টুকলি বিভ্রাট
ফিরোজ আখতার
প্রতিবারের মত এবারেও শালিখপুর হাইস্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষার ইনভিজিলেশন ডিউটি পড়েছে মলয়ের । শালিখপুরে এই নিয়ে পরপর তিনবার ডিউটি পড়লো । স্কুলে শিক্ষক সংখ্যা কম থাকায় আশেপাশের স্কুল থেকে পরীক্ষার সময় শিক্ষক-শিক্ষিকা ধার করতে হয় স্কুলটিকে । এমনিতে রাস্তার ধারে স্কুল । আসতে কোন সমস্যাই নেই । নির্দিষ্ট সময় স্কুলে পৌঁছে গেছে সে । নিজের ডিউটির ঘরটা বুঝে নিয়েছে সেন্টার ইন-চার্জের কাছ থেকে । সেন্টার-ইন-চার্জ পরিচিত মাস্টারমশাই । মৃদু হেসে বললেন, “মলয়বাবু, ছয় নম্বর ঘরের বাঁদিকের জানলাদুটোর নীচের পাল্লাগুলো খুলবেন না” ।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার তাকাল মলয় ।
-“বাঁদিকে যে আমবাগানটা আছে বুঝলেন না… ওখান থেকে টুকলি সাপ্লাই হবে । ওখানে অবশ্য একজন কনস্টেবল থাকার কথা…”
-“তা বেশ, তবে একা একজন কনস্টেবল কতদিকে দেখবে । আপনি কোন চিন্তা করবেন না মাস্টারমশাই । আমি সামলে নেব” ।
পরীক্ষা শুরুর আধঘন্টা আগেই মলয় পৌঁছে গেলো ঘরে । পরীক্ষার্থীরা সবাই মোটামুটি এসে গেছে । নিজের নিজের জায়গায় বসেও গেছে । সবার দিকে একঝলক দেখে নিল সে । সবাই তাকেই জরীপ করছে বলে মনে হল । এবার বাঁদিকের জানলাদুটোর দিকে চোখ গেল তার । দুটো জানলারই নীচের পাল্লাদুটো খোলা । বামদিকে একটা ছোটমত আমবাগান আছে । কিছু অংশজুড়ে আমগছের শুখনো পাতা পড়ে আছে । একটু দূরেই রাস্তা । বোঝাই যাচ্ছে, টুকলি সাপ্লাইয়ের আদর্শ পরিবেশ । জানলাদুটোর নীচের পাল্লাদুটো নিজেই বন্ধ করে দিল মলয় । জানলার পাশে বসা ছেলেদুটো যে মোটেই সন্তুষ্ট হয় নি, সেটা সে তাদের চোখমুখ দেখেই বুঝতে পারলো ।
-“তোমরা সবাই নিজের নিজের জায়গায় বসেছ তো” ?
সকলেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল । এর মধ্যে প্রশ্নপত্র আর খাতাও চলে এসেছে । পরীক্ষা শুরুর পনেরো মিনিট বাকি । প্রশ্নপত্র দেবার বেলও বেজে গেলো । প্রশ্নপত্রগুলি ধীরে ধীরে সকলকে দিতে শুরু করল মলয় । পাঁচমিনিট পর খাতাও দিয়ে দিলো ।
-“কেউ কথা বল না, প্রশ্নপত্র ভালো করে পড় । তারপর উত্তর দেবে” । অভ্যাসবশতঃ যান্ত্রিক গলায় বলে উঠল সে ।
এবার পালা অ্যাডমিট দেখে রোল ও নং মেলানো আর খাতায় সই করা । একে একে পরীক্ষার্থীদের খাতাগুলোতে সই করতে লাগলো সে । বেশ কয়েকজন ছেলে উশখুশ করতে শুরু করেছিল বটে মাঝে, কিন্তু কড়া ধমকে তাদের চুপ করিয়ে দিয়েছে সে ।
খাতায় সই হয়ে গেছে । পাঁচ মিনিটের জন্য চেয়ারে বসল মলয় । হঠাৎ তার কানে এলো শুকনো পাতার শব্দ । শুকনো পাতার উপর দিয়ে কেউ হাঁটছে মনে হচ্ছে । শব্দটা প্রথম জানলার দিকে এগিয়ে আসছে । তাড়াতাড়ি সিট থেকে উঠে প্রথম জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে । এমনভাবে দাঁড়ালো যেন বাইরে থেকে তাঁকে কেউ দেখতে না পায় । হঠাৎ বাইরে থেকে একটা হাত এগিয়ে এলো জানলার ভিতরে । সঙ্গে সঙ্গে একটা গলা হিসহিসিয়ে উঠল ।
-“হাতটা বাড়া, হাতটা বাড়া…”
বিনা বাক্যব্যয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল মলয় । হাতে এসে পড়ল দলা পাকানো এক টুকরো কাগজ । একবার কাগজটার দিকে আর একবার জানলার পাশে বসা ছেলেটার দিকে চাইল সে । ছেলেটার মুখ সাদা হয়ে গেছে ।
-“কাগজটা তোকে দিল” ? ছেলেটার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো মলয় ।
-“না স্যার, আমার না… আমি কিছু জানি না” ।
মনে মনে হাসল সে । মুখে কিছু বলল না । আবার চেয়ারে গিয়ে বসলো । কাগজটা আবার খুলল । গোটা দশেক ছোট প্রশ্নের উত্তর লেখা । ছিঁড়ে কাগজটা পাশে রাখা বিনে ফেলে দিল ।
কিছুক্ষণ পর আবার সেই শুকনো পাতার শব্দ । একই ভাবে জানলা দিয়ে ভেতরে চলে এলো একটা হাত । তবে এবার দ্বিতীয় জানলা দিয়ে । আবার সেই হিসহিসে শব্দ । ‘হাত বাড়া…’ । চোখ দিয়ে ইশারা করল সে দ্বিতীয় জানলাটার পাশে বসা ছেলেটিকে । ছেলেটি এবার নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে দিল । ছেলেটির হাত থেকে টুকলিগুলো নিয়ে আবার ডাস্টবিনে ফেলে দিলো সে । এরকম আরও বারদুয়েক হল । প্রতিবারই টুকলিগুলো হাতে এসে পড়লো মলয়ের । ছেলেগুলোর মুখের দিকে চেয়ে মনে যে একটু মায়া হলনা তা নয় । কিন্তু কি আর করবে সে…!
পরীক্ষা শেষ । খাতাগুলো তুলে নিয়ে দ্রুত মিলিয়ে নিল সে । তারপর, চলে গেল স্টাফরুমে । খাতাগুলো বুঝিয়ে দিল দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষককে । তারপর ধীরে ধীরে স্কুলের বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়াল সে । রানিং অটোগুলো ধরতে হবে । একটু দূরেই বেশ কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে । তার মধ্যে প্রথম জানলার পাশে বসা ছেলেটিকেও দেখল সে । নিজেদের মধ্য জটলা করছে তারা । সে এসে দাড়াতেই প্রথম ছেলেটা একটা ইশারা করল ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে । ছেলেগুলোর মুখের চেহারা বদলে গেলো । প্রত্যেকের মুখে একটা হিংস্র ভাব ফুটে উঠল ।
পাত্তা দিল না মলয় । একটা অটো আসছে । উঠে পড়লো সে অটোটায় । পাশ দিয়ে যাবার সময় দুয়ো ধ্বনি শুনতে পেল সে ছেলেগুলোর মুখে । মুখটা ঘুরিয়ে নিল সে ।
Download ALEEK PATA Mobile APP
| Aleekpatamagazine.blogspot.com |
|ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Puja Issue, 2020 | October-November 2020 | শারদ সংখ্যা -১৪২৭।
| Fourth Year Third Issue |24 th Edition|
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post