একটি কাকের আত্মকথা
প্রতিদিনের এই যন্ত্রণা ক্রমশ আমার কাছে দূর্বিষহ হয়ে উঠছে।
একদিকের নতুন নতুন গগনচুম্বী আবাসনের বাসিন্দারা আমাদের সবসময় তাড়াতেই ব্যস্ত।
আমরা এখানেই জন্মেছি, অন্য দেশ থেকেও
আসেনি। যেদিন থেকে নিজের খাবার নিজেই খেতে শিখেছি, একা একা উড়তে শিখেছি, সেদিন থেকেই এই
সমস্ত গোরাবাজার, ধোবি পুকুর, রেলস্টেশান এলাকা ও তার আশপাশ অঞ্চল নিজেদের বাসস্থান বলেই
জেনেছি। এখানকার বাড়িগুলির সামনে ও পিছনে কতো গাছ ও বড় বড় ডোবা থাকত। আমাদের
খাবারের কোনও অভাব ছিল না। গোরা বাজারে সবসময়ই মানুষের ভীড়। মাছ, মাংস, ফল, সব্জির অফুরন্ত
বেচাকেনা এই বাজারে। নানান ধর্ম ও জাতির মানুষ থাকে এখানে। বাঙালি, অবাঙালি, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, ওড়িয়া, বিহার বা ঝাড়খণ্ডের
নানান সংস্কৃতির মানুষের মেলবন্ধন এখানে। ছোটবেলা থেকেই দেখছি বারোমাস নানা জাতির
নানা উৎসব চলতেই থাকে এখানে। রথযাত্রা, দুর্গাপূজা, ছটপূজা, ইদ, ২৫শে ডিসেম্বর আরও নানান উৎসবের আনন্দ। বাজারের ভীড়, অবিরাম কেনাকাটা
লেগেই থাকে এখানে। ছোট-বড় নানান খাবারের দোকানে, চায়ের দোকানে সব সময় লোকের ভীড় লেগেই থাকত। এখানকার
বাড়ীগুলোর প্রায় সব মানুষেরাই আমাদের পরিচিত ছিল। কক্ষনো কেউ আমাদের সবসময় তাড়াতেই
থাকত না। এখন দিনকাল কেমন যেন বদলে গেছে।
জেসপ কারখানার সেই রমারমা এখন আর নেই। কোন লোকজনের আনাগোনা -কোলাহল নেই, নেই কাজের ব্যস্ততা, নেই কাজের ফাঁকে চা-বিস্কুট খেতে খেতে
আমাদের দিকে একটা-দুটো ভাঙ্গা বিস্কুট ছুড়ে দেওয়া। জেসপের রেললাইনটিও বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুদিন
আগেও এই রেললাইন দিয়ে বিমানবন্ধর পর্যন্ত ট্রেন যাতায়াত করত। ঐ রেলপথ বন্ধ হয়ে এখন
মেট্রোরেল হবে, তবে সেটা ব্রিজের ওপর দিয়ে যাবে। এখন জেসপ কারখানাটিকে আমার
ভূতুড়ে, অপরিচ্ছন্ন
একটি ভাগাড় বলেই ম’নে হয়। তবে হ্যাঁ, এই ভাগাড় থেকে কোন
মৃত প্রাণীর দেহ শহরের রেস্তোরাঁয় পাচার হয়েছে ব’লে শুনিনি। এখানকার প্রচুর বড় বড় গাছ আমাদেরকে যেন সবসময় তাদের
সবকিছু দিয়েই ভালবাসে। শুধু ভালবাসায় পেট যে ভরে না। আবার বাসস্থানের কাছাকাছি
খাবারের ব্যবস্থা থাকাও প্রয়োজন। আমাদের তো শুধু দিনেই খাওয়া।
জেসপ কারখানার কোলাহলের পরিবর্তে এখন শুধুই
আবাসনের বাসিন্দাদের কোলাহল। গাছ কেটে একটা বাড়ির জায়গায় গগনচুম্বি আবাসন, বড়ো ডোবা সাজগোজ ক’রে তাঁর সৌন্দর্য
বৃদ্ধি ক’রে
সুইমিং পুল হিসেবে আবাসনের কৌলিন্য বৃদ্ধি করেছে। এভাবেই মানুষের সংখ্যা ও তৎসহ
কোলাহল বেড়েই চলেছে। চতুর্দিক আলোকময়
থাকায় রাত প্রায় দেখতেই পাইনা। গোদের ওপর বিষফোঁড়া স্বরুপ আজকাল রাতের রাস্তায়
বারোমাস নানান উজ্জ্বল আলো। ফলশ্রুতি স্বরুপ আমরা ব্রাত্য ও নিজভূমে থেকেও শরণার্থী
জীবন যাপনে বাধ্য। চতুর্দিকের আলো থাকায় চোখের ঘুম গেছে উড়ে। অথচ সকালে একটু বেশী ঘুমানোর উপায় নেই। মানুষের কথা ও
চলাচলের শব্দে এখন আমাদের ঘুম ভাঙে। কাকভোর পালটে মানুষভোর হলে বেশ হয়। বনগাঁ, হাসনাবাদ, ঠাকুরনগর ও অন্যান্য
প্রান্ত থেকে মানুষেরা আসতে শুরু করে সূর্যোদয়ের অনেক আগে।
মৃত্যুভয় সত্বেও জায়গার অভাবে আমাদের বিদ্যুতের খাম্বাতে
কোনরকমে বাসা বানাতেই হয় । মৃত্যুভয় শিয়রে জেনেও ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে একাকী রেখে
খাবার সংগ্রহে ছুটি। আমাদের বাসা বানানোর জায়গার ভীষণ অভাব। গাছ না থাকায় বাসা
বানানোর শুকনো সরু ছোট ছোট ভাঙা শাখার ভীষণই অভাব। অগত্যা আবাসনের ব্যালকনি থেকে
কারুর ঝাড়ুর কাঠি, সরু লাঠি নেওয়ার চেষ্টা করি। তাই মাঝে মাঝেই গালমন্দও শুনতে হয়।
চড়ুই কিংবা পায়রাদের বেশ আরাম। আমাদের মতো খাবার সন্ধান করতে হয়না। গৃহস্থরা ডেকে
ডেকে ওদের শস্যদানা খেতে দেয়। সারাদিন গৃহস্থের বাড়ীর আনাচে-কানাচে মজা করছে।
কারুরই দৃষ্টিকটু বোধ হয় না। অন্যদিকে আমদের দেখলেই গৃহস্থেরা রে-রে ক’রে তাড়াতে
আসছে। একটুকরো খাবার ঠোঁটে ক’রে এনে শান্তি ক’রে খেতেও পারব না। কার্নিশ বা
ব্যালকনিতে ব’সে যেই খেতে যাব ওমনি তাড়াবে। হয়ত কষ্টের জোগাড় পড়েই গেল চারতলা
থেকে। আমরা যেন একেবারেই ব্রাত্যজন। বয়ঃজ্যেষ্ঠদের কষ্ট আজকাল আর চোখে দেখা যায়
না। আমাদের জন্য কোন খাদ্যশ্রী, বয়ঃজ্যেষ্ঠশ্রী বা আবাস যোজনাও নেই। আজকাল যেমন
গরম তেমন সূর্যকিরণের উত্তাপ। বড় গাছের আশ্রয় না থাকায় আবাসনের ব্যালকনির রেলিংএ
বা জামা-কাপড় শুকানোর দড়িতে একটু আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করি আমরা। ব্যস, ওমনি সবাই “যা
– যা” বলে তাড়াতে শুরু করে।
২
নিরুপায় হয়ে কখনো এয়ারকন্ডিশনারের পাইপে কখনো বন্ধ জানালার
পাশে আশ্রয় নিই একটু উষ্ণতার খোঁজে। এভাবেই লড়াই ক’রে বেঁচে থাকা। এখনতো শহরজুড়ে লাইটপোষ্ট থেকে লাইটপোষ্টে কেবল-টিভির তারের ছড়াছড়ি। আমাদেরও সুবিধা হয়
কেবলের এই তারের ওপর বসেই কখনো খাবারের জন্য নজরদারী, কখনো একটু বিশ্রাম, কখনো
প্রকৃতির ডাকে সারা দেওয়া।
কখনো
দিনান্তে একটু মিষ্টি মধুর হাওয়ায় হয়ত বসে আছি দুজনে। একদিন লক্ষ্যই করিনি
সন্ধ্যার ফাঁকা রাস্তায় দুটি কিশোর-কিশোরী লাইটপোষ্টের কাছে খুব ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। ওরাও আমাদের ঠিক নীচেই
ওদের আনন্দযজ্ঞে ব্যস্ত। সেদিনই আমার একটু খাওয়া বেশী হয়েছিল। অজান্তে আমার একটু
বিষ্ঠা পড়ে গেলে কিশোরটি ঢিল ছুঁড়তে থাকে।
আচ্ছা,
আমরাও কি একটু নিজেদের মতো কোথাও বসতে পারিনা? আমাদের জন্য কোন “এক কদম স্বচ্ছতাকি
ওর” প্রকল্পও নেই কিংবা “ শৌচালয় নেহি তো দুলহন নেহি” প্রকল্পও নেই। গাছ নেই শান্তি নেই, নেই কেউ আমাদের জন্য
চিন্তা করবার। আবাসনের কার্নিশ, নতুন নতুন
উড়ালপুলের ফাঁকফোকরই এখন আমাদের সহজলভ্য বাসস্থান। আজকাল শুনছি উড়ালপুলও ভেঙে
পড়ছে। তাহলে আমরা কোথায় যাব? তবে কি পাঠ্য
বইতেই লুপ্তপ্রায় অথবা বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণীর তালিকাভূক্ত হব।
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post