ষষ্ঠ বুলেট
স্বরূপ চক্রবর্তী
( প্রথম মুদ্রিত প্রকাশ ঃ " গা ছম ছম" শারদ সংখ্যা ২০১৮)
Collage: Swarup Chakraborty |
১
"জানালার কাঁচটা তুলে দে বিলু, বাইরের হওয়াটা ঠান্ডা লাগছে।"
বললেন অনুব্রত, অনুব্রত দে, বয়স
চল্লিশ,অকৃতদার দোহারা চেহারার অনুব্রত গত আট বছর ধরে হরিদ্বারে
থাকেন,
কাজ করেন একটি আধা সরকারি সংস্থার ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টে, মোটামুটি ভদ্রস্থ চাকরি, বেতন ভালোই, খেলাধুলো থেকে শত হস্ত দূরে থাকা অনুব্রতর একমাত্র শখ বইপড়া, চোখে মাইনাস দশ পাওয়ারের চশমা, থাকেন একাই, আত্মীয় বলতে দেশের বাড়িতে মা বাবা ও এক কাকার যৌথ পরিবার, খুড়তুতো ভাই সোহম অর্থাৎ বিলু থাকে দিল্লিতে, ওখানেই কোনোও বেসরকারী ফার্মে উচ্চপদে কর্মরত, এখনও বিয়ে হয়নি, সে মাঝে মাঝেই হরিদ্বারে হানা দেয় অনুব্রতর কোয়ার্টারে, তার পছন্দ জঙ্গল, তাই সে আসলেই তাকে নিয়ে বেরোতে হয় আশেপাশের পাহাড় জঙ্গল
ভ্রমণে।
সেইমত অনুব্রতর সেকেন্ড হ্যান্ড হুন্ডাই গাড়ি ও অনুব্রত কে নিয়ে
সোহম বেরিয়ে পড়েছে, সময়টি এপ্রিলের মাঝামাঝি, হরিদ্বার দেরাদুন হাইওয়ে ধরে তীর বেগে ছুটছে গাড়ী। গন্তব্য
দেরাদুন হয়ে ‘পন্টা সাহিব’। কয়েকশ
কিলোমিটারের ধাক্কা, মার্চ শেষ , তাই
ছুটি পেতে দুজনের কারোরই অসুবিধে হয়নি, তাই এই দুদিনের ট্যুর।
কলকাতায় এখন পচা গরম, কিন্তু এখানে এখনো সকাল আর রাত্রিতে বেশ ঠান্ডা পড়ে,
সময় প্রায় সন্ধে সোয়া ছটা, রাত নামতে দেরি আছে তবুও বাতাসে শিরশিরানি ধরেছে, গাড়ীর কাঁচটা তুলে দিল সোহম, রাজাজী ন্যাশনাল পার্কের মতিচুর রেঞ্জ দিয়ে চলছে গাড়ি।
প্রায় সত্তরের কাছাকাছি স্পিড, চকচকে পিচ ঢালা রাস্তার দুপাশে ঘন শাল সেগুনের জঙ্গল, মাঝে মাঝে জঙ্গলের মধ্যে ফুলে ভরা পলাশ গাছ, দেখলে মনে হয় যেন জঙ্গলে আগুন লেগেছে, বাস্তবে প্রায় প্রতি বছরই বছরের এই সময়ে শুকনো গাছে ঘষা লেগে আগুন ধরে যায়, অনুব্রত কোম্পানীর টাউনশিপের কোয়ার্টারে নিরাপদ দূরত্বে বসে
দেখতে পান সামনের রানীপুর রেঞ্জের পাহাড় ঘেরা জঙ্গলে লাল মালার মত আগুনের রেখা।
ওঁর জীবনে অ্যাডভেঞ্চার বলতে এটুকুই।
সাধাসিধে জীবনে অভ্যস্থ অনুব্রত একপ্রকার খুড়তুতো ভাইয়ের চাপেই এই গাড়িটি
কেনেন এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর কাছে থেকে অফিসের কলিগের মারফত।
উনি গাড়ি কিনতে চান শুনে পাশের টেবিলের মিস্টার গোয়েল খোঁজ দিলেন
সেকেন্ডহ্যান্ড কার ডিলার ‘উনিয়াল কার
এজেন্সির’, দেরাদুনের নম্বর ওয়ালা দুধসাদা ঝকঝকে সেভেন সিটার গাড়িটি
মাত্র এক বছরের পুরনো। মালিক মাড়োয়ারি, ওঁনার অকাল মৃত্যুর পর ওঁনার স্ত্রী গাড়িটি বিক্রি করে দিতে
চান ,
এটা ছাড়াও ওদের অন্য গাড়ী আছে, কাজ চলে যাবে।
"আপ লাক্কি হো দাদা, চৌদা লাখ কি গাড়ি সিরফ পাঁচ লাখ মে মিল রহা হ্যা আপ
কো।"
মালিকের এই বদান্যতার কারন জিজ্ঞাসা করলে গোয়েল হাসল,
" আরে আপ আম খাইয়ে না, পেড় মৎ গিনিয়ে"।
হক কথা, সুতরাং
কেনা হল গাড়ী, কিন্তু
অতি সাবধানী অনুব্রতর আর ড্রাইভিং শেখা হয়ে ওঠেনি, দুমাস ধরে গাড়িটি পড়েই ছিল গ্যারেজে।
সোহম এসে বলল " ফিরে যাবার আগে তোমায় গাড়ি শিখিয়ে যাব, চিন্তা কোরোনা।"
দিন দুই টাউন শিপের ফাঁকা রাস্তায় সোহমের আন্ডারে অনুব্রতর শিক্ষা চলল,
"এ, বি,
সি, আকসিলেটার, ব্রেক, ক্লাচ, আর এইটে হচ্ছে হ্যান্ড ব্রেক, তোমার ব্রহ্মাস্ত্র, বিপদে পড়লেই ঘ্যাঁচ।"
২
"দাদা, আর একটু পরেই মতিচুর এসে যাবে, রাস্তা ফাঁকা, এখান
থেকে রায়ওলা পর্যন্ত তুমিই চালিও"
"সে কি!" আঁতকে ওঠেন অনুব্রত,
"ভয় নেই, আমি তোমার পাশেই থাকব"।
সামনে মতিচুর লেভেল ক্রসিং, গাড়িটা একপাশে দাঁড় করাল সোহম। স্টার্ট বন্ধ করে চাবি দিল
অনুব্রত কে।
"কিন্তু তা বলে..."
নিমরাজী অনুব্রত কে ঠেলেঠুলে ড্রাইভারের সিটে বসাল সোহম। ভয়ে ভয়ে স্টার্ট দিয়ে
চালাতে শুরু করলেন অনুব্রত।
গাড়ি এগিয়ে চলল লেভেল ক্রসিং এর দিকে, লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে সোজা রাস্তা গেছে রায়ওলার দিকে, আর একটা ভাঙাচোরা রাস্তা চলে গেছে বাঁ দিকে , রাজাজী ন্যাশনাল পার্কের মতিচুর রেঞ্জের ভেতর।
লেভেল ক্রসিং পর হয়ে সোজা যাবার কথা, কিন্তু অনুব্রত বুঝলেন যে স্টিয়ারিং তার হাতে থাকলেও তিনি
নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন, গাড়ি সোজা না গিয়ে গা ছম ছমে জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকতে শুরু করেছে সম্পূর্ন নিজের
ইচ্ছেয়। মাথার ওপর দিয়ে পার হচ্ছে আর্চের ম'ত তৈরি সাইন বোর্ড,
‘স্বাগতম
! রাজাজী ন্যাশনাল পার্ক মতিচুর রেঞ্জ মে আপকা স্বাগত হ্যায়’।
" দাদা! সাবধান! ওদিকে যেও না, সোজা চ'ল "
সোহমের চিৎকার কানে গেল না, গাড়ী চলল তার নিজের মত, চাকার তলায় শুকনো পাতার মচমচানি, ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে, ঝিঁঝিঁ পোকার কান ঝালাপালা করার শব্দ আর জঙ্গলের মিঠে
ঠান্ডা হওয়ার ভরাট দেওয়াল ভেদ করে' এগিয়ে চলে সাদা হুন্ডাই সেভেন সিটার…।
৩
স্টিয়ারিংয়ে বসে থাকা মানুষটির শরীরে হঠাৎ একটি বিদ্যুতের ঝটকা, একটি হিমেল শিহরণ বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে...।
যেন একটি স্বপ্নের শেষ , চোখের সামনে দিয়ে সরে গেল একটি কালো পর্দা।ঘুম পুরোপুরি ভাঙলে স্টিয়ারিংয়ে বসা
ভদ্রলোক যাঁর নাম সুরজমল, সুরজমল রুইয়া, উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন যে সামনের রাস্তা টি কেমন যেন ঝাপসা লাগছে, লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে
অবাক হলেন নিজের নাকের ডগায় মোটা
কাঁচের চশমা দেখে, টেনিস ,ক্রিকেট
খেলা চিরদিনের ফিট মধ্য চল্লিশের রুইয়া কোনও দিন সানগ্লাস ছাড়া অন্য কোনও চশমা ব্যবহার
করেন নি,
ব্যাপার টা ঠিক মাথায় ঢুকল না, চশমাটা খুলে ড্যাশ বোর্ডে রাখলেন,তাঁর পেছনে বসে আছে বাল্য বন্ধু , বিদেশী টিভির ফটোগ্রাফার বিমল ছাবরা ও তার সহকারী শিবম।
পেছনের বাকি সিট গুলোয় ক্যাম্পিং ও ফটোগ্রাফির সাজ সরঞ্জাম ভর্তি, আজ আর কাল ওদের মতিচুর রেঞ্জের আর একটু ভেতরে, যেখানে সাধারণ টুরিস্টরা যায়না, সেখানে গিয়ে জঙ্গলে ক্যাম্পিং করার ও ফটোগ্রাফি করার কথা।
পাশে তাকিয়ে দেখে আরও অবাক হবার পালা, কারন
সেখানে বসে আছে বছর ছাব্বিশ-সাতাশ বয়সী একটি ছেলে।
"হু আর য়ু?"
দাবড়ে উঠলেন সুরজমল, কিন্তু উনি ওঁনার নিজের আওয়াজ যেন চিনতে পারলেন না, ওঁনার প্রশ্নের উত্তরে ছোকরা যা বলল তার বিন্দু বিসর্গ বোঝা
গেল না , আদতে
রাজস্থান নিবাসী সুরজমল রা তিন পুরুষ ধরে দেরাদুনে বসবাস করছেন, সেখানে পল্টন বাজারে তাঁদের বিশাল হীরে জহরতের কারবার, রাজপুর রোডে তার বাবার তৈরি বিশাল 'রুইয়া ম্যানসন', চোস্ত ইংরেজি , হিন্দি ও মাড়োয়ারি ভাষা জানা রুইয়া এই ছেলেটির ভাষা বুঝতে
পারলেন না|
মাথাটা ঢিপ ঢিপ করছে, বোধহয় আসার সময় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে অসময়ে মদ্যপান করার ফল, আসলে রুইয়া পারত পক্ষে মদ
ছুঁয়ে দেখেন না, কিন্তু বাল্য বন্ধুর অনুরোধ ও
ভারতীয়দের মানসিকতা নিয়ে রসিকতার হাত থেকে বাঁচতে উনি বেশ কিছুটা গলাধঃকরণ
করেছিলেন,
বিমল বারণ করছিল ড্রাইভিং করতে, কিন্তু বন্ধুর কাছে হেরে যাবার ভয়ে রুইয়া জিদ করে
চালাচ্ছিলেন গাড়িটা, তাছাড়া এই সেভেন সিটার হুন্ডাই কার টি ওঁনার ভীষণ প্রিয়, ওঁর কথা শুনে চলে গাড়িটি। পাশের ছেলেটি হয়ত ফরেস্টের লোক বা
তাঁকে মাতাল প্রমান করার জন্য বিমলের একটি ছক, তিনি গায়ে মাখলেন না। গাড়ী এগিয়ে চলল।
রুইয়ার চিন্তা সূত্র ছেঁড়ে ময়ূরের
কর্কশ ধ্বনিতে,
বেশ অনেকটা গভীরে চলে এসেছেন ওঁরা, ঘড়িতে
প্রায় সাড়ে ছটা, এখন আর
রাস্তা নেই ,শুধু
জন্তু জানোয়ারের পায়ে পায়ে তৈরি শুঁড়ি পথ, আকাশে কালবৈশাখীর মেঘ জমছে, দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে বোধহয়, হিমেল বাতাস বইছে,সামান্য আলো আছে রাস্তাতে কিন্তু ঘন গাছের ছায়ায় জমাট বাঁধা
প্রাচীন অন্ধকার মনে হচ্ছে যেন শিকারের অপেক্ষয়ায় ওঁৎ পেতে আছে, গাছের ছায়া দীর্ঘতর হয়ে যখন পথকে গ্রাস করবে তখন ওরা
ঝাঁপিয়ে পড়বে।
পেছনের সীটে বসা বিমল আর শিবম ফিসফাস করে কথা বলছে, এটাই জঙ্গলের নিয়ম, ওরা সেটা জানে দেখে রুইয়া খুশি হলেন।
এই জঙ্গলে আগেও এসেছেন তিনি, হয়’ত আসে পাশে বাঘ আছে, তাই ময়ূর ডাকছে, পাশে বসা ছেলেটি দুর্বোধ্য ভাষায় ক্রমাগত কিছু বলেই চলেছে…
“শ... শ ...শ...“
ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে বললেন রুইয়া, ছেলেটির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও নামলেন দরজা খুলে, সাথে নামল বিমল, শিবম গাড়ী থেকে নামল বটে কিন্তু সাথে এলোনা, হয়ত ভয় পেয়েছে, মনে মনে হাসলেন রুইয়া।
বিমল কে নিয়ে সুরজমল অদৃশ্য হলেন গাছের আড়ালে...
অনুব্রত কে গাছের আড়ালে ওভাবে অদৃশ্য
হতে দেখে সোহম প্রমাদ গুনল, একে অচেনা জঙ্গল, তায় অন্ধকার হয়ে আসছে, সে নিজেই ঝাপসা দেখছে,আর
চশমা ছাড়া অনুব্রত তো কিছুই প্রায় দেখতে পাননা, মতিচুর
রেঞ্জে ঢোকার পর থেকেই দাদার আচরণ একদম পাল্টে গেছে, সে যেন অন্য মানুষ। তারপর দাদার "হু আর য়ু"
হুঙ্কার শুনে এবং এই গা ছম ছমে পরিবেশ দেখে সে বেশ থতিয়ে গেছে।
দোনামনা করে, সোহম গাড়ী থেকে নেমে পড়ল দাদাকে খুঁজবে বলে।
ওদিকে রুইয়া ও বিমল জঙ্গল ঠেলে চলেছেন কোনও এক বিশেষ দিকে-
" কিপ ইয়োর সেন্সেস অ্যালার্ট এন্ড ইয়োর ক্যামেরা রেডি, য়ু মে গেট দ্য শট অফ ইয়োর লাইফ " বললেন রুইয়া।
"অফকোর্স, আই আম ওয়েটিং ফর দ্যাট শট টূ " বলল বিমল, আবছায়ায় তার মুখ স্পষ্ট দেখা গেল না,
একটু দূরে একটি খোলা জায়গা, সেখানে শুকনো ঘাসের জঙ্গলে একটি যেন হুটোপুটি।
রুইয়া হাতের ইশারায় বিমল কে থামালেন,
চোখে দূরবীন টি লাগিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন, আকাশে মেঘ ঘনাচ্ছে, হঠাৎ কোথায় যেন একটি বাজ পড়ল, আর ঠিক সাথে সাথে
কিছু বোঝার আগেই একটি গলানো লোহার মত গরম কি যেন একটা কিছু পিঠ ফুঁড়ে বুকের
ডান পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল, যাবার আগে প্রচন্ড একটি ধাক্কার বেগে শরীরটি ঝাঁকিয়ে উঠল, অসহ্য যন্ত্রণা...। যন্ত্রণা বিকৃত মুখে পেছন ফিরে রুইয়া বা
অনুব্রত,দেখলেন যে পেছনে একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতের বন্দুকের নল থেকে এখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কিন্তু
চোখে চশমা না থাকায় লোকটিকে স্পষ্ট চিনতে
পারলেন না অনুব্রত। শুধু তার বাম কানের লতিতে ঝোলানো দুলটিী ঝিকমিকিয়ে ঊঠল।
অসাড় দেহ টা মুখ থুবড়ে পড়ল- অনুব্রতর চোখের সামনে সিনেমার দৃশ্যের মত এক লহমায়
একটি মানুষের জীবনের কিছু ঘটনা ঝড়ের বেগে তীব্র আলোর ঝলকের মতো বয়ে চলল।
৫
" সাহাব, আপ সে মিলনে এক সাহাব আয়ে হ্যাঁয় "
বলে বেয়ারা একটি ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে
দিল,
সাথে একটি চিরকুট।
শীতের সকাল, প্রাসাদোপম
বৃটিশ আমলের রুইয়া ম্যানসন আকারে বিশাল, তবে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষনের কারনে আজও দর্শনীয়। সেদিন সকাল
বেলায় জগিং সেরে সুরজমল ও তাঁর স্ত্রী লনের বেতের চেয়ারে ছাতার নিচে বসে কাগজ পড়তে
পড়তে চা খাচ্ছিলেন এমন সময় বেয়ারা চিরকুট আর কার্ডটি দিল।
" ওয়াইল্ড লাইফ
ফটোগ্রাফার! ইন্টারেস্টিং!"
বলে চিরকুট টি পড়ে শেষ করলেন,
"মেরে অফিস মেঁ বুলাও।"
বলে তড়ি ঘড়ি ওই পোশাকেই অফিসে দৌড়লেন রুইয়া। আসলে এখানে অনেক সময় বিভিন্ন
বিদেশি চ্যানেলের লোকেরা আসে ছবি টবি
তুলতে, রুইয়ার
নিজেরও এ ব্যাপারে ভীষণ উৎসাহ, নিঃসন্তান রুইয়ার অনেকটা সময় এতেই কাটে, ফলে স্ত্রীও বাধা দেন না, কিন্তু আজকে উনি যেভাবে দৌড়লেন সেটা দেখে মিসেস নীলিমা
রুইয়ারও অবাক লাগল।
অফিসে অপেক্ষা রত লোকটিকে দেখে রুইয়া কয়েক সেকেন্ড থেমে গেলেন, ঘাড় অব্দি লম্বা হলদেটে চুলে ঢাকা মুখ, কলারের কাছে জামার বোতামে ঝোলানো রোদ চশমা, বুশ শার্টের ওপর চামড়ার জ্যাকেট ও বিবর্ণ জিন্স ,সাথে রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রং, সব মিলিয়ে টিপিক্যাল ফটোগ্রাফার, কিন্তু সেসবের সাথে বাম কানের লতিতে ঝোলানো চকচকে দুল'টি আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে , তবে সব থেকে চোখ টানে তার
চোখ দুটি, তবে কি..?
স্বভাব সুলভ গাম্ভীর্য দিয়ে মনের উত্তেজনা ঢেকে রেখে সৌজন্য সুলভ হাত বাড়ালেন
রুইয়া-
"রুইয়া! সুরজমল রুইয়া, হাউ
ক্যান আই হেল্প স্যর?"
"আরে! সুরজ! মুঝে নহী পহচানা? বিমল, বিমল ছাবরা, মোহর বাজার? বাড়মের? পতঙ্গ? মোর?"
হ্যাঁ, চিনেছেন
রুইয়া,
সব মনে পড়ছে, মোহর বাজার, বাড়মের,
ঘুড়ি, ময়ূর, সব সব।
"আরে! বিমল তুম?" বলে লোকটিকে জড়িয়ে
ধরলেন রুইয়া।
জোর করে বিমলকে অন্দর মহলে নিয়ে গিয়ে স্ত্রীর সাথে আলাপ পর্ব শেষ করার পর
নীলিমা জানলেন যে আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে বিমল বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়। তারপর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে সে এখন এক নামকরা বিদেশী টিভি চ্যানেলের ওয়াইল্ড
লাইফ ফটোগ্রাফার, ভারতবর্ষের জঙ্গল ও পশু পাখি নিয়ে একটি ডকু ফিচার তৈরির
প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে এখানে।
"এখানে এসেই প্রথমেই গেলাম রাজস্থানের বাড়মের, আমাদের বাড়ি, মনে পড়ে তোর?" জিজ্ঞেস করল বিমল।
"নিশ্চয়ই, আমাদের আর তোদের বাড়ি ছিল পাশাপাশি, আমার ঠাকুরদা রজতমল আর তোর ঠাকুরদা সোহনলাল, ঠিক যেন একই মায়ের পেটের সন্তান, তবে তুই খুবই দুষ্টু ছিলি।"
"হুম, আর আমরা ছিলাম বড়লোক আর তোরা..." বলে হাসল বিমল।
খোঁটা টি গায়ে লাগলো রুইয়ার, উনি মাথা নিচু করে রইলেন , কিছু বললেন না, আসলে, রুইয়া আর ছাবরা দুই পরিবারের মধ্যে সৌহার্দ্য থাকলেও আর্থিক
ফারাক ছিল বিস্তর, শেষে একদিন ভাগ্য অন্বেষণের উদ্যেশ্যে রুইয়ারা চলে আসে দেরাদুনে, সেটা ব্রিটিশ আমল, দেরাদুন তখন একটি ক্রম বর্ধমান শৈল শহর, চারিদিক থেকে লোকে এসে বসবাস করতে শুরু করেছে। সেইসময়
সস্তায় জমি কিনে ছোট খাটো ব্যবসা শুরু করেন রুইয়ার ঠাকুরদা রজতমল ও বাবা উমিচাঁদ, তখন আর্থিক ভাবে সাহায্য করেন বিমলের ঠাকুরদা সোহনলাল, দেরাদুনে রুইয়ারা ধীরে ধীরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের
সম্পত্তি বাড়ায়, দেশ
স্বাধীন হয় , রজত মল
ও সোহনলালের বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যু হয়, তবে শেষ দিন অব্দি তাঁদের সৌহার্দ্য বজায় ছিল।
উমিচাঁদ রুইয়া ততদিনে দেরাদুনে 'রুইয়া এন্ড রুইয়া ডায়মন্ড
এম্পোরিয়ামের' গোড়াপত্তন করেছেন,দেশ
বিদেশ জুড়ে তার কারবার, এর মধ্যে বরাবরের বেপরোয়া বিমল বাড়ি ছেড়ে পালায়, কোনও খোঁজ পাওয়া যায়না, এক মাত্র পুত্রের শোকে প্রাণ হারান বিমলের বাবা, বিমলের মা কে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এই পর্যন্ত দেখার পর ধীরে ধীরে অনুব্রতর আঁধার নেমে এলো ।
৬
ওদিকে সোহম দাদাকে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ
বাজ পড়ার শব্দে চমকে উঠে শব্দের
উৎসের দিকে দৌড়ল, একটি ফাঁকা মত জায়গায় দেখল অনুব্রত উপুড় হয়ে পড়ে আছেন, কাছে গিয়ে বুঝল জ্ঞান নেই, পালস চলছে ঝড়ের মতো। ধীরে ধীরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
কোনোক্রমে অনুব্রত কে নিয়ে গাড়ীতে পৌঁছে জলের ঝাপটা দিয়ে আধা জ্ঞান ফিরিয়ে
পৌঁছল হরিদ্বারে, সারা রাস্তায় দাদার গায়ে ধুম জ্বর, ও ক্রমাগত ভুল বকছে।
পরদিন সকালে হসপিটালে অনুব্রতর পুরোপুরি জ্ঞান ফিরল, এখন তিনি সম্পূর্ন সুস্থ, ডাক্তাররাও তার এই আকস্মিক
জ্বরের কোনও কারণ বুঝতে পারলেন না, ওঁদের মতে হয়ত প্রেশার বেড়ে গিয়ে এটা হয়েছে, একটু রেস্ট করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু অনুব্রত জানেন এসবের কারন কি, সোহম কে তিনি সব খুলে বলতেন, কিন্তু চেপে গেলেন, কারন তাঁরও প্রমান চাই।
ডাক্তার দের বলে বুঝিয়ে ছুটি করানো হলো, ‘উনিয়াল কার
এজেন্সির’ কাছে ঠিকানা নিয়ে পরের দিনই অনুব্রত সোহম কে সাথে নিয়ে পৌঁছলেন দেরাদুনে,
" রুইয়া ম্যানসন’।
৭
সময় আগেই নেওয়া ছিল টেলিফোনে, ‘উনিয়াল কার এজেন্সির’ নবীন উনিয়াল রুইয়া পরিবারকে চেনেন
গাড়ী কেনাবেচার সূত্রে, ফলে কোনও অসুবিধে হয়নি।
মিসেস রুইয়ার সাথে দেখা হলো সুরজমলের অফিসে, কাঁচের পার্টিশান দেয়া অফিস, বাইরে ওয়েটিং রুম, একটি বড় সোফা সেট আর সেন্টার টেবিল, পার্টিশনের ওপাশে টেবিলের সামনে বসে উনি একজন কর্মচারী কে
দিয়ে কিছু লেখাচ্ছিলেন, স্মিত হেসে ইশারায় ওঁদের বসতে বললেন ওয়েটিং রুমে।
লেখা শেষ হতে লোকটি উঠে কাঁচের দরজা
টি খুলে দাঁড়াল।
" ওটা আজই কাগজে যাওয়া চাই, পরশু ছাপা হয় যেন " হিন্দিতে বললেন মিসেস রুইয়া।
লোকটা চলে যেতে উনি অনুব্রতদের ডাকলেন,
একটি গদীমোড়া হাই ব্যাকড রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন ভদ্রমহিলা, বয়স মাঝারি, প্রায় নিরাভরণ, মুখে চোখে বিষণ্নতা মাখানো আভিজাত্য বিদ্যমান।
বললেন "আগামী সোমবার আমার স্বর্গত স্বামীর জন্মদিন, তাই কাগজে একটা-, আপনারা বসুন।"
প্রাথমিক আলাপাদির অনুব্রত সরাসরি তাদের
এখানে আসার কারণ বললেন, কথাবার্তা সব হিন্দি ইংরেজী মিশিয়ে হল, অনুব্রত জানতে চাইলেন তাঁর স্বামীর ব্যাপারে, বিশেষতঃ রুইয়ার বন্ধু বিমল ছাবরার ব্যাপারে, অবাক হয়ে মিসেস রুইয়া বললেন,
" আপনি বিমল কে কি ভাবে চিনলেন?"
"সব জানতে পারবেন, এখন এটুকু বলি যে আপনার স্বামীর মৃত্যুর কারন সম্পর্কে আপনি
কি জানেন?"
"উনি ওঁনার বন্ধু বিমল ও তার সহকারীর সাথে গিয়েছিলেন রাজাজী
ন্যাশনাল পার্কে, ওখানে জঙ্গলের গভীরে ক্যাম্প করে থাকার সময় রাত্রে বাইরে বেরোন, তখন কোনও জংলী জানোয়ার, সম্ভবতঃ বাঘ ওনাকে আক্রমণ করে গভীর জঙ্গলে নিয়ে যায়, তার পর থেকে আর কোনও খোঁজ নেই ওঁনার।"
"এসবই ওঁনার বন্ধু বিমল এর কাছে শোনা , তাইতো?"
"হ্যাঁ, উনি আমাদের পারিবারিক বন্ধু, কিন্তু আপনি ওঁনার নাম জানলেন কিভাবে?"
" বলব সবই বলব , তার আগে বলি যে আপনার স্বামীর মৃত্যুর কারন কোনও দুর্ঘটনা
নয়,
ওঁনাকে খুন করা হয়েছে, "
"কি বলছেন আপনি, প্রমান কি "? চিৎকার করে ওঠেন নীলিমা রুইয়া।"
" প্রমান আমি করে দেবো কিন্তু আপনার সহযোগীতার প্রয়োজন"
দৃঢ় ভাবে বলেন অনুব্রত। শান্ত ভীতু স্বভাবের অনুব্রতর এই রূপ সোহম কখনও দেখেনি।
কিছুটা ইতঃস্তত করে ভদ্রমহিলা চুপ করে থাকলেন।
অনুব্রত বললেন " আচ্ছা, তবে আমি বলি?"
বলে গড় গড় করে রুইয়া ম্যানসনে বিমলের প্রথম দিন আসার থেকে ক্যাম্পিং এ যাওয়া ও
গুলি চলা অব্দি সব কিছু বলে চললেন।
৮
এসব কিছুই সোহমের জানা নেই, কিন্তু বিমলের সাথে হওয়া এমদম পারিবারিক কথাগুলো মিলে যেতে
দেখে মিসেস রুইয়ার চোখ কপালে। কান্নায় ভেঙে পড়ে উনি বললেন, "আমার তখনই ভালো লাগেনি ব্যাপার টা, একটা লোক পঁচিশ বছর বাড়ি ছাড়া, বলছে বিখ্যাত ফটোগ্রাফার, কিন্তু কোনোও প্রমান নেই সেভাবে, কিন্তু আমার স্বামী ছিলেন খুবই সিধে সাধা, বাড়মেরে বিমলের পরিবারের থেকে ওঁনার পূর্বপুরুষের নেওয়া
আর্থিক সাহায্য টা শোধ করতে না পারার জন্য
ওঁনার মনে ক্ষোভ ছিল, উনি বলতেন ভগবানের অভিশাপ নীলিমা, তাই এত সম্পত্তি থাকা সত্বেও সেটা ভোগ করার জন্য আমাদের
কোনো বংশধর নেই, কোনোও
কারন ছাড়াই উনি ছাবরা পরিবারের দুর্গতির জন্য নিজেকে ও নিজেদের পূর্বপুরুষ দের
দায়ী করতেন "।
"তারপর বিমলের সঙ্গে দেখা হবার পর,
" বলে টেবিলের দেরাজ টেনে এক তাড়া স্ট্যাম্প পেপারে লেখা একটি
দলিল বের করলেন।
" দেখুন উনি ওঁনার সম্পত্তির অনেকটা অংশ বিমলের নামে খসড়া করে
রেখেছিলেন, বলে
ছিলেন যে বিমল এর জন্য এই সারপ্রাইজ থাকল, ক্যাম্পিং থেকে ফিরে এসে...।" বলে একটি দীর্ঘশ্বাস
চাপলেন।
" তারপর হঠাৎ উনি চলে গেলেন, জঙ্গলে এটা ওঁনার প্রথম বার নয়, তাই এভাবে চলে যাওয়া টা আমি ঠিক মন থেকে কিছুতেই মানতে
পারছিলাম না", " যদিও পুলিশ এই কেসটা বন্ধ করে দিয়েছে", বললেন মিসেস রুইয়া।
" সম্ভবতঃ মিস্টার রুইয়া চান ওঁনার হত্যার কিনারা হোক, আর আমিও এটা চাই" বললেন অনুব্রত।
“ঠিক আছে আমি এই কেসের ভার প্রাপ্ত অফিসার মিস্টার রাজেশ
বেনিওয়াল কে আজ বাড়িতে ডাকছি, উনি সুরজমলের সহপাঠী ও আমাদের পারিবারিক বন্ধু,” বললেন মিসেস রুইয়া।
সেই মত সেদিন সন্ধ্যায় রুইয়াদের বাড়িতে মিটিং বসল। পারিবারিক বন্ধু বেনিওয়াল কাজ ফেলে চলে এলেন, ফোনে ওনাকে নীলিমা আগেই সব বলে ছিলেন, স্কুলের বন্ধু, মৃদুভাষী সুরজ ছিল ওর খুব কাছের বন্ধু, অগাধ সম্পত্তির মালিক সুরজমলের সাথে ছোট ব্যবসায়ীর ছেলে
রাজেশের বন্ধুত্ব হওয়া আটকায়নি,তাই সুরজ এভাবে স্রেফ গায়েব হয়ে যাবে সেটা ওঁর পক্ষে মানা অসম্ভব হচ্ছিল, প্রমাণের অভাবে বাধ্য হয়ে কেস বন্ধ করে দিতে হয়েছিল, তাই আজ ফোনে নীলিমার কাছে অনুব্রতর কথা শুনে ওঁর শিরায়
শিহরণ খেলে গেল।
সব শুনে বললেন "সবই ঠিক আছে, কিন্তু স্রেফ একটি অনুমান বলুন বা একটি 'ঘোস্টলি এনকাউন্টার', এর ওপর ভিত্তি করে আইন চলবে না, আমাদের প্রমান চাই। বলতে বলতে ঝপ করে আলো নিভে গেল,"বোধহয় ঝড়ে গাছ পড়েছে" বলল সোহম।
"বিমল কে ডাক এখানে, সে এখন দিল্লিতে আছে, আমি প্রমান দেব।" চোস্ত হিন্দিতে হঠাৎ অনুব্রত বলে
উঠলেন।
অনুব্রতর গলা শুনে সবাই চমকে উঠল। কারন গলার স্বর অন্য হলেও মালিক কে সেটা
বুঝতে কারও অসুবিধে হলোনা, একটি হিমেল ভয় সাপের মতো শিরদাঁড়া বেয়ে হিস হিসিয়ে নামল সবার।
৯
Collage: Swarup Chakraborty |
আজ ৩০ শে এপ্রিল, সুরজমল রুইয়ার পঁয়তাল্লিশ তম জন্মদিন,সমস্ত নামী হিন্দি ও ইংরেজি সংবাদপত্রে বড় ছবি সহ বেরিয়েছে
শ্রদ্ধাঞ্জলি, সকাল
থেকে বাড়িতে লোকজনের আসা যাওয়া, শোক জ্ঞাপন চলছে। বিমলকে ডাকা হয়েছে,- তার প্রজেক্টের কাজ নাকি এখনো শেষ হয়নি,দিল্লিতে এক হোটেলে সে আছে, খবর পেয়ে সে রওয়ানা দিয়েছে, সন্ধের মধ্যে এসে পৌঁছবে।ওদিকে দিল্লির হোটেলে সাদা পোশাকের
পুলিশ পাঠিয়ে সার্চের বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
সন্ধ্যায় রুইয়াদের ড্রয়িং রুমে সবাই একত্রিত হয়েছে, দেওয়ালে সুরজমল এর
একটি মানুষ প্রমান ছবি, তাতে ফুলের মালা দিয়ে সবাই মিলে নীরব শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে যে
যার জায়গায় বসল।
এখন শুধু বিমলের অপেক্ষা।
প্রকৃতি যেন আর তার সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিতে চায়, আকাশ জোড়া কালো মেঘ, বৃষ্টির হুমকি, মাঝে মাঝে বজ্রপাত, বেয়ারা কে বলা ছিল, বিমল কে নিয়ে সরাসরি ড্রয়িং রুমে নিয়ে এল সে। প্রথম বার তার
মুখ দেখে- বিশেষতঃ, কানের দুলটিই বলে দেয় সেদিন আবছা দেখা লোকটি ইনিই, আবার অনুব্রতর শরীরে বিদ্যুৎ খেলল, কিন্তু এবার তিনি ভয় পেলেন না, মনে হ’ল কোনও এক শক্তি তার ওপর ভর করেছে, তার সাথে কথা বলতে চাইছে, কিন্তু, সেটা এত দুর্বল মিনমিনে শব্দ যে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা, না কি, সেটা কোনও শব্দ নয়, মাত্র একটি অনুভূতি।
একসঙ্গে এত অচেনা লোককে দেখে বিমল প্রথমটা হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিল।
চেয়ার টেনে বসতে বলা হল তাকে, অফিসার বেনিওয়াল শুরু করলেন, বললেন,
"আপনার প্রিয় বন্ধু সুরজমল, আপনার জন্য একটি উইল রেখে গেছেন, হয়ত আপনি জানেন না, আজ ওঁনার জন্মদিনে ওটা আপনাকে দিতে চাই, আমরা সাক্ষী থাকব"।
এই রকম অপ্রত্যাশিত লাভের আশা দেখে ওর চোখ চকচক করে উঠল সেটা কারও নজর এড়ালো
না।
"কিন্তু আপনারা?" প্রশ্ন করে বিমল
"আমরা মিস্টার রুইয়ার পারিবারিক বন্ধু।” বলে সোহম।
"কিন্তু, তার আগে ওঁনার মৃত্যু ঠিক কি ভাবে হয়েছে সেটা আর একবার আমরা
জানতে চাই।"
বিমল শুরু করে, "আমি তো আগেই বলেছি
যে মাঝ রাতে ক্যাম্পের আসে পাশে
জংলী জানোয়ারের পায়ের শব্দ শুনি, ডাকাবুকো সুরজ দৌড়ে বেরিয়ে যায়, আমি আমার নাইট ভিশন ক্যামেরা ও পিস্তল টি নিয়ে বেরিয়ে আসি, আমার ক্যামেরা নিতে একটু সময় লাগে, বেরিয়ে
দেখি যে,
কিছু একটা সুরজ কে টেনে জঙ্গলে নিয়ে যাচ্ছে, আমি ভয় পেয়ে ফায়ার করি" ।
" ক বার?" প্রশ্ন করেন অফিসার বেনিওয়াল, "ওহ বই দ্য ওয়ে, আই অ্যাম পুলিশ
ইন্সপেক্টর বেনিওয়াল, এই কেসের ব্যাপারে আমি সামান্য জানি।" বলে স্মিত হাসেন বেনিওয়াল।
মনে মনে প্রমাদ গোনে বিমল, বলে "দু বার”|
"অ্যান্ড ইউ মিসড” বলেন বেনিওয়াল।
" আই অ্যাম নট আ হান্টার, আই অ্যাম আ গড ড্যাম ফটোগ্রাফার, দ্যাটস হোয়াই আই মিসড।
বোঝা যায় তাকে এই প্রশ্নের সম্মুখীন আগেও হতে হয়েছে।
“আর পুলিশ আমার পিস্তলে মাত্র চারটি গুলি পায়, আর বিনা অনুমতিতে পিস্তল রাখার জন্য জরিমানাও করে” |
"বাট য়ু ডিড হিট দ্য টার্গেট”| অনুব্রতর গমগমে গলা দিয়ে
শব্দ গুলো বেরোলেও মনে হল যেন অন্য কেউ বলে উঠল। হঠাৎ বাইরে একটা প্রচন্ড
বাজের শব্দের সাথে সব বাতি গুলো নিভে গেল। বিশাল রুইয়া ম্যানসন একটি অশরীরি অন্ধকারে ঢেকে গেল। বেয়ারা
মোমবাতি নিয়ে এল।অনুব্রত বলে চলেন,"অ্যান্ড দ্য টার্গেট ওয়াজ মী, সু র জ ম ল রু ই
য়া”,
কেটে কেটে বলেন অনুব্রত,“তুমি এক গুলিতেই আমায় সাবাড় করে ছিলে, কারন তুমি কোনও ফটোগ্রাফার নও, ইউ আর এ ড্যাম পোচার, চোরা শিকারি, শিকার করাই তোমার মতলব ছিল, এখানে এসে আমার সম্পত্তি দেখে লোভ, রাগ কিছুই সামলাতে পারোনি, তুমি ভেবে ছিলে তোমার দুরবস্থার জন্য আমার পরিবার দায়ী, তাই আমাকে মারতে চেয়েছিলে, সেদিন পুলিশের চোখে ধুলো দিতে আমায় মারার পর তুমি আর তোমার
সাগরেদ আমার দেহটা গভীর জঙ্গলে ফেলে এসেছিলে জঙ্গলের পশুর খাদ্য হিসেবে,আর একটি গুলি তুমি
খুলে ছুঁড়ে ফেলে ছিলে," বলতে বলতে থর থর করে কাঁপছিলেন অনুব্রত।
বিমল তর্ক চালিয়ে গেল, " বাট হোয়ার ইস দ্যাট ব্লাডি সিক্সথ বুলেট?”সোহম অনুব্রত কে জড়িয়ে ধরে ছিল, কোনও জবাব না দিয়ে ধীরে ধীরে উনি নিস্তেজ হয়ে পড়লেন।
১০
পরের ঘটনা খুবই সামান্য,
পরদিনই অনুব্রতর নির্দেশ
অনুসরন করে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক জন সাথে করে পুলিশ, সোহম , অনুব্রত ও বিমলকে নিয়ে বেনিওয়াল অকুস্থলে পৌঁছলেন।
জঙ্গলে কালকের রাত ভোর বৃষ্টির পর আকাশ আজ সম্পূর্ন পরিষ্কার, গাছে রোদ পড়ে চিক চিক করছে, ময়ূর ও কোকিলের ডাক শোনা যাচ্ছে, মানুষের জীবন মৃত্যু নিয়ে যেন কারও মাথা ব্যথা নেই। সবাই কে
নিয়ে জঙ্গলের সেই নির্দিষ্ট স্থানে যাবার পর অনুব্রতর স্পষ্ট অঙ্গুলি নির্দেশ
লক্ষ্য করে সবাই দেখলেন জঙ্গলের সবুজ ঝোপের মাঝে চক চক করছে একটি অব্যবহৃত বুলেট, ‘পিস্তলের ষষ্ঠ বুলেট’।
"ব্যালাস্টিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়ে যাবে যে ওটা কোন পিস্তল
থেকে চলেছে।” বিমলের দিকে ফিরে বললেন পুলিশ অফিসার।
অনুব্রত ফিরলেন রুইয়ার, বর্তমানে তাঁর নিজের হুন্ডাই গাড়িতে, ড্রাইভারের সীটে খুলে পড়ে আছে কালকের কাগজের সেই পৃষ্ঠাটি, যেখানে ছাপা আছে সুরজ মলের বড় ছবি দেয়া স্মৃতি চারণ।
অনুব্রতর মনে হল ছবিটি যেন হাসছে।
।। সমাপ্ত ।।
| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
|Special Puja Issue,2019 | September-October, 2019 |
| Third Year Third Issue |20Th Edition|
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post