সোনা মাডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়
গত কাল থেকেই আমাদের বাড়ি আত্মীয়স্বজনে পরিপূর্ণ। কাকা, কাকিমা, ভাইয়েরা।
কাকার বড়মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন। আমার মামা, মামীমা,
মামার ছেলে মেয়েরা আরও নানান আত্মীয় কুটুমে বাড়ি গমগম করছে।
হাসিঠাট্টা, নানা কথাবার্তা, চিৎকার,
বাচ্চার বায়না আর কান্না সব মিলিয়ে বাড়ি একেবারে জমজমাট।
অন্যদিন এ বাড়িতে আমরা মোটে তিন প্রাণী। সারাদিন বাড়ি প্রায় যেন নিশ্চিন্দি পুরী। কিন্তু আজকের দিন
আলাদা। আজ এক শুভ দিন আর আমার জীবনে এক স্মরণীয় ঘটনা ঘটবে এই দিনে। আজ আমার বিয়ে।
কেমন যেন নিজেকে সাবালক সাবালক বলে মনে হচ্ছে। বেশ ভাল লাগছে।
খুব ভোরে মা তুলে দিয়েছে আমাকে। মা মানে আমার সোনা মা। একদম ছেলেবেলা থেকেই
আমি মাকে এই নামে ডাকি। মাও আমাকে আদর করে ডাকত, আমার সোনা ছেলে। একদম কিন্তু দুষ্টুমি করবে না। করলে তোমার সোনা মায়ের খুব
নিন্দে করবে লোকে।
তা আমার সোনা মায়ের নিন্দে হোক এমন কাজ কি আমি করতে পারি? তাই একদম দুষ্টুমি করতুম না। মা আমাকে রাতে
তার বিছানায় পাশে শুইয়ে আমার সারা শরীর আলতো করে চাপড়ে চাপড়ে আদর করে বলত, আমার সোনা ছেলে তার সোনা মায়ের খুব কথা শোনে।
একদম ভোরে আমাকে তুলে দিয়ে সোনা মা বলে গেল, দেখ এই দধিমঙ্গলে যা খাবি খাবি। আর কিন্তু সারাদিন কিছু খেতে
পাবি না বিয়ে না মেটা পর্যন্ত।
বাইরে তখনও আবছা আঁধার। আমাকে ঘিরে সবাই। বেশির ভাগ মেয়েরাই সামনের সারিতে।
পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছে পুরুষের দল। ভোরের সর্বপ্রথম মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান দধিমঙ্গল।
প্রদীপ জ্বলছে। শাঁক বাজছে। বেশ ভাল লাগছে। একটা রোমাঞ্চ। বিয়ে মানে তো একটা নতুন
অভিজ্ঞতা।
যত যাই হোক আমার মন কিন্তু উড়ু উড়ু। আশ্চর্য সেই মুখটা কই? আমার সোনা মায়ের? যে
মুখের মালিক আজ আমার এই সাতাশ বছর বয়েস পর্যন্ত শুধু আমার চিন্তা করে গেছে অনুক্ষণ
সেই মুখটা কই? শরীর খারাপ হল নাকি হঠাৎ?
-এত চঞ্চল কেন কি খুঁজছিস প্রতুল ?
-আমার সোনা মা কই? দেখ তো
আবার শরীর খারাপ হল নাকি ?
-আরে না না শরীর ওর দিব্বি আছে। কাকিমা বললেন, আজকের দিনে ঝর্ণাদির কত কাজ। সব সামলাতে হবে তো ?
তা ঠিক। এই সংসারের কর্ত্রী বলে কথা তার কি আর ফুরসৎ আছে ? কিন্তু একটি বারের জন্যে আসতে পারল না ?
দেখতে পারল না তার সোনা ছেলে ফলারটা ঠিক খাচ্ছে কিনা ? একটু আগেই তো বলল আজ নাকি সারাদিনে আর কিছু খাওয়া চলবে না।
আমার খুব অভিমান হল সোনা মায়ের জন্যে। আজ আমার এত বড় শুভ দিন তবু তার ফুরসৎ
নেই? যে মানুষটা আমার অসুখ হলে দিনের পর দিন না
খেয়ে আমার মাথার কাছে বসে থাকে মুখ চুন করে। তার চোখের কোণ চিকচিক করতে দেখেছি আমি
স্পষ্ট। আমাকে ভালমন্দ কত কিছু খাওয়ানোর জন্যে যে প্রাণপাত করত সে কেন এই মুহূর্তে
আমার কাছে থেকে দূরে ?
অনুষ্ঠান শেষ হতে আমি সোনা মাকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু সোনা মা তখন কাজ করছে আর
নয় কাজের তদারকি করছে। কাকিমা
বলল, নে নে সর। তোর তো হয়ে গেল। আবার সেই গায়ে হলুদের সময়।
-দেখ না কাকিমা। সোনা মা আজ দধিমঙ্গলের সময় একটু কাছে পর্যন্ত এল না।
আমি কেঁদে ফেলি প্রায়। কাকিমা এবার একটু গলা নরম করল, দেখ প্রতুল আজ তোর বিয়ে। কতবড় একটা কাজ। আজ
কি ফুরসৎ আছে তোর সোনা মায়ের ?
গায়ে হলুদ হল কিন্তু সোনা মা সবার পেছনে সবার আড়াল থেকে একটু দেখল। বিকেল বেলা
সাজের সময়েও তাই। আমি
ছোট ছেলের মত বায়না ধরলুম, আমি
সোনা মায়ের হাতে সাজব।
-বর সাজানোর লোক এসে গেছে পার্লার থেকে। গম্ভীর ভাবে কথাটা বলে বাবা চলে গেল।
গাড়ি এল। সেজেগুজে টোপর মাথায় দিয়ে আমি বাবার সঙ্গে গাড়িতে উঠলুম। পেছনে বড়
গাড়িতে চলল বরযাত্রীর দল। কিন্তু সোনা মাকে কোথাও দেখা গেল না।
গাড়িতে একবার বাবাকে বললুম, সোনা
মা কি আসবে না বরযাত্রীর সঙ্গে?
-তোমার সোনা মা বাড়িতে থেকে কালকের সব গোছগাছ করে রাখবে। কাল যে বধূবরণ। নতুন
বৌকে তুলতে হবে না ঘরে ?
পরের দিন বধূবরণ হল। স্ত্রী আচার হল। হুল্লোড় হল। কিন্তু সোনা মাকে না দেখে
জিজ্ঞেস করলুম, সোনা মা নতুন বৌকে
বরণ করবে না? শাশুড়ি হয়ে বৌমাকে ঘরে তুলবে না ?
কেউ কথা বলল না। আমার কথাটা ক্রমে মিইয়ে ন্যাতা হয়ে গেল। সব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ
করে কাকিমা বরণ করে আমাদের নিয়ে গেল। জানলা দিয়ে একফাঁকে সোনা মার চিক চিক করা
চোখের কোল আর বিষণ্ণ শুকনো মুখ দেখে প্রায় উঠতে যাচ্ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কাকিমা
প্রায় দৌড়ে এল। হাতে তার সন্দেশের থালা। বলল, এস মিষ্টি খেতে হয় দুজনকে। এখন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাক।
একটু পরে অবশ্য নতুন বৌকে ঘরে রেখে আমি বেরোলাম। কাকিমাকে জিজ্ঞেস করতেই দাঁতে
দাঁত চেপে বলল, ন্যাকামো করিস নি
প্রতুল। সোনা মা তোর-
কিন্তু আমি তো এটা জানি। ছেলেবেলায় সেই যখন তিনমাসের ছিলুম সদ্য মা হারা তখন
অবশ্য জানতুম না। তবু তিনমাস থেকে এই সাতাশটা বছর এই সোনা মা ই যে আমার মা ছিল।
আমার সব কিছু দেখা শোনার ভার ছিল। ‘মায়ের অভাব’ এই শব্দবন্ধ আমার কাছে সম্পূর্ণ
অজানা ছিল। জ্ঞান হবার পর প্রথম কিছুদিন কিছুতেই মাথায় ঢুকত না বাবা কেন মায়ের
সঙ্গে শোয় না। বাবার কি তবে মায়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে? পরে অবশ্য আসল কথাটা জেনেছি।
-প্রতুল আচ্ছা পাগল তো তুই ? কাকিমা
ফিসফিস করে বলল, তোর বৌকে বরণ করবে কি ? ও যে বাঁজা মেয়ে মানুষ জানিস না ? এ সব শুভ কাজ-
বাকিটা আর বলল না কাকিমা। আমার কানও এর বেশি হয়ত শুনতে পছন্দ করত না।
না, সোনা মা আমার নিজের মা নয়। আমাদের বাড়ির
কাজের লোক ছিল। আজও তাই আছে। কিন্তু বাঁজা অপরাধে স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে বাবার
সংসারে কাজের লোক হিসেব আশ্রয় পেয়েছিল। আবার সেও আশ্রয় দিয়েছিল সদ্য মাতৃহারা
তিনমাসের সেই শিশুটিকে। অন্যের গর্ভের পালন করা সন্তান দিয়ে নিজের সন্তানের অভাব
পূর্ণ করতে চেয়েছিল।
আমি বড় হলুম। কলেজের পড়া শেষ করে চাকরি পেলুম। সোনা মার কি আনন্দ। আমার কপালে
চুমু খেয়ে বলল, আজ আমার সোনা ছেলে
সাবালক হয়ে গেল। এবার ওর একটা বিয়ে দিতে
হবে।
বাবা অবশ্য মেয়ে খুঁজতে শুরু করল। কাকিমারা জব্বলপুর থেকে এসে মেয়ে পছন্দ করে
গেল। আমার ইচ্ছে ছিল আমার সোনা মা-ই মেয়ে পছন্দ করে। আমি একবার বলেও ছিলুম। কাকিমা
বলেছিল, দেখ প্রতুল আমরা তোর জন্যে খারাপ মেয়ে
পছন্দ করব না।
আজ পর্যন্ত সে কখনও বুঝতে দেয় নি সে আমার নিজের মা নয়। সামান্য একটা বাড়ির
কাজের লোক।
কিন্তু আজ বুঝতে দিল। কিংবা অন্যেরা বাধ্য করল তাকে বুঝিয়ে দিতে। আমার সোনা মা
কেবল একটা অবলম্বন মাত্র ছিল। একটা চারা লাউ গাছকে মাচা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার একটা
সরু কঞ্চি মাত্র। আজ কঞ্চিটাকে সরিয়ে নিলেই বা কি?
'Sona Maa" prothome Ami buji ni..pore buje click korlam,,porlam ...."E kon spondone .mon bikoshilo/kon mridomgone chhondo tulilo /Urdho gogone dhwonilo joyogaan/ Egiye jayo....Lekhok jao,,jao jao"..
ReplyDelete