এক মুঠো আকাশ
সাত বছর ধরে তিলতিল করে সঞ্চয় করে এই ছোট্ট বাড়িটা গড়ে তুলেছে অঞ্জলি। মামীকে
নিজের কাছে এনে রেখেছে। ভাড়াবাড়ি থেকে শাশুড়িকেও নিয়ে এসেছে। বুড়ি এখন ওপরে উঠতে
পারেনা, একতলাতেই পা ঘষটে ঘষটে কোনরকমে হাঁটাচলা করে নিজের
প্রাত্যহিক কাজগুলো করে। মামী থাকায় সুবিধে হয়েছে। নিশ্চিন্তে অঞ্জলি বাইরে যেতে
পারে। সন্ধ্যেবেলাটা সে খোলা ছাদেই কাটায়,কখনো মামী থাকে,কখনো বা একাই। আজও
অঞ্জলি চুপ করে ছাদে বসেছিল। আজকে স্কুলের ঘটনাটা বাড়িতে জানাবে কিনা ভাবছিল। শুধুশুধু
দুটো অথর্ব মানুষকে দুশ্চিন্তায় ফেলা! প্রতিদিন সকাল থেকে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে
এটুকুই তার অবসর। কাকডাকা ভোরে উঠে রান্না চাপিয়েই বাসন মাজতে বসে। এরমধ্যে বুড়ি
শাশুড়িকে কোনক্রমে বিছানা থেকে উঠিয়ে ঘর পরিষ্কার করে বুড়িকে চা মুড়ি দিয়ে নিজে
ভাত ডাল খেয়ে শাড়ি পরে সকাল আটটার মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। মামী বহুবার রান্না
করতে বারণ করেছে, অঞ্জলি শোনেনি। বলেছে, “সকালটা আমিই করি, রাতের খাবারটা তুমিই
করো”। এই ক’বছরে আমার এটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। তুমি তো মাত্র দুবছর হলো এসেছো। "
হ্যাঁ ,দুবছর হলো এই বাড়িটা করে গৃহপ্রবেশ করেছে। সেদিন থেকেই মামী
এখানেই আছে। অঞ্জলি সকালে স্কুলে গেলে দরজাটা শাশুড়ি নিভাননীই বন্ধ করে দেয়। এভাবেই
চলছে আজ সাত বছর। দশটার মধ্যে স্কুলে পৌঁছতেই হবে,অঞ্জলি একটা প্রাইমারি
স্কুলে পড়ায় গত পাঁচবছর ধরে।
মা মারা যেতেই বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে
করে, সামান্য পিয়নের চাকরিতে সংসার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতো। চার বছরের
অঞ্জলি সৎ মা আসার পরেই কিভাবে যেন বড় হয়ে গিয়েছিল, খিদে পেলেও চুপ করে
থাকতো। কান্নাকাটি করতোনা। আরো চারবছর যেতেই দুই বোনের জন্ম হয়ে গিয়েছিল। বাবা
সংসারের খরচ বইতে পারছিল না। একদিন আটবছরের অঞ্জলিকে নিয়ে মামারবাড়ি রেখে এলো। মামার
মুদির দোকান,তবে একমাত্র বোনের মেয়েকে বুকে টেনে নিয়েছিল। মামী
নিঃসন্তান, অঞ্জলিকে পেয়ে দুজনেই আনন্দে মেতে উঠলো। কাছেই সরকারি স্কুলে ভর্তি করে দিল। অঞ্জলি
ভালোবাসার স্বাদ পেলো। কলেজে উঠতেই মামা আচমকাই হার্টফেল করে মারা গেলো। মামীও
শোকেতাপে বিছানা নিলো। তারমধ্যেই মামীর ভাই এসে গেড়ে বসলো।
ভাড়াবাড়ির পাঠ চুকিয়ে স্থায়ীভাবে এখানেই থেকে গেলো। মামীও বাড়িতে একজন
পুরুষমানুষ থাকলে ভালো হবে ভেবে আপত্তি করলোনা। যদিও নিজের ভাইকে ভালোই চিনতো। বেকার,জুয়াড়ি বলে কেউ মেয়েও
দেয়নি। তারজন্য অবশ্য নারীসঙ্গ থেকে সে
বঞ্চিত নয়। খারাপ পাড়ায় তার নিত্য আনাগোনা।
-“দিদি,জামাইবাবুর দোকান এবার থেকে আমিই খুলবো। এভাবে বসে থেকে তো
লাভ নেই। তোকে কিছু চিন্তা করতে হবেনা”।
মামী বুঝেছিল প্রতিবাদ করে লাভ নেই। অঞ্জলি কলেজে চলে যায়,দোকান বন্ধই থাকে। তার থেকে
যদি সুবল,তার ভাই দোকান খুলতে চায়,খুলুক। মুদিখানার
মালপত্তর তো নষ্ট হয়ে যাবে।
-“অনু,কি করি বলতো? সুবলের মতিগতি কখনওই ভালো ছিলনা,বুঝতে পারছিনা ওর হাতে
দোকানের ভার দেওয়া ঠিক হবে কিনা”
-“ চিন্তা করে কি আর হবে! কমাস দেখোই না। তারপর নাহয় অবস্থা
বুঝে ব্যবস্থা”।
বাংলায় এম এ কম্পলিট করে অঞ্জলি তখন বি এড করতে চলে গিয়েছে হোস্টেলে। মামাবাড়িতে
ছুটিছাটায় আসে। ও গেলেই মামী ওর হাত চেপে ধরে, “তুই না থাকলে বাড়িটা
বুকে চেপে বসে।আ জকাল সুবল তেমন টাকাকড়িও দেয়না, বলে, বিক্রিবাটা তেমন
হচ্ছেনা। আমার মনে হয় ওর অন্য কোন মতলব আছে”।
সুবল সেদিন রাতে খেতে বসার সময় বলে, “দিদি অনেকদিন ধরেই
বলবো বলবো করেও বলে উঠতে পারছিলাম না”। অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বলে,
“একটা
ভালো সম্বন্ধ আছে,যদি অঞ্জলির বিয়ে দিতে চাস তো চেষ্টা করে দেখতে পারি”।
-“ আমি এখন বিয়ে করবো না।বিএড কম্পলিট হলে চাকরি করবো”।
-“আসলে এইকদিনে প্রচুর ধার দেনা হয়ে গিয়েছে,এই ভদ্রলোকই আমায়
টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছে”।
-“একথা তুই আগে কেন বলিসনি ? তোর জামাইবাবু সৎ মানুষ ছিলেন আর তুই এভাবে...”, মামী
দুচোখে আঁচল চাপা দেয়।
-“ভদ্রলোককে কালই একবার আসতে বলি। দেখাশুনো হতে ক্ষতি কি! পছন্দ না হলে নাহয়
বাতিল করে দিও”।
সেরাতে মামীর পাশে শুয়ে অঞ্জলি বলেছিল, “
মামী,
আর
কয়েকটা মাস। তারপরেই আমি ঠিক একটা কিছু জুটিয়ে নেবো”।
-“ আমি দুচোখ বুঝলে তুই কোথায় গিয়ে দাঁড়াবি সেটা ভেবেছিস ? তার
থেকে যদি তেমন হয় বিয়েটা করেই নে,আমিও নিশ্চিন্ত হবো”।
-“ তোমাকে যেতে দিলে তো; আমি চাকরি করে তোমাকে আমার কাছে
রাখবো, একদম চলে যাওয়ার কথা বলবে না, মামা যদি থাকতো!” অঞ্জলির গলা ভারভার। মামী অঞ্জলির মাথায় হাত
বুলায়,অঞ্জলি মামীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর দিন সেই ভদ্রলোক, প্রদীপ এসেছিল অঞ্জলিকে
দেখতে- কথাবার্তায় খারাপ লাগেনি।
-“ বাড়িতে আমার মা ছাড়া কেউ নেই,তবে মা প্রায় শয্যাশায়ী,
তাই এই চল্লিশ বছরেও বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। সুবল অঞ্জলির কথা বলতে আমি নিমরাজি হয়েছি,সংসার
দেখার লোক চাই, নতুবা বিয়ের দরকার ছিলনা, আপনারা যদি চান আমার বাড়িতে গিয়ে দেখে
আসতে পারেন, আমি সরকারি অফিসে কেরানিগিরি করি,মাসে যা পাই কুড়িয়ে বাড়িয়ে চলে যায়”।
মামী সুবলের সাথে প্রদীপের বাড়ি গিয়েছিল,ঘরদোর দেখে,প্রদীপের মায়ের সাথে কথা
বলে এসেছিল।
-“ খারাপ তো কিছু দেখলাম না”। মামী অঞ্জলিকে ফিরে এসে বলেছিল,
"কোন চাহিদাও নেই, দ্যাখ কি করবি”। অঞ্জলি দোনামনা করে মত দিয়েই দিয়েছিল। সাদামাটা
একটা মেয়ে,সাতাশ বছর বয়েস,অর্থের জোর নেই,মাথার ওপর অভিভাবক নেই-
বিয়েটা হয়েই গিয়েছিল, খুব বেশি প্রত্যাশা নিয়ে শ্বশুরঘর করতে সেও আসেনি তবু এরকম
হতাশা হবে সেটাও ভাবেনি।
ছোট্ট দুকামরার ভাড়াবাড়ি, শ্যাওলা পড়া উঠোন,অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘর,
গলির দিকে জানলা সারাবছরই বন্ধ থাকে,ঘরে রোদ ঢোকেনা বললেই চলে। বিয়ের দিন
কিছু নিমন্ত্রিত অতিথি এসে রাতেই ফিরে গিয়েছিল,কেউ তাকে বরণডালা নিয়ে বরণ করেনি,প্রদীপের পেছন পেছন ঘরে
ঢুকে শাশুড়িকে প্রণাম করেছিল; নিভাননী বিছানায় বসেই প্রণাম নিয়েছিল,বলেছিল, " তোমায় কি
দিয়ে আশীর্বাদ করি! দাঁড়াও” নিজের হাতের
দুগাছা সোনার চুড়ি থেকে দুটো খুলে অঞ্জলির হাতে পরিয়ে দিয়েছিল।
চমক অপেক্ষা করছিল ফুলশয্যার রাতে। পাশের ঘরে শাশুড়ি আছে,প্রদীপ ঘরের দরজা বন্ধ
করে অঞ্জলিকে বললো, “একটা কথা বলার আছে”। অঞ্জলি খাটে চুপ করে বসেছিল।
প্রদীপ ঘরে পায়চারি করেই যাচ্ছিলো, “আমি এক পরস্ত্রীকে ভালোবাসি,তার গর্ভজাত এক সন্তানও
আছে,এই বিয়েটা একান্ত মায়ের অনুরোধে করতে বাধ্য হয়েছি, তাছাড়া
আমি যাকে ভালোবাসি তার স্বামীও জানেনা যে বাচ্চাকে সে নিজের মনে করে সেটা আসলে তার
নয়, কিন্তু এই মুহূর্তে নিতাও তার স্বাচ্ছন্দ্যের ঘর ছেড়ে আসতে রাজি নয়”।
অঞ্জলি ছিটকে দাঁড়িয়েছিল, “এই প্রহসনের কি দরকার ছিল ? আমার
জীবনের কি কোনই দাম নেই?”
প্রদীপ অঞ্জলির পা ধরে বলেছিল, “ক্ষমা করুন, আমি আপনার কোন ক্ষতিই
করবো না, আপনি নিজের মতো থাকবেন, তাছাড়া সুবল তো তোমার মামার সব কিছুই উড়িয়ে
দিয়েছে, ভাড়াবাড়ির ভাড়া কদ্দিন দিতে পারে কে জানে?” অঞ্জলি নিজের বিয়ের সাজ খুলে
ঘরের শাড়ি পরে চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে ছিল। প্রদীপ মাটিতে মাদুর পেতে শুয়েছিল। এভাবেই
বেশ কয়েকমাস কেটে গেলো,এর মধ্যে অঞ্জলির বিএড পড়াও শেষ হয়েছিল, মাঝেমাঝে রাতে
প্রদীপ বাড়ি ফিরতোনা,অঞ্জলি বুঝতে পারতো সে কোথায় আছে।
ততদিনে নিভাননী অঞ্জলির ওপর বেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, “বৌ,তুই খুব ভালো মেয়ে,ভাগ্যিস তুই এয়েছিলি তাই
মরার আগে এই যত্নটুকু পেলাম”। “তা হ্যাঁরে ,প্রদীপ তোকে ভালোবাসে তো?
সারাদিনে একবারটিও দেখতে পাইনা”।
অঞ্জলি বুড়ির মায়ায় জড়িয়ে পড়ে। হাতের জমানো পয়সায় বাইরে থেকে মামীকে ফোন করে,খোঁজখবর নেয়,বুঝতে পারে মামী ভালো
নেই, নিজের দুর্ভাগ্যের কথা আর বলতে পারেনা।
একদিন প্রদীপ বাড়ি ফিরে বললো, “নিতার স্বামী আক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে, এখন থেকে আমি ওর সাথেই
থাকবো, ছেলেটা পাঁচমাসের,
নিতা একা সামলাতে পারবেনা, তুমি পারলে মাকে দেখো”। অঞ্জলি পাথরের মতো বসেছিল সারারাত। পরদিন প্রদীপ
চলে গিয়েছিল, প্রথম দিকে কিছু টাকা পাঠাতো, অঞ্জলি চাকরিতে জয়েন করার পরে তাও বন্ধ
করে দেয়।
মামী পরে সব জানতে পারে, নিভাননীও বুঝতে পেরে অঞ্জলির হাত চেপে ধরে, “আমায়
ফেলে যাসনি বৌ”। এতো কষ্টেও অঞ্জলির হাসি পায় ঐ " বৌ" ডাকটা শুনলেই, কি
কপাল করেই না জন্মেছিল!
তারপর চাকরি, ঘর সব সামলে এই বাড়ি করেছে, কিছু ধার শোধ এখনো বাকি।
স্কুলের অফিসে আজ নতুন ছেলেমেয়ে ভর্তির দিন ছিল। সেখানেই আজ প্রদীপের দেখা
পেয়েছিল,ছবছরের ছেলেটির হাত ধরে বেরোতেই অঞ্জলির মুখোমুখি। নীরবে
প্রদীপ চলে গিয়েছিল।
আজ বাড়ির ছাদে বসে অঞ্জলি ভাবছিল,সেও তো প্রদীপের মতো পরপুরুষ সঙ্গ
করতে পারতো,অন্ততপক্ষে একটা বাচ্চাও যদি হতো! নিজেকে বড় রিক্ত লাগে। কাঁধে
কার হাত! চোখ মুছে পেছন ফিরতেই দ্যাখে,মামী।
-“তোর শাশুড়ি বলছিল তোর আবার বিয়ে করা উচিত, আমিও তাই মনে করি”।
-“ একবারেও শিক্ষা হয়নি বুঝি!”
-“ এবারে আমি নিজেই যা করার করবো”।
-“না,মামী না। আমি আর কোন বিয়েতে নেই; শুধু যদি একটা সন্তান
থাকতো!”
-“ সেইজন্যই তো বিয়ে করতে বলছি”।
অঞ্জলি আর কিছু বলেনা, মামী, তার শাশুড়ি এরা গতানুগতিক
চিন্তাভাবনায় অভ্যস্ত,তাও যে তার আবার বিয়ের কথা ভেবেছে,এটাই অনেক।
এর মাসছয়েক পরে অঞ্জলি মামীর গলা জড়িয়ে শুয়ে বলে, “মামী,
একবার
পেটের ওপরে হাত রাখো,দুষ্টুটা বড্ড নড়াচড়া করছে।" পেটের ওপর পরম মমতায় মামী
হাত রাখে,অঞ্জলির আনন্দোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত
ভালোলাগায় মামীর মুখ ভরে ওঠে।
অঞ্জলি অনেক ভেবে স্পার্ম ডোনেশন ব্যাঙ্কেই গিয়েছিল মাস ছয় আগে।
সমাপ্ত
| Aleekpatamagazine.blogspot.com |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Monsoon Issue,2020 | July-September 2020 |রিমঝিম সংখ্যা।
| Third Year Sixth Issue |23 rd Edition|
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post