পয়লা বৈশাখ
বনবীথি পাত্র
এখনো
খাওয়া শেষ হলো না তোমার, এইটুকু খেতে এতক্ষণ লাগে? রান্নাঘর থেকে একটা ট্রেতে দু-কাপ চা আর দুধের গ্লাস নিয়ে বেরিয়ে মহুলকে অকারণ ধমক লাগায় । প্রতিটা
ছুটির দিনের মতোই সকাল থেকে মেজাজ গরম পিয়ালীর । মায়ের হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়েই মহুলের সামনে থেকে বাটার টোস্টের প্লেটটা টেনে নেয় । দুপিস
পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে একটু আধটু খেয়েছে , বেশিটাই তখনো পড়ে রয়েছে । অকারণেই একটু বেশি আওয়াজ করে দুধের গ্লাসটা নামিয়ে বলে
, চটপট খেয়ে নাও । আটটা বাজতে আর দেরি নেই । একটা
মানুষ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে আর তখনো তুমি রেডি হতে পারবে না , সেটা মোটেও ভালো দেখায় না । দুধ খেয়ে যাচ্ছো , তার
ওপর ঐ লুচি-পরোটা
খবরদার মুখে দেবে না । খেতে বললে বলবে , তুমি
ব্রেকফাস্ট করে গিয়েছ । ডিম
- চিংড়িমাছ একদম খাবে না , ওগুলো খেলেই তোমার অ্যালার্জি বেরোয় । কি হলো দুধের গ্লাসটা নিয়ে বসেই থাকবে নাকি দুধটা খাবে ।
রবিবার
সকালে মা-মেয়ের এই গম্ভীর কথাবার্তা মুখস্থ হয়ে গেছে পরমার । আজ
রবিবার নাহলেও পয়লা বৈশাখের ছুটি । কাল রাতেই ঋতমের মা ফোন করে বলেছেন , ওদের
বাড়িতে কি একটা অনুষ্ঠান আছে তাই মহুলকে সকালে নিয়ে যাবে ।
কোর্ট
থেকে এমনটাই নির্দেশ আছে , মেয়ে মায়ের কাছে থাকলেও ছুটির দিনে বাবা চাইলে মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারেন । ঋতমের বা ওর
বাড়ির কোন ভালোটাই শুনতে পছন্দ করে না পিয়ালী । মহুলের মনে ঋতম বা ওর বাড়ির কোন প্রভাব ফেলতে চায়নি , কিন্তু
আইনি জটিলতায় শিকড়টা উপড়ে ফেলতে পারেনি ।
গ্লাসের
দুধটুকু শেষ করতে বলে বাথরুমে স্নানটা সারতে ঢুকে পড়ে পিয়ালী । তার ও বেরনোর
তাড়া আছে । আগে ছুটির দিনগুলো বাড়িতেই থাকতো পিয়ালী , কিন্তু
কিছুদিন থেকেই ছুটির দিনগুলোতে যেন অফিসের থেকে বেশি তাড়াহুড়ো করে বেরনোর জন্য । ফিরতেও বেশ রাত হয় । ঋতম
মহুলকে পৌঁছে দিয়ে চলে যায় , তার অনেক পরে ফেরে পিয়ালী । হুইলচেয়ারে বসেও মেয়ের নতুন জগৎটার আন্দাজ করতে অসুবিধা হয়না পরমার । কিছু
বলতে গেলেই পিয়ালীর সেই এক অভিযোগ , এমন ছেলের সাথে জীবনটা জুড়ে দিয়েছিলে যে পাঁচবছরের মধ্যে মেয়ে নিয়ে ফিরে আসতে হলো । আমার জীবনটা তো শেষ হয়েই গেছে , একটু
কি নিজের জন্য বাঁচার অধিকার নেই আমার !!!!
ঋতমকে
ছেলে হিসাবে তো ভালোই লেগেছিল তখন , পরিবারটাও ভালো.....তবু কেন যে ওদের সংসারে পিয়ালী নিজেকে মানিয়ে নিতে পারল না কে জানে !!!! ঋতমকে এখনো কিন্তু বেশ ভালো লাগে পরমার । মহুলকে পৌঁছে দিতে এসে পিয়ালী না থাকলে একটু বসে পরমার সাথে গল্প ও করে
যায় মাঝেমাঝে ।
ঋতম
ঠিক সময়ে এসে মহুলকে নিয়ে গেছে । তার কিছুক্ষণ পরেই বেড়িয়ে গেছে পিয়ালী । আজ
প্রথমবার দোতলার বারান্দা থেকে পিয়ালীর নতুনবন্ধুটিকে দেখেছে পরমা । ছেলেটির আর্থিক প্রাচুর্যকে ছাপিয়ে যেন তার উগ্রতাটাই চোখে পড়ে পরমার । প্রতিটা
ছুটির দিন এইভাবে একজনের গাড়ি করে সকালে বেড়িয়ে যাচ্ছে আর সেই কোন্ রাতে ফিরছে , দুদিন পরে তো পাড়ার লোকে পাঁচজনে পাঁচকথা বলবে । এটুকুও কি বোঝেনা পিয়ালী !!!!!!
মনে
মনে ঠিক করেন এবার একটু শক্তভাবেই কথা বলতে হবে মেয়ের সাথে ।
চারদিকে
আজ কত হৈচৈ ....একসময় সকালবেলা উঠে স্নান সেরে আগে পাড়ার মন্দিরে পুজো দিয়ে এসে তবে কাজকর্ম শুরু করতেন পরমা । পয়লা বৈশাখ মানেই নানারকম রান্নার ব্যাপার ছিল । সন্ধ্যেবেলা
একটু ঘুরতে বেড়নো আর রাতে বাইরে কোথাও খেয়ে বাড়ি ফেরা । কোথায় যেন বদলে গেল দিনগুলো । মেয়ের
বিয়ের বছর না ঘুরতেই মানুষটা চলে গেল । তার একবছরের মধ্যেই সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে কি যে হলো
, সারাজীবনের জন্য হুইল চেয়ার বন্দী । নাতনিটা এখন এখানে থাকে বলে তাও কিছুটা সময় কেটে যায় । বছরের
প্রথম দিনটাতে আজ বড্ড ফাঁকা ফাঁকা সারাটাদিন , মনজুড়ে শুধুই স্মৃতির টানাপোড়েন ।
বিকালের
আগে থেকেই আকাশ জুড়ে কালো মেঘের আনাগোনা , কালবৈশাখীর সঙ্কেত যেন । হয়ত ঝড়-বৃষ্টি আসতে পারে ভেবেই মহুলকে বিকালেই পৌঁছে দিয়ে গেছে ঋতম ।
বছরের
প্রথম দিনেই এলোমেলো করে এলো কালবৈশাখী । প্রকৃতি যেন ভাঙনের খেলায় নেমেছে । মহুলটা
ভয়ে দিম্মার কোলের কাছে জড়োসড়ো । অনেক পরে ঝড় থেমে শুরু হলো বৃষ্টি , প্রবল
বৃষ্টি । পিয়ালী তখনো ফেরেনি । মহুলের
বোধহয় মায়ের জন্য মনখারাপ করছে , কান্নাকাটি শুরু করেছে । ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না পিয়ালীকে । নাতনিকে
সামলাতে পারছে না কিছুতেই ।
মেয়ে
কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে ফোন করেছে । ঐ বৃষ্টির
মধ্যে সাথে সাথে ছুটে এসেছে ঋতম । "আমার মা-কে খুঁজে এনে দাও
"
ছোট্ট
মহুলের বায়নায় অতো রাতে কোনো ঠিকানা ছাড়াই খুঁজতে বেড়িয়েছে ।
ঋতম
কি করে যে পিয়ালীকে খুঁজে পেল জানা হয়নি , তবে অনেকটা রাতে পিয়ালীকে সাথে করেই ফিরেছিল ঋতম । বড্ড বিধ্বস্ত লাগছিল পিয়ালীকে । বাড়ি
ফিরেই মহুলকে জড়িয়ে আকুল কান্নাতে ভেঙে পড়েছিল পিয়ালী ।
মহুল
বেচারি কেমন একটা আতঙ্কের মধ্যে ছিল যেন । মাকে ফিরে পেয়েও বাবাকে ছাড়তে চায়নি মহুল । ঋতম
এবাড়িতেই থেকে গেছে , পিয়ালীও কোন আপত্তি করেনি । ভালো থাকার জন্য আপন মানুষগুলোর স্পর্শ বড়ো বেশি দরকার । বহুদিন বাদে আজ বাবা আর মায়ের মাঝখানে শুয়ে বড় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে মহুল ।
ঝড়ের
শেষে বৃষ্টিটাও থেমে গেছে , জানলার গ্রিল ছুঁয়ে ছুঁয়ে এখনো গড়িয়ে পড়ছে জলের ফোঁটা । গুমোট গরমটা কেটে গিয়ে হালকা একটা ঠাণ্ডা বাতাস জুড়িয়ে দিচ্ছে শরীরের ক্লান্তি , মনের
বিষণ্ণতা ।
নতুন
বছরের প্রথম রাতটায় মহুলের মতোই বড় নিশ্চিন্ত লাগছে পরমার ।।
সব সময়ের মতই। দারুন লিখেছো দিদি।
ReplyDeleteআমি কাটোয়ার পিকি (চুমকীর দাদা)