টেনশন
প্রতীক
কুমার মুখার্জি
১
ক্যাম্পাসের মাঠে ক্রিকেট খেলছিল
বুবলারা। স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার বিশাল ক্যাম্পাসে কুড়িজনের দলটা মশগুল হয়ে ছিল
খেলায়। হঠাত জিকো বলটা সপাটে তুলে মারতেই পিছনে ছুটল বুবলা - এটা ধরতেই হবে তাকে, নইলে এই বিচ্ছুদের টিমের ডাকাবুকো ক্যাপ্টেন
হিসেবে মান থাকবে না।
বলটা মাঠ পেরিয়ে সোজা উড়ে গেলো এস
বি আই গেস্টহাউসের দিকে। ক্যাচ হবার সম্ভাবনা নেই, কারণ সেটা
আগেই ওভার বাউন্ডারির গন্ডি পেরিয়ে গেছে। অগত্যা কেয়ারি করা পাতাবাহারের ঝোপের তলা
থেকে বলটা খুঁজে মাঠের দিকে ছুড়তেই, গেস্ট হাউসের দরজা খোলার আওয়াজে
বুবলা পিছন ফিরে তাকালো - এবং স্ট্যাচু হয়ে গেল সাথে সাথেই!
এ চেহারা যে ভোলার নয়। গেস্ট হাউস
থেকে বেরিয়ে আসছেন আর কেউ না, স্বয়ং ভীষ্মদেব সামন্ত - সেই ছফুট
লম্বা, টকটকে ফরসা, মুগুরভাঁজা বিশালবপু! সেই কাঁধ
অব্দি লম্বা কাঁচাপাকা চুল (এখন পনিটেলে সজ্জিত) বিশাল গোঁফের সাথে মানানসই
গালপাট্টা, প্রশস্ত কপালে সেই লাল টিপ ধকধক করে জ্বলছে! পরনে
শুধু ঘিয়ে গরদের ধুতি আর উত্তরীয়র জায়গায় লিনেনের শার্ট ট্রাউজার্স, আর হাতে ভাঁজ করা ব্লেজার।
দরজায় তালা দিয়ে ঘুরেই তার দিকে
তাকিয়ে একটা জিঘাংসালোলুপ হাসি, তারপর নারকীয় একখানা থাম্বস ডাউনের
পর সেই বুড়ো আঙ্গুল নিজের গলায় আড়াআড়ি চালিয়ে দেওয়া ! অতএব তিনিই স্বয়ং! একসাথে
মাথাটা ঘুরে উঠে পেটে মোচড় দিল বুবলার। শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে নেমে যাওয়া শীতল
স্রোতটা জানান দিল তার সামনে ভীষণ বিপদ।
ভদ্রলোক অবিশ্যি ইশারা করার পর
বুবলাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, তর্জনীতে চাবি ঘুরিয়ে শিস দিতে
দিতে মেনগেটের দিকে হাটা দিলেন। সম্বিত ফিরে পেতে বুবলা পায়ে পায়ে মাঠে ফিরে এসে
ফিল্ডিং করতে শুরু করল। সে যে মোটেই শান্তিতে ছিলনা, সেটা বোঝা
গেলো দু ওভার পরেই।
বিশ্বদুরন্ত ও নামকরা দুষ্টু, ক্যাম্পাসের দস্যিদলের অন্যতম মাথা বুবলা, ওরফে
অন্তরীক্ষ সেন জীবনে প্রথমবার, মাঠে অসুস্থ বোধ করায়, বন্ধুদের কাঁধে ভর দিয়ে সি উইং এর লিফটে চড়ে অসময়ে ফ্ল্যাট অভিমুখে রওনা দিল।
বাড়িতে ফিরতে বুবলার মা পড়ে গেলেন ফাঁপরে, কারণ তার
তেরো বছরের ক্ষুদে দানবটির এ হেন করুণ অবস্থা দেখে ওনারা একেবারেই অভ্যস্ত নন।
সন্ধ্যেবেলায় বাবা অফিস থেকে ফিরে
দেখেন ছেলে নেতিয়ে পড়েছে। তার মায়ের তো কাঁদোকাঁদো অবস্থা। হাজার প্রশ্নে জর্জরিত
করে চলেছেন ছেলেকে, 'কেউ কিছু বলেছে?' 'কারু সাথে
ঝগড়া হয়েছে?' 'বাইরে কিছু খেয়েছিস?' 'হঠাত পড়ে
গেছিলি?' ‘মাথায় লেগেছে নাকি বলবি আমায়?’ ইত্যাদি
ইত্যাদি। বুবলা চুপ - তার মুখ গম্ভীর, ভুরু দুখানি কুঞ্চিত, আর চোখদুটি চিন্তাক্লিষ্ট। স্ত্রীর ঝোলাঝুলিতে অগত্যা ডাক্তারবাবুর
স্মরণাপণ্য হতে হলো সেনবাবুকে।
তিনি এসে পরীক্ষা করে স্মার্ট
হাসিতে বললেন, "এ এখন সবার হচ্ছে, হিট স্ট্রোক," দিয়ে ছাপমারা কাগজের উপর একগাদা ফরমায়েশ লিখে দিয়ে করকরে পাঁচশো টাকা পকেটতস্থ
করে লিফটে ওঠার আগে সেনবাবুকে আলাদা করে ডেকে বললেন, "একটু শক তো
পেয়েছে, তবে চিন্তার কিছু নেই, বাকি কথা
রাতে হোয়াটস্যাপে হবে!"
সেনবাবু ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে
স্টেয়ারকেসের বিশাল জানলা দিয়ে নিজের অজান্তেই একবার বাইরে তাকালেন। এখান থেকে
গেস্টহাউসের সামনেকার দিকটা পরিস্কার দেখা যায়। তার মুখে বিরল এক অভিব্যক্তি ফুটে
উঠেই মিলিয়ে গেল - আশেপাশে কেউ কোথাও আছে কিনা এক ঝলক দেখে নিয়েই তড়িঘড়ি তিনি
ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লেন।
২
আলাদা করে বলি। কে এই ভীষ্মদেব
সামন্ত, কেনই বা আমাদের দাপুটে বুবলার তাকে দেখে আত্মারাম খাঁচাছাড়া
হবার উপক্রম? তিনিই বা কেন প্রতিহিংসার হাসি আর খবরদারিতে বুবলাকে
টেনশনে রোস্ট করে চলেছেন? বুবলার বাবা কেন এতো কিছুর পরও বেশ
নির্লিপ্ত? ডাক্তারের সাথে তার হোয়াটস্যাপে কিসের কথা? কেনই বা তিনি গেস্টহাউসের দিকে তাকিয়েই নিজেকে সামলে নেন? কিছু বোঝা যাচ্ছে না, তাইতো?
ঠিক আছে, এখন আগস্টের
মাঝামাঝি। সব জানতে হলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে - এই ধরো এপ্রিলের শেষের
দিকটায়, গরমের ছুটির সময়টাতে। তার আগে বুবলাদের গ্রামের বাড়ির
সম্বন্ধে বলে নিই একটু।
বুবলাদের আদি বাড়ি বর্ধমানের
মেমারি গ্রামে। ওখানে এখনো তিনমহলা একখানা বাড়ি আছে ওদের। সেনবাবুরা তিন ভাইবোন, পালা করে নিজের নিজের সময়মত দেখাশোনা করেন সেই বাড়ির। পূজো, গরমের ছুটি আর শীতের সংক্ষিপ্ত ছুটিতে সবাই জমায়েত হয় ওইখানে। এমন কোনো ছুটি
যায়না যখন বুবলারা গ্রামের বাড়ি যায়না ছুটি কাটাতে। এবং প্রতিবার সে কোনো না কোনো
দুর্ধর্ষ কীর্তি রেখে আসে তাদের আদি গ্রামের বাড়িতে।
বুবলার ভাইবোন নেই, সে একা। কাকার এক মেয়ে, এক ছেলে, আর পিসির এক
মেয়ে। তাদের এই দলে চারজনের ভিতর খুড়তুতো ভাইবোন এমনিতে শান্ত। কিন্তু পিসির মেয়ে
আর বুবলা হল দুষ্টুমির ক্যাটালিস্ট। এই দুজনের উস্কানিতে বাকি দুজন ও নিমেষে
নিজেদের ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলতে পিছপা হয়না – হলেই যে প্রেস্টিজ ইস্যু। এদের
ধুন্ধুমার কান্ডে গ্রামের মানুষ ত্রস্ত হয়ে থাকলেও, গ্রামতুতো
স্নেহমায়ার বশে, সেভাবে কেউ মুখ খোলেনা। অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে
করতে নিজেদের প্রবোধ দেয়, "আহা, মিষ্টি
বাচ্চাগুলো। কদিন বই তো নয় - ফিরে গেলেই সব ঠিকঠাক আবার!"
সুতরাং অত্যাচার চলতে থাকে, উত্তরোত্তর বেড়ে চলে এই বোম্বেটে বাহিনীর বোমাবর্ষণ। বাবা মায়েরা প্রমাদ গুনতে
থাকেন, গ্রামের লোকেদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে হাতজোড় করতে থাকেন
চুপিচুপি। কিন্তু দিনদিন তাদের চিন্তাও বাড়তে থাকে। বলা বাহুল্য, মুখ্য চিন্তাটা বুবলা আর তার পিসীর মেয়েকে নিয়ে - সব কিছুর মাস্টারমাইন্ড ওরা
দুজন। এদের কিছু কাজের নমুনা দিলেই বুঝতে পারবে তোমরা, বানরবাহিনী
বা পংগপালের চেয়ে কিছুমাত্র কম যায়না এদের হাতযশ।
গ্রামের প্রতিটা বাগানে একটি ফলও
আস্ত থাকেনা - ঠিক আছে, ফল খাচ্ছ খাও, সমস্ত কাচা ফলগুলি পেড়ে ফেলে নষ্ট করার মানে কি? রয়েছে
গুলতির কেরামতি, তা দিয়ে কখনো কারো ছাগল ভেড়া, নয়তো ছিপের
ফাতনা লক্ষ্য করে টিপ করে মাছধরার বারোটা বাজানো, এগুলো
সাধারণ। শান্তভাবে চলেফিরে বেড়ানো গরুমোষের ল্যাজ মুচড়ে দিয়ে সেগুলোর সাথে সাথে
গ্রামের শান্তি নষ্ট করা, এ কোনদেশী ভদ্রতা বলতে পারো?
কাকতাড়ুয়ার মাথার হাড়ি, কলসী কুজো, কুকুর বিড়ালের ল্যাজে কোল্ড ড্রিঙ্কসের ক্যান বেধে
দিয়ে সেগুলোকে টিপ করা, কিচ্ছু বাদ যায়না এই বিচ্ছুদের হাত, থুড়ি, গুলতি থেকে। পাড়াগাঁ অঞ্চল, অনেকে ভূতে
অপদেবতায় ভয় পায়। ভর সন্ধ্যায় ফাকা জায়গা দেখে দল বেধে আপাদমস্তক সাদা থান জড়িয়ে
হঠাত কাউকে ভয় পাওয়ানো, এসবেও পিছপা নয় এরা। কাকপাখিতে
টেনে আনা আধখাওয়া ইঁদুর ইত্যাদি ফেলে রেখে আসে কারো তুলসীতলায়, কি নিকোনো উঠোনের মাঝবরাবর।
এর দাওয়ায় শুকোতে দেওয়া আচার, বড়ি বা আমসত্ত্ব চুরি করে অন্য বাড়িতে রেখে আসা, তারপর
নিষ্পাপ মুখে জমিয়ে দুইবাড়ির ঝগড়া দেখতে যাওয়া, এসব ওদের
কাছে নস্যি। আগের বছর কলকাতা থেকে একটা রবারের লাউডগা সাপ নিয়ে গিয়ে ভয় দেখাতে
গিয়ে সে এক সাংঘাতিক কান্ড। আরেকটু হলে বিচ্ছিরি একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতো
শীতলজেঠুর।
দুষ্টুমি ছোটবেলায় সকলে একটু আধটু
করেই থাকে, কিন্তু এদের দুষ্টুমির ধরনটা ভালো নয়। ক্ষতিসাধনের
একটা প্রছন্ন চেষ্টা আছে এতে। এই নিয়ে সবাই বড়ই উদ্বিগ্ন - সবাই ভাবতে থাকে কি করে
এদের থামানো যায়, কারণ এরপর লোকে আর বাচ্চা বলে ছেড়ে কথা বলবেনা।
৩
এতদিন ছুটিতে গ্রামজুড়ে লুঠতরাজ
চালালেও, অজানা কারণবশত কিছু লোকের থেকে দূরে থাকত এই
বিচ্ছুবাহিনী। যেমন কবিরাজ শ্যামাপদ পাকড়াশী মশাই এর ধারেকাছে ঘেঁষত না এরা। এই
তালিকায় পড়তেন পঞ্চায়েত প্রধান পরিতোষ কর্মকার, পুরোহিত
শিবতোষ গাংগুলী, আর অবশ্যই ভীষনদেহী ভীষ্মদেব সামন্তমশাই।
সামন্তরা ছিলেন এ গ্রামের জমিদার।
জমিদারি গেছে, কিন্তু ঠাটবাট, দানধ্যান, আর আলগা চাকচিক্যের সাথে বিশাল চকমিলানো বাড়িটা, হরেকরকম
গাছপালার বিশাল উদ্যানের সাথে তিনটে বিশাল বিশাল দিঘী সেই জমিদারীর প্রমাণ।
বিশালদেহী ভীষ্মদেব আসলে সেনবাবুর বন্ধু, একইসাথে গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা
করেছেন, কিন্তু রাজাপ্রজায় একটা ব্যবধান রয়েই গেছে। বাড়ির
মন্দিরে নিজে যখন পূজো করেন গরদের ধুতি উত্তরীয় গায়ে, কপালের লাল
টিপ আর গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে বুক কেঁপে ওঠেনা এমন মানুষ খুব কমই আছে গ্রামে।
ভীষ্মদেব এদের কাণ্ডকারখানা সম্পর্কিত
সব খবর রাখতেন, কিন্তু সেভাবে কিছু বলতেন না - হয়তো আত্মপ্রসাদ অনুভব
করতেন এরা তাকে কোনোদিন আক্রমণ না করায়। এক দুবার সেনবাবুকে ডেকে বন্ধুর মতই
বুঝিয়েছিলেন বাড়ির ছেলেদের বাগে আনার ব্যবস্থা করতে। আর সেটা কোনোভাবে শুনে ফেলে
বুবলা। ব্যস, আর যাবে কোথায় – চ্যালেঞ্জ নিয়েই ফেলল বুবলা। ওনার তো
কোনোদিন কোনো ক্ষতি করিনি আমরা? তাহলে আমাদের শাসন করতে বলবেন কেন
উনি?
তাই এইবার গরমের ছুটিতে গিয়ে
অন্যান্য দুষ্টুমীর সাথে একটা জিনিস করার দুঃসাহস করেছিল বুবলা। ছোটখাটো অপারেশন
অনেক হয়েছে, এবার সে টার্গেট করেছিল ওই দশাসই ভীষ্মদেবকেই। এবং
ঠান্ডামাথায় প্ল্যান করে করেছিল কাজটা।
ওরা ওনার পুকুরে, বাগানে, বাড়িতে কোথাও হাত দেয়নি, কারণ জানতো
ওসব জায়গার নাগাল পাওয়া কঠিন। তাই, চুপচাপ নিজের মোবাইল ঘেটে এমন কাজ
করেছিল, যাতে ছোটাছুটি না করেও সে দুষ্টুমীর ফল হল
বিচ্ছিরীরকমের। আর ঠিক কলকাতায় ফিরে আসার দিনে কায়দা করে বিস্ফোরণটা ঘটিয়েছিল
বুবলা এন্ড কোম্পানি, যাতে গ্রামে অশান্তি হলেও কেউ তার টিকি ছুতে না পারে।
ঘটনার দিন সকাল নটায় বিরাট একটা
ট্রাক গ্রামে ঢোকার প্রধান রাস্তায় এসে থামল। এরপর ছোট রাস্তা, অতবড় গাড়ি আর ঢুকতে পারবেনা। ইউনিফর্ম পরা লোকজন নেমে এসে ভীষ্মদেবের ঠিকানা
খুঁজতে, সবাই বাড়ি দেখিয়ে দিলো। লোক দুজন বাড়িতে এসে
সামন্তমশাইকে বলল, "আপনার অর্ডারি মালপত্র এসে গেছে
স্যার, রিক্সা ভ্যান বা গরুর গাড়ি পাঠাতে হবে, নিদেনপক্ষে ছোট গাড়ি, নইলে অত জিনিস আসবে কি করে? আর এই আপনার বিল, তিন লক্ষ একুশ হাজার। এটা সিওডি আছে, কার্ডে করবেন না ক্যাশে, স্যার?"
দেখেশুনে সামন্তমশাই এর গালে মাছি, শিবনেত্র অবস্থা!! বিলের শোভা বাড়াচ্ছে বেয়াল্লিশ ইঞ্চির টিভি, কম্বো মাল্টিপ্রসেসর ফ্রিজ, গাদাখানেক ব্র্যান্ডেড ফার্নিচার, দামী দু টনের চারটি এসি ইত্যাদি। ফরসা রঙ আস্তে আস্তে দুধেআলতা হতে শুরু করতেই
ফোনটা বেজে উঠল ওনার - "মিস্টার ভি ডি সামন্ত? আপনার বাড়ি
যাবার একটা ঠিকঠাক ল্যান্ডমার্ক বলুন তো! আমি এশিয়ান পেন্টস ইজিপেন্ট থেকে বলছি, আপনার বাড়িতে আজ থেকে কাজ শুরু। জব কার্ডে লেখা আছে আমরা এগারোটায় শুরু
করবো।" ধপ করে শ্বেতপাথরের রোয়াকে বসে পড়লেন ভীষ্মদেব, চোখমুখ বিস্ফারিত। আর ঠিক সেই সময়েই সেনবাবুরা কলকাতা ফেরার জন্য বাড়ি থেকে
বেরোলেন।
যখন সামন্তবাড়ি পেরোচ্ছে বুবলারা, তখন সেখানে ধুন্ধুমার কান্ড! আপাদমস্তক সিঁদুররাঙ্গা ভীষ্মদেব, বাজখাঁই গলায় প্রশ্নবাণ দেগে চলেছেন, "কিসের অর্ডার? কিসের বুকিং? কে করেছে? কলকাতা থেকে বুকিং হয়েছে? আমার কাছে স্মার্টফোনই নেই! এই অর্ডার কিভাবে আপনাদের কাছে গেছে তার আমি কি
জানি?" ঘটনাটা ঘটছিল ঠিক সামন্তবাড়ীর সামনে রাস্তার উপর, আর সেটাই গ্রাম থেকে বেরোনোর একমাত্র প্রধান সড়ক। বুবলাদের গাড়ি ওখান দিয়ে পার
হবার সময়েই তার মিচকে হাসিমুখটা তাঁর চোখে পড়ে গেলো – আর যায় কোথায়? পিছনে দেখা গেলো ছুটে আসছেন ভীষ্মদেব,"তুই করেছিস?এত সাহস তোর?আমি শেষ দেখে ছাড়বো। রোককে, রোককে!!
জেলে গিয়ে পচবি তুই, আমি আসছি কলকাতায়। এর প্রতিশোধ আমি নেবো। গ্রামছাড়া
করবো তোকে।"
গাড়ি চলার সাথে সাথে কথাগুলো
মিলিয়ে যেতে বুবলা দেখলো মায়ের চোখে জল, আর বাবা কপাল টিপে ধরে বসে আছেন
চুপ করে। সেই সময়েই উল্টোদিক থেকে আসা আরেকটা ট্রাক তাদের থামালো, "ভীষ্মদেব সামন্তের ঠিকানা বলতে পারবেন? ট্রাক ভরতি
জামাকাপড়, ওনারই সমস্ত অর্ডার। একবার বাড়ি খুজে পেলেই ট্রাক
খালি।" বুবলা গম্ভীরভাবে পিছনদিকে ফেলে আসা গ্রামটা দেখিয়ে দিতেই বাবার হাতের
একটা বিরাশি সিক্কার চড় আছড়ে পড়ল তার গালে - প্রথমবার!!
৪
এসব কথাই শুয়ে শুয়ে ভাবছিল বুবলা।
সেই এপ্রিল মাসের ঘটনা, আর এটা আগস্ট - তিনমাস কেটে গেছে, সে ভেবেছিল ফাঁকা আওয়াজ। কিন্তু তিনমাস পরে লোকটা এসেছে, তাকে এক দেখাতেই চিনেছে, নিঃশব্দে শাসিয়েছেও। তাহলে এবার কি
হবে - সত্যি সত্যিই কি তাকে জেলের ঘানি টানতে যেতে হবে? সে শুনেছে, অল্পবয়সী অপরাধীদের আলাদা জেল আছে। আবার গা পাক দিয়ে উঠল বুবলার।
সেদিন অনেক রাতে ঘুম এলো বুবলার, মাঝে মাঝেই চমকে উঠে বসছিল সে। পরদিন সকালে উঠেই বারান্দায় ছুটে গেলো, সম্ভবত কালকের ব্যাপারটার সত্যাসত্য যাচাই করার জন্য। গেস্টহাউসে তালা দেখে সে
যারপরনাই খুশি হয়ে রেলিঙে ভর দিয়েই আঁতকে উঠে পিছিয়ে এলো। ব্যালকনির ঠিক নিচে
দাঁড়িয়ে ভীষ্মদেব সামন্ত, তার দিকে আঙ্গুল তাক করে হাতের
মুদ্রায় বন্দুক চালিয়েই তাদের লিফটের দিকে এগোতে লাগলেন তিনি। বুবলা শিউরে উঠে
ছুটে গিয়ে বাথরুমে দরজা দিলো।
কিন্তু পনেরো মিনিট কেটে গেলো, তাদের বাড়িতে কেউ বেল বাজালো না দেখে পায়ে পায়ে বেরিয়ে এসে সোজা নিজের ঘরে
গিয়ে শুয়ে পড়ল ডানপিটে বুবলা। কিছুক্ষণ পরে তার মা গিয়ে দেখলেন তার রীতিমত কম্প
দিয়ে জ্বর এসেছে। সেদিন স্কুল যাওয়া বন্ধ হল ছেলের। কিছুক্ষণ পর পরই বুবলা জানলার
ফাক দিয়ে, কখনো পর্দা সরিয়ে, বা ব্যালকনি
থেকে উঁকি দিতে লাগলো – লক্ষ্য গেস্টহাউস। কিন্তু ‘নো সাইন অফ সামন্ত!’ লোকটা গেলো
কই? পুলিশের কাছে তার নামে নালিশ করতে নয়তো?
বিকেলে খেলতে নামছিল না বুবলা, কিন্তু বন্ধুরা ডাকাডাকি করতে বুকে বল পেলো সে। মা লক্ষ্য করলেন প্রথমবার, ছেলেকে একটু অন্যরকম লাগছে ! অন্যদিনের মতো ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব টা যেন জলে
ভেজানো মুড়ির মতোই নরমের দিকে! ‘আমার একমাত্র ছেলেটার মাথাটা ঠান্ডা করে দাও ঠাকুর, আমি কামাখ্যার মন্দিরে তোমায় গয়না...’ এই অব্দি ভাবতে ভাবতেই দরজায় প্রবল
ধাক্কার সাথে ডোরবেলের আওয়াজে ছুটে গেলেন তিনি।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে
বুবলা – দরদরিয়ে ঘামছে সে। ‘কি হয়েছে বাবা, ফিরে এলি
কেন?? শরীর খারাপ করছে? কি হয়েছে বল আমায়?’ দুরন্ত বুবলা আর কিছু না বলে মায়ের হাতে একটা লাল গোলাপ গুঁজে দিয়ে ফোঁপাতে
ফোঁপাতে মায়ের বুকে মুখ ঢাকল। পরে সন্ধ্যেবেলায় বাবা বাড়ি ফেরার পর সে জানালো
বিকেলে মাঠে যেতেই গেস্টহাউসের লোকটা হন-হনিয়ে এসে বুবলার হাতে ফুলটা ধরিয়ে দিয়ে
একটা ‘থাম্বস আপ’ দেখিয়ে হা হা করে হাসতে হাসতে গেস্টহাউসের দিকে ফিরে যায়।
বাবা সব শুনে যেন আমলই দিলেন না, বললেন, ‘তোর মত দানবকে যদি কোনো ভদ্রলোক ফুল দিয়ে থাকেন তিনি
নিশ্চয় ভুল করেছেন, তারই উচিত ডাক ছেড়ে কাঁদা।‘ তখন বুবলা আসল কথাটা বলল, ‘বাবা, লোকটা আর কেউ না, আমাদের
গ্রামের সামন্তকাকু!’ বাবা বললেন, ‘হতেই পারেনা, ভীষ্মদেব গ্রাম ছেড়ে এভাবে বেরোতেই পারেনা, দাঁড়া, তাও আমি গ্রামে ফোন করে খোঁজ নিচ্ছি।‘ কিন্তু গ্রামে ফোন করে দেখা গেলো সত্যিই
ভীষ্মদেব গ্রামে নেই, বাইরে কোথাও গেছেন। অবশ্য কোথায় গেছেন সে ব্যাপারে
কেউ বলতে পারলোনা।
পরের তিনটে দিন বুবলার তেরো বছরের
জীবনে সবচেয়ে অন্ধকার দিন হিসেবে গণ্য হয়ে থাকলো। বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে ক্যাম্পাস
সংলগ্ন সমস্ত জায়গা থেকে নানাভাবে নিঃশব্দে আমাদের তুখোড় বুবলাকে টেনশনে জর্জরিত
করে তুললেন ভদ্রলোক। কিন্তু ওই পর্যন্তই, তার বেশি কিছু ঘটলো না – একটা কথাও
উনি বলেননি। কিন্তু তার নিজের করে আসা অনাসৃষ্টি ও তার ফলে অগ্নিশর্মা সামন্তকাকুর
মুখ থেকে বেরোনো প্রতিটা শব্দ মনে পড়তে লাগলো বুবলার, মনে করালেন
গেস্টহাউসের অতিথি। বাবা মা দু তিনবার গেস্টহাউসে গেলেন বটে দায়সারা, কিন্তু দেখা হলোনা ভীষ্মদেবের সাথে।
শেষে মরিয়া বুবলা পুলিশকে ফোন করার
কথা ভেবেও হাত গুটিয়ে নিলো। সে ভাবলো, পুলিশ যদি আসে, তাহলে সব শুনে তাকেই ধরবে, কারণ সত্যি কথা, আজ অব্দি সামন্তকাকু তার এতটুকু অনিষ্ট করেননি। এতদিন যা অনিষ্ট করার সে
করেছে। ভিতরে ভিতরে কোথায় যেন তার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসছে। সে নিজের অবস্থা দেখে
আগে তার করা সমস্ত দুষ্টুমির জন্য আক্ষেপ করতে শুরু করেছে!
৫
চারদিন চলার পর আর পারলোনা বুবলা।
বাবা মায়ের সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সমস্ত দোষ স্বীকার করে তাঁদের পা ছুয়ে
প্রতিজ্ঞা করলো যে আর কখনো সে দুষ্টুমি করবেনা। মায়েরা নরম মনের মানুষ, সেই বিধি মেনেই যেন মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবা বললেন, ‘নে, এবার নিজে ফোন করে সামন্তকাকুর কাছে ক্ষমা চাইবি, আমি ডায়াল করছি…’ কথা শেষ হতে না হতেই বুবলা লাফ দিয়ে উঠে বলল, ‘ফোনের কি দরকার, আমি এক্ষুনি গিয়ে কাকুর সাথে সব সেটল করে ফেলছি!’ বলে
তিন লাফে বেরিয়ে গেলো ফ্ল্যাট থেকে।
এবার সেনবাবু হতভম্ব ভাবে স্ত্রীর
দিকে চেয়ে হাত উল্টে, ‘যাচ্চলে, এবার সামলাবো কি করে?’ বলেই দেখেন, তাঁর স্ত্রী তাঁর দিকে চোখ পাকিয়ে বসে আছেন। ঝামেলা
হবার আগেই সেনবাবু বললেন, ‘শোনো, যা করেছি
তাতে হয়তো তোমার গোপালের একটু কষ্ট হয়েছে, না করলে ও
বজ্রংবলী হয়ে দেশবিদেশে ল্যাজের আগুন ছড়িয়ে বেড়াতো। তোমার ছেলে আর কোনদিন দুষ্টুমি
করলেও, বদমায়েসী করবেনা, আমার
গ্যারেন্টী রইল। এবার তাড়াতাড়ি গেস্টহাউসে চলো। এই অবস্থায় তাকে কি করতে হবে, সহদেব মোটেই জানেনা।‘
গেস্টহাউসের অবস্থা তখন মারাত্মক!
ওই বিশাল চেহারায় কালো একটা জিম ভেস্ট আর লিওটারড পরে নাকিসুরে বিশুদ্ধ মার্কিনীতে
পরিত্রাহি চিৎকার করে চলেছেন ভীষ্মদেব, থুড়ি সহদেব সামন্ত, ‘হে বয়, প্লীজ লিভ মি। হোয়াট অন আর্থ! লেট মি গো! লেট গো মাই
লেগস – আই গন্না ফল!!’ কিন্তু কে শোনে কার কথা? অতবড়
চেহারার লোকটির পা ধরে ঝুলে আছে বুবলা – দেখে মনে হচ্ছে যেন গোল্ডেন বীকড কিং ঈগল
পায়ে করে ছোট্ট একটা মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে !!
অনেক কষ্টে দুজনকে ছাড়ানো গেলে, গেস্টহাউসে তালা দিয়ে সবাই ফিরে এলো বুবলাদের ফ্ল্যাটে। সেখানে বসেই জানা গেলো
যে গেস্টহাউসের অতিথি মোটেই ভীষ্মদেব সামন্ত নন, ইনি তার যমজ
ভাই সহদেব সামন্ত, আমেরিকাবাসী কুড়ি বছর যাবত। প্রতিবছর দেশের বাড়িতে
এসে পনেরো বিশদিন থেকে যান। আর এই পুরো প্ল্যান টা বেরিয়েছে সেনবাবু আর ভীষ্মদেবের
মাথা থেকে। ঠিক করেছিলেন, বুবলার বুদ্ধিমত্ত্বার কাঁটা ওনারা
বুদ্ধিমত্ত্বার দ্বারাই তুলবেন – ছুটিতে পাকানো অশান্তির শোধ নেবেন ছেলেটাকে
টেনশনে ছুটোছুটি করিয়ে! বুবলা এবং তার মায়ের এই যমজের ব্যাপারটা জানা না থাকায়
প্ল্যান করতে কোনো অসুবিধাই হয়নি!
সব জানার পর প্রবল হাসাহাসির ভিতর
একটা ফোঁপানোর আওয়াজে সবাই দেখলো বুবলা হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে। আজ কেউ তাকে বাধা দিলো না, শুধু সহদেব তার পকেট থেকে একটা দামী ডিজিটাল ক্যামেরা বাড়িয়ে ধরে বলল, ’ফ্রম টুডে দিস ইস ইওয়স, জাস্ট ডিলিট দ্য স্ন্যাপস আই টুক
টু কিপ এন আই অন ইউ, মিস্টার ডেনিস!’ মার্কিনী মানুষ তো, ওদের কাছে ডেনিস হলো দুষ্টুমীর ইউনিট!
বুবলাই ঠিক করল পরেরদিন সবাই মিলে
গ্রামে যাবে, প্রথমে ভীষ্মদেবকাকু, তারপর সমগ্র
গ্রামবাসীর কাছে ক্ষমা চাইবে সে। তার বাবা এটা জানিয়ে সামন্তকাকুকে ফোন করার কথা
বলতে গেলে বুবলা বারণ করে, ‘সারপ্রাইজ দিয়ে শুরু হয়েছিল, সারপ্রাইজ দিয়েই শেষ হোক!’
পরদিন গাড়িতে সামনের সীটে বসা
সহদেবকাকুকে জিগ্যেস করলো বুবলা, ‘আই ডিড দ্য মিসচীফ ইন এপ্রিল, হোয়াট টুক ইউ সো লং?’ এক গাল হেসে চকচকে সদ্য কামানো
গালে হাত বুলিয়ে জবাব দিলেন ছোট সামন্ত, ‘ইট টুক লং টু গ্রো সাচ ম্যামথ
হুইস্কারস টু লুক লাইক ভীষ্মা !!’
মা পিছনের সীট থেকে অবাক হয়ে
তাকাতে বাবা বুঝিয়ে দিলেন, ‘আরে আমেরিকার অফিসে তো ওরকম বুনো
রাক্ষসের মত গোঁফদাড়ি রাখতে দেয়না!’
‘আরেকটা প্রশ্ন বাবাকে,’ গম্ভীর মুখ বুবলার, ‘ডাক্তারবাবুর সাথে হোয়াটস্যাপে কি
কথা হতো তোমার?’ সেনবাবু বললেন, ‘সে অনেক কথা
বাবা, যতটা শক তুমি লোককে দিতে, তার কতটা
তোমার শরীর নিতে পারে তার হিসেবপত্র করতাম আমরা। বড় হয়ে বাবা হও, সব হাড়ে হাড়ে বুঝবে!’
হাসির রোল উঠিলো, গাড়ী সবেগে ‘ছুটির ডেস্টিনেশন’ এর দিকে ‘ছুটিতে’ লাগিলো।।
| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Lock-down Issue,2020 | April 2020 |হাসিরাশি সংখ্যা।
।নববর্ষ ১৪২৭| Third Year Fifth Issue |22nd Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post