উড়ান
মানসী গাঙ্গুলী
ছোট্ট
মেয়ে উমা,জ্ঞান পৌঁছে বাবাকে দেখেনি সে। বস্তুত 'বাবা' বলে সবার কেউ থাকে তা-ই তার জানা ছিল না। তার জন্য
বাড়িতে ছিল না কোনো আদর,আপন বলতে জানত কেবল মা ও দাদুকে।
ঠাকুমা,কাকা,কাকীমা সবার মাঝে থেকেও
তারা যেন ছিল তার কাছে দূর গ্রহের বাসিন্দা। ছোট থেকেই পড়তে শিখে গিয়েছিল তাদের
চোখের অবজ্ঞার ভাষা। একটু বড় হলে স্কুলে ভর্তি হল উমা। ক্রমে জানতে পারল সবার একটা
বাবা থাকে,তারই কেবল নেই। বাড়ি ফিরে মাকে উতলা করে তুলত সে,বাবার প্রশ্নে মাকে জর্জরিত করে তুলত,"মা,আমার বাবা কে? আমার বাবা কোথায় থাকে? আমার বাবা আমার কাছে আসে না কেন?" মা বুঝে পেতেন না ওইটুকু মেয়েকে কি জবাব
দেবেন,এসব কথার কি উত্তর দেবেন তিনি তাই কথা ঘুরিয়ে দেবার
চেষ্টা করতেন। আরও বড় হলে দেখল সে বাবার প্রসঙ্গ মাকে কষ্ট দিত। বুঝতে শিখল বাবা
তার মাকে ত্যাগ করে চলে গেছেন আর তাই মা ও সে সবার অবজ্ঞার,অবহেলার
পাত্র। মা নির্বিকার,কোনো প্রতিবাদ,কোনো
বাকবিতন্ডায় থাকতেন না কখনও। বস্তুতঃ যার হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন, তিনিই যখন তাকে ছেড়ে সব দায়িত্ব অস্বীকার করে চলে যান,তার জোরটা আর থাকে কি করে? কাজেই বাধ্য হয়েই মা সব
মেনে নিতেন। কলের পুতুলের মত নিজের কাজ করতেন,ছুটতেন অফিসে,আর্থিক সহায়তা করার কেউ ছিল না যে আর তিনি তা নিতেও চাননি,কারও করুণার ভাত তিনি খেতে চাননি। মায়ের মত আত্মমর্যাদা বোধ উমারও ছোট
থেকেই। তাই ভুলেও কখনও মা ছাড়া কারও কাছে কোনোকিছু আবদার সে করত না। মায়ের কাছেও
যে খুব কিছু আবদার করত তেমনও না। দশবছর বয়সেই সে যথেষ্ট পরিণত,ভেতরে তৈরী হয়েছিল অদম্য জেদ। সেই বয়সেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল বড় হয়ে
মায়ের দুঃখ ঘোচাবে সে। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন,যা ভাবা যায় তাকে
ফলপ্রসু করতেও আসে নানা বাধাবিপত্তি। তার মধ্যে যে টিঁকে থাকতে পারে সে-ই জয়ী হয়।
উমার বড় হবার পথেও পদে পদে বাধা এসে হাজির হয়েছিল। নানা ভাঙাগড়ার অভিঘাতে জীবনটা
তার হয়ে উঠেছিল শুধু সংঘাতের আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের।
মানসিকভাবে
যতই পরিণত হোক,বয়স তো মোটে ১২তখন,তাই যখন তারই সমবয়সী বন্ধুদের দেখত, শুনত ওদের
বাবা-মায়ের কাছে আবদার করা,ওদের দেখে ওর মনে হত যেন সুখী
প্রজাপতি,দু'দিকে দুই নরম ডানা মেলে
যেন তারা উড়ে বেড়াত,ওরও সাধ হত অমন উড়তে কিন্তু পারত না,মনে হত কে যেন অলক্ষ্যে এসে ওর একটা ডানা কেটে দিয়ে গেছে,কিন্তু মন বাধা মানত না। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে,চোখে
অনেক স্বপ্ন,বুকের ভেতর কষ্ট,সর্বদা
মনে হত যদি দুটো ডানা থাকত,খুঁজে আনত তার বাবাকে,মায়ের কাছে এনে দিত আর ছোট্ট মিষ্টি নরম একটা প্রজাপতি হয়ে বাবা-মায়ের
চারপাশে উড়ে বেড়াত। মায়ের হাসিমুখ ভাসত ওর চোখের সামনে আর বুকের মাঝে হত
রক্তক্ষরণ। মা যতক্ষন কাজে বাইরে থাকতেন,দাদুই ওকে সামলাতেন,নজর রাখতেন। যদিও সে ছিল খুব বুদ্ধিমতী,কোনটা তার
করা চলে আর কোনটা চলে না,সে ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তাই
তাকে সামলানো দাদুর পক্ষে সহজ ছিল। স্কুল থেকে ফিরে,দাদুর
সঙ্গে দুটো কথা বলেই সে নিজের স্কুলের পড়া করে নিত মা ফেরার আগেই। পড়াশুনায়ও
অত্যন্ত ভাল ছিল,রীতিমত মেধাবী ছাত্রী ছিল সে। বাড়িতে অনাদর
পেলেও,স্কুলে টিচাররা সকলে ওকে ভালবাসতেন,তাই তাঁরা প্রয়োজনে পড়াশুনায় ওকে সাহায্য করতেন। কোনোদিন কোনো প্রাইভেট
টিউটর ছাড়াই স্কুলে ভাল রেজাল্ট করে
স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করে উমা কলেজে ভর্তি হল। ওদিকে কাকার ছেলে পাঁচটা প্রাইভেট
টিউটরের কাছে পড়েও খুবই সাধারণভাবে স্কুলের গন্ডী পার হলে তাই নিয়েই বাড়িতে তীব্র
অসন্তোষ দেখা দেয়। সেই শুরু। যখন উমা বি.এ অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী,হঠাৎই একদিন তাদের কেন্দ্র করে বাড়ীতে
অশান্তি তীব্র আকার ধারণ করে। ঠাকুমা তাদের বাড়ী থেকে বের করে দিতে চাইলে,দাদু তাদের রক্ষা করতে আসেন আর উত্তেজনায় হঠাৎই অসুস্থ বোধ করেন। সিভিয়ার
স্ট্রোক,আর তার তিনদিনের মাথায় তিনি চলে গেলেন। মাথার ওপর
থেকে ছাদ প্রকৃত অর্থেই সরে গেল,সে বাড়ীতে আর ঠাঁই হয়নি তাদের।সঙ্গে
কিছু জামাকাপড়ের দুটি ব্যাগ আর স্বর্গত দাদুর আশীর্বাদ সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হল তাদের।
শুরু হল মা-মেয়ের লড়াই।
"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেহ নাহি দিবে অধিকার"...অতএব লড়াই করেই
জয়ের দরজায় পৌঁছাতে হবে। লড়াই চলছিলই,তবে বাড়ীর মধ্যে থেকে
কিছুটা হলেও ছিল তা সহজ। কিন্তু আজ! কোথায় যাবে তারা! লড়াই এখন হল আরো কঠিন। তবু
হারবার পাত্রী নয় উমা,তার ইচ্ছেরা ডানা মেলতে চায় অনেক দূরের
পথে,হোক তা দুর্গম,পৌঁছাতেই হবে
গন্তব্যে। ছোট থেকেই বাবার স্নেহে বঞ্চিত,বিরুদ্ধ
পরিস্থিতিতে সকলের উপেক্ষায় বড়
হতে হতে অদম্য জেদ বাসা বেঁধেছে ওর মনে আর তারই ফলস্বরূপ ইকোনোমিক্স অনার্সে
ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হল উমা। এরপর এম.এ এবং তাতেও আশানুরূপ ভাল রেজাল্ট, তবে মায়ের পক্ষে এই এম.এ পড়ানোটা খুব দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। তবুও সব বাধা
ওরা অতিক্রম করে উঠল আর মেধাবী উমা একটা এমএনসিতে চাকরী পেয়ে গেল। স্বপ্নেরা পাখা
মেলতে শুরু করল ফুরফুরে প্রজাপতির মত।
এখন ওদের সুখের দিন তবে
প্রচুর খাটুনি। হোক,তাতে
উমার কিছু আসে যায় না। ওর সিনসিয়ারিটি ওকে খুব তাড়াতাড়ি বেশ উচ্চতায় পৌঁছে দিল।
বছর দু'য়েক পরে কোম্পানি থেকে ছ'মাসের
জন্য ওকে আমেরিকায় পাঠাল। মা একা হয়ে পড়লেও মেয়ের সাফল্যের জন্য তিনিও সব কিছুতে
প্রস্তুত। উমার মাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়েছে খুব। মা-ই বুঝিয়েছেন ছ'টা মাস দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
উমার
রক্তাক্ত হৃদয় আজ ডানা মেলেছে সুদূরে। মা সাথে এসেছিলেন ছাড়তে,দু'জনেই নিজেদের
সামলালো নিপুণভাবে। মায়ের গালে চুমু খেয়ে উমা চলল এগিয়ে উড়ানের পথে। মনে মনে ডানায়
ভর করে অনেক উড়েছে,তবে জীবনে এই প্রথমবার সত্যি করে উড়ল ও
উড়োজাহাজের ডানায় ভর করে। উইন্ডো সিট ছিল,প্রথম দিকটায় খুবই
উত্তেজিত,দু'চোখ ভরে দেখছে তার শহরকে
উপর থেকে,গানের মত মনে হচ্ছে ওর 'সারে
জাঁহাসে আচ্ছা'। আস্তে আস্তে মেঘের দেশে প্রবেশ। অনেক ছবি
তুলেছে মোবাইলে,মাকে দেখাবে বলে। ইস,মাকে
সঙ্গে নিতে পারলে কি যে ভাল হত,মা ও তো কখনও কোথাও যায়নি।
মনে মনে ভাবে,সুযোগ হলে মাকে অনেক অনেক ঘোরাবে ও।
দীর্ঘ যাত্রার পর
পৌঁছালে,সেখানে ওর জন্য সব ব্যবস্থা করা ছিল। মায়ের
কত চিন্তা ছিল একা বিদেশে কিভাবে কি করবে বলে,কিন্তু ভরসা
ছিল মেয়ের 'পরে। একদিন পর নতুন দেশের নতুন অফিসে জয়েনিং,চিন্তা তো একটু ছিলই। সেখানে ক'দিন যাতায়াতের পর
জানতে পারল যার আন্ডারে ও কাজ করছে তিনি একজন বাঙ্গালী যদিও তাঁকে দেখে বোঝা যায়
না মোটেই,আর চলনবলনেও তাঁর সাহেবিয়ানা। দীর্ঘ ২৪ বছর তিনি
আমেরিকাবাস। পাঁচ বছর বাকী তাঁর অবসরের। ওনার সম্পর্কে দেশে থাকার সময়েই ও অনেক
শুনেছে,সবাই ওনাকে শ্রদ্ধা করে,যদিও
উনি খুব কড়া,কাজের ব্যাপারে কোনো কিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করেন না। উমার আগ্রহ ছিল ওনার আন্ডারে কাজ করার,ওনাকে দেখার,সে আশা ওর পূর্ণ হয়েছে।কাজ করতে করতে
উমাকে মাঝেমাঝেই ওনার সংস্পর্শে আসতে হয়েছে আর শ্রদ্ধায় ওর মাথা নত হয়ে গেছে ওনাকে
দেখে, যেমন দেখতে,তেমন পান্ডিত্য,তেমনই কাজপাগল।উমাও কাজের ব্যাপারে অত্যন্ত সিনসিয়ার হওয়ায়,অল্পদিনেই সে ওনার স্নেহধন্য হয়ে ওঠে। সবাই ‘ডি কে’ বলেই চেনে ওনাকে। ক্রমে
জানতে পারে স্ত্রীকে নিয়ে এদেশে আসার অল্পদিন পরেই ওনার স্ত্রী মারা যান,সেই থেকে কাজই ওনার ধ্যানজ্ঞান,আর দেশেও যাননি কখনও।
উমার কেমন যেন মায়া হয় ওনার প্রতি,দিনে দিনে কেমন খুব আপনার
জন মনে হয় ওর,আর উনিও ধীরে ধীরে উমার সাথে খুব অন্তরঙ্গ ভাবে
কথা বলেন,কোনোরকম বসসুলভ মনোভাবই নয়। ক্রমে কিছু ব্যক্তিগত
কথাও উনি শেয়ার করতে থাকেন ওর সাথে,এভাবেই উমা একদিন বুঝতে
পারে যে উনিই ওর বাবা যিনি ওর জন্মের অল্প পরেই অন্য মহিলার হাত ধরে চলে আসেন
আমেরিকায়। যদিও তাঁকে হারাতে হয় অচিরেই কিন্তু লজ্জায় আর দেশে ফিরতে পারেননি বা
সবিতা (উমার মা) র সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারেননি। তার জন্য তিনি খুবই অনুতপ্ত। উমা
কিন্তু কোনোভাবেই জানতে দেয় না যে সে ওনারই মেয়ে। আনন্দে বিহ্বল সে,অপেক্ষা কেবল বাবা-মাকে মিলিয়ে দিতে পারার,ওঁরা দু'জনে প্রজাপতির মত পাখা মেলে উড়লে তবেই ওর স্বপ্ন সফল। তলে তলে মাকে আনার
ব্যবস্থা করে ও। মা অবাক,ও বলে,এত
সুন্দর দেশ,তার একার দেখে শান্তি হচ্ছে না,তাই সে মাকে দেখাতে চায়।
ওদিকে
অফিসে বসকে জানায় তার মা আসছে বলে। তিনি উপযাচক হয়ে আলাপ করতে চান,দেখতে চান এমন যাঁর মেয়ে,কেমন সেই মা। উমা তো এটাই চাইছিল। ছোট থেকে বাবার জন্য যেমন তার মনোকষ্ট
ছিল তেমনি দেখেছে মাকেও কষ্ট পেতে। বড় হয়ে সে বেদনা সে অনুভব করেছে। এখন দেখছে ও,বাবা মানুষটি খারাপ নয়,জীবনে একটা ভুল করে ফেলেছিলেন,যার মাশুলও তাঁকে দিতে হয়েছে।
ছুটির দিনে এক
রেস্তরাঁয় মাকে নিয়ে যাবার কথা হল সন্ধ্যায়,সেখানেই হবে
আলাপ-পরিচয়। সামনাসামনি দু'জনে দু'জনের
পানে চেয়ে থাকেন অপলক,উমা সরে পড়ে সেখান থেকে অলক্ষ্যে,কিছু দূরে। অবশেষে উমার সকল ইচ্ছা পূরণ হল। ওর স্বপ্নরা আজ ডানা মেলে সঠিক
গন্তব্যে পৌঁছেছে। ও আজ ফুরফুরে এক প্রজাপতি,এতদিন
ক্ষতবিক্ষত হৃদয় বয়ে বেড়াবার পর। ও এখন আমেরিকার ঐ অফিসেরই পার্মানেন্ট কর্মী,বলাই বাহুল্য,ওর বাবারই দাক্ষিণ্যে। মা,চাকরী থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে আমেরিকায়, নতুন সংসার
সেখানে তাদের তিনজনের।
ছোট
থেকে যে ইচ্ছে ওর ডানা মেলতে চেয়েছিল,ভাগ্যের পরিহাসে যা
পারেনি,আজ ওর জীবনের সফলতার সাথে সাথে ইচ্ছেরাও দিয়েছে উড়ান।
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post