প্রত্যয়
শম্পা সান্যাল
Image Courtesy: Google Image Gallery |
লক্
খুলে দরজা ঠেলে হিরক ঘরে ঢুকে ঘুরে দাঁড়ায়। গাঢ় স্বরে বলে-এসো!
দাঁড়িয়ে আছো কেন!
সদ্য
পরিণীতার মতো আত্রেয়ী ঘরে ঢোকে। উচ্ছল পিকু দুই হাতে ট্রলি নিয়ে আসতেই হিরক বলে-ওয়েলকাম, জুনিয়র!
তারপর হাসতে হাসতে বলে-যা দ্যাখ্, বাঁ
দিকের ঘরটা তোর। লাগেজ একেবারে ওখানেই রাখ্।
আয়েত্রীর
চোখ দ্রুত মেপে নিচ্ছে চারপাশ। ফ্ল্যাটে ড্রয়িং-ডাইনিং একসাথে থাকে বেশিরভাগ; এই
ফ্ল্যাটটায় সেরকম নয়।
-এই
দ্যাখো এটা ড্রয়িং রুম। আমার মতো করে রাখা সব। এবার তুমি সাজিও যেমন খুশী। এদিকে
এসো। গেস্ট-রুম আর এটা হলো পিকুর ঘর। কি! ঠিকঠাক!
পিকু আড়াআড়ি বিছানায় চিৎপটাং।
-এই, কিরে!
হাত- পা না ধুয়েই
-আরে
বাবা! সোজা তো গাড়িতেই এলাম।
হিরক
হাসে। বলে-ছাড়ো! এসো এদিকে। সুন্দর সাজানো, বোঝাই
যাচ্ছে বেডরুম। হিরক মুখভঙ্গি করে চোখ নাচিয়ে
' কেমন' প্রশ্ন করতে করতে ঘরের
অন্যদিকের দরজা খোলে।
-ওদিকেও
ঘর?
-এসো
তো!
দোলনা
ঝুলছে। বেশ বড় ব্যালকনি। রেলিং ধরে নীচের দিকে তাকায়। এগারো তলা থেকে বাধাহীন কতদূর অবধি চোখ যায়। পিকুও এসে
দাঁড়িয়েছে।
-ওয়াও!
বাপী। ব্যালকনিটা তো ব্যাপক!
-তোর
ঘরের সাথেও তো আছে।
-হ্যা
দেখলাম তো! তবে ওটা পুরো ঘিরে খাঁচা বানিয়ে দিয়েছো!
হিরক
হাসে। -এখনই
তুমি ওড়ার অনুমতি পাবে না স্যর্।
তিনজনের
মুখেই তৃপ্তির হাসি।
হিরক
বলে-তোমরা
ফ্রেস হয়ে নাও। আমি কফি আনছি।
-না, না।
তুমি কেন!
-আরে
ম্যাডাম! কিচেনে ইন করে দায়িত্ব নেবেন। এখনো আমিই ইন- চার্জ এ আছি কিনা! বলে
হাসতে হাসতে হিরক চলে যায়।
বছর
তিনেক আগে এই ফ্ল্যাটটা কিনে একটু একটু করে সাজিয়েছে। হিরকের মুখে তৃপ্তির হাসি।
আদরে, বিলাসিতায়
একা একা বড় হওয়া আত্রেয়ীর হিরকের সঙ্গে আলাপ, ঠিক
আলাপও নয়, এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা। বাবার দারুণ
ভালো লেগে গেল হিরককে। ঐবাড়ির কারো সূত্রে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিল। ইদানিং
বাড়িতে আত্রেয়ীর বিয়ের প্রসঙ্গ শুরু হয়েছে। হিরক দেখতে শুনতে ভালো, সর্বোপরি
এই বয়সেই কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এমন পদে আসীন ; বাবা-মা, দাদা
বারুইপুরের বাড়িতে থাকেন। শিক্ষিত, ভদ্র পরিবার। হিরক সম্প্রতি
কোলকাতায় পোস্টিং পেয়ে এসেছে। হিরকের পরিবারেও ওর বিয়ে নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।
সবদিক দিয়ে উভয়পক্ষ সন্তুষ্ট, অতএব, দুই-হাত
এক হয়ে গেল নির্বিঘ্নে। অষ্টমঙ্গলা সেরে ফিরেছে, আত্রেয়ী
পরেরদিন সকালে রান্নাঘরে ঢুকতে যেতেই শ্বাশুড়ি এবং রাঁধুনি সমস্বরে-আরে, বাসীকাপড়
তো! বাইরে বসো। তোমার চা দিচ্ছি।
-না, আমি
একটু গরম জল চাইছিলাম।
-সেতো
বাথরুমে গিজার আছে!
পিত্তি
জ্বলে যায়। অপ্রসন্ন মুখে আত্রেয়ী বলে-খাবো।
-চা
খাবে না!
-আগে
গরম জল খাবো। হবে কি!
শ্বাশুড়ি-
রাঁধুনি আবারো দৃষ্টি বিনিময়। শ্বাশুড়ি একটু রুষ্ট স্বরে বলেন-হবে
না কেন! মিনুর মা, একটু জল গরম করে দাও। আর ছোটবৌমা শোনো, ঐ
পোষাকে বাইরে আসবে না। আর সকালে উঠে বাসী কাপড়
ছেড়ে শাড়ী পরে নীচে চলে আসবে। মেজোবৌমার হাতে হাতে সাহায্য করে দেবে। আত্রেয়ী
অবাক হয়ে যায়। নাইটির উপরে হাউসকোট পরা। কি খারাপ!
ঘরে
এসে গজগজ করে-কোথায় এসে পড়লাম রে বাবা! বাপী দেখলো না, শুনলো
না!
হিরকের
ঘুম ভেঙ্গে যায়।
-এই!
কি হলো!
-কিচ্ছু
না। ঘুমাও তুমি। বাব্বা! আমি যেন অচ্ছুৎ!
হিরক
ছোটবৌদির দেওর, বন্ধু সব।
সব শুনে বলে-বৌদি প্লীজ একটু দেখিয়ে শুনিয়ে দিও। এক
পরিবার থেকে অন্য পরিবারের নিয়ম-কানুন আলাদা হবেই। ওকে একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে নিও।
প্রথম থেকেই হিরকের পরিবারের সঙ্গে
আত্রেয়ীর ছন্দভঙ্গ সম্পর্ক তৈরী হলো।
আত্রেয়ীর
মা-বাবা প্রথম জামাই ষষ্ঠীতে এসি উপহার দিলেন। সোজা কথা মেয়ের কষ্টের কথা বুঝে বা
জেনে। হিরক কিছুতেই নিজেদের ঘরে লাগাতে রাজী
তো হলোই না ; বাবা-মায়ের ঘরে লাগিয়ে দিলো। আত্রেয়ীর সঙ্গে
এ প্রসঙ্গে কোনো কথাও বললো না। আত্রেয়ী প্রবল বিরক্ত
-আমার
বাবার দেওয়া
-হ্যাঁ,জা মাইষষ্ঠীতে
আমাকে গিফ্ট দিয়েছেন, তাই না! আমার বাবার ঘরে লাগিয়েছি। তো? অবশ্য
আগে জানতে পারলে আমি বারণ করতাম ওঁনাদের। আচ্ছা! তুমি তো জানতে? বারণ করলে না কেন?
-আশ্চর্য!
কেন বারণ করবো!
-একারণেই
করা উচিৎ ছিল যে, গরমে আমরা আরামে থাকবো, আর
বাড়ির সবাই বিশেষ করে বাবা-মা
-সে
কিনে লাগালেই হয়! আমার বাপী তো সবার জন্য দিতে পারে না!
-দিতেই
হবে না। এবার থেকে এরকম উপহার দিতে না করবে।
বাবা-মাও
প্রবল অস্বস্তিতে। হিরককে বারণ করেছিলেন। বড়দা এখানে থাকে না। ছোড়দার সঙ্গে কথা
বলে অবশেষে আর দুই ঘরেই এসি ঢুকলো।
দেখেশুনে আত্রেয়ী কিছুদিন গুম্ মেরে থাকলো।
বাপের বাড়ি গেলে আসার নাম করে না।
আসলেও সংসারে সেভাবে যুক্ত হয়না। মানসিকতার ভারসাম্যের অভাব পদে পদে। আত্রেয়ীর
বিরুদ্ধে নিত্য মায়ের অভিযোগ। অথচ ভিন্ন স্বাদের রান্না করে যখন আত্রেয়ী, বাড়ির
সবাই সেসব উপভোগ করলেও মায়ের পছন্দ হয় না। উল্টে -ও!
এতো কিছু দিয়ে রান্না করলে ঘাসও রেঁধে
খাওয়া যায়!
এই
নিয়ে আত্রেয়ীর যথারীতি হিরকের কাছে অভিযোগ। নিজের ব্যস্তময় জীবনে এ উৎপাতে বিরক্ত হয়ে মাকে বলেই ফেলে একসময় হিরক-আমি
নিজে দেখে বিয়ে করেছি! ছোট ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে দামী দামী জিনিসপত্র তো তখন
পাঁচজনকে দেখাতে খুব ভালো লাগছিল। থাকো ঐ নিয়ে।
-তোর
দাদাদের দেখে বিয়ে দিইনি! বড়বৌমা, মেজোবৌমা এরা কি হাভাতে
ঘরের! বিবাহবার্ষিকী মানাবি তারজন্য কোলকাতায় যেতে হবে? কেন, বাড়িতে
সবাইকে নিয়ে আনন্দ করা যায় না!
-বাড়ির
সবাইকে নিয়েই তো হচ্ছে মা!
-না।
আমি আর তোমার বাবা যাবো না।
-কেন!!
-আমাদের
আর টানাটানি করো না। ঐ আদিখ্যেতা দেখার ইচ্ছে নেই আমার।
-এরকম
করলে তো মা একসাথে থাকা যায় না!
-কি!
ও! আচ্ছা! আমরাই সমস্যা তাই তো!
মায়ের
কথায় বাবাও বিরক্ত হন।
-উফফ্, আজকালকার
ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একটু মানিয়ে চলতে তো হবেই। সবকিছুতে আপত্তি করলে চলে না উমা।
আসলে সবার সুবিধার্থে কোলকাতায় এক হোটেলে
আয়োজন। মার অনিচ্ছা নেই। রয়েছে এতোগুলো টাকা এভাবে খরচে আপত্তি।
বড়দা
কর্মসূত্রে এখন ব্যাঙ্গালোরে থাকে। হিরকেরও
বদলির চাকরি। তাই কোলকাতায় পোস্টিং পেয়ে অসুবিধা হলেও সবার সাথে থাকার জন্যই
বাড়ি থেকে অফিসে যায়-আসে। শেষমেষ ছোটবৌদির পরামর্শে হিরক অফিস থেকে প্রাপ্ত
বাড়ি নেয়। শুরু হয় আর একপ্রস্থ অশান্তি। হিরককেই উদ্যোগ নিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে
বাড়ির সবার অনুমতি আদায় করতে হয়।
নিজের সংসারকে আত্রেয়ী মায়ের সাহায্যে
মনমতো করে সাজায়। হিরককে প্রায়ই অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়। ফ্ল্যাট বন্ধ করে
আত্রেয়ীও বাপের বাড়ি চলে যায়। প্রথম প্রথম বারুইপুরে হিরক আত্রেয়ীকে নিয়ে
গেলেও আত্রেয়ীর অনিচ্ছা বুঝে এখন একাই যায়। মা, ঘুরিয়ে
আত্রেয়ীকে নিয়ে কথা তোলে। চুপচাপ শোনে। মা-ও যদি একটু বুঝতেন!এরমধ্যে বাবা
অসুস্থ, প্রোস্টেটের প্রবলেম। হিরক ওর ওখানে থেকে
চিকিৎসা করানোর কথা বলে ফিরে আত্রেয়ীকে বলতেই আত্রেয়ী বিরক্ত।
-কেন!
ওখানে ওরা অতোজন আছে আর এখানে তো
হিরকের
সংক্ষিপ্ত উত্তর-আমার বাবার চিকিৎসা এখানে থেকেই হবে।
হিরকের
দৃঢ়তার পরিচয় আত্রেয়ী আগেই পেয়েছে। তাই আর কথা এগোলো না।
শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আসলে শ্বাশুড়িকে আত্রেয়ী বলে-মা, রান্নার
লোক আপনার মতোন এঁটো কাঁটা মানে না। একটু মানিয়ে নেবেন। মনে মনে বলে-আমাকেও
মানিয়ে নিতে বলতে না! হুঁ ,হুঁ বোঝো এবার!
-না।
বাড়ির বাইরে আমি ওসব নিয়ে ভাবিনা। তুমি চিন্তা করো না।
ও
বাবা! আচ্ছা জিনিস তো! আত্রেয়ী একটু দমে যায়।
শ্বশুরমশাইকে
ডাক্তার দেখানো, নার্সিংহোমে রেখে অপারেশন, পোস্ট
অপারেশন পিরিয়ড সব মিলিয়ে দু-আড়াই মাস শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সহ থাকতে বাধ্য হয়
আত্রেয়ী। এরমধ্যে আত্মীয় স্বজন আসছে দেখতে। প্রায় রাতেই হিরকের সঙ্গে অশান্তি।
আত্রেয়ী অবাক হয়ে যায় একদিন সকালে ; হিরক বাবা-মাকে বলে-এখন
তো বাবা তুমি অনেকটা ফিট, তাইতো!
-এ্যা
হ্যাঁ , এবার বাড়ি চলে গেলেই হয়।
-আর
একটা চেক-আপ আছে বাবা। মা, রান্নার লোক, কাজের
লোক তো আছে। আত্রেয়ী তাহলে ক'দিনের জন্য বাড়ি যাক্! কি!
অসুবিধা হবে?
-না, না
আমার কোনো অসুবিধা নেই। বৌমা বাপের বাড়ি গেলে যাক্ না!
হতভম্ব
আত্রেয়ী বলে-আমি বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা কখন বললাম! তুমি
হঠাৎ করে কি বলছো!
-না।
বলোনি। আমিই বলছি।
-সেটা
আমি বুঝবো।
শ্বশুর-শ্বাশুড়ি
পরবর্তী চেক-আপের পর চলে গেলেন। হিরক আত্রেয়ীর মনোভাব বুঝে আর থাকার অনুরোধ করলো
না। বাবা-মাও স্বচ্ছন্দে থাকতে পারছিলেন না। চলে গেলেন।
আত্রেয়ী
সন্তানসম্ভবা।
হিরক
উৎফুল্ল ; -উফফ্, আমি বাবা হবো! ভাবতেই কেমন
লাগছে! আনন্দে আত্রেয়ীকে জড়িয়ে ধরে বলে, দারুণ
খুশি তাই না!
-না!
দ্যুৎ! ভাল্লাগেনা! বিয়ের পরে সবাই কতো
ঘোরে। আনন্দ করে। আর আমার দ্যাখো!
-তুমি
খুশি নও!!
-এতো
তাড়াতাড়ি আমি চাইনি। কোথায় একটু ঘুরবো, আনন্দ
করবো!
-এই
দেড় বছরের মধ্যে আমরা তো গেছি!
-হ্যা, ঐ
হানিমুনে যাওয়া! ওটা কি ঘোরা হলো!
-হলো
না! মানে ওটা বেড়াতে যাওয়া নয়! তারপর বন্ধুরা মিলে ফ্রেজারগঞ্জে গেলাম। অফিস
থেকে রায়চক।
মুখে
অসন্তুষ্ট প্রকাশ করলেও ক্রমশঃ আত্রেয়ী
পরিস্থিতি মেনে নিলো। দুই পরিবারের আনন্দে এখন বরং খুশীই আছে
কিন্তু এইসঙ্গে নতুন সমস্যাও এলো। হিরকের
ছোড়দা-ছোটবৌদি বিয়ের পাঁচবছর পর
আজো নিঃসন্তান। ডাক্তার, চিকিৎসায় গত দুবছরে কম
পয়সা খরচ করেনি ছোড়দা। তিনভাই- এর মধ্যে ওর আয়টা একটু কম, তবু
কম চেষ্টা করছে না। আত্রেয়ীকে দেখছেন কোলকাতার নামকরা গাইনোকোলজিস্ট। হিরক
ছোটবৌদিকে ওর ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো ঐ
ডাক্তারকে দিয়ে দেখাবে বলে। আত্রেয়ী বাপের বাড়ি রয়েছে। ডাক্তার সবরকম ভাবে
পরীক্ষা করে রায় দিলেন, রয়েছে
ছোড়দার সমস্যা। ওষুধে কাজ হওয়া মুশকিল। শেষ চেষ্টা করতে পারেন, সফলতার
গ্যারান্টি যদিও দিতে পারছেন না। হিরক আলাদা করে কথা বলে বোঝে ছোড়দার সমস্যা গভীর। তবুও একটা চেষ্টা-IUI (Intra Uterine
Insemination) ছোট একটি অপারেশন হয়ে যায়। নির্ধারিত সময়ের
অল্প কিছু আগে আত্রেয়ী ছেলের জন্ম দেয়।
আনন্দিত হিরকের এর মধ্যেও একটা চাপা
দুঃখ। ছোটবৌদির প্রথম অপারেশন সাকসেস হয়নি; দ্বিতীয়বার
করতে হবে। এই ভয়টা হিরকের ছিলই, ডক্তরের সঙ্গে কথা বলে
ছোড়দাকে বোঝায়। এবার ছোটবৌদির IVF হয়। হিরকের উদ্যোগে ছোটবৌদির জন্য চিকিৎসা-সংক্রান্ত খরচ করা; আত্রেয়ীর
যা মানসিকতা, অশান্তি আনবেই। সন্ত্রস্ত হিরক দেখে, আত্রেয়ীর
তেমন কোনো ভাবপ্রকাশ নেই। নিশ্চিন্তে অন্নপ্রাশনের জন্য আত্রেয়ী-ছেলেকে নিয়ে
বাড়ি আসে। অনেকদিন বাদে সব মনোমালিন্য ভুলে সবাই আনন্দে একত্রিত। আর এই সময়ই
ছোটবোদি সন্তানসম্ভবা বোঝা যায়। সবাই যখন উপরি পাওনায় উল্লাসে, আত্রেয়ী
আক্রান্ত সন্দেহ রোগে। ফল, আবারও অশান্তি। ভুলটা
হিরকেরই, সবকথা আত্রেয়ীকে জানিয়েছিল। সেটা যে এভাবে
আঘাত হয়ে আসবে, চিন্তাতেও আসেনি। আত্রেয়ী ছোড়দার অক্ষমতা
জানে। কি অপারেশন হয়েছে তাও জানে। তবু ওর ধারণা-হিরকের
সৌজন্যে ছোট বৌদি সন্তানসম্ভবা। এতোদিন সহ্য করতে করতে হিরক ক্লান্ত। এবার আর চুপ
থাকা সম্ভব হলো না। অন্নপ্রাশন মিটে যেতেই অশান্তির হাত ধরে আত্রেয়ী চলে এলো
বাপের বাড়ি। আত্রেয়ীর বাবা-মা বিপদের গন্ধ পেয়ে এবার সচেতন। জামাই- এর সঙ্গে
কথা বলেন। হিরকেরও ছেলেটার জন্য কষ্ট হয় ; সম্পর্কে
ছেদ টানার কথা ভাবতে গিয়েও তাই সেদিকে হিরক যায় না। দূরে থাকলে সমস্যা মিটবে এই
আশায় সময়ের আগেই ট্র্যান্সফার নেয়। যথাসময়ে ছোটবৌদিরও ছেলে হয়। ছোটবৌদি
বরাবর বন্ধু-সম। অভিমান করে বলে-ভাইপোর কি দোষ! একবারটি ওকে
দেখতে আসবে না! আত্রেয়ীকে বলতেই সহজ গলায় বলে-অন্নপ্রাশনে
যাবো। এখন গেলে তো ! হিরকও ভেবে দেখে আত্রেয়ী ঠিকই বলছে। সত্যি, ছুটি
তো একটা বড় ব্যাপার। তাল কাটলো সেই ছোটবৌদিই। ছেলের চারমাস বয়স। এখন নাকি সবাই
বলে, একদম
হিরকের আদল পেয়েছে ছেলে। তাই ছবিও পাঠিয়েছে।
আত্রেয়ীকে হিরক দেখিয়ে বললো-দ্যাখো, তোমার
ছেলে তোমার মুখ পেয়েছে। আর এ ব্যাটা কাকার!!
ব্যাঙ্গের
হাসি হেসে আত্রেয়ী বলে বসে-কাকা না বাবা! আবারো উঠে আসে পুরোনো সন্দেহের জের। ধৈর্যের
বাঁধ ভেঙ্গে গেল হিরকের। আগেরবার অসহ্য লাগলেও সবদিক ভেবে মিটিয়ে নিয়েছিল হিরক ; আজ
মনে হচ্ছে মস্ত ভুল করেছে! চূড়ান্ত অশান্তি আর যেটা হওয়ার ছিল, হলো
সেটাই। আত্রেয়ী ছেলেকে নিয়ে চলে গেল বাপের বাড়ি। আবার।
সময়ের সাথে সাথে হিরকের মা-বাবা গত, গত
আত্রেয়ীর বাবা। আত্রেয়ীর বাবা মা জামাই- এর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন নিয়মিত।
শ্বশুরমশাই অনুতাপ করে বলতেন "দোষ আমাদেরই।
বড় বেশি আদর দেওয়া ওকে আজকের পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে।" হিরকও দৃঢ় ভাবে শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে জানিয়েছিল, "ওর
বাবা মা ,কি পরিবার, তাদের
ত্যাগ করে চলতে পারবে না। আত্রেয়ীকে থাকতে হলে আমার পরিবারকে নিয়েই থাকতে হবে।
ছেলের প্রতি দায়িত্ব যতটুকু সম্ভব করবে।"
আত্রেয়ীকে
ওর বাবা-মা অনেক বুঝিয়েছিলেন ঠিকই ,কিন্তু অনেক আগেই সচেতন হওয়ার
দরকার ছিল সেশিক্ষাও পেলেন। হিরক সবার
অনুরোধে আত্রেয়ীর সঙ্গে কথা বলে, আত্রেয়ী ওর জেদেই থেকে যায়
; কেবলমাত্র
হেরে যাবে, ছোট হবে
এসব ভাবনাই আত্রেয়ীকে অনড় রাখলো ; অথচ
একটু নরম হলেই কিন্তু জীবন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতো। অহং বোধ এইভাবেই বুদ্ধিবিনাশ
ঘটায়। বাবা চলে যাওয়ার পর আত্রেয়ীর মা উঠে পড়ে লাগলেন দুজনকে একত্রিত করার
জন্য। ইতিমধ্যে ছেলেও অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। বাবা আছে আবার নেই, ক্রমশঃ
রক্তাক্ত হতে থাকে ভিতরে ভিতরে। রুক্ষ মেজাজ। পড়াশোনায় অমনোযোগী। আত্রেয়ীও
পরিস্থিতি বুঝতে পারছে। পারছে ত্রুটি বিচ্যুতি অনুভব করতে। কিন্তু নিজে থেকে
যোগাযোগে আজো দ্বিধা। হিরক ফোন করে, টাকা পাঠায় ছেলের জন্য।
ছেলেই একদিন বাবাকে বলে বসে-আমরা একসাথে থাকি না কেন!!?
-আমাকে
প্রায়ই এখানে ওখানে দৌড়াতে হয়। তোর পড়াশোনা আছে!
-আমি
খুব ছোট না বাপী! তোমাদের সমস্যা কি নিয়ে
জানিনা তবে তোমরা আমাকে নিয়ে ভাবো না, এটা বুঝি।
-না,না।
তোর কথা ভাবি না! প্রতিমাসে টাকা
-বাপী!
টাকাটাই সব!
হিরক
বুঝতে পারে পিকুর যন্ত্রণা ।
-তোর
মা-কে কেন প্রশ্ন করিস না?
-আগে
আগে করেছি। এখন আর করবো না।
-কেন?
-মা
কাছে থেকে বোঝে না আমার কষ্ট? আমার লজ্জা ; আমার
দুজনই আছো , আবার নেইও!
-জানিস
কিনা জানিনা ; আমি চেয়েছিলাম। যাইহোক দেখছি
-না
বাপী। আমার কথায় তোমাকে দেখতে হবে না। তোমাদের কাউকে না।
দড়াম
করে ফোনটা ফেলে পিকু বেড়িয়ে যায়। আওয়াজ শুনে আত্রেয়ী-কি
হলো! ফোনটা এভাবে ফেলা ! কার ফোন বলতে বলতে
ফোনটা তুলতেই শোনে
-হ্যালো, পিকু!
আমার
-তুমি!
তুমি পিকুকে ফোন করেছিলে?
-হ্যাঁ
-ও
বিরক্ত হয়! কেন করো বলোতো!
-সত্যি
কি! সঠিক জানো তো?
-মানে?
-মানে! খুঁজে বের করো। ছাড়ছি।
আত্রেয়ী
হাতড়ে বেড়ায়। হিরকের কথার অর্থ বোঝে
না। পিকুও আজকাল বড় অবোধ্য; যখনতখন মেজাজ দেখায়। বাবার
জন্য একটা যন্ত্রণায় আছে, বোঝে। বোঝায় মা-ও। কেবল বোঝেনা, কি
করে আবার ফিরে পাবে হারানো সম্পর্ক। অপমান, অভিমানের
পারদ নিম্নমুখী, কেবল রয়ে গেছে অহং যা মরেও মরে না। আর তাই
নিজে থেকে হিরককে বলে উঠতে পারেনা-চলো না,আবার
নতুন করে শুরু করি! পিকু ওর বাবার জন্য কষ্টে আছে। ও তোমাকে চায়!
হিরক
ছেলের কথা ভেবেই চেষ্টা করে আবার আসে
কলকাতায়। ইতিমধ্যে বারুইপুরের বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। দাদারা যে যার মতো
আছে। নিজেও একটা ফ্ল্যাট কিনেছে। দাদারাও
বলে, ডিভোর্স
যখন করিসনি, ছেলের কথা ভেবে ওদের এবার কাছে নিয়ে আয়।
চেষ্টা তো করেছিল ; আত্রেয়ী জেদ দেখিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
মর্মাহত হিরক ভেবেই রেখেছিল, এবার
আত্রেয়ী ফিরিয়ে দিলে সম্পর্কে ইতি টানবে। টানবেই। আর ছেলেকেও পাওয়ার জন্য আইনী
লড়াই-এ যাবে। পিকু এখনো অ্যাডাল্ট নয় যদিও কিন্তু সন্তান হওয়ার সংবাদে
আত্রেয়ী তো দুঃখ পেয়েছিল! তবে! শেষবারের মতো আত্রেয়ীকে হিরক ফোন করে
-হ্যালো!
-বলছি........
আশ্চর্য! এবার আত্রেয়ী অবাক করে ওকে। ঔদ্ধত্য
ছেড়ে বিনয়ী হয়েছে, নম্র হয়েছে। অনেকটাই পাল্টে গেছে তবে
ছেলেমানুষী ভরা আদুরে মুখটা রয়ে গেছে যা বারবার হিরককে কাছে টানে। আজো।
-আসুন
ম্যাডাম। কফি রেডি।
।। সমাপ্ত ।।
| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
|Special Puja Issue,2019 | September-October, 2019 |
| Third Year Third Issue |20Th Edition|
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post