শীতকালটা এসেই গেলো
Picture Courtesy: Google Image |
.
মোবাইলে মেসেজ টোনটা শুনেই দীপ্ত বুঝতে পারে , শ্রুতির মেসেজ । এই নিয়ে
আধঘন্টা অন্তর চারটে মেসেজ এলো । হাসি হাসি মুখে মোবাইলটা বের করে পকেট থেকে , এবার একটা রিপ্লাই না
পেলে ম্যাডামের মাথা গরম হয়ে যাবে । তখন পুরো প্ল্যানটাই বানচাল হয়ে যাবে হয়ত ।
দীপ্তর জন্য অনেক্ষা না করে অটো ধরেই হয়ত বাড়ি চলে যাবে । আর তারপর.....
উফ্ , তারপরের টুকু আর মনে করতে
চায়না দীপ্ত । অভিমানের পারদ গলতে সেই মাঝরাত ।
ছোট্ট একটা মেসেজ সেন্ড করে দেয় , আমি আসছি ঠিক সময়ে ।
চারটে পঁচিশ , আধঘন্টা
সময় আছে এখনো । চটপট হাতের কাজগুলো সারতে থাকে দীপ্ত ।
সময়মতো বাইক নিয়ে পৌঁছে যায় শ্রুতির অফিসের সামনে ।
তারপর
দুজনে মিলে পৌঁছে যায় ওদের প্রিয় সেই নির্জন গঙ্গার ঘাটে । এইখানেই ওদের
দুজনের প্রথম দেখা হয়েছিল দুবছর আগে । কথাচ্ছলে আলাপ , পরিচয় , মোবাইল নম্বর বিনিময় , কিছুদিন দেখা নাহলে
মনখারাপ , চুটিয়ে প্রেম , অবশেষে সাড়ে তিন মাস আগে
বিয়ে । দুজনের অফিসেই কাজের এত চাপ , হানিমুনটাই
হয় ওঠেনি এখনো ।
পড়ন্ত বিকাল , শেষ
হেমন্তে সূর্যের আলো বড় তাড়াতাড়ি নরম হয়ে যায় । শেষ আলোর রেখাটা এলোমেলো আলপনা
এঁকে যাচ্ছে জলের বুকে । গঙ্গার শিরশিরে ঠাণ্ডা হাওয়া একটা শীতের আমেজ তৈরি করছে ।
তবু সারাদিনের অফিসের ক্লান্তির শেষে অবশ্য হাওয়াটা মন্দ লাগছে না দীপ্তর ।
শ্রুতির বোধহয় একটু শীতশীত করছে , সালোয়ারের
ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে দীপ্তর সাথে একটু ঘন হয়ে বসে ।
বাবু পাখি নেবেন , আচমকা
পিছন থেকে ডাকটা শুনে চমকে উঠেছিল দুজনে ।
খাঁচায় বন্দী ছোট্ট ছোট্ট দুটো রঙীন পাখি , দেখেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল
দীপ্তর । শ্রুতি বারণ করা সত্ত্বেও কড়কড়ে এক'শ
টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিল খাঁচা সহ পাখি দুটো । যথারীতি মুখভার শ্রুতির , খাঁচায় পাখিকে আটকে রাখা
মোটেও পছন্দ নয় ওর । এইভাবে পাখি পোষা মানে পাখিদের কষ্ট দেওয়া ।
দীপ্ত তখন ফিরে গেছে ওর ছোটবেলায় । ওদের বাড়িতে একটা খাঁচায়
পোষা টিয়াপাখি ছিল , নাম ছিল কেষ্টদাস । কি
সুন্দর কথা বলতো । খুড়তুতো জেঠতুতো ভাই-বোন মিলে ওরা ছ-জন ছিল । ঠাকুমার শুনে শুনে
ওদের বলতো , এই তোরা পড়তে বস । ওকে না
দিয়ে কেউ কিছু খেলেই চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করতো । কেষ্টদাস যখন মারা যায় , দীপ্তর সামনে তখন
মাধ্যমিক পরীক্ষা । আপনজন মারা যাওয়ার মত কষ্ট হয়েছিল সবার । দীপ্ত তো কটাদিন
পড়াশুনোয় মন বসাতেই পারেনি । ইচ্ছা থাকলেও তারপর আর পাখি পোষা হয়নি ।
সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরার পথে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার প্ল্যান ছিল
। কিন্তু তাতে রাজি হয়না শ্রুতি । একবার মুড বিগড়ে গেলে সহজে স্বাভাবিক হতে পারেনা
, এইটা শ্রুতির খুব খারাপ
অভ্যাস ।
দীপ্ত আজ অবশ্য আপন খেয়ালে মত্ত । বাড়ি ফিরেই খাঁচা নিয়ে ছোটে
ব্যালকনিতে , যেখানে আজ থেকে ওরা থাকবে
। বৃষ্টির ছাট এলে অবশ্য সরিয়ে দিতে হবে খাঁচাটা । রবিবার একটা বড় খাঁচা কিনে আনবে
ওদের জন্য , তাহলে বেশ আরাম করে থাকতে
পারবে ।
শ্রুতির পা ফেলা , জিনিসপত্র
সরানোর আওয়াজেই বোঝা যাচ্ছিল মেজাজের উত্তাপ । সন্ধ্যের এককাপ চা টাও না করে টিভি
চালিয়ে বসে যায় শ্রুতি , সাথে মোবাইল নিয়ে খুটখুট
। ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হতে হতে দীপ্ত ভালোই বুঝতে পারছে , টিভিটা অকারণেই চলছে ।
শ্রুতির সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ-ই নেই । হোয়াটসঅ্যাপে মগ্ন এখন সে । দীপ্ত-ই
রান্নাঘরে গিয়ে চা করে এনে এককাপ নামিয়ে দেয় শ্রুতির সামনে । মানভঞ্জনের চেষ্টা না
করেই চলে যায় বেডরুমে , ল্যাপটপটাকে নিয়ে শরীরটা
গড়িয়ে দেয় বিছানায় । আহ্ , সারাদিন পর কি শান্তি ।
কি এমন অন্যায় করেছে পাখি দুটোকে এনে , যে এতো মেজাজ গরম হয়ে গেল
? দেখা যাক্ কতক্ষণ রাগ করে
কথা না বলে থাকতে পারে । আজ নিজে থেকে কিছুতেই কথা বলবে না দীপ্ত ।
রাতে খাওয়ার টেবিলে দীপ্তর সবচেয়ে অপছন্দের খাবার , প্রেসার কুকারের সিদ্ধভাত
আর ডিমের অমলেট । শ্রুতি আজ সবটুকুই করছে দীপ্তকে জব্দ করার জন্য । তবু কোন কথা না
বলে ঐ ভাত-ই গিলে নেয় দীপ্ত । শ্রুতি অবাক চোখে দীপ্তর খাওয়া দেখছিল , তখনি একবার চোখাচোখি হয়ে
যায় দুজনের । চট করে নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে , যেন
দীপ্তকে দেখতে ওর বয়েই গেছে ভাব এনে সিচুয়েশনটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করে শ্রুতি ।
খাওয়া সেরে অন্যদিনের মতই শুতে চলে যায় দীপ্ত । শ্রুতির
রান্নাঘরের কাজ , তারপর রূপচর্চা সেরে
বিছানায় যেতে রোজ-ই দেরি হয় । ক্লান্ত শরীরে তীর্থের কাকের মতো চেয়ে চেয়ে শ্রুতির
ত্বকচর্চা দেখে । এই রাত্তিরবেলা এতো সাজের যে কি আছে বোঝেনা । আজ অবশ্য শুতে
যাওয়ার আগে ব্যালকনিতে পাখি দুটোকে একবার দেখে আসে দীপ্ত ।
যা কোনদিন হয় না , আজ
তাই হলো । বিছানায় শুতেই কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বুঝতে পারেনি ।
ফোঁপানির আওয়াজে ঘুমটা ভাঙতেই নিজের-ই খারাপ লাগে দীপ্তর ।
অন্ধকারেও বুঝতে অসুবিধা হয়না শ্রুতি কাঁদছে । কান্নাকাটি করলেই ওর মাথা যন্ত্রণা
হয় , আর মাথার যন্ত্রণা হলে যা
কষ্ট পায় বেচারি চোখে দেখা যায় না । ইস্ শ্রুতিকে আজ একটু বেশি অবহেলা করে ফেলেছে , খুব কষ্ট পেয়েছে ও ।
আলগোছে শ্রুতির হাতটা স্পর্শ করতেই কারেন্ট খাওয়ার মত সরে যায় শ্রুতি । গায়ের
ঢাকাটা আরো ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে আরো কিছুটা দূরে সরে যায় ।
তাও শ্রুতিকে কাছে টানার চেষ্টা করে দীপ্ত । অভিমান যে এতো
সহজে কমবে না সাড়ে তিনমাসের অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছে দীপ্ত ।
তখন অনেকটা রাত , দীপ্তর
বাহুপাশে আবদ্ধ শ্রুতি ।
সকালেই পাখি দুটোকে উড়িয়ে দেবো , এই তোমায় ছুঁয়ে কথা দিলাম
।
সত্যি বলছো , ওদেরকে
আকাশে ছেড়ে দেবে ?
হুম দেবো তো , এই
দেখো তোমাকে ছুঁয়ে বলছি । বলেই আরো কাছে টেনে নেয় শ্রুতিকে ।
শ্রুতির খিলখিল হাসির আওয়াজে বোঝা যায় মেঘ পুরোপুরি কেটে গেছে
।
দীপ্ত বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা করছে বলতেই নিজের গায়ের চাদরের গরমে
দীপ্তকে টেনে নেয় শ্রুতি ।
উফ্ শান্তি , অবশেষে
শীতকালটা এসেই গেলো.........
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post