সাবান
দ্বিজেন্দ্রনাথ
মিশ্র ‘নির্গুণ’
অনুবাদঃ রাজীবকুমার সাহা
Image Courtesy: Google Image Gallery |
এক
সুখদেব
গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমার সাবান কই?”
শ্যামা
রান্নাঘরে ছিল। সাবানদানি তুলে দৌড়ে এসে দেওরের হাতে দিয়ে বলল, “এই
নাও।”
সুখদেব
তাতে একবার আঙুল ছুঁইয়েই চিৎকার করে উঠল, “তুমি মেখেছ? কেন?”
অনুচ্চ
কণ্ঠে শ্যামা উত্তর দিল, “ওই মুখে শুধু একটুখানি।”
“এতবার
বারণ করা সত্ত্বেও আমার সাবান নিলে ফের? লজ্জার মাথা কি চিবিয়ে খেলে?”
“বকছ
কেন?”
শ্যামা
রাগে সাবানদানি সেখানেই ছুড়ে ফেলে গটমট করে চলে যেতে যেতে বলে গেল, “একটু
সাবান কী মেখেছি মহাভারত যেন অশুদ্ধ হয়ে গেল।” তারপর রান্নাঘরের চৌকাঠে পা দিয়ে
মুখ ফিরিয়ে বলল, “অচ্ছুৎ নাকি, আমি?”
উনুনে
তরকারি ফুটছিল। শ্যামা ঢাকনা উঠিয়ে দেখে তা আধপোড়া হয়ে আছে ততক্ষণে। ধপ করে কড়াই
নামিয়ে রাখল মেঝেতে। “যা, পুড়ে ছাই হয়ে যা! খাওয়াদাওয়া
সব বন্ধ আজ।” বলতে বলতে কানে এল বড়ো খোকা জলভর্তি বালতি হেঁচড়ে টেনে নিয়ে চলেছে কোথায়।
চমকে ওঠে হা হা করে উঠল শ্যামা। “অ্যাই হতভাগা, জল
নিয়ে যাচ্ছিস কোথায় বল।”
“চান
করব। কাকা বলেছে।”
শ্যামা
উঠে এসে ছেলের হাত থেকে বালতি ছিনিয়ে নিয়ে চান-ঘরের দরজায় দাঁড়াল এসে। সুখদেব ছোটো
ভাইপোকে সামনে বসিয়ে সাবান মাখছিল মাথায়। একনজর বৌদিকে দেখে গজগজ করতে লাগল, “ধুর, কালো
করে দিয়েছে সাবানটা একেবারে। মা কালীর রং লেগে গেছে সাবানে।”
“কী
বললে? আমি মা কালী!” ফুঁসে উঠল শ্যামা।
সুখদেব
উত্তর দিল না। চুপচাপ ভাইপোর মাথায় সাবান মাখতে লাগল।
শ্যামা
সশব্দে বালতি রেখে ফের জিজ্ঞেস করল, “মা কালী আমি?”
সুখদেব
শঙ্কিত হয়ে বলল, “আরে, আস্তে আস্তে। দাদা ফিরেছে।”
শ্যামা
চকিতে ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে দরজার সামনে একজোড়া জুতো চকচক করছে।
ওপরের
ভাড়াটেদের একটা বড়ো দেওয়ালঘড়ি আছে। টং করে আধঘণ্টার শব্দ ভেসে এল সে থেকে। শ্যামা
তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে ভাত বেড়ে ডাক দিল, “খেতে এসো।”
ব্রজলাল
আসনে বসে খাবারে একনজর বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আজ
তরকারি কিছু হয়নি বুঝি?”
“না।”
“ওই
বাটিতে কী?”
“একটু
লাউ রেখেছি সুখুর জন্যে। তুমি বাপু ডাল-ভাজা দিয়ে খেয়ে নাও।”
ব্রজলাল
আজ্ঞা মেনে একগ্রাস মুখে দিয়েই শান্তস্বরে বলল, “নুনটা
দাও দেখি।”
নুনদানি
পাতের কাছে রাখতে রাখতে শ্যামা জিজ্ঞেস করল, “কেন? কম
হয়েছে নাকি?”
“দাওইনি
বোধহয়।”
“বাজে
কথা বোলো না। আমার স্পষ্ট মনে আছে দিয়েছি। বাজি।”
ব্রজলাল
হেসে বলল, “বেশ। তবে ভালো চাও তো খানিকটা নুন ডালে ফেলে
দাও এখুনি। সুখু খেতে এল বলে। তখন টের পাবে কত ধানে কত চাল।”
শ্যামা
ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল, “কেন? কী হবে? জেল-ফাঁস
দেবে? কারও কেনা গোলাম নই আমি।”
হাসতে
হাসতে ব্রজলাল বলল, “আচ্ছা বাবা, আচ্ছা।
তুমি রাজরানি। দাও, আর একটু ভাত দাও।”
খেয়ে
ওঠে ব্রজলাল ফের অফিস যাবার তোড়জোড় করতেই শ্যামা এসে দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়াল। গোমড়া
মুখে জানাল, “আমার সাবান চাই একখানা।”
“সাবান!
কীসের সাবান? ও তুমি সুখুকেই বোলো। ওই ফাইলটা দাও তো। আরে, ছাতাটা
গেল কই আবার!”
তখুনি
রান্নাঘর থেকে আওয়াজ এল, “বৌদি, ভাত
বাড়ো।” সঙ্গে দুয়ো টানল দুই কচি কণ্ঠ, “বৌদি, ভাত
বাড়ো।”
শ্যামার
বড়ো খোকা আলাদা পাতে খায়। ছোটোটি খায় কাকার হাতে। নেয়েধুয়ে এসে একসঙ্গে খেতে বসেছে
তিনজনে। বড়ো খোকা চোখমুখ কুঁচকে হঠাৎ বলে উঠল, “এহ্, ডালে
আজ এত নুন!”
শঙ্কিত
দৃষ্টিতে শ্যামা দেওরের মুখে তাকাল চকিতে। কিন্তু সুখদেব ভালোমন্দ কিছু বলল না।
উলটে ভাইপোকে ধমক দিল, “খেয়ে ওঠ চুপচাপ।” তারপর বাটিটা সামনে ঠেলে দিয়ে
বলল,
“আর একটু তরকারি দাও তো, বৌদি।”
শ্যামা
হেসে জানাল, “আর তো নেই, ভাই।”
“সে
কি! শেষ?”
“এই
দেখো,” শ্যামা তরকারির কড়াই টেনে এনে দেখাল, “পুড়ে
গেছে সব। যতটুকু পেরেছি ও থেকেই ছেঁকে তুলে রেখেছি তোমার জন্যে। তরকারি একটা না
হলে তো খেতে পারো না।”
“কড়াইটা
দাও তো, পোড়া তরকারির স্বাদ কেমন হয় দেখি।”
শ্যামা
আঁতকে ওঠে কড়াই পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল, “কী ছিষ্টিছাড়া কথা! নাও, আর
একটু ডাল দিয়ে খেয়ে ওঠো আজ লক্ষ্মীটি।”
বড়ো
খোকাও আর একটু ডাল চাইল। শ্যামা ডালের হাঁড়ি তার সামনে রেখে বলল, “নে, নিয়ে
নে যত খুশি।”
“অ্যাঁ!
এতে ডাল কই, ও মা!”
ভার
মুখে শ্যামা উত্তর দিল, “নেই আর। পেট না ভরলে আমাকেই
খেয়ে নে, পেটুক কোথাকার।”
ছোটো
ভাইপোর এঁটো হাতমুখ ধুইয়ে সুখদেব কলেজে যাওয়ার জন্যে তৈরি হতে গিয়ে দেখে জামার
দুটো বোতাম গায়েব। সুই-সুতো আর বোতাম হাতে সুখদেব বৌদির সামনে এসে দাঁড়াল। শ্যামা
খেতে বসেছিল মাত্র। সুখদেব জামা তার কোলে ফেলে দিয়ে তাড়া দিল, “জলদি
বৌদি, জলদি।”
শ্যামা
তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে এসে জামা আর বোতাম নিয়ে বসল। শ্যামার বাড়া ভাতের দিকে নজর গেল
সুখদেবের। সেই পোড়া তরকারির খানিকটা ভাতের পাশে। শ্যামা তাড়াতাড়ি সুখদেবের জামা
তুলে ভাতের থালা আড়াল করে বলল, “নাও, হয়ে
গেছে। যাও তো এবারে, খেতে বসি।”
বড়ো
ভাইপো দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। তার আজ স্কুল ছুটি। কলেজে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে ভাইপোকে
টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল সুখদেব।
মিনিট
চারেক বাদে বড়ো খোকা দইয়ের একটা খোরা নামিয়ে রাখল মার পাতের পাশে। শ্যামা পোড়া তরকারি
মেখেই খেয়ে নিচ্ছিল কোনোক্রমে। আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “দই
কোত্থেকে আনলি রে?”
ছেলে
দৌড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গেল, “কাকা কিনে পাঠিয়েছে।”
দুই
পাশের
বাড়ির পাঞ্জাবিদিদি ছোটোদের জামাকাপড় যত্ন করে সেলাই করে দেয়। তার স্বামীকে শ্যামা
গরজ করে ব্রজলালকে বলে তার অফিসে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। সুখদেব নিজের জামাকাপড় সব
দত্ত কোম্পানি থেকে তৈরি করায়। ভাইপোদের জামা-প্যান্টও গতবার ওখান থেকে সেলাই
করিয়ে আনিয়েছিল। কিন্তু বাড়ি এনে পরিয়ে দেখা গেল সব ছোটো মাপের, মজুরিও
নিয়েছে এক কাঁড়ি। দেওর-বৌদির যুদ্ধ হল। ফলে এইবার জামাকাপড় সব পাঞ্জাবিদিদির হাতেই
সঁপে দিয়েছে শ্যামা। খুব সুন্দর মাপের তৈরি হয়েছে জামা, শ্যামা
স্বভাবতই খুশি। একটাকা হাতে দিয়ে হেসে বলল, “ওদের
বাবার জামাকাপড়ও এখন থেকে তুমিই সেলাই করবে, দিদি।”
“নিশ্চয়ই।
দাদার জামা আমিই করে দেব। তবে টাকাটা রেখে দাও দিদি, ও-টাকা
আমি নিতে পারব না।”
“সে
কি! মজুরি ছাড়া কাজ করবে কেন? না না, টাকাটা
নিতেই হবে তোমাকে।”
পাঞ্জাবিদিদি
জবাব দিল, “আমাকে লজ্জায় ফেলো না, দিদি।”
জল ভরে এল চোখে তার। “ওদুটো কি আমার ছেলে নয়, বলো!
মাথার দিব্যি রইল দিদি, টাকাটা নিয়ে যাও।”
ওই
একটা টাকাই ছিল শ্যামার কাছে। তাই হাতে নিয়ে সারাদিন চেষ্টা চালাল একটা সাবান যদি
কেউ এনে দেয়। কাউকে পাওয়া গেল না। শেষে অনেক শিখিয়ে পড়িয়ে বড়ো ছেলেকে টাকাটা হাতে
পাঠাল গলির মাথায় মোড়ের দোকানটায়। মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগল, ‘আসুক
সাবান আজ। রোজ চান করব এ দিয়ে।’
কিন্তু
ছেলের মাথায় গোবর পোরা। খানিক পরেই দুই আনার কাপড় ধোওয়ার বিশ্রী গন্ধওলা একটা
সাবান আর চৌদ্দ আনা মার হাতে রেখেই দৌড়ে পালিয়ে গেল সে। শ্যামা সে সাবান ছুড়ে ফেলে
গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকল গিয়ে।
আধঘণ্টা
পর ব্রজলাল বাড়ি ফিরল, তারও আধঘণ্টা পর সুখদেব। শ্যামা খাবার আগলে বসে
আছে, কিন্তু
ব্রজলালের পাত্তা নেই। তার কোন বন্ধু এসে জুটেছে, ঘরে
বসে আড্ডা মারছে। শ্যামা কয়েকবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে ফিরে এসেছে। দু’বার
ছেলেকেও পাঠিয়েছে বাপকে ডেকে আনতে। ব্রজলাল প্রত্যেকবারই জানিয়েছে, “আসছি, যা।”
কিন্তু ওঠার নাম নেয়নি।
বিরক্ত
শ্যামা দেওরকে বলল, “তুমি খেয়ে নেবে, এসো।
আরেকজন তো আজ কথা গিলেই পেট ভরবে দেখছি।”
সুখদেব
ঠাট্টা করতে ছাড়ল না। বলল, “মহারানির আদেশ হলে আমি গিয়ে
হাতজোড় করে বলি, ‘খাবার ঘরে আসতে আজ্ঞা করুন, মহারাজ’?”
শ্যামা
হাসতে হাসতে জবাব দিল, “আরে গুলি মারো মহারাজের। ভাত বেড়ে ফেলেছি, বোসো
এসে।”
সুখদেব
এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “খোকারা কই?”
শ্যামা
মুচকি হেসে জবাব দিল, “কাকার শ্বশুরবাড়ি গেছে। প্রিয়ংবদাদের চাকর
এসেছিল। ওদের ওখানে আজ ব্রত-পাঠ হবে। তুমি যাবে না?”
“ধুত, বাজে
বকো না তো!” তারপর একটা গ্রাস মুখে তুলেই বলল, “জল
দাও গ্লাসে।”
সুখদেব
নাকেমুখে খেয়ে ওঠে জামাকাপড় পালটে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াল এসে ফের। শ্যামা দেওরের
এঁটো থালা হাতে বেরিয়ে আসতেই চাপা গলায় সুখদেব ডাকল, “বৌদি।”
চোখ
তুলে তাকাল শ্যামা।
“বৌদি, দারুণ
একটা ছবি চলছে আজ।”
“যাচ্ছ
নাকি?”
“পকেট
খালি, বৌদি।”
শ্যামা
একটু ভেবে বলল, “চৌদ্দ আনায় চলবে? আছে
আমার কাছে।”
“আরে, দাও
দাও।”
শ্যামা
পয়সা এনে দেওরের হাতে দিয়ে বলল, “ফিরে এসে ওদিকের দরজায় টোকা
দিও। জেগে থাকব।”
“আচ্ছা।
দাদা জিজ্ঞেস করলে কী বলবে?”
শ্যামা
চুপিচুপি বলল, “বলব যে প্রফেসর শর্মার কাছে গেছ।”
সুখদেব
খুশি হয়ে, “বেশ বেশ, এই
ভালো।” বলে পা টিপে সদর দরজা অবধি গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ফের। গলা নামিয়ে ডাক দিল, “বৌদি!”
শ্যামা
চোখের ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“স্যালুট।”
সুখদেব
নেমে গেল রাস্তায়। শ্যামা হেসে উঠতেই পেছন থেকে ব্রজলাল সহসা বলে উঠল, “ভাত
বাড়ো।”
তিন
দু’বছর
আগে একটা মেয়েকে পড়াতে যেত সুখদেব। সেখানেই ছাত্রীর বান্ধবী প্রিয়ংবদার সঙ্গে আলাপ
হয় তার। পরিচয় কখন গভীর প্রণয়ে বদলে গেছে টের পায়নি কেউই। ক্রমে প্রিয়ংবদার
পড়াশোনা বন্ধ হল। দু’জনের দেখাসাক্ষাতেও ছেদ পড়ল। তখন কাগজের টুকরোয় মনের কথা
ব্যক্ত করা ছাড়া অন্য উপায় রইল না।
শ্যামা
একদিন ধোপাকে ময়লা কাপড় বের করে দিচ্ছিল। পকেট খালি করে দেওরের কোট ধোপার হাতে
তুলে দেওয়ার আগে একটুকরো কাগজ খুলে দেখল লেখা আছে, ‘হৃদয়েশ্বর...’
শ্যামা
মনের খুশি গোপন রেখে একচোট ধমকাল দেওরকে। সুখদেব কেঁচো হয়ে গেল বৌদির সামনে।
চিঠিটা ফিরিয়ে দিতে মিনতি জানাল বারবার। শ্যামা মুখ টিপে অতিকষ্টে হাসি চেপে ধমকে
ওঠে বলল, “এই চিঠি তোমাকে নয়, তোমার
দাদার হাতে দেব, বাড়ি আসুক। টের পাবে কত ধানে কত চাল।”
সুখদেব
ঝপ করে পা চেপে ধরল শ্যামার। সেদিন থেকে শ্যামার কথা ছাড়া এক পা বাড়ায় না সুখদেব।
বৌদিকে
একদিন সুযোগ করে দূর থেকে প্রিয়ংবদাকে দেখিয়েও এনেছে সে। বাড়ি ফেরার পথে শ্যামা
উক্তি করল, “সর্বনাশ! এই তোমার প্রিয়ংবদা? রূপে
তো সাক্ষাৎ লক্ষ্মী গো! আমি তো তার নখের যুগ্যিও নই দেখছি। সে আমাকে দিদি বলে
মানবে তো?”
সুখদেব
উত্তর দিল, “খুন করে ফেলব।”
“কাকে? আমাকে?”
সুখদেব
কোনও উত্তর দিল না।
দ্বিতীয়
দিনেই প্রিয়ংবদাদের চাকর এসে একটা চিঠি দিয়ে গেল শ্যামার হাতে। শ্যামা ভাঁজ খুলে
দেখল লেখা আছে, ‘দিদির চরণকমলে প্রণাম। এই হতভাগিনীর কী এমন
অপরাধ ছিল যে এত কাছে পেয়েও ছোটো বোনটা দিদির মুখদর্শন থেকে বঞ্চিত হল? একটিবার
পায়ের ধুলো মাথায় নিতাম, এই জীবন সার্থক হল ভেবে
নিতাম। ইতি, তোমার দাসী।’
শীত
পড়েছে খুব। শীতে ভোর ভোর স্নান সেরে রান্নার কাজে বড্ড কষ্ট হয় শ্যামার। শ্যামা কী
ভেবে দেওরের আলমারি খুলে পোকায় কাটা শত ছিদ্র একখানা সোয়েটার বের করে আনল। রোজ
স্নানের পর সোয়েটারটা পরলে বেশ আরাম পাওয়া যায়।
হঠাৎ
একদিন সুখদেবের খেয়াল হল, মোড়ের মাথায় চায়ের দোকানের
ছেলেটাকে এই শীতে একটা পুরনো সোয়েটার দেবে বলে এসেছিল। সে আঁতিপাঁতি করেও সে
সোয়েটার খুঁজে পেল না। একটা একটা করে সব জামাকাপড় ছুড়ে বিছানায় ফেলল, সোয়েটারের
দেখা মিলল না। গেল কোথায়?
দাওয়ার
রোদে পিঠ দিয়ে বসে ডাল বাছছিল শ্যামা। সুখদেব এসে বলল, “বৌদি, আমার
পুরনো সোয়েটার ছিল একখানা...”
“ওটা
আমি নিয়েছি। কেন?”
“তুমি!
কেন? আর
আমার আলমারি খুললে কার হুকুমে?”
শান্ত
কণ্ঠে শ্যামা উত্তর দিল, “ফালতু পড়ে ছিল, বের
করে এনেছি।”
“আমাকে
একবার জিজ্ঞেস করতে পারতে! আমার জিনিসপত্রে হাতই বা দাও কোন আক্কেলে?” গলা
চড়াল সুখদেব।
শ্যামা
উত্তর দিল না।
সুখদেব
একটুক্ষণ অপেক্ষা করে ফের জিজ্ঞেস করল, “কোথায় সেটা? বের
করে দাও।”
“ঠিক
আছে, তুমি
ঘরে যাও, নিয়ে যাচ্ছি আমি।”
সুখদেব
অনড়। “না, এক্ষুনি দাও।”
শ্যামা
দেওরের দিকে পিঠ করে সোয়েটার খুলে ছুড়ে দিয়ে বলল, “এই
নাও।”
থমকে
দাঁড়িয়ে রইল সুখদেব। শ্যামা নির্বিকার মুখে ডাল বাছতে লাগল ফের। সোয়েটারটা তুলতে
গিয়ে সুখদেব খেয়াল করল শ্যামার চোখ টলটল করছে জলে।
আড্ডাবাজ
বন্ধুটি আজ সকাল না হতেই ফের গিয়ে ঢুকেছে ব্রজলালের ঘরে। খানিক পরেই বেরিয়ে গেল
ব্রজলালকে সঙ্গে করে। সাড়ে ন’টায় ব্রজলাল ফিরে এল হাসিমুখে। খেতে বসেও হাসছে। খেতে
খেতে সহসা বলে উঠল, “তোমার ছোটো জাকে দেখে এলুম, বুঝলে?”
শ্যামা
হাঁড়িমুখে বসে ছিল তখন থেকে। ব্রজলালের কথার কোনও উত্তর দিল না। ব্রজলাল ফের বলল, “শরীর-স্বাস্থ্য
ভালোই, সুখুর কাঁধ সমান পৌঁছে যাবে প্রায়।”
শ্যামা
এতেও নিরুত্তর রইল।
ব্রজলাল
ভাত শেষ করে জল খেয়ে উঠে গেল। ঘড়ির দিকে নজর ফেলতে ফেলতে অফিসের জন্যে তৈরি হতে
লাগল। চুল আঁচড়াতে গিয়ে আয়নায় দেখল দরজার চৌকাঠে শ্যামার প্রতিবিম্ব। কানে এল, “আমায়
একটা সোয়েটার এনে দাও।”
ব্রজলাল
বিরক্ত স্বরে উত্তর দিল, “আজ আবার সোয়াটার? রাস্তা
দাও, দেরি
হয়ে যাচ্ছে। সুখুকে বোলো, এনে দেবে।”
শ্যামা
নাছোড়বান্দা। বলল, “তাহলে টাকা দিয়ে যাও, আমি
আনিয়ে নেব কাউকে দিয়ে।”
“কাউকে
দিয়ে কেন?” ব্রজলাল একটাকার একটা নোট স্ত্রীর হাতে দিয়ে
বলল,
“নাও, ধরো। সুখু এনে দেবে! কোথায়
সে নবাব?”
কিন্তু
সুখদেবের খোঁজ পাওয়া গেল না। ঘণ্টা পর ঘণ্টা কেটে গেল সে ফিরল না। রান্নাঘরে খাবার
ঠাণ্ডা হচ্ছে। শ্যামা বারবার উঠোনে নেমে সদর দরজায় দৃষ্টি ফেলছিল। ভাইপোরা হাত
ধরাধরি করে মোড়ের মাথায় চায়ের দোকান অবধি খুঁজে এসেছে। কাকা নেই। মনখারাপ করে
কাকার বিছানায় উঠে বসে আছে তারা।
গলির
শেষপ্রান্তে সুখদেবের বন্ধু থাকে একজন। শ্যামা বড়ো খোকাকে ডেকে বলল, “যা
তো বাবা, বিদ্যাভূষণকে একবার জিজ্ঞেস করে আয় দেখি, কাকা
কোথায় গেছে জানে কি না। বলবি, মা খুব চিন্তা করছে।”
এমনি
সময় দরজার সামনে জুতোর আওয়াজ উঠল। শ্যামা দৌড়ে বেরিয়ে এসে দেখে সুখদেব কোমর
ঝুঁকিয়ে জুতোর ফিতে খুলছে।
খাবার
ঘর নিস্তব্ধ। একটা কথাও কেউ উচ্চারণ করছে না। ছেলেরাও ইশারায় পরস্পর কথা বলছে।
সুখদেব একবারের জন্যেও পাত থেকে মাথা তোলেনি। তিনজনে খেয়ে ওঠে ঘরে ঢুকে খানিক পরেই
যখন স্বভাবসিদ্ধ হৈ হট্টগোল শুরু করল তখন বুক খালি করে নিশ্চিন্ত একটা শ্বাস
বেরিয়ে এল শ্যামার।
হঠাৎ
বড়ো খোকা দৌড়ে এসে মার হাতে একটা চিরকুট আর পেন্সিল ধরিয়ে বলল, “এটা
পড়ে জবাব লিখে দাও।”
শ্যামা
হাতের কাজ ফেলে কাগজটা পড়ে দেখল, সুখদেব লিখেছে—
‘আমার
হাতে প্রফেসর শর্মার দামি একটা বই খোয়া গেছে। আজ উনি চেয়ে পাঠিয়েছেন সেটা। দোকান
থেকে কিনে নিয়ে ফেরত দেব। সাড়ে দশ টাকা চাই। তুমি কারও কাছ থেকে ধার করো। আমি সকাল
থেকে টাকাটার বন্দোবস্তের চেষ্টা করছিলাম, পাইনি।
এখন তুমিই ভরসা। দাদাকে জানিও না, আমার মাথার দিব্যি।’
শ্যামা
সে কাগজের পিঠে লিখে পাঠাল—
‘আমার
কাছে দশ টাকা আছে। নিতে পারো। আট আনা জোগাড় করে নিও।’
অল্প
পরেই ছেলে আবার চিঠি নিয়ে ফেরত এল, ‘দশ টাকাই সই। পাঠিয়ে দাও।
দাদাকে কিছু বোলো না। আমি সামনের মাসে শোধ করে দেব।’
শ্যামা
লিখে পাঠাল—
‘তোমার
দাদাকে জানাব না, নিশ্চিন্তে থাকো। আর সে টাকা তোমায় শোধ দিতে
হবে না। আমার মাথার দিব্যি।’
চার
বিকেলে
সুখদেব কলেজ থেকে ফিরে এসে দেখে বাড়ি তোলপাড়। বড়ো ভাইপো উঠোনের পেয়ারাগাছটার তলায়
দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আর শ্যামার ঘর থেকে ছোটোটার ভয়ার্ত চিৎকার ভেসে আসছে, “কাকা, কাকা
গো, ও
কাকা...”
সুখদেব
ত্রস্তপায়ে বড়ো ভাইপোর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “অ্যাই, কী
হয়েছে রে!”
উত্তর
এল,
“মা ভাইকে খুব মেরেছে। এখন দড়ি দিয়ে বাঁধছে।”
সুখদেব
কোনওমতে বইপত্র টেবিলে ছুড়ে ফেলে জুতো পায়েই তড়িৎগতিতে শ্যামার ঘরে ঢুকল গিয়ে।
দেখে শ্যামা ছোটো ছেলের কোমল হাতদুটো দড়ি পেঁচিয়ে বাঁধছে আর বলছে, “ডাক
তোর কাকাকে। দেখি কে বাঁচায় আজ।”
সুখদেব
ধাক্কা মেরে শ্যামাকে সরিয়ে দিয়ে ভাইপোর হাত খুলে কোলে তুলে নিল। ভাইপো কাকার বুকে
মুখ লুকিয়ে হিক্কা তুলে কাঁদতে লাগল।
চোখে
ভিজে গেল সুখদেবের। গম্ভীর কণ্ঠে বৌদিকে জিজ্ঞেস করল, “এভাবে
মারলে কেন ওকে?”
শ্যামা
উত্তর দিল না। ফের প্রশ্ন এল, “কেন মারলে, বলো?”
শ্যামার
এবারে চোখ তুলে কৈফিয়ত দিল, “নিজের ঘরে গিয়ে দেখে এসো
একবার। তোমার কালিভর্তি দোয়াত ভেঙে চৌচির করেছে। একটাকার ধাক্কা এখন।”
“এজন্যে
মারলে!”
শ্যামা
নিরুত্তর। সুখদেব বলল, “আজ ছেড়ে দিলাম। আর কখনও এমন করলে এ-বাড়ির জলও
ছোঁব না বলে দিলাম।” তারপর ভাইপোকে কোলে করে ঘরে থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গেল, “আধমরা
করে ফেলেছে ছেলেটাকে একেবারে। তুমি মা!”
বাইরে
এসে দেখে ঢাকা এক থালা হাতে প্রিয়ংবদাদের চাকর দাঁড়িয়ে আছে উঠোনে। বৌদিকে ডেকে
দিয়ে ভাইপোদের নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল সুখদেব।
আজ
প্রিয়ংবদাদের বাড়ি নেমন্তন্ন ছিল সবার। যায়নি কেউ। প্রিয়ংবদা সারাদিন পথ চেয়ে বসে
রইল, নিজেও
খেল না। শেষে সন্ধে নেমে আসতে মাকে বলে খোকাদের জন্যে মিঠাই পাঠিয়ে দিয়েছে চাকরের
হাতে।
শ্যামা
থালা খালি করে দিতে চাকর মিনতি করল, “মা, আপনাকে
দিদি ডেকেছেন একবার। যেদিন বলবেন আমি এসে নিয়ে যাব। একদিন আমাদের বাড়িতে পদধূলি
দিন দয়া করে।”
শ্যামা
খুশি হয়ে বলল, “আরে, সে তো আমার নিজেরই বাড়ি।
তুমি অমন করে বোলো না।”
চাকর
হাতজোড় করে বলল, “আমি তাহলে কবে আসব, মা?”
শ্যামা
অধীর কণ্ঠে জানাল, “কাল তো রবিবার, এদের
ছুটি আছে। কালই যাব তাহলে। তুমি দুপুরের পরপর চলে এসো, খেয়েদেয়ে
রওনা হব।”
“তা
হবে না, মা। যা হোক শাকান্ন দুটো আমাদের ওখানেই খাবেন।”
শ্যামা
সলজ্জ হেসে বলল, “আচ্ছা যাও, তাই
হবে।”
পাঁচ
সেদিন
অনেক দেরি করে বাড়ি ফিরেছে ব্রজলাল। ঘরে ঢুকেই তাড়া দিল, “খেতে
দাও জলদি, খিদেয় পেট জ্বলছে। আচ্ছা, এ-ঘরেই
নিয়ে এসো নয়।”
শ্যামা
উত্তর দিল, “হবে না।”
“সে
কি! রান্না চাপাওনি এখনও?”
“রান্না
হয়েছে। তবে তোমার জন্যে নয়।”
“কী
আজেবাজে বকছ বলো তো! যাও, বেড়ে নিয়ে এসো শীগগিরই।”
শ্যামা
গেল না। উলটে ধপ করে বসে পড়ল পাশের চেয়ারে। বলল, “আগে
আমার একটা কথার জবাব দাও।”
“কী
কথা?”
শ্যামা
অল্প ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, “এই বাড়ির গিন্নি কে?”
অধৈর্য
ব্রজলাল হেসে উঠল। “কেন, তুমি!”
শ্যামা
মাথা দুলিয়ে বলল, “বেশ, আমি। তা এই কথাটা ওই
আড্ডাবাজ লোকটিকে জানাওনি? নইলে সে গায়ে পড়ে আমার
দেওরের বিয়ে ঠিক করার কে? আর তুমিই বা আমার মত না নিয়ে
কাউকে কথা দিয়ে এলে কোন আক্কেলে, অ্যাঁ?”
“বাহ্
রে, আমি
সুখুর বড়ো ভাই, ওর গার্জেন!” হাসছিল ব্রজলাল।
শ্যামা
ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “আর আমি?”
“তু-তুমি
ওর বৌদি!”
“শুধু
বৌদি?”
ব্রজলাল
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না। চুপ করে রইল।
শ্যামা
এবারে পিঠ টানটান করে জানাল, “আমিই ওর মা। ওর দিদি, ওর
বোন সব। বুঝলে? আমার মানা থাকলে এক পাও ফেলে না সে। বিশ্বাস না
হলে ডেকে জিজ্ঞেস করে দেখো। তুমি আজ ওর বিয়ে ঠিক করে দেখো, কালই
আমি ওকে নিয়ে চলে যাব এখান থেকে। ভেবেছ কী, আমাকে?”
“ধেত্তেরি!
কী, বলতে
চাইছ কী? জলদি বলো, বললাম
তো খিদে পেয়েছে জোর!”
“অ্যাই-ত্ত!
পথে এসো। বলো যে তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে...”
ব্রজলাল
তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, “ইচ্ছার বিরুদ্ধে, কী?”
“আমি
সুখুর বিয়ে দেব না।”
“আচ্ছা
বাবা, তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি সুখুর বিয়ে দেব না।
হয়েছে? এবার খেতে দাও।”
শ্যামার
নড়ার নাম নেই। ফের বলল, “বলো, আমার
ভুল হয়ে গেছে, মানে...” সুখদেবকে সামনে দেখে সহসা চুপ করে গেল
সে।
সুখদেব
দাদা-বৌদির একটু আধটু কথাবার্তা শুনে ফেলেছে হয়তো। শ্যামার দৃষ্টি অনুসরণ করে
ব্রজলাল ঘাড় বাঁকিয়ে ছোটো ভাইকে দেখতে পেয়ে মুচকি হাসল। শ্যামা ততক্ষণে গায়ে আঁচল
টেনে পালিয়ে গেছে দ্রুতপায়ে।
খাওয়াদাওয়া
প্রায় শেষ। ব্রজলাল জল খেয়ে মস্ত এক ঢেঁকুর তুলে স্ত্রীর শান্ত মুখে তাকিয়ে বলল, “তাহলে
এখানে সুখুর সম্বন্ধ করছ না, তাই তো?”
শ্যামা
জোর মাথা নেড়ে জবাব দিল, “প্রশ্নই ওঠে না।”
ব্রজলাল
জানাল, “কিন্তু ওরা তো একশো টাকা অগ্রিম দিয়ে ফেলেছে
আমাকে।”
“ফিরিয়ে
দাও।”
অস্বস্তি
ভরা কণ্ঠে ব্রজলাল বলল, “তা দেব। কিন্তু জানোই তো, পরশু
সুখুর পরীক্ষার ফি জমা দেবার শেষদিন। কাল রোববার। এক সপ্তাহের জন্যে টাকাটা রেখেই
দিই বরং হাতে, কী বলো? এক
তারিখ বিকেলেই বেতন পেয়ে যাব। সেদিনই নয় ফিরিয়ে দেব।”
“একদম
নয়।”
“তবে!
সুখুর ফির বন্দোবস্ত করব কোত্থেকে?”
“সে
হয়ে যাবে। ওপরের মাড়ওয়ারিদিদি জিনিস বন্ধক রাখে। আমার লকেটটা বন্ধক রেখে নিয়ে আসব
টাকা। কখন চাই বলে রেখো।”
বিস্মিত
ব্রজলাল এঁটো হাতের পিঠ কপালে ছুঁইয়ে বলল, “তোমার
খুরে খুরে দণ্ডবৎ।”
শ্যামা
ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বাধা দিল, “আরে আরে, ওই
সুখু আসছে, হাত নামাও!”
কিন্তু
সুখদেব খাবারঘরে ঢুকল না। উঠোনে দাঁড়িয়েই বলল, “বৌদি, খেতে
দাও।”
ছয়
রবিবারটা
এলেই সকাল সকাল জলখাবার খেয়ে দুই ভাই বেরিয়ে যায়। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা মেরে
ফিরতে ফিরতে সেই দুপুর সাড়ে বারোটা একটা। এই হচ্ছে দুই ভাইয়ের অভ্যেস। আজও বেরিয়ে
গেছে যথারীতি।
এদিকে
শ্যামার আজ প্রিয়ংবদাদের বাড়ি যাবার কথা। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের কাজ শেষ করে আয়নার
সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। দেখে, বাম ভুরুর নিচ থেকে কানের
লতি অবধি উনুনের কালি লেগে গেছে কখন। তাড়াতাড়ি মুছে ফেলতে চাইল তা। হাতের পিঠ দিয়ে
বার কতক ঘষে আয়নায় মুখ পরীক্ষা করল ফের। চমকে ওঠে দেখে সে কালি এখন সারা মুখে
ছড়িয়েছে প্রায়। শ্যামা শঙ্কিত চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হল, না, দেখে
ফেলেনি কেউ। তাড়াতাড়ি সাবানদানি তুলে নিয়ে চান-ঘরে ঢুকল গিয়ে।
সাবান
ঘষে প্রথমে মুখ ধুল। তারপর হাত ধুল। শেষে পায়ের দিকে নজর যেতেই দেখে বেশ নোংরা
দেখাচ্ছে তা। পায়ে সাবান মাখতে শুরু করল শ্যামা।
সহসা
বাঁদিকে একটা ছায়া পড়তেই দৃষ্টি ফেলল সেদিকে। হাতের সাবান হাতেই রয়ে গেল, চোখে
নেমে এল অন্ধকার। কাঁধে গামছা ফেলে সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিস্মিত সুখদেব।
শ্যামা
নিশ্চল বসে রইল ঠায়। কী করা উচিত মাথায় আসছে না। সুখদেব আচমকা হেসে ফেলে বলে উঠল, “আরে, বসে
রইলে কেন? পা ধুয়ে জায়গা ছাড়ো না জলদি!”
সম্বিৎ
ফিরে পেল শ্যামা। শুকনো হেসে পা ধুয়ে উঠে গেল তাড়াতাড়ি। ঘরে এসে শুকনো কাপড় চেপে
ভালো করে শুকোল সুখদেবের সাবান।
সুখদেব
বালতিতে নল খুলে দিয়ে জলের ধারায় চোখ ফেলে রেখেছিল একদৃষ্টে। কে জানে কী ভেবে
চলেছে। হঠাৎ দরজার নিচ গলে পায়ে এসে ঠেকল সাবানদানি। ঝট করে দরজা খুলে দেখল, বৌদি
পালিয়ে যাচ্ছে তড়িৎবেগে।
সাবানটার
দিকে অল্পক্ষণ একমনে তাকিয়ে রইল সুখদেব। তারপর সেটা তুলে নিয়ে পলায়মান শ্যামার
দিকে ছুড়ে মারল সবেগে। কিন্তু সাবান শ্যামাকে ছুঁতে পারল না। কেন কে জানে সে
মুহূর্তে ওপরের পেটমোটা মাড়ওয়ারি শেঠ এসে দাঁড়িয়েছেন সেখানে আর সাবানটা সজোরে গিয়ে
আঘাত করল তাঁর পেটে। “আরে, মেরে ফেলল রে!” বলেই পেট
চেপে বসে পড়লেন শেঠজী।
শ্যামা
চকিতে পেছন ঘুরে দাঁড়াল। সুখদেবেরও নজর এড়াল না তা। ঘাবড়ে গিয়ে দৌড়ে এসে অনেক
কষ্টে শেঠজীর তিন মনি দেহটা টেনে ওঠাতে ওঠাতে বলল, “আরে
শেঠজি, কোত্থেকে একটা বাঁদর লাফিয়ে পড়ল একটু আগেই। তার
হাতে এই সাবানটা ছিল দেখেছি।”
শেঠজী
একহাতে মাটিতে ঠেকনা দিয়ে আরেক হাতে সাবানটা কুড়িয়ে আনলেন। হাতে নিয়ে উলটেপালটে
পরখ করে একবার সুখদেবের মুখে বাঁকা দৃষ্টি ফেলে উক্তি করলেন, “সাবান
তো নতুনই দেখছি। কম সে কম ছয় আনার জিনিস দিয়ে গেল হনুমান।”
শেঠজী
সাবান পকেটে ভরে চলে গেলেন। সুখদেব আর শ্যামা চেয়ে রইল সেদিকে।
ওদিকে
প্রিয়ংবদাদের চাকর এসে দাঁড়িয়েছে শ্যামাকে নিয়ে যেতে। শ্যামা ব্যস্ত হাতে ছেলেদের
সাজিয়ে গুছিয়ে বাইরে এনে দাঁড় করাল। ভয়ে ভয়ে দেওরের সামনে গিয়ে মিনমিন করে বলল, “তোমার
রুমালটা একটু দেবে?”
“কেন? তোমারটা
কী হল?”
“নাও, রুমাল
আবার কবে ছিল আমার!”
“বেশ।
রুমাল ছাড়াই যাও তবে।”
শ্যামা
অনুনয় করল, “দাও না ভাই, অল্পক্ষণেরই
তো ব্যাপার!”
সুখদেব
গলা চড়িয়ে বলে উঠল, “না। দেব না রুমাল। যাও যেখানে যাচ্ছ।”
শ্যামা
তাড়াতাড়ি দেওরের মুখে হাত চেপে বলল, “আরে, চিল্লিও
না, ওদের
চাকর দাঁড়িয়ে আছে বাইরে!”
সুখদেব
গলা আরও এক পর্দা উঠিয়ে বলে উঠল, “জাহান্নামে যাক।”
শ্যামা
ঘাবড়ে গিয়ে বেরিয়ে গেল দ্রুত।
সাত
প্রিয়ংবদা
দিব্যি কেটে বলল, “সত্যি বলছি দিদি, কতবার
যে ওর মুখে শুনেছি, আমার বৌদির কাছে লক্ষ্মণের সীতাও তুচ্ছ। কতবার
তোমার গর্ব করতে করতে জলে ভরে গেছে ওর চোখ। তখন ধরা গলায় বলে, বৌদি
আমার বসুমতী। এমনই ধৈর্য, এমনই খোলা মন, এমনই…
শোনো না, আমায় কী বলে জানো? বলে, বৌদির
পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে জীবন সার্থক করে নিও।” বলতে বলতে তারও চোখ টলটল করতে লাগল।
শ্যামারও
গলা বুজে আসছিল। অনেক চেষ্টার পর কোনোক্রমে ভারী গলায় বলল, “কে
জানে কোন জন্মে কী পুণ্য করেছিলাম বোন যে এমন স্বামী আর দেওর পেলাম। তারা সাক্ষাৎ
দেবযোনির সৃষ্টি। পথের ধুলো রাজমুকুটে গিয়ে লেগেছে। কিন্তু মুকুট তো মুকুটই বোন, ধুলো
ধুলোই।”
সজল
কণ্ঠে প্রিয়ংবদা উত্তর দিল, “না দিদি, তুমি
দেবতার কণ্ঠের বরমালা। পথের ধুলো তো এই হতভাগী, যে
তোমার চরণের স্পর্শে পবিত্র হয়ে গেল।” বলেই শ্যামার পদধূলি মাথায় নিল প্রিয়ংবদা।
এমনি
সময় শ্যামার ছোটো খোকা প্রিয়ংবদাদের পোষা বেড়ালটাকে কোলে করে সামনে দাঁড়াল এসে।
প্রিয়ংবদা দু’হাতে কোলে টেনে নিল তাকে। দু’গালে স্নেহ চুম্বন এঁকে দিয়ে জিজ্ঞেস
করল,
“কী নাম তোমার?”
ছেলে
পালটা বলল, “না। আগে তোমার নাম বলো।”
প্রিয়ংবদা
হেসে ফেলল।
শ্যামা
বলল,
“এ তোর কাকিমা হন, বাবা। বুঝলি?” পরক্ষণেই
প্রিয়ংবদার সুন্দর শাড়িটার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, “এহ-হে-হে!
দেখেছ! শাড়িটা নোংরা করে ফেলেছে পা ডলে ডলে। নামিয়ে দাও বোন শীগগির।”
ছেলে
নতুন কাকিমার গলা আরও শক্ত করে জড়িয়ে উত্তর দিল, “উঁহু, নামব
না আমি। কিছুতেই না।”
প্রিয়ংবদা
হেসে বলল, “ছেলে আমার বিলেত যাবে পড়তে, না
রে? কী
হবি, ব্যারিস্টার?”
“উঁহু, আমি
তো প্রেসিডেন্ট হব।”
শ্যামা
হাসতে হাসতে বলল, “নাও দেখো, এখন
থেকেই তোতাপড়া করছেন কাকা।”
প্রিয়ংবদা
ম্লানমুখে বলল, “আমার দাদা আমাকে মানুষ করতে বড্ড কষ্ট করেছে
একসময়। আমার চোখের সামনে এ-দুটি মানুষের মতন মানুষ হলে বুকটা হালকা হয়। কী রে, যাবি
তো বিলেত?”
কোলে
মুখ লুকিয়ে খোকা উত্তর দিল, “না কাকিমা, কাকা
তো আমাকে আমেরিকা পাঠাবে বলেছে পড়তে। প্লেনে করে যাব। কাকিমা, তুমি
চড়েছ কখনও প্লেনে?”
এমন
সময় প্রিয়ংবদার মা এসে বললেন, “এসো মা, খাবে
এসো।”
রামশঙ্কর
প্রিয়ংবদার দাদা। বাজারে বেশ ক’টা দোকান ভিটের মালিক সে। অকালে স্ত্রী চলে গেছে।
বাড়ির কর্তা সেই।
রামশঙ্কর
ব্যস্ত হয়ে শ্যামাদের জন্যে খাবার বাড়ছিল, এমন
সময় শ্যামা এসে দাঁড়াল। রামশঙ্করের মা অন্য ঘরে কী আনতে গেলেন, শ্যামা
এসে ঝপ করে বসে পড়ল উনুনের পাশে। লুচি বেলে কড়াইতে ছেড়ে বলল, “আজ
আমি বেড়ে খাওয়াব আমার দাদাকে।”
নিজের
জন্যে বাড়া পাতে রামশঙ্করকে জোর করে খাইয়ে তবেই ছাড়ল শ্যামা। প্রিয়ংবদার দিকে তাকিয়ে
বলল,
“আয় বোন, খেয়ে নিই এবারে, জোর
খিদে পেয়েছে।”
প্রিয়ংবদার
মা অত্যন্ত আশান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মা, তাহলে
কালই রামকে আমার বড়ো জামাইয়ের কাছে পাঠাই?”
শ্যামা
ভুরু কুঁচকে বলল, “সে আবার কোন ক্ষেতের মুলো গো? আপনার
বড়ো মেয়ে যা বলবে তাই হবে।”
প্রিয়ংবদার
মার চোখে তবুও কিছুটা সন্দেহ উঁকি দিয়ে থাকবে। শ্যামা লক্ষ করে বলে উঠল, “মাসিমা, আমার
সুখুর সঙ্গে প্রিয়ংবদারই বিয়ে হবে, কথা দিয়ে গেলাম।”
রামশঙ্কর
হাত ধুয়ে এসে কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। শ্যামা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল, “দাদা, আপনার
দোকানে সাবান পাওয়া যায় না?”
“নিশ্চয়ই।
নানান রকম। দুয়েকটা কোম্পানির এজেন্সিও তো আমারই হাতে।”
শ্যামা
তর্জনী তুলে বলল, “তাহলে একটা শর্ত আছে।”
প্রিয়ংবদার
মার মুখ শুকিয়ে গেল। রামশঙ্কর ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “ক-কী
শর্ত, দিদি?”
“আপনাকে
মাসে একটা করে সাবান পাঠাতে হবে আমার জন্যে। বলুন, রাজি?”
রামশঙ্কর
হা হা করে হেসে উঠল। তার মা মাথায় হাত রেখে বললেন, “হায়
রে পাগলি!”
কিন্তু
শ্যামা গম্ভীর। দুঃখ করে বলল, “আপনি জানেন না মাসিমা, একটা
সাবানের জন্যে কী গঞ্জনা সইতে হয় আমায়।”
রামশঙ্কর
তাড়াতাড়ি বলল, “আমি আজই এক বাক্স সাবান পাঠিয়ে দিচ্ছি দিদি, ভেবো
না।”
চাকর
পেছন থেকে বলে উঠল, “হ্যাঁ, আমি
বাড়ি দিয়ে আসব বিকেলে।”
শ্যামার
বড়ো খোকা আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিল সব। সে হঠাৎ রামশঙ্করের সামনে উদয় হয়ে বলল, “মামাবাবু
মামাবাবু, সেদিন না, মা
আর কাকার মধ্যে খুব ঝগড়া হয়েছে সাবান নিয়ে।”
শ্যামা
ধমকে ওঠে বলল, “চুপ কর, নারদমুনি
কোথাকার!”
ছেলে
তাতে কান দিল না। সে বলতে লাগল, “সত্যি বলছি, মামাবাবু।
আজও যা কাণ্ডটা ঘটল না ওই সাবা...”
শ্যামা
উড়ে এসে মুখ চেপে ধরেছে ছেলের। ঘর কেঁপে উঠল হাসির শব্দে।
।। সমাপ্ত ।।
| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
|Special Puja Issue,2019 | September-October, 2019 |
| Third Year Third Issue |20Th Edition|
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post