‘মন’ এর কথা
দেবশ্রী চক্রবর্তী
(এই ঘটনার স্থান, কাল, পাত্র সবই অতিমাত্রায় বাস্তব)
সকাল থেকেই বাড়িতে সে এক হুলুস্থুল কান্ড, হবে নাই বা কেন?
আজ যে মনের এক্সাম, আজ শর্ট হ্যান্ডের প্র্যাক্টিক্যাল, সকাল সকাল মাতু রান্না বান্না করছে, ভাত, আলুসেদ্ধ, ঘী কিছুই বাকি নেই। কিন্তু মনের গলা দিয়ে যে কিছুই নামে না, তার ওপর ছোটমামার মেদিনীপুরের ট্রেনের টাইম হয়ে যাচ্ছে, সে বিদ্যাসাগার ইউনিভার্সিটির ইকনমিক্স এর ছাত্র, মাতু একবার তাকে খাওয়ায় একবার মন কে, মন ভাতটা মুখে নিয়ে একবার পুরো বাড়ী ঘুরে আসে মুখের ভাত টুকু শেষ করতে, কে বলবে যে সে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী, ও, বলাই হয়নি, মাতু হোল মনের দিদা, জন্ম থেকে বেশির ভাগই মন তার দিদার কাছেই থেকেছে, মায়ের বয়স কম হওয়ায় তার পক্ষে তিন তিনটে বাচ্চা সামলানো দুস্কর ছিল। আগে দিদাকে মন মা বলেই জানত, পরে আশপাশের প্রতিবেশিনী দিদাদের কথায় প্রথমে অসুবিধে হলেও পরে দিদাকে মা এর বদলে মাতু বলতে শুরু করে। ছোটমামা মনের থেকে পাঁচ ছয় বছরের বড়, বয়সের বেশী ফারাক না থাকায় দুজনে ভাই বোনের মতো খুনসুটি, ঝগড়া, মারামারি করেই বড় হয়েছে, মনের আর এক মামা আছে সে, অতিশয় গম্ভীর, স্বল্পভাষী, একটুতে রেগে যায়, কাজেই বাড়ির সবাই তাকে একটু ভয়ই পায়। মাসীদের বিয়ে হয়ে গেছে, যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত, রিটায়ার্ড রেলওয়ে কর্মচারী অবসর কাটান পাড়ার দাদুদের সাথে তাস খেলে বা টিভি দেখে, কখনও বা রিক্সা দাদুর রিক্সা চড়ে মাতুর সেজ ভাই, মানে সেজ দাদুর বাড়িতে গিয়ে সময় কাটান।
ফিরি আবার সেই দিনে, তো, আজ মনের এক্সাম, এদিকে আকাশে মেঘের ঘনঘটা, বৃষ্টিও শুরু হয়েছে, কাজেই, ছাতাটা নিয়েই বেরোতে হবে, বড়দের প্রণাম করে মন কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল, এমনি তে সে ছোটমামার সাথে বন্ধুর মতই মেশে, কিন্তু এই পরীক্ষার সময় ছোটমামাও তার চরণ দুখানি মেলে ধরেন, মন ভক্তি ভরে প্রণাম করে, বাবা! পরীক্ষার ভয় কি যে সে ভয়? সবারই আশীর্বাদই চাই, যাক, এটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে, যাক। এক হাতে ছাতা আর অন্য হাতে সাইকেল নিয়ে মন কলেজে পৌঁছল, পরীক্ষাও হল ভালো ভাবে, এবার, বাড়ী ফেরার পালা, কিন্তু বৃষ্টি আর থামেই না, সেই এক হাতে সাইকেল, অন্য হাতে ছাতা, পিচরাস্তা তে তেমন একটা অসুবিধে হলনা, তবে, বাদ সাধল কাঁচা রাস্তা টুকু, রাস্তার এক দিকে পুকুর, অন্য দিকে সুন্দর ধানের ক্ষেত, কয়েকটা সাদা বক এক পায়ে দাঁড়িয়ে বেদম ভিজছে, যেন অঝোর ধারায় ধ্যানে বসেছে, তবে, ধ্যান ভগবানের, না মাছের, তা ঈশ্বরই জানেন। ওদিকে পুকুরে ছাতা মাথায় দু একজন মাছ ধরছে-রাস্তাটা কাদায় জ্যাব জ্যাব করছে, কোথাও উঁচু, কোথাও বা নিচু, কিছু দূরে কতগুলি ছোট বাচ্চা অই জল কাদাতেই খেলা করছে, একবার মন ভাবল – হেঁটেই যায়, কিন্তু হেঁটে গেলে সম্মান যায়, তাই সাইকেল চালানোই ভালো, যেমন ভাবা, তেমনি কাজ, কিন্তু আজ, সাইকেলটা কেমন যেন দুলে দুলে চলছে, খেয়েছে! সামনে একটা গর্ত, ওদিকে কেমন যেন একটা হাওয়া মন কে ধাক্কা দিয়ে গেল। ছাতার সাথে মন উড়েই যাচ্ছিল প্রায়, কোনোক্রমে নিজেকে মন সামলে নিতে চেষ্টা করেও হার মানল, সাইকেল একদিকে, মন একদিকে, মন ছাতা হাতে বসে পড়ল মাটিতে, লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেছে, কোনরকমে উঠে দাঁড়াতেই বাচ্চা গুলো খিল খিল করে হেসে উঠল, এক ধমক দিয়ে বাচ্চা গুলোকে মন বলল, “ পরে হাসবি, আগে ছাতাটা ধর”। সাইকেল টা তুলে পুকুরের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, নাঃ ওরা মাছ ধরছে, কেউ কিছু দেখেনি। বাড়িতে আসা মাত্রই মাতুর উদ্বেগ, “ কি রে!, জামার এই অবস্থা, ছোট লাগেনি তো?”
মন বলল, “ না, না, বৃষ্টির জন্য কাদা জলের একটু ছিটে লেগেছে”।
মনে হল, মাতু বিশ্বাস করে নি। রাত্রে বড়মামা বাড়ি ফিরে এসেছে বুঝতে পেরে টিভি ছেড়ে দৌড়ে পড়তে বসে যায় মুন। মামা পাশ দিয়ে যাবার সময় বলে গেল, “ কিরে!, তুই নাকি আজ পড়ে গিয়ে ছিলি?” মাতু বলল, “ ওই দ্যাখ, আমি, ঠিকই বুঝে ছিলাম, তা তুই কি ভাবে জানলি?”
মামা বলল, “অর্ক মাছ ধরছিল, ও দেখেছে”।
মনের অর্ক মামার ওপর ভীষণ রাগ হল, আর, রাগ হল হঠাৎ আসা ওই ঝড়টার ওপরেরও।
তা, এমনি করেই দিন কাটছিল মুনের, এক্সামও শেষ হল, ক্রমশঃ রেজাল্টের দিন এগিয়ে আসছিল, এখন আর এক কান্ড, মনের মেডিটেশন আর পুজোর সময় ক্রমেই বাড়তে লাগল, বাড়িতে আর কারও বুঝতে বাকি নেই কেন মুনের এই পুজো পাঠের ধুম বাড়ল। সেদিন, মন খুব মন দিয়ে পুজো করছিল, পুজো হবার পর ঠাকুরের দিকে পেছন করে চলতে নেই বলে সে ঠাকুরের দিকে তাকাতে তাকাতে পেছনে হাঁটতে লাগল, বেশ কিছুটা যাবার পর মুন কিছুর সাথে ধাক্কা খেল, আর ওমনি এক বিকট গোঙ্গানির শব্দ পেলো, সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে পেছন ফিরে দেখে কি ছোটমামা দুই হাত মাথার উপরে করে নমস্কারের মুদ্রায় এক পা তুলে নিজেকে ব্যলেন্স করার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টায় টল টল করছে, আর সেই সাথে মুখে এক যন্ত্রণার ছাপ, হবে নাই বা কেন? মন যে তার মাটির ওপর একমাত্র পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েছিল, মামার এইরূপ দুর্গতি দেখার পর মন প্রচণ্ড হাসি চেপে তড়িঘড়ি মাতুর পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল, মাতু জিজ্ঞাসা করল, “ কি হয়েছে রে? এত হাসছিস কেন?” সমস্ত কথা বলতে বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসা দাদুভাইএর অট্টহাস্য শোনা গেল।
মাতুও হাসি চাপতে পারল না, মামা ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে মাতুকে বেজায় রেগে বলল, “ মা, মন কে বোঝাও যে ও এখনও বড় হল না , আমার পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েছিল, তোমরা হাসছ? ওর পেছন ফিরে হাঁটার কি ছিল?” বলে রেগেমেগে ক্লাবে চলে গেল।
সেদিন বিকেলে ছোটমামা মনকে বলল, “ শোন, আজ ক্লাবে আমাদের একটা পিকনিক আছে, আসতে দেরী হবে, মা কে ম্যানেজ করেছি, কিন্তু রাত্রে মা ঘুমিয়ে পড়বে, তুই জেগে থাকিস বুঝলি? দরজায় টোকা দিলেই দরজা টা খুলে দিস”।
মন বলল, “ ঠিক আছে”, ঘাড় নাড়ল ঠিক যেন রামভক্ত হনুমান।
রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর যথা সময়ে সবাই শুয়ে পড়ল, বড়মামা দোতলায় নিজের ঘরে শুতে চলে গেল, দাদুভাই তাঁর নিজের ঘরে, মন আর মাতু একসাথে তাদের নিজের ঘরে।
মনের প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল, কিন্তু তাহলে তো মামার রাতে বাড়ি ফিরে ঢুকতে অসুবিধে হবে, দাদুভাই আর বড়মামা জেগে যাবে, সুতরাং ঘুমোলে চলবে না, এদিকে, সারাদিন সংসার সামলে মাতু বেজায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, নাক ডাকছে, ঠিক যেন শান্টিং ইঞ্জিন, ছুক্...ছুক্...ছু...উ...ক, এই লয়ে মাতুর ট্রেন যে কতগুলো স্টেশন পেরিয়ে গেল কে জানে? কিন্তু, ছোটমামার এখনো আসার সময় হল’ না, মনের এইসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ গাড়ীর ঘরের দরজা তে খুট খুট শব্দ হল, মেইন গেট লক করা আছে, সুতরাং, মামা নিশ্চয়ই গাড়ীর ঘরের দিক দিয়েই এসেছে, মুন ধীর পায়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কোনোক্রমে গাড়ী ঘরের দিকটায় পৌঁছল, একটু সময় লাগল কিন্তু আলো জ্বালালে যে সবাই উঠে পড়বে, যাই হোক দরজাটা মন আস্তে আস্তে খুলল, বাইরে তাকাতেই একরাশ ফুটফুটে চাঁদের আলোতে গাছগুলো কে কেমন সুন্দর, মায়াবী লাগল, পাতা গুলো আলতো আলতো দুলছে, চারিদিক নিঃস্তব্ধ, গাছের পাতায় কেউ যেন রূপো ঢেলে দিয়েছে, জ্যোৎস্নাতে সেগুলো চকচক করছে, খুব সুন্দর একটা মিষ্টি হাওয়া বইছে। কিন্তু একি! মামা তো আসেনি! কতক্ষণ এমনি ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল খেয়াল নেই, সম্বিৎ ফিরতেই ভয় পেয়ে হাতের চেটো ঘামে ভিজে গেছে বোঝা গেল, “তবে কি নিশিতে ডাকল? অদ্যই কি তবে শেষ রজনী? এবাই কি হবে? মাতুকেই বা কি ভাবে ডাকবে?” মনে হচ্ছে কেউ যেন গলাটা চেপে ধরেছে, গলা থেকে কোনও আওয়াজ বের হচ্ছে না, প্রচণ্ড চীৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে, এমন সময় অন্ধকার ফুঁড়ে কে যেন সামনে এসে দাঁড়াল, আর যায় কোথায়? যে আওয়াজ টা এতক্ষণ আটকে ছিল, সেটা বেরিয়ে এল। মন নিজেও বুঝল না যে এত জোরে সে কি বলল, বিশাল এক থাবায় তার মুখ কে যেন বন্ধ করে দিল, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখল যে তার ছোটমামা একহাতে তার মুখ চেপে অন্য হাতের তর্জনী নিজের ঠোঁটের ওপর রেখে, ইশারায় মন কে চুপ করতে বলল।
এবার মুনের হুঁশ ফিরে এল, ওদিকে ওপরের বড়মামার ঘর থেকে আওয়াজ এল, “ কে! কে!”, জ্বলে উঠল আলো, মন এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল, ওই অত রাত্রে মামার বকা খাওয়ার ইচ্ছে এতটুকুও নেই তার। যে দেরি করেছে, দরজাও সেই বন্ধ করুক, এক দৌড়ে মাতুর আঁচলের তলায় গিয়ে শুয়ে পড়ল মন, মাতুর গায়ের গন্ধ মেশানো আঁচলে প্রশ্রয়ের আস্বাস, এবার আর কেউ ধরতে পারবে না, ওদিকে বারান্দায় কোনও শব্দ নেই, সব চুপচাপ, যেন কিছুই হয়নি, ওপরের ঘরের আলোও নিভে গেল, শুধু দাদুভাইয়ের কাশির আওয়াজে মন এটুকু বুঝল যে দাদুভাই মোটেই একটুকুনও ঘুমনই, ছোটমামা ওই অন্ধকারে কি করে যে নিজের ঘরে গেল কে জানে? মন ধীরে ধীরে অতল ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেল।
| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Lock-down Issue,2020 | April 2020 |হাসিরাশি সংখ্যা।
।নববর্ষ ১৪২৭| Third Year Fifth Issue |22nd Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post