অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Friday, February 14, 2020

গল্প- ক্যাম্প ফায়ার-সিলভিয়া ঘোষ


ক্যাম্প ফায়ার


সিলভিয়া ঘোষ


(  সম্পাদকের কথা-  "প্যারাফেলিয়া"-একটি বিশেষ মানসিক অবস্থা, প্রবনতা  অথবা রোগ-আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অপরাধ এবং অনেক অপরাধের কারনও  - এই গল্পে এরকমই কিছু ভুক্তভোগীর কথা রয়েছে)


Image Courtesy: Google



(১)

শীতের সকালে রান্নায় ব‍্যস্ত শ্রীতমা, হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। হাত ধুয়ে ধরতে যেতেই কেটে গেলো।  অজানা নম্বর।  বাধ্য হয়েই কল ব্যাক করতে হল তাকে।

মনসিজ  মুখার্জিদের দেড়শ বছরের যৌথ পরিবারের ক্ষয়ে যাওয়া  পলেস্তারায় গায়ে আলসে রোদ্দুর এসে পড়েছে। তাতেই সরগরম হয়ে উঠেছে  হেরিটেজ বিল্ডিং।  বর্তমানে  কচি কাঁচা মিলিয়ে  তা প্রায়  জনা পঁচিশের পাত পড়ে এক এক বেলায় এ বাড়িতে।    
ওপারের কণ্ঠস্বরটি চেনা লাগলো না  শ্রীতমার ।  তবুও বেশ  রাগতো  স্বরে সে বলল  ...এই নম্বর থেকে একটা ফোন এসেছিলোকাকে চাইওদিক থেকে উত্তর আসে আপনাকে। মনে মনে ভাবতে থাকে সেতাকে আবার দরকার  হলো কার !  তার আগে জানতে হবে কে ইনি? সঙ্গে সঙ্গেই জিগ্যেস করে সে, আপনার পরিচয়টা !  ওপার থেকে একটা মহিলা কণ্ঠ ভেসে আসে...আমাকে ভুলে গিয়েছিস জানি তবুও ফোন করে মনে করালাম। আমি সুগন্ধা। মনে পড়েছে? এক নিমেষে  শ্রীতমা ফিরে গেলো বছর কুড়ি আগে ক্লাস টেনের অঙ্কের পিরিয়ড, রীতাদির ক্লাসে। 

বসন্তের পলাশ রাঙা দুপুর, পুকুর পাড়ে  দোতলার ক্লাসরুমে মাঝে মাঝে হাওয়ায় ভেসে আসে কচি আমের মুকুলের ঘুম জড়ানো সুবাসিত সুগন্ধ  সঙ্গে  নতুন  স্টাইলিশ টিচার রীতাদি। যিনি ক্লাসে ছেলেদের তো বটেই মেয়েদেরও  স্টাইল আইকন ।  সুদীপ্ত, ঋজু, শুভ, সায়ন, রাজর্ষিদের সঙ্গে সঙ্গে  সুগন্ধা, শ্রীতমা সহ বাকী ক্লাসও ইয়ার্ডলি রেড রোজে মাতোয়ারা।  অহ্ ক্যায়া আদায়ে !  তখন বাজারে  তালের ঐশ্বর্য রাই  আর ক্লাসে রীতা দির কোন পার্থক্য নেই। মনে মনে  সে সব কথা ভাবতেই ঠোঁটের কোণে অজান্তেই হাসির রেখা এবং গায়ের মধ্যে কাঁটা দিতে লাগলো শ্রীতমার। দিন গুলো কিভাবে কেটে গেলো টেরই পায়নি যেন।  আজকাল  ফেসবুকহোয়াটস অ্যাপে   যাদের সাথে যোগাযোগ  আছে তারা কলেজে কিম্বা দিঠির স্কুলের বন্ধুর মায়েরা।  একমাত্র কয়েকদিন আগে মনসিজের ইচ্ছে তে  দিঠিকে  ক্যারাটে ক্লাসে ভর্তি করতে গিয়েই স্কুলের বন্ধু  নীলুর  সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে।  কত পুরনো কথা সেদিনও দুজনে বলেছিলো।

এতক্ষণ সুগন্ধা কি যে সব বলে গেলো তার  উত্তরেই  বা কি কি  জবাব দিয়েছে মনে করতেই পারছে না সে।  কিছুটা  ধাতস্থ হয়ে বলল, আমার নম্বর তুই পেলি কি করেকত দিন পর আবার  যোগাযোগ হলো  আর সবার খবর কি?

(২)

আলিপুর দুয়ার ছাড়িয়ে কোচবিহারের এই অংশটা ভূটানের কাছাকাছি হওয়ায় প্রকৃতি অতি মনোরম। জায়গাটার নাম রসিকবিল।  চারিদিকে কত নাম না জানা পাখির আনা গোনা এই শেষ বসন্তেও। শান্ত অথচ কী আদিম এই রসিক বিল।  সকালে মোরাম বিছানো রাস্তায় হেঁটে এসেছে শ্রীতমা।  অনেকদিন পর সূর্যোদয়  দেখে  মনটা বড়ই আনন্দে ভোরে গেছে তার। বাচ্চা গুলো সব ঘুমাচ্ছে। নইলে ওদের নিয়েও যেতো সে। আজ মনে  হচ্ছে সত্যি  জীবনে এরকম এক আধটা রি ইউনিয়ন দরকার। সেদিন সুগন্ধার ডাকে সারা দিয়ে সে ভালোই করেছে যদিও কমন ফ্রেন্ড  নীলু যদি ফোন নম্বরটা না দিতো তাহলে কি এমন জায়গায়  সবার সঙ্গে মজা করে ঘুরতে পারতো !  এই রি ইউনিয়নে  সবচেয়ে খুশি বাচ্চাগুলো। কতদিন পর সংসার ছেড়ে, দায়িত্ব ছেড়ে স্বাধীন ভাবে থাকছে এখানে সে।
ওদিকে থেকে ব্রেকফাস্ট করার  জন্য  ডাক দিচ্ছে  রাজর্ষি। সবাই কেমন বদলে গেছে এই কুড়ি বছরে। রাজর্ষি  এখন কলকাতা পুলিশের বড় কর্তা। সায়ন, একজন সফল শিল্পী, কথা বার্তায়  বিদেশের  তুলনা সর্বদা। ঋজু  কর্পোরেট দুনিয়ায় একজন  ব্যস্ত  মানুষ। মজার কথা হলো  ছেলেরা কেউ বৌ বাচ্চাদের নিয়ে আসেনি। মেয়েদের টিমের অনেকেই চাকরী করে।  শ্রীতমার  মতো এক দু জনই হোম মেকার। দিঠি দৌড়ে এসে শ্রীতমার গালে চুমু খেয়ে বলে আজও থাকবো এখানে মানি ! শ্রীতমা মেয়েকে কাছে টেনে  বলে হ্যাঁ মানি। ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে বেশ কিছু প্ল্যান হয় সবার। এই যেমন প্রতি বছর একবার করে পিকনিক, ঘুরতে যাওয়া একসাথে এইসব আর কি।

আজ এখানে ক্যাম্প ফায়ার বসবে কথাটা বলল সায়ন। অদ্যই শেষ রজনী  বন্ধুরা।  এই শীতে কাঠ জ্বালিয়ে কক রোস্ট হবে সঙ্গে কিছু গেম, নাচ, গান, ফান। কথাটার সায় দিল সবাই। কেবল চারটে চোখের ইশারা ধরা পড়লো শ্রীতমার নজরে। বাকীরাও দেখেছে মনে হয়। সারাদিন আশেপাশে চিড়িয়াখানা, রসিক বিলে নৌকা বিহার, মাছের পাইকারী বাজার দেখেই কেটে গেলো। সন্ধ্যা নামতেই তোড়জোড় শুরু হলো  ক্যাম্প ফায়ারের। মোটামুটি সবাই বসেছে শীতের জামা কাপড় পরে আগুন পোহাতে। ছেলেদের হাতে ড্রিঙ্কস। মাঝে মাঝে উঠে আসছে পুরনো সব ব্যথাদের কথা। মেয়েরা পাঁচ ফোড়নও কাটছে আবার গানও গাইছে।  "এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়" গাইছে সুগন্ধা। এর মধ্যেই  কে যেন বললবান্টি আর নীলু কি  হোটেলের ঘরেই হানিমুন টা সেরে নিল !  সবাই হো হো করে হেসে ওঠে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে।

  (৩)

ঝুলন গান করছে "দূরে কোথায়  দূরে দূরে"...গানের সুরটা তখনও হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে... ঠিক সে সময় নীলুর গলায়  অস্বাভাবিক একটা চিৎকার  শোনা গেলো...

ছেলেরা সবাই দৌড়ালো  সেদিকে সঙ্গে সুগন্ধা আর কেয়া। প্রায় দশ মিনিট পর সবাই এসে দাঁড়ায় আগুনের সামনে। রাজর্ষি  থাকাতে অনেক কাজ তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে।
সবচেয়ে বিধ্বস্ত  লাগছে বান্টি কে।  সকলে আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা করতে থাকে নীলু কে। সুগন্ধা, বান্টি কে বলে রিলাক্স। কি হয়েছিল রে ? বান্টি, লজ্জা, ভয়, ঘেন্না মিশিয়ে বলে নীলু  আর আমি যখন বেশ ইন্টিমেট ঠিক তখনই কেমন যেন মনে হতে লাগলো। ঘরে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির আছে।  কথাটা মনে হতেই  উঠে বসে দেখি বন্ধ  দরজাটা কিছুটা ফাঁক, কেয়ার টেকারের ছেলেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে  লোভী শেয়ালের মতো জিভ চাটছেচোখ দুটো কামনার রঙে লাল টকটকে ।  দরজার ডুপলিকেট চাবি ওর কাছে থাকে, তাই ও এমনটা করতে পারে। কালই অবশ্য নীলু বলেছিলো বাথরুমটা সাবধান। কেমন যেন গা টা শিরশির করে।  সুগন্ধা বলে  এবার থেকে সতর্ক থাকিস বান্টি।  বান্টি বলে শালাবিকৃত যৌনতা আমার পিছ ছাড়ে না ! যেখানেই যাই না কেন আমরা...

ওদিকে ছেলেরা নীলু মানে ব্ল্যাক বেল্ট  হোল্ডার  নীলাক্ষী  চট্টোরাজ কে  ড্রিঙ্কস দিয়ে বসায়।  নীলু   আগা গোড়াই ছেলেদের  সঙ্গে । ওর চেহারায় কেন বাড়তি  মেদ নেই, উন্নত অবনত উপত্যকারও চিহ্ন ছিলনা কোনদিন। সে সময়  ছেলেরা ওকে  নিমাই বলেই ডাকতো। আজও এর ব্যতিক্রম নেই। 


বান্টি কিন্তু ঠিক নীলুর বিপরীত মানুষ।  যাকে বাইরে থেকে  দেখে কিছুই বোঝা যায়না। তবে স্কুলে সবাই বুঝতে পারতো নীলুর প্রতি বান্টির পজেজিভনেসটা একটা অন্য মাত্রা দিতে চলেছে হয়তো । 

(৪)

ঝুলন যেন কেমন কঠিন হয়ে গেছে। বছর দশের ছেলে দিব্য কে বলে তাড়াতাড়ি খাও আর চলো এখান থেকে।  শ্রীতমা বলে কি হলো তোর আচ্ছা ঝুলন যতদূর মনে পড়ে তোদের বাড়িতে আমাদের  পাড়ার  বাবুসোনা কে যেতে দেখেছিলাম। সবাই বলতো তোর সাথে না কি ইয়ে ছিল, তাহলে বিয়ে করলি  না কেন রে?

খানিকটা চুপ থেকে  ঝুলন বলে সে এক ইতিহাস। আজ থাক না হয়। 
শ্রীতমা বলে কেন বলনাতোকে আজ  খুব আপসেট লাগছে ! দিব্য তোমরা বাচ্চারা  আমাদের ঘরে  যাও,   টিভি দেখো, দরজা দিয়ে বসো। আমরা আসছি।   রাজর্ষি ওদের সঙ্গে যায় হোটেলের ঘরে। 

ঝুলন বলে চলল - মাঝে মাঝে আমি বাড়ি না থাকলেও সোনা আসতো আমাদের বাড়িতে। মা ওকে দিয়ে এটা ওটা আনাতো। বাবার সাথে মায়ের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল কোন কারণে। মা, বাবার  সঙ্গে খুব কম কথা বলতো। যাই হোক, একদিন  আমি কলেজে গিয়েছি। মুষলধারায় বৃষ্টিতে রাস্তা ঘাট জলপূর্ণ।  আমি বাড়ি ফিরে এলাম।  বাড়ি ঢুকতেই সব কেমন চুপ  চাপ মনে হলো অন্য দিনের তুলনায়। কোন  কথা না বলে আমি দো তলায় ঢুকতেই দেখি বাবা, মায়ের ঘরের দরজার আড়াল থেকে কি যেন দেখছে আর  দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বমেহন করছে। আমার ঘেন্না হলো বাবাকে এক ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকতেই দেখি এক বিভৎস দৃশ্য।  মা আর বাবুসোনা...উফফ ! 

সেই যে বমি করতে করতে বাড়ি ছেড়েছি আর বাড়ি যাইনি আমি। বাবামা দুজনেই মারা গেছে কয়েক বছর আগে পিছে। আমি শ্রাদ্ধ শান্তিও করিনি।  দিব্যর বাবা  উজান সেদিন আমার হাতটা শক্ত করে না ধরলে আজ হয়তো ট্রেনে কাটা পড়া কোন ঝুলনের গল্প উঠতো রি ইউনিয়নে।    হঠাৎ   কাঁদতেে থাকে ঝুলন। কাঁদতে কাদঁতে ঝুলন বলে বড্ড ভয় হয় রে। দু দুটো মিস ক্যারেজের পর এই ছেলে। সেই কবে থেকে এতটুকু  ছেলেকে  বোর্ডিং স্কুলে  রেখেছি  জানিস ।   আমার সংস্পর্শে  ছেলেকে বেশী  রাখতে ভয় পায়  উজান । কথা কটা বলেই  ঝুলন কাঁদতে থাকে ডুকরে ডুকরে। শীতের ছুটিতে বাড়ি এসেছে, জোর করে নিয়ে এসেছি আমি, উজান শাস্তি স্বরূপ সারারাত আমাকে ওর সঙ্গে  গল্প করে যেতে বলে ফোনে।  যাতে ছেলের দিকে  আমি  নজর দিতে না পারি।

 শ্রীতমা ঝুলনের  মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে বলে কাঁদিস না। আমারই ভুল  হয়েছে তোকে না জেনে আঘাত করলাম। স্তব্ধ পরিবেশে  সুগন্ধা বলল জীবন বড় বিচিত্রতাই না !  কেয়া বলল সে আর বলতে... "তুম ইতনা জো মুসকুরা রাহি হো/ ক্যায়া গম হ্যায় জিসকো ছুপা রাহি হো..."

(৫)

মেয়ে সৌমিলী কে নিয়ে অনেক লড়াই করে আজ এ জায়গায় দাঁড়িয়ে  আছি কথাটা বলে সুগন্ধা।  আমার মেয়ের বাবা  পিয়ূস বিখ্যাত এক ওষুধের কোম্পানির  এম আর ছিল। ভালো টাকা মাইনে পেতো কিন্তু কোনদিন ফ্ল্যাট কিনতে বা বাড়ি তৈরি করতে চাইত না। দুই তিন ঘর ভাড়া আছে এমন বাড়িতেই ভাড়া থাকতে পছন্দ করত। প্রথম প্রথম ভাবতাম মা বাবা নেই তাই হয়তো লোকজন ভালোবাসে, পরে অবশ্য এ ধারণা ভাঙে ।  একদিন রাত তিনটে নাগাদ হঠাৎ  চিৎকার শুনলাম চোর চোর চোর...
ঘুম ভেঙে গেলে   পাশে হাত দিয়ে ঠেলতে যাবো দেখি কেউ নেই। গা টা ছমছম করে উঠল। একটু পরে বেশ হাঁফাতে হাঁফাতে গা ভর্তি ঘাম  নিয়ে এসে পাশে শুলো।  পরের  দিন জিজ্ঞেস করাতে বলল চোর ধরতে গিয়েছিলাম। আমার মনে  কেমন যেন হতে লাগলো ।  পাশের ঘরের মেয়েটা  পরে বলেছিল ওদের বাথরুমের জানালায় একটা ছায়া মূর্তি দেখেছিল যার চোখ দুটো পিয়ূসের মতোন। দিন পনেরো পর  ও বলল প্রমোশন হয়েছে বাইরে বাইরে থাকতে হবে তাই  এ বাড়ি ছেড়ে একটা ভালো বাড়ি নিয়েছে যেখানে  আমার সুরক্ষা বেশ ভালো।  সেখানে চলে এলামপাশে এক ঘর ভাড়াটে আর আমরা।  ভদ্রলোকের ওষুধের  ব্যবসা ফলে পিয়ূসের সাথে বেশ  বন্ধুত্ব হলো। বাড়িওয়ালা উপরে থাকেন সরকারী চাকুরে। বাড়িটা    আমার বেশ ভালো লাগলো।  মাঝে মাঝে  ও বাইরে যেতো অফিসের কাছেপাশের বাড়ির বৌদি আর ওঁনার মেয়ে সঙ্গ দিতো আমার।  মিলি হয়েছে  সবে  একমাস, আমার  মা  আসতে পারলো না কারণ  শরীর  ভালো ছিলোনা সে সময়...  একটা বয়স্ক লোক রাখা হলো।  পিয়ূস  বাইরে গিয়েছে অফিসের কাজে আমি আর মাসি বাচ্চা নিয়ে আছি। ভোরের দিকে প্রায় চারটে নাগাদ  কেমন যেন চিৎকার শুনলাম  পাশের ঘর থেকে, তাড়াতাড়ি বাইরে এসে শুনি অন্ধকার ঘরের ভিতর  জানালার পর্দা সরিয়ে কে যেন টর্চের আলো ফেলে দেখছিল ওদের ।   ঠিক দিন পনেরো পর  আবার বাড়ি চেঞ্জ করতে বলল ও। এরকম দেড় বছরে  চারটে পাঁচটা বাড়ি বদলছিলাম আমরা।  মনটার মধ্যে কেমন খচ খচ করতো। কি একটা ঘটনা ধরেও ধরতে পারছিনা। এবার জোর করে একটা ভালো এলাকায় ফ্ল্যাট নিলাম আমরা। অফিসের কাজে পিয়ূস বাইরে আছে আমি নিশ্চিন্ত।  আমার বেড রুমের উল্টো দিকের  ফ্ল্যাটের  এক কাকিমার বেডরুম। ওঁনার মেয়ে প্রায় আমার বয়েসীদেখতে সুন্দর, বাড়িতেই থাকে। মিলি কে ডেকে ডেকে কথা বলে, আদর করে। সেদিন রাতে পিয়ূস নেইআমার গলাটা শুকিয়ে গেছে  তেষ্টায়, কি মনে হতে উঠে জল খেয়ে, ঘড়ির দিকে তাকালাম, সাড়ে তিনটে বাজেজানালার পর্দা তুলে বাইরেটা  দেখতে যেতেই একটা চেনা জানা কিছু ঘটছে মনে হলো। ভালো করে চোখ ডোলে দেখিএকটা লোক কাকিমাদের জানালায় পাইপ বেয়ে উঠে গেছে যার জামা, হাইট  চুলের কাট সবটাই আমার ভীষণ ভীষণ চেনা।  এরপর  ওর বন্ধু পার্থর সাহায্য নিয়ে ডাক্তারমোক্তার  সব করে জানতে পারলাম   এ রোগের নাম পিপিংটম। রোগটা  সারাতে পারিনিবেরিয়ে এলাম তিন বছরের মেয়ে  নিয়ে। মিউচুয়াল ডাইভোর্স  হলো গত বছর।

সবাই চুপচাপ যখন , তখন শুভ বলে ওঠে "আবে তোরা সব মেয়েরা কি এখানে মী টু র ক্যাওড়া নিয়ে বসলি না কি বে?

সবাই তখনও বিষাদে আচ্ছন্ন....


(৬)


চুপচাপ পরিবেশে  শ্রীতমা একটু হেসে   মনে মনে ভাবে বিয়ের আট দিনের মাথায় মায়ের কাছে যে কথা জেনেছে তা যদি এরা শুনতো তবে তো
শ্রীতমা যখন শ্বশুর বাড়ির সকলের নামে নিন্দা করছিল তখন    তিথি খানিকটা আদেশের সুরেই  বলেছিলেনঅ্যাডজাস্ট  করতে শেখো।  
    
কাদের সাথে অ্যাডজাস্ট করবো  মা? তুমি কি জানো মনসিজের কাকাটা একটা  অসভ্য অসুস্থ লোকতুমি কি জানো আমার শাশুড়ী  রোজ রাতে আমার বেডরুমের জানালা, দরজার বাইরে আড়ি পাতেন  আর  জানালার পর্দার তলা  দিয়ে উঁকিঝুকি মারেন!   এক নিঃশ্বাসে সবটা বলে হাঁফাতে থাকে শ্রীতমা। 

 তাহলে তো আমার কথা জানলে তুই  অজ্ঞান হয়ে যাবি।  অ্যাডজাস্ট কিভাবে করতে হয়  জানিস !  

কি করে জানবো  না বললে !  বেশ রাগত  স্বরেই বলল শ্রীতমা।

বিয়ের পর  যখন  তোদের যৌথ পরিবারের আদি  বাড়িতে এসেছিলাম   তখন বাড়িটাকে  চিড়িয়াখানা  লাগতো।  তিন চার শরীকি  একসঙ্গে এক  বাড়িতেই  থাকতো। তিনতলা বাড়িটা সব সময় সরগরম থাকতো। কিন্তু এত বড় বাড়িতে কলঘর ছিল দুটো। তোর মামমামদের দেখেছি কোন অন্ধকার ভোরে উঠে কলঘরের কাজ সেরে সারা দিনের মনে কাজ সারতে যেতেন।  পেট খারাপ বা বহুমূত্র ব্যামো থাকলে মালসা কিম্বা  টিনের বড় কৌটা ছিল  সম্বল। পরে অবশ্য অ্যাটাচ বাথরুম থেকে  ইউরিনাল আর বেডপ্যানে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভাবতো গোটা বাড়িতে জনা চল্লিশ লোকের জন্য দুটো কলঘরঅ্যাটাচ বাথরুম তো  দূর !  কিন্তু এতো অসুবিধা থাকতেও  বাড়িটার মধ্যে  আলাদা প্রাণ ছিল। বলতে বলতেই তিথি যেন কেমন উদাস হয়ে যায়...তারপরেই সম্বিত ফিরেই বলে হ্যাঁ তা যা বলছিলাম...  দুটো কলঘরের মধ্যে  বড় বড় দুটো চৌবাচ্চা ছিল। টাইমের জল এক চৌবাচ্চা পূর্ণ করে  আরেক চৌবাচ্চায় যাতে যেতে পারে তার জন্য একটা  ছিদ্র ছিল। যাতে  লোহার পাইপটা ঢুকিয়ে দেওয়া থাকতো যা ছয় ইঞ্চি লম্বা  হবে হয়তো। জল কম থাকলে তাতে চোখ লাগালে অন্য কলঘরের লোকের আগলা গা দেখা যেতো।  এ সব কথা জানতামই না যদি না তোর  বড়মা সতর্ক করে দিত পাটনা থেকে এসে। কিন্তু তার আগে আমি তো  আদূল  গায়ে  কতদিনই তো স্নান করেছি।  তোর বড়মা আমার বিয়ের ছয় মাস পর ডাবু হোতে এসেছিলেন পাটনা থেকে। তখন আমরা দুপুর বেলায় খাওয়া দাওয়া  মিটিয়ে লুডো, তাস খেলতাম। পার্টনার  বলতে  ছোটকাকার  দুই মেয়ে তোর  প্রিয়  তুলি পি আর  টুটুন পি। ওরা বয়সে অনেকটাই ছোট তবুও আমাদের সাথে খুব ভাব ছিল। প্রথমে ভাবতাম   টুটুন একটু   আত্মভোলা  তাল কানাতাই বারবার এক কথা জিগ্যেস করে। সকাল  থেকেই আমাকে অন্ততঃ পঞ্চাশবার জিজ্ঞেস করতো  আমি কখন স্নান করবো।  আমি ইয়ার্কি মেরে বলতাম কেন গো একসঙ্গে স্নান  করবে না কি?   ও কেমন হাসতে হাসতে বলতো না দুকুরের তাস খেলবো  একসাথে তাই !  তুলি কে দেখতাম দিদিকে আগলে  রাখতো সব সময়। এখনও যেমন দেখভাল করে তখনও  তাই করতো।  এই রকম দিদি আসার পর একদিন তিন তলায় যাচ্ছি টুটুনকে ডাকতে যেতেই  দরজার বাইরে থেকে   শুনতে পাই তুলি বকছে টুটুন কে ।  বলছে আবার তুই  হাত দিয়ে ওসব করছিসসুস্থ থাকতে ইচ্ছে করেনা  তোর !   উত্তরে টুটুন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল আজ যে নলে চোখ লাগিয়ে মেজ বৌদির স্নান দেখলাম। তারপর থেকে   আর শরীরে খিদে নেই হাতটা ওখানে রাখলেই আরাম লাগছে। দলা দলা বের হয় রে।  হঠাৎ  একটা থাপ্পড়ের আওয়াজ আসে । আমি আর দেখতে যায়নি তখন হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। দৌড়ে  দিদির কাছে এসে কান্না শুরু করতেই দিদি বলল এই কারণেই তো দিদি এ বাড়িতে থাকে না।  আর কখনও আলগা  গায়ে  কলঘরেও যায় না। বড়দা বিয়ের পর নিষেধ করে দিয়েছিলেন। তোর বাবা কে এসব কথা বলতেই বলল টুটুন মানসিক ভাবে অসুস্থ। এরপর নদী দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। হাঁড়িও একে একে আলাদা হলো। আমরা চলে এলাম ভাড়া বাড়িতে। প্রায় ১০ বছর ভাড়া থাকার পর  এই বাড়ি হলো আমাদের।

   ভোর বেলায় জানালার তলা দিয়ে রোদ এসেছিল বলে মনে হলো। অস্বস্তি হচ্ছে  তাই চোখটা খুলতেই মশারীর ভেতর দিয়ে দেখলাম  শাশুড়ী চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।

কেন তোর শাশুড়ী উঁকি ঝুঁকি দিয়েছেন বলেই কি উনি রোগী হবেনঅনেক মায়েরাই দেখতে চান সন্তানরা   ঠিকমতো সহবাস  করতে পারছে কি না।  এতে কোন দোষ নেই। তোদের আবার সবটাতেই...

আজ্ঞে না !  দুপুরে  উনি দরজা বন্ধ করতে দেননা। ভারি  পর্দা তাতে অসুবিধা হবেনা বলে আমরা  দুপুরে শুতেই উনি আসেন বিড়াল পায়ে। আমাদের উষ্ণ কথাবার্তা এবং সহবাসে দৃশ্য পর্দা সরিয়ে দেখেন আর হস্তমৈথুনে রত থাকেন যা আমার আগে মনসিজের চোখে পড়েছে।

সে সব দিনের কথা ভাবলেই আজও গায়ে কাঁটা দেয়  শ্রীতমার। দিন বদলেছে তবে একটা ভয় আজও রয়ে গেছে। 

বান্টি বলে  বিদেশের মতো যদি এদেশেও যদি   বাচ্চাদের টিকা বা প্রতিষেধকের  সাথে সাথে প্রতি বছর মনোবিদের কাছে  যাওয়াটা বাধ্যতামূলক হতো তবে হয়তো এসব রোগ, রোগের থেকে খুন খারাপী, হতাশা বা ডিপ্রেশন কিছুটা কম করা যেতো।  কি জানিস বিদেশে মনোবিদের দাম অনেক।  আফশোস এদেশে সাধারণ লোকের কাছে আজও শুধুই মাথার ব্যামো সারাবার ডাক্তার  তারা। চল ফেরা যাক, অনেক রাত হলো ।  কাঠের আগুন নিভে গিয়েছেশুধু নিভন্ত আগুনে তাপ ছড়িয়ে পড়ছে  চারপাশের আকাশে বাতাসে। রক্ত মাংসের পোড়া গন্ধ আদিমতাকে ঢাকতে পারছে না। বন্য পরিবেশঝিঁ ঝিঁ পোকার  ডাক    কেমন যেন  নগ্ন করে দিয়েছে আবহ কে। ঝুলন আবার গাইছে "ভালোবাসি ভালোবাসি এই সুরে কাছে  দূরে/ স্থলে জলে বাজায় বাঁশি"...



| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
  | Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
| Winter Issue,2010 | January 2020 |
| Third Year Fourth Issue |21st Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |


   Back To Index- সূচিপত্র
















No comments:

Post a Comment

Please put your comment here about this post

Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান