অহিভূষণের
সর্প দোষ
স্বরূপ চক্রবর্তী
অলঙ্করণঃ মিঠুন দাস |
সকাল সকাল কলিং বেলের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙলো অহিভূষণ আচার্য্যর , দরজায় দুম দুম ধাক্কা, সাথে খোট্টা দুধওয়ালার চিল চিৎকার, "ওহী বাবু, ও ওহী বাবু, উঠবেন? কি না উঠবেন?" স্ত্রী দিন দশেকের জন্য বাপের বাড়িতে, ফলে বাধ্য হয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে গজ গজ করছিলেন অহিভূষণ, " ব্যাটা খোট্টা, দরজা ভেঙে ফেলবে বোধহয়"।
ধড়াম করে দরজা খুলে রামশরণ কে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, " ব্যাটা ঠিকঠাক বলতে না পারিস তো নাম ধরে ডাকিস কেন? শুধু বাবু বলে ডাকতে পারিস না?"
"কাহে বাবু, ক্যা হুয়া?"
"আমার মুণ্ডু হুয়া, ব্যাটা অর্বাচীন", "আমার নাম অহিভূষণ, ফের যদি দেখি ওরকম পাঁঠার মতো চিৎকার করে ওহী বাবু ওহী বাবু বলেছ, তাহলে তোমার একদিন কি আমার"।
"ক্যা হুয়া বাবু, ওহী তো বোলা, আপনার, নাম, ‘ওহী’ বাবু" অবাক হয়ে বলে রামশরণ।
" ব্যাটা মস্করা হচ্ছে? বেরো বেরো বলছি"।
রামশরণ কিছু না বুঝে "সিয়ারাম, সিয়ারাম" করতে করতে বিদায় নিল।
ছোটো বেলায় অহিভূষণ এর ঠাম্মা বলতেন, " বাবা আমার সাত রাজার ধন এক মানিক," আর, মা কে বলতেন , "দ্যাখ ছোটবউ, ছেলেকে আগলে রাখিস, কারণ ওর সর্প দোষ আছে"। উফফ এই সর্পদোষ , মনে পড়লে আজও শিউরে উঠতে হয় তাঁকে।
আজ একে তো শনি বার, তার ওপর শেষ শীতের আকাশ বেশ পরিষ্কার, রোদ একটু কম ,তবে , মোবাইল টা আর একবার দেখলেন, হলুদ সূর্য্যের ওপর কালো মেঘ, যেটা থেকে আবার কি না বৃষ্টি ঝরছে। অর্থাৎ আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে বৃষ্টি, কিন্তু বাস্তবে তার কোনও চিহ্ন নেই। ওই ছোকরা ক্যাশিয়ার দীপক টা আজ তাঁর নামটা অবশ্যই বদলাবে বোধহয়, উফফ এই সর্পদোষ! কিছুতেই পিছু ছাড়ে না, নানা ভাবে হেনস্থা করেই চলেছে, কিন্তু, একা বাড়িতে থেকেই বা লাভ কি? সেই তো নিজেকে হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবে, অহিভূষনের যে কাজে ভীষণ অনীহা, এর থেকে অফিসের ক্যান্টিন ভালো, আর তা ছাড়া দেখাই যাক না ‘গুগুল বাবার’ জোর কত।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে অফিসে চললেন ‘ওহী’ বাবু থুড়ি, অহিভূষণ বাবু, বেসরকারি ব্যাঙ্ক কর্মী, মধ্য চল্লিশের নির্বিরোধী নিপাট অহিভূষণ আচার্য্য।
ঘটনাটি খুলে বলা যাক, ফেব্রুয়ারির শেষ হতে চলল অথচ এই যখন তখন মেঘের প্রকোপে শীতটা নাছোড়বান্দা অতিথির মতো কিছুতেই আর মুলুক ছেড়ে যেতে চাইছে না , সবাই বিরক্ত, এদিকে মধ্য চল্লিশের টেক স্যাভি ব্যাঙ্ক কর্মী অহিভূষণ আচার্য্য একেবারে যাকে বলে "নেট-আসক্ত", আর গুগুল বাবার দীক্ষা নেওয়া ভক্তও বটে, তাই , তিনদিন আগে যখন ঝকঝকে রোদ্দুর ভরা আকাশ নীল বরণ ধারণ ধরেছে, পাড়ার মোড়ের শিমুল গাছটি আড়মোড়া ভেঙে লজ্জায় লাল লাল ফুল ফোটাতে শুরু করেছে, আর, আকাশে বাতাসে, ফেসবুক টেসবুকে ‘বসন্ত এসে গেছে গেছে’ রব উঠেছে তখনই একদিন লাঞ্চ ব্রেকে অফিসের বড়বাবু অহিভূষণ আচার্য্য আর ক্যাশিয়ার দীপক দস্তিদার এক্কেবারে তর্ক বিতর্কে অফিস ক্যান্টিনের প্লাইউডের সৌখিন দেওয়াল আর জানালার কাঁচ গুলো প্রায় ভেঙ্গে ফেলেন আর কি। কারণ গুগুল বাবা বলেছেন যে আজ থেকে তিন দিনের মাথায় অঝোর বৃষ্টি অথবা শিলাবৃষ্টি,ফলে শীতের পুনরাগমন।
- "না, অসম্ভব, শীত চলে গেছে, আর আসতেই পারেনা, এইতো গেলো রবিবার, গিন্নির হুকুমে গায়ে দেবার মোটা লেপগুলো সব রোদ দেখিয়ে ডিভানের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতে গিয়ে কোমরে ফিক ব্যথা ধরল, ভারী বলে ভারী! এক্কেবারে গন্ধমাদন", বলে কোমরে হাত বোলালেন দীপক বাবু," বলে কি না আবার বৃষ্টির পূর্বানুমান,ওই গুগুল বাবার মাথা খারাপ ,বুঝলেন 'অহি বাবু'", বলে তড়পালেন দীপক বাবু, বোধহয় শীত ফিরে এলে গিন্নির তাড়নায় পুনরায় ওই গন্ধমাদন আবার না মস্তকে ধারণ করতে সেই ভয়ে।
অহিভূষণ ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন,
কারণ দুটো,একে তো গুগুল বাবাকে যা তা বলা, আর দ্বিতীয় ওই 'অহি বাবু' নামে ডাক, কারণ ছোটবেলায় যেদিন থেকে তিনি জেনেছেন 'অহি' হচ্ছে বাংলা অভিধান মতে বিশেষ্য পদ যার অর্থ হলো 'সর্প', আর সাপের মালা পরেন যিনি তিনি হলেন ‘অহিভূষণ’ অর্থাৎ মহাদেব শিব , কিন্তু লোকজনের নাম ছোট করে বলার অভ্যাসের কারনে ‘শিবের’ ‘সাপ’ হতে দেরী হয়না, আর, এই নাম শুনলেই অহি বাবুর পিত্তি জ্বলে যায়। তার মতে ঠাকুমা বর্ণিত সর্প দোষের থেকে কিছু কম নয় এই নামের বিকৃতি। কিন্তু আসল রাগের কারণ তার ওই সর্প দোষ নয়, বরং এক দোষী সর্প...তাই সাপকে যতটা না ভয় তার চেয়ে বেশী সাপের ওপর রাগ, কারন? দেখা যাক...
" দ্যাখো দীপক, তুমি আমার ভাই এর মত, তাই বলে আমার নাম নিয়ে যা তা বলার অধিকার তোমায় কে দিয়েছে?" রাগে থমথমে মুখে কথা কটা অহিবাবু বললেন।
" যা তা? কেন? আপনার নাম অহিভূষণ আচার্য্য নয়?" অবাক হয়ে বলে দীপক।
"হ্যাঁ, অহিভূষণ, অর্থাৎ 'অহি' বা সর্প যাঁর ভূষণ, অর্থাৎ 'শিব', আর, তুমি আমায় 'শিব' না বলে 'সাপ' বলছ"।
একথা শুনে দীপক বেশ মজা পায়। বলে, "আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আপনাকে সাপ না বলে শিবই বলব, তবে, একটা শর্ত আছে"।
"হুম", অহিবাবুর ছোট্ট প্রতিক্রিয়া।
" শর্ত হলো যে পরশু শনিবার বৃষ্টি হলে আপনি শিব, নতুবা সর্প," দীপক বিশদ হয়।
এই বারে একটু চিন্তায় পড়লেন অহি বাবু, তবে, যা থাকে কপালে, বলে টেবিল ঠুকে পাকা জুয়াড়ির ভঙ্গিতে বলে উঠলেন-
" ঠিক হ্যায়, মঞ্জুর।"
তো, আজ আকাশের মেঘ দেখে গুনগুনিয়ে গান বেরিয়ে এলো,
"আকাশে মেঘ করেছে,
ঝরঝরিয়ে হবে বরিষণ,
রাস্তায় কাদা হবে জল জমবে,
পাগলা হবে মন"...
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো ঝমাঝম বৃষ্টি।
একটুপরেই দীপক এসে যোগ দেয় টেবিলে, হেসে বলে,"হুমম, দাদা, আপনি তো দেখছি জিতেই গেলেন, আপনার সর্প দোষ কাটল দেখছি, আজ থেকে আপনি অহিবাবু নন, অহিভূষণ,সাপ নন শিব। তবে,যদি কিছু মনে না করেন,আপনার এই অহি শুনলে রেগে যাবার কারণ টা কি জানা যায়?আজ অহিভূষণ খুশ মেজাজে ছিলেন, বললেন," বলতে পারি, তবে, একটা শর্তে, এই কথা কাউকে, বিশেষতঃ তোমার বউদি কে বলা চলবে না"।
"ও কে, ডান, " বলল দীপক।
"ও কে, ডান, " বলল দীপক।
ইতিমধ্যে বাইরে শুরু হয়েছে অঝোর বৃষ্টি...
উনি যেটা বলেছেন সেটা শোনাই আজ…
নাম নিয়ে অহিভূষণ কেন এইরকম সংবেদনশীল, সেটা জানতে হলে জানতে হবে অহিভূষণ এর সর্পদোষ এর ব্যাপারে, পেছতে হবে প্রায় সাড়ে তিন দশক, অহিভূষণ তখন 'অহিভূষণ আচার্য্য' বা 'অহিভূষণ বাবু' হয়ে উঠেন নি...
তখন তিনি শুধুমাত্র 'পিকলু',বাবা,মা,ভাই,বোন,ঠাম্মা,দাদু,জ্যাঠা,কাকা ইত্যাদি বাংলা অভিধানে যত সম্পর্ক হয় সব রকমের সম্পর্কের মিলনস্থল, যাকে সাধু বাংলায় যৌথ পরিবার বলে, সেই পরিবারের তখনও পর্যন্ত্য সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য; 'পিকলু'। সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে থাকা, আর ভাই বোনদের সাথে মিলে ঠাম্মা-দাদুর প্রশ্রয়ে ও আশ্রয়ে নানাবিধ পুন্য কর্ম- যথা, 'হরি মুদির বাগানের গাছের ফল চুরি', 'রানী গোয়ালীনির গবাদি পশুদের দড়ি খুলে তাদের মুক্তির আস্বাদ দেওয়া', 'ছোট্ট ছেলে মেয়েদের হাতের মোয়া ছিনিয়ে দৌড়োনো' বা 'ক্ষেতের মটর শুঁটি দিয়ে পিকনিক করতে না দেওয়া প্রতিবেশীর টিনের চালায় রাতের অন্ধকারে পাথর ফেলে ভূতের ভয় দেখানো' ইত্যাদি কর্মকান্ড নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, স্কুলে নাম লেখানো আছে, ব্যস, ওই পর্যন্তই, এত বড় রাজকার্য্য সামলে স্কুলে বিশেষ একটা যাওয়া হয়ে ওঠেনা। বয়স আর শারীরিক উচ্চতায় কম হলেও দাপটে আর দুষ্টুমি তে পিকলুর স্থান অনেক ওপরে, তার কারণ ঠাম্মা। আসলে বিয়ের অনেকদিন পরেও পিকলুর বাবা মায়ের সন্তানাদি হচ্ছিল না, অনেক পুজো -আচ্চা - মানত - কিরে করার পর কোনও এক পুন্য লগ্নে পিকলুর মায়ের কোল আলো করে আবির্ভুত হলেন শ্রীমান পিকলু,এক্কেবারে ক্ষীণ শরীরের, ছোট্ট ইঁদুরের মত, এরপর যথারীতি নামকরণ ইত্যাদির পালা এলো, সেইসময় পন্ডিত মশায় গণনা টননা করে' ক্ষীণ দেহী অহিভূষণ এর বিষয়ে বললেন "এ ছেলে ক্ষণজন্মা, ভবিষ্যতে অনেক টাকার মধ্যে থাকবে",তা আছেন, কারণ অহিভূষণ ব্যাঙ্কের যে শাখায় কাজ করেন, সেটা মুখ্য শাখা হবার কারণে অনেক নগদ জমা থাকে স্ট্রং রুমে, আর, সেই স্ট্রং রুমের দায়িত্ব ওনার হাতেই, ফলে, পন্ডিত মশাইয়ের কথা একেবারে ফেলে দেওয়া যায়না, টাকার মধ্যে আছেন তিনি, একপ্রকার টাকায় ডুবে আছেন। তো , এতো গেল ভালো কথা, কিন্তু পন্ডিত মশাইয়ের এর পরের কথাই হলো মোক্ষম, যার কারণে পিকলুর এত প্রতিপত্তি। চশমাটা নাকের ডগা থেকে ঠেলে তুলে পন্ডিত মশাই বললেন, শুনুন মা ঠাকুরণ, এই ছেলের কিন্তু 'সর্প দোষ' আছে, সে কথা শোনামাত্র পিকলুর ঠাম্মা সৌদামিনী দেবীর আর্তনাদে বৃদ্ধ পন্ডিতমশায়ের খাগের কলমের জন্য রাখা কালিভর্তি মাটির দোয়াতখানি উল্টে পড়ে গণনার কাগজের ওপর, তারপর সব ঘেঁটে ঘ; যাকগে, পন্ডিতমশাই অনেক ভেবেচিন্তে উপায় বের করলেন, বললেন, "সর্প অর্থাৎ অহি, আর এই অহি কে বশ করে গলায় ধারণ করেন শিবশঙ্কর, তাই, তাকে বলা হয় অহিভূষণ, তাই, আজ থেকে এই ছেলের নাম হোক অহিভূষণ, অহিভূষণ আচার্য্য, ‘অহি’র সাথে ‘ভূষণ’ থাকলে বোধহয় সর্পদোষ কাটবে।" তা, এই সর্পদোষ এর কল্যানে আর ঠাম্মার বরাভয়ে জন্য পিকলু মাত্র আট বছর বয়সেই মহা পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে,কারণ ভাইবোন, পাড়া প্রতিবেশী যে কেউই কোনও অভিযোগ নিয়ে আসুক না কেন, পিকলুর ঠাম্মা আগলে দাঁড়ান, বুঝিয়ে বা বকে ধমকে ফেরৎ পাঠান, বলেন, "তোরা না ওর নিজের ভাইবোন,বন্ধু, প্রতিবেশী,ওই একটা ছোট্ট ছেলে,ওকে নিয়ে নালিশ করিস!" এতে যদি মামলা মিটে যায় তো ভালো, না হলে ঠাম্মার ব্রহ্মাস্ত্র, আঁচলের কোন দিয়ে চোখের কোনা মুছে বলেন, "বাছার আমার এমনিতেই সর্প দোষ,আর, তার ওপর, তোরা..."।
এইভাবেই সর্পদোষ এর কল্যানে অহিভূষণ এর দোর্দন্ড প্রতাপ রাজত্ব চলছিল। বয়স,আকার বা পদমর্যাদায় ছোট যারা তারা অহিভূষণ এর দাসত্ব স্বীকার করে নিয়ে ছিল নির্দ্বিধায়, যারা বয়স বা আকারে বড়, তাদের কে ঠাম্মার বকুনির ভয় দেখিয়ে দাসত্ব করতে বাধ্য করেছিলেন অহিভূষণ।
এইভাবেই সর্পদোষ এর কল্যানে অহিভূষণ এর দোর্দন্ড প্রতাপ রাজত্ব চলছিল। বয়স,আকার বা পদমর্যাদায় ছোট যারা তারা অহিভূষণ এর দাসত্ব স্বীকার করে নিয়ে ছিল নির্দ্বিধায়, যারা বয়স বা আকারে বড়, তাদের কে ঠাম্মার বকুনির ভয় দেখিয়ে দাসত্ব করতে বাধ্য করেছিলেন অহিভূষণ।
কিন্তু যে কোনোও মহান সম্রাটেরও শত্রুর অভাব থাকেনা,আর,শত্রু সুযোগ ছাড়ে না সেইরকম কিছুই ঘটতে চলেছিল অহিভূষণের জীবনেও।
পিকলুদের বিশাল যৌথ পরিবারের উপযুক্ত বিরাট বাড়ি,নিজস্ব পুকুর বাগান ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় পাড়ার অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে, বাড়ির সামনেই একটি প্রায় মিনি দীঘির আকারের জলাশয়ে প্রচুর মাছ ছেড়েছেন পিকলুর দাদু, মাঝে মাঝে জেলে ডেকে উনি মাছ ধরান,আর, এই মাছটা ছোট, এটার স্বাদ ভালো হবেনা, ইত্যাদি বাহানায় প্রায় নব্বই শতাংশ মাছ আবার পকুরেই ছেড়ে দেন, আর বাড়ির কাজের লোক কে আদেশ দেন বাজার থেকে হেঁসেলের জন্য মাছ আনতে। ফলতঃ,মাছ গুলি ইয়া ইয়া সাইজের হয়ে উঠছিল,আর এভাবেই দাদুর প্রশয় পেয়ে জলে মাছ আর ঠাম্মার প্রশয় পেয়ে ডাঙায় পিকলু দিন দিন বেড়ে উঠছিল, আর পিকলুর মতই মানুষজনের প্রতি মাছদেরও সমীহ একেবারেই চলে গিয়েছিল ফলে,পুকুরে বাড়ির লোকজন নামলেই ওরা প্রায় হাতের কাছে চলে আসতে শুরু করেছিল।
পুকুরটিতে পিকলুদের বাড়ির দিকে একটি বাঁধানো ঘাট ছাড়া বেশীর ভাগটাই বড় বড় কচুগাছের জঙ্গলে ঘেরা পাড়, চটচটে এঁটেল মাটির তৈরি। সাপ খোপের রাজত্ব,ফলে পুকুরের একমাত্র বাঁধানো ঘাট ছাড়া অন্য কোনো ঘাট পারতপক্ষে ব্যবহার করা হয়না,তবে,নিন্দুকেরা বলে যে পাড়ার কিছু লোক পিকলুর দাদুর চোখের আড়ালে ছোট ছোট হাত জাল ওই জঙ্গলের পাঁকে ফেলে আসে, ফলে আর কিছু না হোক কিছু মাগুর,প্যাঁকাল বা ভাগ্যে থাকলে কিছু দুঃসাহসী রুই কাতলাও ধরা পড়ে, এছাড়াও বাবা,কাকা ও কলেজ পড়ুয়া দাদারা ওদিকে যায় লুকিয়ে ধূমপান করতে,সে করুক গিয়ে,ওসব এখন পিকলুর সিলেবাসের বাইরে। পিকলুর রোজকার কাজ ছিল সারা সকাল রাজকার্য্য সেরে সেনাবাহিনী নিয়ে পুকুরের ঘাট থেকে ঝাঁপিয়ে জলে পড়া ও বেশ ঘন্টাখানেক ধরে জলে দাপানো, যতক্ষণ না ঠাম্মার ডাক পড়ে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য।
পুকুরটিতে পিকলুদের বাড়ির দিকে একটি বাঁধানো ঘাট ছাড়া বেশীর ভাগটাই বড় বড় কচুগাছের জঙ্গলে ঘেরা পাড়, চটচটে এঁটেল মাটির তৈরি। সাপ খোপের রাজত্ব,ফলে পুকুরের একমাত্র বাঁধানো ঘাট ছাড়া অন্য কোনো ঘাট পারতপক্ষে ব্যবহার করা হয়না,তবে,নিন্দুকেরা বলে যে পাড়ার কিছু লোক পিকলুর দাদুর চোখের আড়ালে ছোট ছোট হাত জাল ওই জঙ্গলের পাঁকে ফেলে আসে, ফলে আর কিছু না হোক কিছু মাগুর,প্যাঁকাল বা ভাগ্যে থাকলে কিছু দুঃসাহসী রুই কাতলাও ধরা পড়ে, এছাড়াও বাবা,কাকা ও কলেজ পড়ুয়া দাদারা ওদিকে যায় লুকিয়ে ধূমপান করতে,সে করুক গিয়ে,ওসব এখন পিকলুর সিলেবাসের বাইরে। পিকলুর রোজকার কাজ ছিল সারা সকাল রাজকার্য্য সেরে সেনাবাহিনী নিয়ে পুকুরের ঘাট থেকে ঝাঁপিয়ে জলে পড়া ও বেশ ঘন্টাখানেক ধরে জলে দাপানো, যতক্ষণ না ঠাম্মার ডাক পড়ে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য।
তো, সেবার ফেব্রুয়ারির প্রায় শেষের দিকে সরস্বতী পুজো ছিল,পিকলুর মেজ জ্যেঠুর ছেলে পল্টু হাই স্কুলের পড়া শেষ করে শহরের কলেজে ভর্তি হবার জন্য এন্ট্রান্স দেবে,পল্টু পড়াশোনায় ভালোই,আর তার সাথে বেশ রাশ ভারী ও সাথে ওজনেও ভারী, পিকলুর জন্মের আগে সে ই ছিল পরিবারে সবার ছোটো এবং বলাই বাহুল্য আদরের, পিকলু আর তার সর্পদোষের ফেরে পড়ে পল্টুকে এখন পিকলুর অধীনস্থ হতে হয়েছে, ঠাম্মার ও বড়দের প্রশ্রয় তো আছেই,এছাড়াও রয়েছে পিকলুর প্রবল প্রতাপ ও ভাইবোনের কুখ্যাত দলবল। তাই পল্টু কে দমে থাকতে হয়, পিকলু বোঝে সে কথা, আর পলটুকে জব্দ করার ফিকির খুঁজতে থাকে। তাই সেদিন,কলেজে যাবার জন্য যখন পল্টুর জন্য একটি বড় প্যান্টুলুন সেলাই করে বাড়ির দর্জি মোবারক মিঞা ডেলিভারি দিতে এল, তখনই পিকলুর সেই প্যান্টুলুনের দরকার পড়ল,এখন আর তাকে কে বোঝায়, মোবারক যতই বলে " ছোট বাবু তোমার জন্য এই পোশাক যথেষ্ঠ বড়, তোমাকে ছোট মাপের প্যান্টুলুন সেলাই করে দেব'খন । আর যায় কোথায়, প্রবল প্রতাপের অধিকারী রাজাধিরাজ অহিভূষণ এর চেহারা নিয়ে কটাক্ষ! প্রবল জেদ ধরলেন মহারাজ, এই প্যান্টুলুনই তার চাই, সুতরাং, পিকলুর চিল চিৎকার,মঞ্চে ঠাম্মার প্রবেশ, আর ব্যস গল্প শেষ।
বহু কষ্টে দড়ি দড়া দিয়ে বুকটা টা ম্যানেজ হলো, কারণ কোমরের সাধ্য হলোনা প্যান্টটি ম্যানেজ করে, ফলে, প্যান্টটি বুক অব্দি তোলা হলো,পা গুলো গুটিয়ে মুড়ে দেওয়া হলো, কিন্তু পায়ের চারপাশ গুলি বেশ ফুলে থাকলো, ব্যাপারটা দেখতে হলো অনেকটা যেন দুটো গোদা পায়ের উপর বিষফোঁড়ার মতো অহিভূষণের আবক্ষ মুন্ডু।
যাকগে, এই পোষাক পরে দলবল নিয়ে অহিভূষণ চললেন রাজ্য জয়ে।
প্রথম লক্ষ্য হরিমুদির সব্জি বাগান, কয়েকদিন আগে প্রজাগণ কে সাথে নিয়ে অহিভূষণ ঢুকেছিল হরিমুদির বাগানে, ইচ্ছে ছিল টম্যাটো,কড়াইশুঁটি,গাজর,মর্তমান কলা ইত্যাদি দিয়ে জলযোগ করার, কিন্তু সেদিন হরি বাড়িতেই ছিল, বাগানে শব্দ পেয়ে গিয়ে হাতেনাতে সৈন্যসমেত রাজাকে গ্রেফতার করে,আর, সৌদামিনী দেবীর এজলাসে কিচ্ছুটি হবার নয় জেনে হরিমুদি সমস্ত সৈন্যদের সামনে মহারাজ কে কান ধরে ওঠবস করায়, অহিভূষণ ভীষণ অপমানিত হন। কিন্তু পল্টুটা জানতে পারলে হ্যা হ্যা করে হাসবে, তাই সব চেপে যান, অনেক দিনের মন্ত্রণা করার পর ছোটদা ‘মহামন্ত্রী বিল্টু’ পাক্কা খবর নিয়ে এসেছে,আজ সুবর্ন সুযোগ,আজ হরিমুদির আর পল্টুর দুজনের প্রতিশোধ এক সাথে নেওয়া যাবে। সেই মত প্যান্টুলুন পর্ব শেষ করে পল্টুটাকে হারিয়ে বিজয়ী অহিভূষণ চললেন হরিমুদি নিধনে, হরিমুদির বাড়িটা পিকলুদের পুকুরটির ওপারেই প্রায়, বেড়া দিয়ে ঘেরা কয়েক বিঘে জমি, জমির মধ্যেই বাড়ি আর ফল শাক সব্জীর বাগান, হরি খুব যত্নে রাখে এই বাগানটি, বাগানের বেড়ার বাইরে অনেকটা খোলা চাষের জমি, ছাওয়া বলতে একখানি প্রাচীন আমগাছ, গাছময় মোটা মোটা পিঁপড়ে,অনেক দূরে সরু রেখার মতো রেল লাইন, শীতের ফসল সব কাটা হয়ে গেছে, তাই , এখন জমি গবাদি পশুর চারণভূমি, দেখা গেল বিল্টুর খবর একদম ঠিক, শীতের রোদ্দুর ভরা ধূ ধূ মাঠে শুধুমাত্র রানী গোয়ালীনির হৃষ্টপুষ্ট গভীদ্বয় কালী-করালী চোখ বুজে জাবর কাটছে, এ তল্লাটে রানী গোয়ালীনির ঝগড়ার ও কালী - করালীর শিংয়ের গুঁতোর সুনাম আছে,এখন এদুটি কে হরিমুদির বাগানের রাস্তাটা চেনাতে হবে, ব্যস,তা হলেই হবে, এবারে গরুর কান ধরে,বিশেষতঃ রানী গোয়ালীনির গরুর কান ধরে ওঠবস করে দেখাও তো বাছাধন।
প্ল্যান মতো অহিভূষণএর হুকুমে বিল্টুকেই উঠতে হলো আমগাছে, পিঁপড়ের কামড় খেয়ে কোনও ক্রমে পাতা সমেত একটি মোটা ডাল হস্তগত করে, ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে গাছ থেকে নামল বিল্টু, এরপর কালী-করালীর গলায় বাঁধা দড়ির অন্য প্রান্তের খোঁটা টি খুলে পাতার লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে কালী- করালীকে হরিমুদির বাগানে গ্যারাজ করে দিয়ে অহিভূষণ সদল বলে বাগানের বেড়ার বাইরে ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন, কালীটা হ্যাংলার মতো আম পাতা খাচ্ছিল হামলে পড়ে, কিন্তু হঠাৎ করেই বেড়ার ওপারে খচমচ খচমচ শব্দ আর পর মুহূর্তে ই বাগানের বেড়া ভেঙে কালী উর্ধস্বাসে দৌড়ে বেরোলো, গলায় বাঁধা লম্বা দড়ি, আর তার প্রান্তে বাঁধা খোঁটা,সেই খোঁটায় করালীর পা জড়িয়ে করালী রাঙচিতের বেড়া শুদ্ধু সসৈন্য অহিভূষণ এর ওপর পপাত চ, অহিভূষণ এর সৈন্য দল ‘করালী’ চাপা পড়ে গোঙাচ্ছে, অহিভূষণ এই বিপদের মাঝে সৈন্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে চাইলেও বস্তবে দেখা গেল যে মাটিতে চিৎ হয়ে আছেন, আর ডান পা টা কোনও অমোঘ টানে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আর বাধ্য হয়েই গোটা শরীর টা, যেটা কিনা ইতি মধ্যেই পল্টুর ঢোলা প্যান্টের মধ্যে প্রায় ঢাকা পড়েছে এগিয়ে যাচ্ছে, -আসলে কালীর কানের মধ্যে আম গাছের বাঘা পিঁপড়ে, কালীর গলার লম্বা দড়ি,আর অহিভূষণ এর ঢোলা প্যান্ট, এই ত্রহ্যস্পর্শের কল্যানে অহিভূষণ কলীর গলায় বাঁধা পড়েছেন, এ অটুট বন্ধন কিভাবে আলগা হবে, ভাবতে ভাবতেই কালী অহিভূষণ কে সাথে নিয়ে হরিমুদির চৌহদ্দি ও কাঁকর ভর্তি রাস্তা পেরিয়ে পুকুরের বাঁধানো পাড়ের উল্টো দিকে কচু বনের জঙ্গলে সেঁধিয়ে গেল, আর তার পরেই দুর্গন্ধময় পাঁকের পাড় পেরিয়ে সিধে গিয়ে পুকুরের জলে গিয়ে পড়ল, কিন্তু সেখানেও শান্তি নেই, বোঝা গেল সে একটি চোরা জালের মধ্যে পড়েছে , আর সেই জালে ইতিমধ্যে কিছু পাঁকের প্রাণী স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ধরা পড়েছে, অহিভূষণ তাঁর তাবৎ গর্ব, প্রতিপত্তি নিয়ে দড়ি বাঁধা অবস্থায় বুক অব্দি পাঁকে এই জালের বাসিন্দা দের সাথে পড়ে থাকলেন।
ইতিমধ্যে বল্টু গিয়ে বাড়ীতে খবর দিয়েছে, যতটা সম্ভব রাজকীয় গোপনতা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বলেছে, বিশেষতঃ হরিমুদি আর তার বাগান সংক্রান্ত চক্রান্ত একেবারে বাদ। যাই হোক, সবাই মিলে জাল,মাছ,কালী সহ অহিভূষণ কে উদ্ধার করল।
এই ঘটনায় দুজনের সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে, প্রথমতঃ পল্টুর নতুন প্যান্ট আর অহিভূষনের প্রতিপত্তির ফানুস দুটোই ফেঁসে ফর্দা ফাঁই।
এক বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে অহিভূষণকে হাজির করা হলো, ঠাম্মা কেঁদে ভাসালেন, পল্টু দৌড়ে এল প্যান্টের খবর নিতে, পাঁকে ভিজে অদ্ভূত আকার ধারণ করেছে প্যান্টটি, বিশেষতঃ দুটি পা , কোল বালিশের আকার নিয়েছে, কিন্তু,পল্টুর নজর গেল প্যান্টের কোমর, অর্থাৎ কিনা যেটা দড়ি সহযোগে অহিভূষণ এর প্রায় বুক উচ্চতায় বাঁধা হয়েছিল, দড়ি ঠিকঠাকই আছে, কিন্তু বোধহয় ‘প্রাণ’ পেয়েছে, তাই তার ডগাটা লিক লিক করছে, ইতিমধ্যে ঠাম্মা এগিয়ে গিয়ে তাঁর সাধের পিকলুকে জড়িয়ে ধরতেই যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তখনই পল্টু চিৎকার করে উঠল, " ঠাম্মা, সাপ সাপ, পিকলুর প্যান্টে সাপ", বাকি ঘটনা চোখের নিমেষে ঘটে গেল,সর্পদোষ এর ভয়ে আক্রান্ত সৌদামিনী দেবী এক ঝটকায় প্যান্টের দড়ি খুলে দিলেন, আর পিকলুর ডবল সাইজের প্যান্ট সড়াৎ করে দোর্দন্ডপ্রতাপ অহিভূষণ আচার্য্যর সমস্ত মান সম্মান সমেত নিচে নেমে গেলো, একটি জল ঢোঁড়া মুক্তি পেয়ে মাটিতে পড়ল ,আর, অহিভূষণ আচার্য্য হাইজাম্পের বিশ্বরেকর্ড ভেঙ্গে বিল্টুর কাঁধে চেপে বসলেন, চারিদিকে হাসির হুল্লোড় এর মাঝে নগ্ন দোর্দন্ডপ্রতাপ অহিভূষণ আচার্য্য তাঁর সমস্ত মান সম্মান ধুলায় মিটে যেতে দেখলেন।
আর কিচ্ছু বলার মুখ নেই... এক বাড়ী লোকের ও নিজ সৈন্যদলের সামনে অহিভূষণের মাথা কাটা গেলো। বজ্জাত পল্টুটা সবাই কে বোঝাল যে অহিভূষণের প্যান্টে ‘অহি’ ঢুকে ছিল, আর, বীরপুঙ্গব অহিভূষণ ‘ঢোঁড়া’ কে ‘বোড়া’ ভেবে মহামন্ত্রী বিল্টুর মাথায় চেপে বসে ছিল। এর পর ধীরে ধীরে অহিভূষণ এর প্রতিপত্তি কমতে শুরু করে , আর, কেও যদি ভুল করেও কে "অহি" বলে ডাকতো তো উনি তাকে মারতে দৌড়তেন।
"আর আজও কেউ ওই নামে ডাকলেই সেই তিক্ত স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে তাই আর কি" , সলজ্জে বললেন অহিভূষণ।
"আর আজও কেউ ওই নামে ডাকলেই সেই তিক্ত স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে তাই আর কি" , সলজ্জে বললেন অহিভূষণ।
"ওহ এই ব্যাপার! "বলল দীপক, "যাক, আজ আপনার সর্পদোষ সত্যিই কাটল"।
একথায় দুজনেই একসাথে হো হো করে হেসে উঠলেন।।
| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Lock-down Issue,2020 | April 2020 |হাসিরাশি সংখ্যা।
।নববর্ষ ১৪২৭| Third Year Fifth Issue |22nd Edition|
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post