ টপ টপ করে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে যা চুনাপাথরের সংস্পর্শে এসে জমাট বেঁধে বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করছে যা পুরোটাই প্রকৃতি নির্ভর ৷
কাঠের আলপথ |
শেষে লেবু জল পান করে একই রাস্তায় বিদায় নিলাম ৷ অবশ্য স্থানীয়দের থেকে জেনে নিলাম এখানে বাঘ , কুমীর , ইত্যাদি ইত্যাদি কেউ আছে কিনা ৷ তারা আমাদের নির্ভাবনায় ফিরতে বললো এখানে নাকি ওসব কিছু নেই ৷
এবারের গন্তব্য আর এক বিস্ময় " মাড ভলকান " ৷ এখানের যাতায়ত রাস্তাটা বেশ কষ্টকর ৷ ধাপে ধাপে মাটির সিঁড়ি বানানো ৷ কোনটায় কাঠের টুকরো আছে কোনটায় নেই ৷ বেশির ভাগ জায়গা পিছল ৷ রাস্তার দুদিকে ঘন জঙ্গল ৷ কোন গাইড নেই নিজেদেরই যেতে হচ্ছে ৷ তবে সঙ্গী হল একটি হাড় জিরজিরে সারমেয় ৷ ও কিন্তু পুরো সময়টা আমাদের সঙ্গ দিল ৷ জল ছাড়া সঙ্গে কোন খাবার নেই ৷ ওকে তুষ্ট করতে পারলাম না ৷ " মাড ভলকান " দেখলাম যার থেকে ক্রমাগত মাটির নিচ থেকে উঠে আসছে গরম কাদামাটি ৷ সেই কষ্টকর রাস্তাটি ওঠা যতো সহজ মনে হয়েছিলো নামা ততোধিক কষ্টকর ৷ ধীরে ধীরে আমরা সবাই নিরাপদে নামলাম ৷ গাইড সারমেয় আমাদের পিছন পিছন নেমে এল ৷ নিচে এসে গাড়িতে রাখা বিস্কিট দিলাম সারমেয় কে ৷ আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল , তাকিয়ে এক ঝলক দেখে নিলাম সারমেয় প্রাপ্য ঘুষ পেয়ে মহাখুশি ৷
রঙ্গতে রাত্রিবাসের পর সূর্যোদয় দেখলাম রঙ্গতের আম্রকুঞ্জ সাগর তটে ৷ মাছধরায় ব্যস্ত জেলেকে ক্যামেরা বন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ৷ জেলে ভাইয়ের ছবি নিচ্ছি বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল ছবি তোলবা ৷ বললাম হ্যাঁ ৷ সঙ্গে সঙ্গে এতো সুন্দর একটি ভঙ্গি দিল ৷ সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা শট নিয়ে নিলাম ৷
কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্যদেব তার সোনার আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠল ৷ সেই মোহময়ী আভায় ভেসে গেলাম ৷ প্রাণ ভরে শান্ত স্নিগ্ধ সূর্যের পরশ মেখে বিদায় নিলাম ৷ পথে পড়ল পঞ্চবটী জলপ্রপাত ৷ এরপর এলাম মরিছিদ্রা সাগর তটে ৷ আন্দামানের প্রতিটি সাগর তট ভিন্ন ধরনের ৷ কোনটার সঙ্গে কোনটার মিল নেই ৷ কোনটায় প্রবল ঢেউ , কোনটায় বড় বড় পাথরের চাই , কোনটা শান্ত রূপালী বালুর চাদর বিছানো ৷ গাইডের নির্দেশ ছাড়া নামা অনুচিত ৷ অনেকক্ষণ এই সাগর তটে কাটালাম ৷ পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ছে ফেনিল জলতরঙ্গ ৷ যতদূর চোখ যায় সমুদ্র আর আকাশ মিলেমিশে একাকার ৷ চোখ , মন সার্থক করে ডিগলিপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ৷
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post