গো .. গো ..গোয়া
শম্পা সান্যাল
(এই লেখার সমস্ত ছবি লেখিকার নিজের তোলা)
মানচিত্রে পূর্বে অধিস্থিত আমি এক্কেবারে পেট কেটে চলে এসেছি পশ্চিমে। পুরোনো গল্প উপন্যাসের পশ্চিমে যাওয়া মানে এই পশ্চিম নয়! ভৌগোলিক অবস্থানে বঙ্গোপসাগরের পাড় থেকে এসে দাঁড়িয়েছি আরব সাগরের তীরে। আরব সাগরের জল সত্যিই বেশি নোনা কিনা জানিনা তবে সবটাই নিয়ে এসেছে মধুর আস্বাদ।
ছেলে এখন প্রবাসী। কর্মস্থল মুম্বাই, অতএব সময় সুযোগ পেলে চলে আসা বাণিজ্যনগরীতে। আসলেই ছোট-খাটো ট্রিপ হয়েই যায়। পুনে কিংবা শিরডি সহ মালসেজ ঘাট এভাবেই দেখা। এবারেও ব্যতিক্রম নেই। মুশকিল একটাই, ছুটি। ঐ শনি-রবি সহ একটা দিন ছুটি নিয়েই ছেলেকে যেতে হয়। খারাপ কি! এই বা ক'জন পায়!
এবার গন্তব্যস্থল গোয়া।
গোয়া এমন একটা জায়গা, সমস্ত ভ্রমণপিপাসুদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং অবশ্যই আলাদা 'মাত্রা' সংযোজিত। আমার বা আমাদের কাছে অনেক বেশি তাৎপর্য বহন করে আনলো গোয়া প্রবেশের আগেই ,গ্লাস কোচ। সৌজন্য: কোঙ্কন রেলওয়ে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে উদ্দেশ্যে উপনীত হওয়া এক নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে এলো গ্লাস কোচ। মুম্বাই থেকে জনশতাব্দী ট্রেনের শেষ কোচ এটি। এয়ারকন্ডিশন এবং প্যান্ট্রি সহ চেয়ার কার। ভোরবেলায় ট্রেনে ওঠার পর থেকে আমরা বোধহয় সব যাত্রীই উত্তেজনা প্রকাশে ছেলেমানুষী করেছি। খ্যাচ্ খ্যাচ্ শব্দের বিরাম নেই। যতজন যাত্রী, ততজনই তো ফটোগ্ৰাফার! ভেজ- নন ভেজের অর্ডার চলছে, সঙ্গে চা-কফি তো অবশ্যই। চেয়ারের অ্যারেঞ্জমেন্ট যথেষ্ট ভালো। একসঙ্গে মুখোমুখি হতে চাইলে ঘুরিয়ে নাও চেয়ার। সব চেয়ারের পিছনে প্লেনের মতো টেবল্ আছে। সর্বশেষ কোচেরও আবার শেষ অংশটুকু আলাদা মাত্রা সংযোজন করে। ওখানেও দাঁড়িয়ে যেতে পারো, ইচ্ছে হলে। মাঝে কয়েকটি স্টেশনে দাঁড়িয়েছে ট্রেন। এরমধ্যে রত্নগিরি স্টেশনে মিনিট পাঁচেক দাঁড়ায়। আমার কর্তা
তো রত্নগিরি করে পাগল, কেন কে জানে! -আরে চলো! একটু নামি তো! -আচ্ছা, বেশ চলো। ছেলে দেখেশুনে দুজনকে দাঁড় করিয়ে খ্যাচ্। একসঙ্গে চারজন মিলে কোথাও যাওয়া আমাদের এই প্রথম, আর তাই আনন্দটাও অনেক বেশি। পুত্রবধূ অঙ্কিতার সঙ্গে আমি আগে গেছি তবে এবার সুদীপের পক্ষে সম্ভব হয়েছে একত্রিত হওয়া। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত পরিবেশের মাঝে আরেকটি বিষয় টানেল। অন্ততঃ আঠাশ- তিরিশটা টানেল পেরিয়ে যেতে হয় আর তাই নেটওয়ার্কও সেইমতো লুকোচুরি খেলে চললো। এই আছে, এই নেই।
বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ এসে পৌছালাম মাডগাঁও। ক্যাবে করে এবার নির্দিষ্ট রিসোর্টে যাওয়া। উৎসুক হয়ে দেখছি সম্পূর্ণ অচেনা আমাদের এক রাজ্যকে। কেন্দ্রশাসিত থেকে এখন পূর্ণ রাজ্য। একসময় পর্তুগিজদের অধীনস্থ মানচিত্রে এতোটুকুই জায়গা পায়। সবুজে সবুজ চারপাশ। ছেলে যেখানে থাকার ছেলে
যেখানে থাকার ব্যবস্থা করেছে, ঢোকার পর মনে হলো কোনো নার্সারিতে থাকবো বোধহয়! কেয়ারী করা সুন্দর বাগান থাকে। এখানে যত্ন- অযত্নের মিশেলে এমনই এক পরিবেশ! পাতার বাহার কিছু আমিও দেখাই,
দেখেছিও তবে এতোরকম!! তারসাথে কতো রকমের যে গাছ! ঘরে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা আছে। সব জায়গায় আগেই জানতে হয় ফ্রিজ আছে কিনা কারণ ইনসুলিন। সুদীপের জন্য। ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়লাম আমরা। দশ মিনিট দূরত্বে যে বিচ আছে সেটি একটু ফাঁকা। অগত্যা একটু দূরের বিচেই চলো। ড্রাইভিং জানলে গাড়ি ভাড়া নেওয়া যায় তবে আমি রাজী হলাম না। সুদীপও দেখলাম আমার কথায় সায় দিলো। রাস্তা ভালো তবে একদম নতুন আর বিশেষ করে সুদীপ কিছুই উপভোগ করতে পারবে না ।গোয়াতে বেশ কয়েকটি বিচ দর্শনীয়। আমরা রয়েছি দক্ষিণ গোয়ার Benaulim Beach এ। সন্ধ্যে তো আর হয়ই না। সমুদ্রের কাছে গেলে চপলতা ছোঁবেই ছোঁবে। বয়স ভুলিয়ে
দেয় উচ্ছশিত জলরাশি। নতুন করে যেন পাওয়া! প্রতিবারই সমুদ্রে গেলে ঝিনুক কুড়োতেই হবে। নানান আকারের, নানান রঙের ঝিনুক কুড়োতে লাগলাম।
পরে যে ওগুলো কোথায় যাবে! কাল মাত্র একটা দিনই আমাদের হাতে। আরো একটা দিন হলে অবশ্যই ভালো হতো তবে ছেলে এখন ছুটি নিচ্ছে না পুজোতে বাড়ি যাবে বলে। সন্ধ্যের পর আমরা ছাড়া মনে হচ্ছে রিসোর্টে কেউ নেই। ঘরের মধ্যে আমাদের আওয়াজই যথেষ্ট। ডাইনিং হলে আর যেতে ইচ্ছে করছে না, নো প্রবলেম। ঘরেই সার্ভিস পেলাম। পরদিন সকালে আমি আর সুদীপ ব্যালকনিতে বসে চা খেয়ে রিসোর্ট ঘুরে দেখলাম। সত্যিই মনে হচ্ছে, যেন কোনো বাড়িতেবেড়াতে এসেছি।না, যদিও এটা home stay নয়। সাতটায় গাড়ি বলা ছিল কিন্তু এমন বৃষ্টি যে পিছিয়ে দিতে হলো সময়। ঘড়ি ধরে চলা জীবনে সুযোগ এলে লাগামছাড়া হবেই। বৃষ্টি একটু কমতেই সাগর- সঙ্গমে। ওরা তিনজন একটু একটু নামছে, দ্রুত একজন বাঁশি বাজিয়ে জানিয়ে দিলো, ঐ স্থান নিরাপদ নয়। দেখিয়ে দিলো একটু দূরের দিকে। আমি বসে বসে আবারও দেখছি আর ভাবছি, এবছর সাগরের সঙ্গে জড়িয়ে আছি যেন! পুরী বাতিল হয়ে গেছিল তাই দিঘা গেছিলাম মে মাসে। ধারণা ছিল আরব সাগর শান্ত, তবে আমার ধারণাকে চুরমার করে তার যে ভয়ঙ্কর রূপ দেখালো!! ব্রেকফাস্ট করে গোয়া দর্শনে রওনা হলাম। প্রথম গন্তব্য, গোয়ার বিশেষ দ্রষ্টব্য অন্যতম চার্চ Basilica of Bom Jesus
বিখ্যাত রোমান ক্যাথলিক গির্জা যেখানে St Francis Xavier শায়িত আছেন।
World heritage এ অন্তর্ভুক্ত। রবিবার, অতএব বেশ ভীর। প্রবল বর্ষণে কোনোরকমে দৌঁড়ে ঢোকা। গাইডের সাহায্যে ঘুরে ঘুরে দেখা হলো সব। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। চার্চের থেকে বের হওয়ার আগেই স্টল একটা মাঝারি সাইজের মোমবাতি বাহাত্তর টাকা! নিলাম তবে মনে মনে ভাবলাম, হিন্দুদের দোষ দিই কেন আর! দেখেশুনে এবার চলো ফোর্ট দর্শনে। আধ্যাত্মিক পটভূমি ছেড়ে কঠোর বাস্তবকে নেওয়া আমাদের জন্য অনেকটাই সহজ কিন্তু সিঁড়ি দেখে বীরাঙ্গনা কিঞ্চিৎ ভীত। লক্ষৌ-র অভিজ্ঞতা মনে করে ভয় পাচ্ছিলাম তবে না, এখানে সিঁড়ি মোটামুটি ঠিকঠাক। নীচে লাইট হাউসের ছবি দিয়েছি, যেখানে
অনেকগুলো সিঁড়ি চড়তে হবে, সৌভাগ্য, চড়তে
হয়নি আমাদের।Fort Aguada__1612 তে তৈরি। ঐ সময় বাণিজ্য জাহাজের জন্য দিকনির্দেশনা মিলতো এই ফোর্টের সৌজন্যে। আগুয়াডা__মানে জল। পরিশ্রুত জলের জন্য জল-যানের আগমনের জন্যই এই ফোর্টের নামে জলের ছোঁয়া। সমুদ্র তীরবর্তী ফোর্টের উপরেই কেবল যাওয়া চলে। জালি দিয়ে দেখা যাচ্ছে কোথাও সিঁড়ি, কোথাও দীর্ঘ জলের লাইন। মেরামতিও চলছে। খ্যাচ্ খ্যাচ্ করতে করতে দৌড়াই অল্প সময়ের মধ্যে যতোটুকু খেতে পারি আরকি!
ফোর্ট থেকে দেখা যায় Sinquerim Beach আর এখন যেখানে দাঁড়িয়ে সেটি Candolim Beach। ছোট্ট একটা বাঁকে গিয়ে এই দুই বিচ মিশে আছে আর আমি ঠিক এখানেই পেয়ে গেলাম গোয়া বলতেই যে ছবি মনে ভাসে,
প্রথমেই যে ছবি দিয়েছি।অনেক
হয়েছে, এবার বাঙালি খাবে। চার্জ দিতে হবে কিনা! চলে এলাম Calangute Beach এ। জমজমাট বাজার দেখে আমার তো খাওয়ায় মন নেই।বিচটাও দারুণ তবে জোয়ার এসেছে। অত্যন্ত তৎপর প্রশাসন কঠোর হাতে সামলাচ্ছে যাতে কোনো অঘটন না ঘটে। বেশিক্ষণ তো আমরা থাকতেও পারবো না। ক্রুজে চড়তে হবে তো! সমুদ্র সৈকতে গোয়ার আরো একটি আকর্ষণ মান্ডভী নদী। ঘুরে ফিরে সে বয়ে চলবে আপনার সঙ্গে। ঝর্ণা হয়ে সে 'দুধসাগর' -এ পরিণত। বিশাল একাধিক ক্রুজ মূলতঃ ক্যাসিনো। যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত যা আমার পুরোনো স্মৃতি বলে-লঞ্চ। মাথাপিছু পাঁচশো টাকায় একঘন্টা নদীবক্ষে বিচরণে মেলে আদিবাসী নৃত্য আবার ডিস্কো থেকও। আপাততঃ আমাদের ছোট্ট সফরের শেষে এসে পড়েছি। সময়াভাবে আমাদের রিসোর্ট থেকে একঘন্টার দূরত্বে হওয়া স্বত্ত্বেও দেখা হলো না Spice Farm এবং রামকৃষ্ণ মিশন। বাকী রয়ে গেল একাধিক বিচ, মিউজিয়াম ইত্যাদি। আমরা যখন কোথাও যাই, সব দেখে আসতে কি পারি!! দক্ষিণ গোয়াতেই
রয়েছে Palolem very popular beach.
patnem তাকে ভাগ করেছে Rajbag. বিদেশীদের একচ্ছত্র আধিপত্য এখানেই। অবশ্যই ধনী এদেশীরাও আছেন। সবমিলিয়ে আমার মনে হয়েছে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য নানান বিচকে তুলে ধরা হয়েছে। ট্যুরিজমের সার্থক প্রয়াস। উত্তর গোয়ায় Panjim(Panaji) অত্যন্ত পুরোনো ঐতিহাসিক এবং সংস্কৃতি ধন্য রাজ্যের রাজধানী। সারা রাজ্যে সুবিখ্যাত চার্চ রয়েছে। সম্ভব নয় সব দেখা। যা পেলাম যত্নে লালিত থাকবে আজীবন সঙ্গে সঙ্গে এটাও ভুলবো না-গোয়ায় এসে আমি আবার শৈশবকে খুঁজে পেয়েছিলাম। ছেলে তো প্রথমেই আমাদের দুজনের পোষাক নিয়ে চিন্তান্বিত; এরপর আমার জুটলো মানানোসই চটি। আহ্লাদে আট না আশি, ভাগ্যে সইলে তো!
-ওরে বাবা! দাঁড়া রে!
-কেন! কি হয়েছে?
-বলবে তো আগে! দাঁড়াও।
নতুন জুতোর অবদানে পা সজ্জিত হয়ে খুশি নয়, তাই দু- পায়ে ব্যান্দ-এইড শোভা বিস্তার করলো। মনে পড়লো, পুজোর সময় বাটার 'জয়' জুতো পরে বেরিয়ে আসতাম জুতোকে হাফ-স্যান্ডেল করে। শেষমেষ রক্ষাকর্তী আমার বৌমা চটি বিনিময়ে আমাকে যে আনন্দ দিলো!!
ফেরার সময় নরম্যাল কোচ। সকাল সাড়ে আটটায় ছেড়েছে। ভালো লাগছে না আর। এখন মনে হচ্ছে কখন গিয়ে বাড়ি পৌঁছোবো। রত্নগিরি আসতেই ছেলে চলো আবার তোমাদের ফটো তুলবো।
-চলো না রে বাবা!
-খোঁড়াতে খোঁড়াতে দেখবি আমি ট্রেনে উঠতে পারলাম না। বেশ হবে।
-আরে, যে কোনো কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়বে!
আবার যুগলে লেন্সবন্দী। নির্দিষ্ট কোচে ফিরেও এলাম।
হ্যাঁ, এবার আমাদের বাসস্থলের কথা একটু বলি।
Palm Grove Cottage located in between main Benaulim beach &
Trinity (Vadi beach). Complimentary breakfast আজকাল সব হোটেলেই থাকে, এখানেও আছে। আর সব প্রায় একই রকম। ছোট লাইব্রেরী আছে, যদিও সময় পাইনি দেখার। প্রথমে ঢোকার পর সাদর অভ্যর্থনার মাঝে চমকে উঠলাম একজন বৃদ্ধের আপ্যায়নে ; যেন ভি.বালসারা এসে দাঁড়িয়েছেন। ভালো লেগেছে, কোনো হোটেল বলে মনে হয়নি একবারও। গোয়ানিজ গ্ৰামের ছোঁয়ায় পাড়ার মধ্যে দিয়ে নিজের ঘরে পৌঁছে যাওয়া যেন। স্টেশন থেকে একটু দূরও তাই।আতিথেয়তা ঠিকঠাক। অল্প বয়সী একটি ছেলে আমাদের ড্রাইভার ছিল। অসম্ভব ভালো ড্রাইভ করে এবং ব্যবহারও খুব খুব ভালো। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অর্থাৎ দক্ষিণ-উত্তর, ফিরে উত্তর.... অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দ্রুত গতিতে এগিয়ে গিয়ে যতোটা সম্ভব আমাদের ঘুরিয়ে রাতে
যখন ছেড়ে যাচ্ছে, সারাদিনের সারথিকে ছাড়তে মনখারাপ হচ্ছে। -বাই আন্টি। বাই আঙ্কেল। মনে মনে বলি-ভালো থাকিস বাবু।ঘরে ড্রয়ারের ভিতরে বাইবেল রাখা। পুরোনো, নতুন মিশেলে কমপ্লিট এডিশন। ভিতরে পেয়ে গেলাম যিশুখ্রিস্টের ছবি। চাইতেই পেয়ে গেলাম। এ ছবি কিছু দুর্লভ নয়, তবে কেন নিলাম!??
।। সমাপ্ত ।।
| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
|Special Puja Issue,2019 | September-October, 2019 |
| Third Year Third Issue |20Th Edition|
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post