অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Tuesday, October 20, 2020

শিশির পর্ব- গল্প- স্বাদ- শ্রাবণী গুপ্ত সরকার

 

স্বাদ
শ্রাবণী গুপ্ত সরকার


বন্যার খুব কান্না পায় এখানে। নাঃ! সব সময় নয়, মাঝে মধ্যে। যদিও সবাই শুনলে খুব বোকা ভাববে ওকে। গ্রামে তো দুবেলা পেট ভরে খেতেই পেতো না। শীতে, গরমে, বর্ষায় নানারকম কষ্ট, রোগভোগ লেগেই ছিল. ভাগ্যিস ওদের গ্রামে শুটিং ছিল। কি কপাল! সেখানে সুপার স্টার দোয়েল বর্মণ এসেছিলেন-আর বন্যার টুলটুলে মিষ্টি বুদ্ধিদীপ্ত মুখখানা তার নজরে পড়ে গিয়েছিল।

  অ্যাই মেয়ে শোন! তোর নাম কিরে? বন্যা! খুব সুন্দর নাম তো। স্কুলে পড়িস? কোন ক্লাস? আমার সঙ্গে কলকাতায় যাবি? না বেড়াতে নয়, বরাবরের জন্য’। ক্লাস এইটের বন্যা প্রশ্নের চোটে থতমত খায়। ইতিমধ্যে ওর মা পদ্ম দুই বাড়ির কাজ সেরে শুটিং দেখতে হাজির হয়েছে- ঝাঁপিয়ে ঢুকে পড়লো কথাবার্তার মাঝে। ঠিক হয়ে গেল বন্যা শহরে যাবে, ইস্কুলে ভর্তি হবে আর দোয়েল ম্যাডামের কাছে থাকবে। খানিকটা কাজকর্মও করবে। ম্যাডাম একবারে তিন হাজার টাকা ধরিয়ে দিলেন পদ্মর হাতে। প্রতি মাসে মানি অর্ডারে টাকা আসবে। ইচ্ছা করলেই পদ্ম মেয়েকে দেখতে যেতেও পারবে।

ব্যাস, বন্যা চলে এল কলকাতার একটা আকাশ ছোঁয়া বিশাল ফ্ল্যাটে। না, দোয়েল ম্যাডাম মানুষ ভালো, বেশী খাটান না, বকাঝকা তো করেনই না। কথামতো কাছাকাছি একটা ইস্কুলে ভর্তিও করে দিয়েছেন। যদিও বন্যার পড়াশোনার ঝোঁক কমই। ওর ভালো লাগে ম্যাডামের ড্রেসিং টেবিলের উপরে সাজানো শিশি বোতল গুলোকে। কিন্তু হাত দেওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। চুরি করা হবে তো! না বলে অন্যের জিনিসে হাত দিলে।  

ম্যাডাম কিন্তু সব বোঝেন, ওকে বেশ কিছু সাজের জিনিস উপহার দিয়েছেন। বলেছেন সবসময়ে ফিটফাট থাকতে। ম্যাডামের একটা কাচ বসানো ঝকঝকে জয়পুরী ঘাঘরা খুব পছন্দ বন্যার। গতমাসে রাজস্থানে শুটিং করতে গিয়ে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে একটা চমৎকার ঝলমলে, ঠান্ডা মেশিন বসানো দোকান থেকে পছন্দ করে ঘাঘরাও কিনে দিলেন। বন্যা সেদিন ঠাকুরকে অনেক বার প্রণাম ঠুকেছিল নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে।

আর বন্যা ভীষণ ভালোবাসে নানারকম রান্না করতে, যেটা এখানে একদম বন্ধ। বন্যার কাজ ম্যাডামের সঙ্গে থাকা। আসলে ওনার তো কেউ নেই। ঘর-সংসার তো করেন নি, থাকার মধ্যে ছিলেন মা। তিনিও মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে, সেটা ও ম্যাডামের কাছে শুনেছে। একা একা থাকতে তো কারুরই ভালো লাগে না। অবশ্য কতটুকু সময়ই বা বাড়িতে থাকেন-তাও বন্যার সঙ্গে কথা বলতে খুবই ভালোবাসেন দোয়েল।  

তবে বন্যার কান্না পায় কেন? আসলে সকাল বেলা ফলের রস, নানারকম ফল, টোস্ট দিয়ে দিন শুরু হয়। ঠিক আছে তাতে আপত্তি নেই। ভালোই লাগে। কিন্তু দুপুরে স্যুপ, সেদ্ধ করে নুন গোলমরিচ ছড়ানো সবজি আর মুরগী-মোটে ভালো লাগে না। আবার রাতে দুপুরের মতোই খাওয়া। হয়তো কখনো একটু পুডিং বা আইসক্রীম থাকে। বন্যার মনে হয় কতদিন মায়ের রান্না করা শুক্তো, মাছের ঝাল আর বড়ির টক খায় নি, চোখ ভর্তি হয়ে আসে জলে।

 মা মুখে বলেছিল বটে, মাঝে মাঝে দেখতে আসবে বন্যাকে, কিন্তু পাঁচবাড়ির কাজ করে আর দুরন্ত ভাই দুটোকে সামলে মোটেই সময় পায় না। এদিকে ম্যাডাম বলেছেন সামনের বছর বোর্ডের পরীক্ষায় পাশ করতেই হবে। নইলে ম্যাডামের সঙ্গে থেকে কাজকর্ম শিখতে পারবে না। অনেক কিছু শিখে নিয়েছে বন্যা—থ্যাঙ্ক ইউ, ওয়েলকাম, সরি, কন্ডিশনার, ময়শ্চারাইজার, পুডিং, স্যুপ। তবে আরো অনেক কিছু শিখতে বাকি।   

আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে কেমন অচেনা লাগে বন্যার আজকাল। এত চকচকে চুল আর ঝকঝকে চামড়া ছিল নাকি আগে? আসলে ম্যাডাম কতো দামী দামী জিনিস কিনে দেন, তাতেই তো এত জৌলুষ। না, ম্যাডামের ধারে কাছে তো বন্যা কোনোদিনই আসতে পারবে না। অত সুন্দর মাখন রঙা রেশমী ত্বক, নিঁখুত সুন্দর মুখ, সিল্কের মতো এক ঢাল নরম কালো চুল-সে সব যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে! কিন্তু দোয়েল ম্যাডামের দেওয়া পোশাক আর গয়নায় সেজে বন্যাকেও বেশ দেখায়-অন্তত দেওয়াল জোড়া বিরাট আয়নাটা সেকথাই বলে।  

একদিন ম্যাডামের ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে দোয়েল দেখলেন বাচ্চা মেয়েটা রাতের খাবার সাজিয়ে রেখেছে টেবিলে-নিজেও না খেয়ে অপেক্ষা করছে। মনটা ভিজে গেল একদম। শেষবার মা এইরকম যত্ন করে টেবিল সাজিয়েছিলেন জন্মদিনে। তার পরেই সেই সেখানে চলে  গেলেন যেখান থেকে কেউ কখনো ফেরে না। সিংগল মাদারের কাছে বেড়ে ওঠা দোয়েল বন্যার মধ্যে কি নিজের বিপন্ন কৈশোর দেখতে পেয়েছিলেন?

বন্যাকে কাছে ডেকে দোয়েল বললেন, “প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল এসেছিস এখানে, কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো? স্কুল থেকে ফিরে একা একা থাকিস, কষ্ট হয় না রে?”

না দিদি...ইয়ে ম্যাডাম সেখানে তো ইস্কুলে যেতে পারতাম না গো রোজ। মায়ের সঙ্গে কাজ করতে যেতাম যে। এখানে আমার অনেক বন্ধু হয়েছে-সবাই তোমার কথা জিগায় তো”।

দোয়েল একটু হেসে বললেন, “ আবার! জিগায়? আর তোর ইচ্ছা হলে না হয় দিদিই বলিস। ম্যাডাম বাইরের লোকজনের সামনে বলবি। তা হলে তোর অসুবিধা নেই তো কিছু?”

এবার চুপচাপ নখ খুঁটতে শুরু করে বন্যা। “অ্যাই বন্যা! বল না”।

দিদি আমার না আসলে খেতে খুব কষ্ট হয়। খুব ইচ্ছা করে ওখানে যেমন খেতাম-আলুপোস্ত, টকের ডাল আর পুঁটিমাছের চচ্চড়ি খেতে”। দোয়েল খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হেসেই ফেললেন। মেয়েটার অকপট সারল্য তার মনের বাদ্যযন্ত্রে সঠিক ঝঙ্কারে বেজে উঠেছে। “তুই রান্না করতে পারিস?

হ্যাঁ, আমার খুব ভালো লাগে তো রান্না করতে”।

বন্যার মুখের অভিব্যক্তি দেখে দোয়েল বললেন, “তবে কাল আমি আর তুই বাজারে যাবো, তোকে সব চিনিয়ে দেবো। পরের দিন থেকে ড্রাইভারের সঙ্গে তুই যাবি। ইচ্ছা মতো বাজার করবি আর নিজের জন্য রান্না-কি রে, এবার খুশি তো?” অপ্রত্যাশিত এই প্রাপ্তিতে বন্যার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে।

 পরের দিন বাজারে গিয়ে কিছু শাক-সবজি আর ফল কিনে দুজনে গেল মাছের বাজারে। মাছের বাজারে শোরগোল পড়ে গেল দোয়েলের এই অপ্রত্যাশিত আগমনে। ভেটকি, ইলিশ, রুই-কাতলার ভীড়েও বন্যা খুঁজে খুঁজে কিনলো মৌরলা আর পুঁটি মাছ। বাড়ি ফিরেই বন্যা খুশিভরা মুখে ছুটলো রান্না ঘরে। দুপুরে খাওয়ার সময়ে বন্যা খুব ভয়ে ভয়ে বললো, “দিদি! একটু পুঁটি মাছের চচ্চড়ি খাবে গরম ভাত দিয়ে?” দোয়েলের মুখে প্রশ্রয়ের হাসি দেখে খুব যত্ন করে একটা সাদা প্লেটে ভাত আর চচ্চড়ি দিল বেড়ে। মুখে দিয়েই একটা অপ্রত্যাশিত চমক লাগলো দোয়েলের—বহুদিন আগে খাওয়া মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ পেলেন মুখে। “বা! দারুণ হয়েছে তো! এবার থেকে দুপুরে বাড়িতে খেলে অল্প করে তোর রান্নাই খাবো। তার জন্য দু ঘণ্টা বেশি জিম করতে হয় তো সেও ভি আচ্ছা”।

বন্যার আলোভরা গর্বিত মুখটা দেখে দোয়েলের বুকের ফাঁকা জায়গাটা ভরে উঠছিল আস্তে আস্তে। মুখের স্বাদ যেন মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। মা-বাবার বিফল দাম্পত্য কোনোদিনই তাকে সংসার করায় উৎসাহ যোগায় নি, একাই ছিলেন তাই। কোথা থেকে মেয়েটা এসে বন্যার মতোই তার বুকের শুকনো খাতটাকে মায়া-জলে ভরিয়ে দিয়েছে।

দোয়েলের জন্মদিনে খুব ছোট্ট একটা ঘরোয়া পার্টিতে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ডেকে বন্যার হাতের রান্না খাইয়ে অবাক করে দিলেন দোয়েল। সবার মুখে প্রশংসা শুনে বন্যার খুশি আর ধরে না। সময় এগিয়ে চলে। এখন বন্যা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ছে। দোয়েল বর্মণ ধীরে ধীরে অভিনয় কমিয়ে পরিচালনার কাজে আসছেন। দুজনেরই ইচ্ছা পাশ করে বন্যা একটা রেস্তোরাঁ খুলবে। নাম হবে ‘স্বাদ’।

মা আর ভাইদের নিয়ে আসবে নিজের কাছে। বন্যা ভাবে, ভাই দুটো ভালোভাবে লেখাপড়া শেখার সুযোগ পাবে। আর মা নানা রকম ভুলে যাওয়া পুরোনো দেশী রান্নার সন্ধান দিতে পারবে বেশ।

এতদিন ওরা অনেক কষ্ট করেছে। এবার নাহয় একটু খুশির মুখ দেখুক, সসম্মানে বাঁচুক ওরা।  তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবেন দোয়েল।  আর এই আনন্দের আস্বাদও বন্যার রান্নার থেকে নেহাত কম নয়


Download ALEEK PATA Mobile APP
DOWNLOAD ALEEK PATA ANDROID APP


| Aleekpatamagazine.blogspot.com |
  |ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Puja Issue, 2020 | October-November 2020 | শারদ সংখ্যা -১৪২৭।
| Fourth Year Third Issue |24 th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
পড়া শেষ? পত্রিকা বন্ধ করুন


No comments:

Post a Comment

Please put your comment here about this post

Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান