লাল আলো
সান্ত্বনা দাস
সেই ঘরটায় ওরা চারজন এখনও বসে থাকে। সারাদিনে নিজেদের কাজ সেরে সন্ধ্যাবেলা ওরা চলে আসে এই ঘরটায়। আগেও আসত, তখন ওরা ছিল পাঁচজন বিমল, অতীন, মাধব, শুভ আর সোমনাথ। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট একটা গ্রাম ।একটু দূরেই শহর। একটু পর পর ট্রেন যায়। গ্রামের নাম ফলবতী। পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে ঝির ঝিরে নদী তির তির করে।ফুলে ফলে গ্রামের শ্রী আছে। স্কুল আছে। পাঁচ বন্ধু স্কুলে যায়, পড়াশোনার পর শুরু ওদের ডানপিটেমি। ছুটির দিন গুলতি মেরে আম পাড়া, পাখি ধরার খাঁচা যত রসদ জড় ছিল ঐ পোড়ো ঘরটায়। গ্রামের পাশে জঙ্গলের মধ্যে ঘর। বড়রা বলত 'যাসনা ওখানে, ভূত প্রেত দত্যি দানো আছে ,সাঁঝবেলায় সব জড় হয় ওখানে।' ডানপিটেগুলো চিৎকার করে বলত 'তোমাকেও নিয়ে যাব দাদু '।কার বাড়িতে মড়া পোড়ানো, কোথায় রোগীকে হাসপাতালে দেওয়া সোমনাথ বিমলের দল আগে হাজির। অতীনের মায়ের খুব জ্বর সেবার, সারা রাত অতীন আর মাধব বসে বসে মায়ের মাথায় জলপটি দিল। তিন্নি বোনের বিয়েতে পাঁচজনে মিলে খাটাখাটনি করে তুলে দিল বিয়ে। তিন্নির মা নেই, অসুবিধে কাউকে সেরকম বুঝতে দেয় নি।
সেবার পুজোয় অন্নদা মাসীকে সবাই টিফিনের পয়সা জমিয়ে কাপড় কিনে দিল। রাস্তার পাশে তেঁতুল বাগান লোকে এড়িয়ে যায় ঐ রাস্তা বলে কে যেন বসে থাকে গাছে ।ওরা যায় তেঁতুল পাড়তে। এরকম করে ওরা কৈশোর পার হতে চলল।
স্কুল শেষ করে শহরে কলেজে ভর্তি হল। ট্রেনে করে যায় ট্রেনেই ফেরে, একসঙ্গে। একদিন হঠাৎ ট্রেন থেকে সবাই নেমে পার হয়েছে শুধু সোমনাথ পার হতে পারল না। লাল সিগন্যাল হঠাৎ নিবে গিয়েছিল, হয়ত যান্ত্রিক গোলযোগ । বিপরীত দিক থেকে এসে পড়ল আর একটা ট্রেন। সোমনাথ আর উঠল না। চার বন্ধু ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর দেহটার ওপর,বলল 'তুই আমাদের ছেড়ে যাস না সোমনাথ '। সোমনাথের হাতটা একটু উঠল, হয়ত ওদের আশ্বস্ত করতে চাইল তারপর স্থির হয়ে গেল।
গ্রামের লোকজন চোখের জলে বিদায় জানাল ওকে। তার পর থেকে ঐ স্টেশনে আর ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট হয় নি। একটা লাল আলো যথা সময় স্টেশনে সিগন্যাল দেয় ।সবাই দেখে দূর থেকে। না কেউ কাছে যায় না। সন্ধ্যা বেলা শেষ ট্রেনে ফেরের চার বন্ধু অতীন বিমল শুভ আর মাধব। লাল আলোটা সিগন্যাল দেয়, ট্রেন থামে। চার বন্ধু এগিয়ে চলে ঐ পোড়ো ঘরটার দিকে, সঙ্গে চলে সেই লাল আলো, কখনও চারজনের মধ্যিখানে কখনও শেষে। ওরা কোনো দিকে তাকায় না, নিজেদের মধ্যে শুধু কথা বলে। ঘরে ঢুকে যায় সবাই। বেশ কিছুক্ষণ পরে ওরা বার হয়। লাল আলোটা আর থাকে না। এখন গ্রামের সবাই আর বলে না 'ওখানে যাস না ভূত আছে, বলে ওদিকে যাস না, ওখানে আমাদের সোমনাথ আছে '।
বেশ লাগলো। ধন্যবাদ-সৌরভ
ReplyDelete