অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Wednesday, October 2, 2019

গল্প-পুঁজি - প্রতীক কুমার মুখার্জি



পুঁজি

প্রতীক কুমার মুখার্জি
Image Courtesy: Google Image Gallery



চার নম্বর অটোটার পিছনে দৌড়ে গিয়েও কোন লাভ হলনা - নির্ধারিত চারজনের জায়গায় ইতিমধ্যেই পাঁচজনে চড়ে বসেছে। বাসগুলোর দিকে তাকানোই যায়না, মৌচাকে থিকথিক করা মৌমাছির মতো উপচে পড়া ভিড় নিয়ে যেন রাগে গর্জন করতে করতে অফিসমুখো মানুষ নিয়ে ছুটছে। মহানগরের ‘অফিস টাইম’ - যে সময়টা শুধু ঊর্ধ্বশ্বাসে সামনের দিকে তাকিয়ে দৌড়নোর জন্য বরাদ্দ!!

পকেটে অবশ্য ট্যাক্সি ভাড়া একশো টাকা জোর করে দিয়ে দিয়েছেন মা, সঙ্গে ঠাকুরের প্রসাদী ফুল। কিন্তু জোয়ান ছেলে সে, ট্যাক্সির পিছনে খরচ করতে প্রবৃত্তি হয়না। একটা ইন্টারভিউ এরই তো ব্যাপার - প্যানেলে ঢুকে গেছে অভিনব, আজই যা হবার হয়ে যাবে। বিমলকাকু আশ্বাস দিয়েছেন। আজ কোনমতে উৎরোতে পারলেই তাদের অভাবের সংসারের অন্তত একটা হিল্লে হতে পারে।

বাবার রোগক্লিষ্ট শরীরে বার্ধক্য থাবা বসিয়েছে অকালে। মা সংসারের হাল ধরে অনেক দেনা করে ছেলেকে কয়েকটা পাস করিয়েছেন, যদিও আজকের চাকরীর বাজারে এটুকু বিদ্যা ভীষণভাবেই অপ্রতুল - ভরসা সুপারিশ। অভিনব ও তার ছোট বোন মিঠুর করা কিছু টিউশান, আর মায়ের চার বাড়িতে ঠিকে কাজের লোকের রোজগারে কোনমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জীবন - থুড়ি, কালযাপন তাদের।

একশোটা টাকা বলে কথা! চাকরীটা তো নাও হতে পারে - তখন? সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত লাগাল অভিনব। বাসেই যাবে সে, কত আর দূরত্ব উল্টোডাঙ্গার বাগুইয়াটি থেকে? আগে থেকেই বুকপকেটে খুচরো পয়সায় বাসভাড়াটা বার করে রাখল সে। গল্প এগোবার আগে আমাদের অভিনব সম্বন্ধে কিছু কথা জেনে রাখা দরকার।

বাগুইয়াটির পিছনের বস্তিতে জন্ম ও বেড়ে উঠলেও অভিনব কিন্তু আপাতত সার্থকনামা। ভীষণই ভদ্র, সৎ, পরিশ্রমী, রুচিবান কিন্তু অন্তর্মুখী মানুষ সে। কোথা থেকে এ গুণ সে পেলো সেটা বিচারসাপেক্ষ, কিন্তু বস্তিতে সবাই তাকে সম্ভ্রমের চোখে দেখে। বইএর পোকা সে, দেশ বিদেশের অনেক খবরাখবর তার নখদর্পণে। ভীষণ চাপা স্বভাব তার, কখনও কারো কাছে সে কোন আবদার করেনি জীবনে!

তার এই স্বভাবটা জন্মগত, আর পরবর্তীকালে যখন সে মুন্সী প্রেমচাঁদের লেখা পড়ে, ‘ইদ্গাহ’ গল্পের সেই ছোট ছেলেটি যেন তার ভিতরে আরও ভীষণভাবে বেঁচে ওঠে। ট্রেনে ট্রেনে বাদাম, ডালমুট, ঝুরিভাজার সওদাগর বাবার কাছে মুখ ফুটে একখানা ঘুড়ি অব্দি কখনও চায়নি সে। বর্তমানে নিঃশব্দে তাদের টিউশানের পারিশ্রমিক ঢেলে ফাঁকফোকরগুলো ভরাট করতে চাইতো ভাই আর বোনে।

অভিনবের বাবা মানুষটা কিন্তু বস্তিতে জীবন শুরু করেননি। তাঁর বহুদিনের চাকরী ছিল একটি বেসরকারি অফিসে, যেখানে শেষে তালা ঝুলে যায় - পরিণতি হকারগিরি। ফলে ভাইবোনের মননশিলতার অভিনবত্ব  সহজেই অনুমেয়। তাদের ছোটবেলাটা তাও ভাল ছিল, অভাব অনটন আরও বেশী করে গলা টিপে ধরল যেদিন থেকে বাবা পা ফস্কে ট্রেন থেকে পড়ে গেলেন। একটা পা গোড়ালি থেকে কাটা গেল।

তারপর থেকেই ভাইবোনের নীরব লড়াই শুরু হল। ভোগবিলাসের যাবতীয় সামগ্রী, খাবারদাবার, পোশাক ইত্যাদির হাতছানি উপেক্ষা করতে পেরে তারা হয়ে উঠেছিল বস্তির গর্ব। অবিনবের ভিতর আরেকটি গর্ব ছিল - দারিদ্রের অহঙ্কার। মায়ের কাজের বাড়িগুলি থেকে পুরনো জামাকাপড় দিলে সে প্রবল আপত্তি করত। যা কিনতে পারবে তারা তাই পরবে, এমনকি বাবা মাকেও পুরনো কিছু পরতে দিতো না সে!

বস্তি যখন, কেবল টিভির পদার্পণ ঘটবেই। প্রচুর ঘরে অন্যায়ভাবে হুকিং করে টিভি চলে তাদের বস্তিতে। অনেকের মোবাইল ফোন হয়েছে। কিন্তু ভাইবোনের এসব ব্যাপারে কোন আগ্রহই নেই। বাবা দীর্ঘশ্বাস আর মা চোখের জল ফেলে ভাবেন, এই রকম লক্ষ্মী সন্তানদের জন্য কিছুই করতে পারলেন না ওঁরা, পড়াশোনার সুযোগ তো দূর অস্ত, দুবেলা একটু ভাল খাবারও দিতে পারেন না ওদের মুখে!

জোগাড় করে আনা বইপত্র, খবরকাগজ বা পত্রিকা, মোটকথা যা পাওয়া যায় তাতেই মুখ ডুবিয়ে থাকে অভিনব। ভাইবোনের মধ্যে মাঝেমাঝে হাসাহাসি ও খুনসুটি চলে মৃদু গুনগুণ শব্দে। মা সেদিন কাজের বাড়ি থেকে আনা একটা রংজ্বলা, ফুটো শাড়ি পরতেই অভিনব চুপ করে গেল। ইচ্ছের বাইরে কিছু হলে মুখে পড়ে কুলুপ, আর চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ে নিঃশব্দে অভিনবের, এই বয়সেও।

তাদের বস্তিতে কোন কুকুর, বেড়ালের ছানা ড্রেন বা ডোবার জলে পড়ে গেলেও প্রাণে বেঁচে যায়। গাছ থেকে পড়ে যাওয়া পাখির কচি ছানা, পা ভাঙ্গা ছাগলছানা ইত্যাদি কত পশুপাখি যে অবিনব আর তার দলবলের অবিশ্রান্ত শুশ্রূষায় ভালো হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এমনকি বেশ কিছু ভবঘুরে, পাগল, ভিখারি জানে যে এই রোগা ছেলেটা একবার খোঁজ পেলে তাদের অন্তত একটু খাবার আর নিঃশর্ত যত্ন জুটবে।

আরেকটা কাজ করে অভিনব নিঃশব্দে - প্রতি মাসে বস্তির প্রতিটি বাড়ির দুয়ারে একটি টিনের কৌটো নিয়ে দাঁড়ায়। পরিবারের লোক অনুযায়ী মাথাপিছু কুড়ি টাকা করে ওই টিনে ফেলে বস্তির মানুষ ছেলেটাকে  চোখ ভর্তি জল চেপে আশীর্বাদ করে। প্রত্যেকে জানে এইটুকু পুঁজি হল তাদের মতো গরীবদের মেডিক্লেম - এবং এর দরুন যৎসামান্য হলেও উপকৃত বস্তির মানুষ।

এটুকুই অভিনবের ক্ষমতা। প্রতিকূলতা, অভাব, অনটনের সাথে লড়েও সে সবার জন্য করার চেষ্টা করে। আরও প্রচুর কাজ করার ইচ্ছে তার - কিন্তু সাধ ও সাধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব। শুধু যদি একটা চাকরী পাওয়া তাহলে তাদের সংসার ছাড়াও বস্তির জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখে সে। কোথায় যেন পড়েছিল সে - মান আর হুঁশ মিলে মানুষ। বড়লোক হতে চায়না সে, শুধু একজন ভালো মানুষ হবে সে।

অভিনবের লক্ষ্য, সততার সাথে উপার্জন করে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবে সে। বস্তিতে থাকলেও তাসখেলা, মদ মাতালের আসর, মাইক চালিয়ে নাচগান, ঝগড়াঝাঁটি, মারপিট, আড্ডা ইত্যাদি কখনও তাকে ছুঁতে পারেনা। সে অন্যরকম - সে সত্যিই অভিনব। সেই ছেলে এখন বাগুইয়াটির মোড়ে দাঁড়িয়ে মরিয়া হয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে চায় সময়মত।

বাদুড়ঝোলা একটি বাস বেছে নিল অভিনব - মানে বাছতে হলনা আলাদা করে অবশ্যই! অনভ্যাসের ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুঁতির শেষে সে একেবারে তলার পাদানিতে কোনরকমে একটা পা রাখতে পারল, আর হাতে পেলো বাসের জানলার একটা ফ্রেম। কয়েক মুহূর্তেই ও বুঝতে পারল যে এভাবে তো পারবেনা, তার দুর্বল শরীর পেরে উঠবে না ঝুলে থাকতে, নেমে পড়তে চাইলো তৎক্ষণাৎ।

কিন্তু বাস ততক্ষণে গতি নিয়েছে। প্রাণ হাতে নিয়ে ঝুলে থাকল সে - আর তখনই বাসের ভিতর থেকে প্রবল কথা কাটাকাটির আওয়াজটা প্রথম কানে এলো তার! মন দিল না সে ওইদিকে - তার মনে এখন দুটি চিন্তা। আজ কি সফলতার মুখ দেখবে সে? পারবে কি তার পরিবারকে দিতে একটি সুস্থ, সচ্ছল, সুন্দর জীবনের উপহার? বাস্তবে ফিরল সে - তার হাত, কাঁধ ব্যাথায় টনটন করছে ইতিমধ্যেই!

বাসের প্রতিটি মানুষের কান যেন সেদিকে - বৈচিত্র্যহীন জীবনে কিছুটা হলেও যেন বিনোদনের অবকাশ! কি নিয়ে ঝামেলা তা বোঝা যাচ্ছেনা অবশ্য, তবে ঝামেলা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে যেন! কথাকাটাকাটি থেকে আস্তে আস্তে ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে। বাসের ভিতর তিলধারণের জায়গা না থাকায় ভীড়ের চাপটা দরজার দিকে ছড়াতে শুরু করল আর আতঙ্কে প্রমাদ গুনল দরজায় ঝুলন্ত অসহায় কিছু মানুষ!

চলুন দেখা যাক বাসের ভিতরে কি নিয়ে এতো গণ্ডগোল হচ্ছে! এয়ারপোর্টের কাছাকাছি থাকে রনি আর রব্বি, ছোটবেলার দুই বন্ধু। সাথে আছে সিম - রনির বোন। এদের বাবা মায়ের অনেক সাধ করে দেওয়া নাম হল যথাক্রমে রণজিৎ, রবীন্দ্র ও অসীমা। এদের বয়স মোটামুটি অভিনবের কাছাকাছি, পড়াশোনা নামকরা কনভেন্টে, আর প্রত্যেকে বেশ বড়লোকের বাড়ির সন্তান।

কাজেই এরা প্রাচুর্যের মধ্যেই বড় হয়েছে, সচ্ছলতা ও অতিরিক্ত পাওয়া এদের কাছে অভ্যেস ও অধিকার। এটুকু বয়সেই তারা নানারকম নেশায় সিদ্ধহস্ত। বাবা মায়ের হাতের বাইরে চলে গেছে তারা, তাই তাঁরাও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের আজকের প্রোগ্রাম হল - রনি তার বোনকে আইপড কিনে দেবে, তারপর তারা কোন রেস্তোরাতে খানাপিনা সেরে, ডিস্ক এ গিয়ে রাত করে বাড়ি ফিরবে।

সবার বাড়িতেই গাড়ী আছে, কিন্তু কেউই আজ ম্যানেজ করতে না পারায় মেজাজ ঠিক ছিলোনা। বাসে চাপাটা তাদের কাছে ভীষণই নিচুতলার কাজ মনে হয়। আজ গাড়ী না পেয়ে তারা ওলা বা উবের বুক করতে চেয়েছিল, কিন্তু অফিসটাইম, তাই কোনরকম ট্যাক্সিই পায়নি তারা। নতুন জিনিস কেনার তাড়না প্রবল মনে হওয়ায়, গজগজ করতে করতে বাসেই উঠে পড়েছিল তিনমূর্তি।

রব্বির কাছে রনি ছয় হাজার টাকা পেতো, আজ সেই টাকা ও বাকি টাকা এটিএম থেকে তুলে আইপড নেবার কথা। কিন্তু এটিএম থেকে রব্বি মাত্র তিন হাজার টাকা তুলেছে। বাকিটা পরে দেবে সে। তাহলে বাকি টাকার কি হবে - এই নিয়ে সুত্রপাত। শুধু একটা কথাই বেফাঁস বলেছিল রনি - ‘তুই জানিস যখন আজ আমাদের প্রোগ্রাম, কেন টাকাটা সময়ে তুললিনা? টাকাটা মেরে দিবি নাকি ?’

পাবলিক বাসে অচেনা লোকজনের সামনে এই অতর্কিত আক্রমণ রব্বির সহ্য হলনা। সেও চোখা চোখা বিশেষণে সাজিয়ে দিল তার উত্তর - যেটা ভাইবোনের একেবারেই ভালো লাগলো না। সেখান থেকে এক কথা হতে হতে, নানান সত্যি বেরিয়ে পড়তে শুরু করল। কথার পিঠে কথা উঠতে তারা নিজেদের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, এমনকি তাদের বাবা মায়েদের পেশা, নেশা ও চরিত্র নিয়ে টানাটানি করতে শুরু করল।

অশান্তিটা হয়তো আর বাড়ত না, হটাত করে তাদের বাবার রোজগার নিয়ে কি একটা আলপটকা  মন্তব্য করে বসল রব্বি সিমকে উদ্দেশ্য করে - ফলে সিম এক থাপ্পড় মেরে বসল তাকে। প্রতিহিংসায় রব্বি সিম কে মারতে উদ্দ্যত হতেই রনি আর রব্বিকে আটকানো গেল না আর, একটি ঘুষিতে রনির ঠোঁট ফেটে ঝুলে পড়লো। আর অল্প সময়েই তাদের এই অশান্তি ছড়িয়ে পড়লো বাসের অভ্যন্তরে।

এইটুকু ছেলেমেয়েদের ভিতর এতো রাগ, হতাশা, জিঘাংসা লুকিয়ে ছিল? এরা তো জীবনে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। লজ্জা লাগছে না তাদের? তারা ভালো বাড়ির ছেলেমেয়ে, ভালো ভালো স্কুলে পড়েছে প্রত্যেকে - সামান্য কটা টাকার বেহিসাবে তাদের ক্ষোভ, না পাওয়ার যন্ত্রণা, একে অপরের প্রতি নোংরা মনোভাব লুকিয়ে রাখা, সব বেরিয়ে আসতে লাগলো ভলকে ভলকে।

যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়তে চাইছে যেন কাঁধ থেকে হাতদুটো - তার জীবনে কক্ষনো সে এভাবে ঝুঁকি নেয়নি। আর কখনও সে এভাবে বাসে চাপবেনা - ভিতর থেকে অসহায়তা যেন ডুকরে কেঁদে উঠলো। কখন নামতে পারবে সে? আর যে পারছেনা অবিনব! বাস যে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো ছুটছে কোথাও না দাঁড়িয়ে - এই বাঙ্গুর ছাড়িয়ে গেল। ড্রাইভারের এই ট্রিপে আর প্যাসেঞ্জারের দরকার কি - তার বাস টইটম্বুর যে!!

ভিতরের ঝামেলাটা শেষ পর্যন্ত যেন হটাত বোমার মতো ফেটে পড়ল। ঠেলাঠেলি থেকে মারপিট শুরু হয়েছে, মহিলা ও শিশুদের চীৎকার, অশ্রাব্য গালিগালাজ আর বাস থামাবার জন্য চেঁচামেচি। কন্ডাক্টারের ‘রোককে! রোককে!’ আর বাস পেটানো সত্ত্বেও বাস একই গতি ধরে রেখেছে। দরজায় ঝোলা মানুষগুলো আতঙ্কে আর্তনাদ করলেও কারো ভ্রূক্ষেপ নেই, প্রানভয়ে প্রত্যেকে হতবাক। এই দুঃস্বপ্ন কখন শেষ হবে?

অভিনবর ইন্দ্রিয়গুলো আর কাজ করছে না, সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে থাকা হাতদুটো যেন অসাড়, আর ভিতরের অসীম ধাক্কাধাক্কির ফলে তার মতো পাদানিতে দাঁড়ানো কয়েকজনের নীচে পড়ে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। অভাব অনাহারক্লিষ্ট একুশ ছুঁই ছুঁই জীবনের কিছু ছবি তার চোখের সামনে দিয়ে দৌড়ে গেল - তার মন এখন কিছু ভাবছেনা, তার দৃষ্টি এখন মধ্যবর্তী।

একটা সুন্দর বারান্দায়, বাবাকে ফর্সা জামাকাপড়ে বসে কাগজ পড়তে দেখল অভিনব। পরক্ষনেই নীল দড়ির মতো পাকানো শিরা সম্বলিত মায়ের হাতদুটো আর মিঠুর মুখটা একবার ভেসে উঠতেই তার স্রান্ত হাতদুটো আলগা হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে লোপ পেয়ে গেল দৃশ্য, বর্ণ, গন্ধ, শব্দের যাবতীয় ঐকতান - সব ঢেকে গেল কালো পর্দায়।

ধূসর পিচরাস্তার উপর একটি নিঃস্পন্দ শরীর পড়ে - পোশাকি ভাষায় যার নাম ‘বডি’! মাথার উপর দিয়ে পিছনের চাকা চলে গেছে। রাস্তার ঢালু দিক বেয়ে সর্পিল ধারায় গরম রক্তের চুইয়ে পড়া। আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে কয়েকটি রক্তমাখা কয়েন। রোজকার মতো আরেকটি পথ দুর্ঘটনা। পুলিশ এসে যাবে এখুনি, বিক্ষোভ হবে, হয়তো অবরোধও। ক্ষিপ্ত জনতা হয়ত আগুন দেবে কোন বাসে - নিষ্ফল আক্রোশে!

অভিনবকে আর মায়ের অতি কষ্টের রোজগার একশো টাকাটার জন্যে ভাবতে হবেনা কোনদিনও! সে তার সামান্য পুঁজি রক্ষা করে মায়ের হাতে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল! ভাবতেও পারেনি অভিনব, সেটা করতে গিয়ে তাদের কঙ্কালসার সংসারের শেষ আশাটুকু, অযত্নে পালিত পুঁজিটুকুও বিনা দোষে, অনাদরে লাশকাটা ঘরে পৌঁছে যাবে এইভাবে!!

পরদিন দুর্ঘটনা কলামে দু কলমে লেখাটা বেরোতে অধিকাংশ ভদ্রসন্তান ভ্রু কুঁচকে ‘বস্তির জানোয়ারগুলো কলকাতাকে শেষ করে দিল - সারাক্ষণ বাসের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বদমায়েশি। যতসব সমাজবিরোধীর দল। বেশ হয়েছে, পৃথিবী থেকে অন্তত একটা অপদার্থ বাদ গেছে! এখন এর জন্যে এবার কোথায় আগুন জ্বলে কে জানে? বস্তির শহীদ বলে কথা!’, এই সারমর্মের চর্বিতচর্বণ করে বিনোদনের পাতা ওলটান।

দুর্ঘটনার পরের দিনই ভি আই পি রোড নতুন সাজে ঝকমক করছে - রাস্তার দু ধারে অগুন্তি মানুষ সবুজ মেরুন পতাকা নেড়ে শোরগোল করছে। যে সে ব্যাপার নাকি - আজ যে বিশ্ব ফুটবলের রাজপুত্র আসছেন কলকাতায়, সুদূর পর্তুগাল থেকে!!! জনতা ধন্যি ধন্যি করছে, ক্রীড়া মন্ত্রকের পক্ষ থেকে এ কি অভিনব প্রচেষ্টা শহরের মানুষের জন্যে!!!




#এই গল্পের চিন্তাধারা সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত। কোন জীবিত অথবা মৃত ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কোনরূপ কর্মকাণ্ডের সাথে যদি এই গল্পের কোন ঘটনার মিল থেকে থাকে, তা সম্পূর্ণ কাকতালীয় ও অনিচ্ছাকৃত।



।। সমাপ্ত ।।

| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
  | Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
|Special Puja Issue,2019 | September-October, 2019 |
| Third Year Third Issue |20Th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |















No comments:

Post a Comment

Please put your comment here about this post

Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান