মুখোশের আড়ালে
অরিন্দম ঘোষ
অন্ধকার অমাবস্যার
ধরণীর বুকে আলোক তরণীর মতো মনে হচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ ! যেন কেউ দিওয়ালীর আশার সহস্র
সহস্র টুনিবাল্ব প্রজ্জ্বলন করেছে সমুদ্রের ঢেউ গাত্রে। কিন্তু তটভূমিতে এসে উথালপাতাল
করা আশার ঢেউ রূঢ় পাথরের জমিতে এসে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করাটাই হল বাস্তব!
সমুদ্রের তটভূমিতে এরকমই একটা
পাথরের উপর বসে ছিলাম আমি আর আমার অন্তরাত্মা। ছয় ছয়টা বছরের অবকাশে আবার একাকী-
নিঃস্ব - নিঃসঙ্গ! দূরের ঝাউ পাতায় বাতাসের সিরসিরানি আমি স্পষ্টভাবে শুনতে
পাচ্ছিলাম। শুধু মন্দিরার সাথে এই দীর্ঘ ছয় বছরের সম্পর্কের যতি চিহ্নটা খুঁজে পাচ্ছিলাম
না।
অনেক প্রশ্ন সমুদ্রের বিশালতায়
ডুবে গিয়েও আমার মনে ঢেউ তুলছিল। কয়েক ফোঁটা নোনা জলও যেন আমার অজান্তেই বিশালাকায়
সমুদ্রের জলে মিশে গেল।
মন্দিরার সেই চিৎকার করে বলা
কথাগুলো - কাপুরুষ কোথাকার! এক্ষুণি বিয়ে করতে পারবে না তো এতদিন আমাকে ব্যবহার করলে
কেন ? আমাকে আস্তে আস্তে আরো অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছিল। শেষ
সিগারেটটাও জ্বালিয়ে নিলাম ফস করে। তাও কি কোন আলো জ্বলল এই নির্জন তালসারির অজানা
অচেনা তটভূমিতে?
রঙিন বুদবুদের মতোই মেয়েরা
ক্ষণিকের রামধনু দেখিয়ে আমার জীবন থেকে কেন যে মিলিয়ে যায়। এই
নিয়ে বারবার তিনবার। প্রথমে বিপাশা, তারপর অনন্যা আর সবশেষে মন্দিরা।
বিধাতা কি তবে আমার ললাট লিখনের
সময় কোন মেয়ের স্থায়িত্ব আমার জীবন কালে রাখতে ভুলে গেছেন ?
২
পাঁচ হাজার পাঁচশো...এক
পাঁচ হাজার পাঁচশো... দুই
পাঁচ হাজার পাঁচশো... তিন
হাতুড়ির তিন নম্বর আঘাতেও যখন আর
কোন দাবিদার পাঁচ হাজার পাঁচশোর চেয়ে বড়ো কোনো বুলি হাঁকাল না, তখন বুঝলাম যে
নিলামে ওঠা ঐতিহাসিক কাঠের বিটকেল মুখোশটি আমারই হল। অবশ্য অদ্ভুতুড়ে দর্শনের
জন্যেই লোকজন মুখোশটির উপর নিলামে তেমন আগ্রহ দেখায়নি!
তাও যদি মুখোশটি মমির পরানো
মুখোশ হত! তাও তো নয়। কোনও এক অজ্ঞাত কুলশীল মিশরীয় অভিজাতের শখের জিনিস বোধ হয়।
পুরানো ঐতিহাসিক মিশরীয় মুখোশটির
কথা আমি প্রথম জানতে পারি কোলকাতার চিনাপট্টীতে এক পুরানো কিউরিওর দোকানে। প্রাচীন
জিনিসপত্র সংগ্রহ করার এই শখ আমার বহু দিনের।
পাঠকদের অবগতির স্বার্থে জানাই
যে, আমার নাম অনির্বাণ সরকার। সাংবাদিকতা পেশার সাথে এই পুরানো জিনিস সংগ্রহ করার
নেশাও অনেকটা দায়ী আমার হঠাৎ হঠাৎ করে একা-একাই বাইরে বেড়িয়ে যাবার জন্যে।
৩
স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধতম অন্ধকূপের
মধ্যে দিয়ে এ কোথায় এগিয়ে চলেছি আমি? সর্পিল সরীসৃপে ভরা এ কোন জগৎ? কোনওমতে নিজেকে
বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে এগিয়ে চলেছি আমি।
সামনে দেখি একটা ভয়ঙ্কর ড্রাগন
মুখ দিয়ে যে আগুন বার করছে। একটুর জন্য প্রাণবায়ু রইলো শরীরে। নাকি আমি মরে গেছি?
হঠাৎ পা পড়ল একটা হাল্কা পাথরে। ঢুকে গেলাম আরেক অন্ধকার সুড়ঙ্গে।
সুড়ঙ্গের খাতে নদীর মত বয়ে চলেছি আমি। এ কোন অজানা নিয়তির
পথে ?
হঠাত্ করেই বোধোদয় হলো যেন।
সাত-সাতটা দরজা কোনও জাদু মায়াবী মন্ত্রবলে পিছলে পিছলে পার করে অন্ধকারের মধ্যেই
উজ্জ্বল মায়াবী রূপালী আলোয় ঢাকা একটা ঘরে আমি পৌছে গেছি।
অদ্ভুত ব্যাপার হ’ল ঘরে কোনও আলোক উত্স নেই। তবে কোন রহস্যময় পথে আলোক এখানে প্রবেশ করছে ?
তবে কী এইখানে আসা আমার ভবিতব্য ছিল ?
ঘরের মধ্যবর্তী অংশে একটা সুবিশাল
দাঁড়িপাল্লা। দু’ জন অতিমানবিক দৈব শক্তি ধারী পুরুষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা চলছে।
তাদের মধ্যে আবার একজনের মুখটি শৃগালের মত। তাকে অন্য জন অনুবিস নামে সম্বোধন
করছে।
ভাষাটা কোথায় যেন শুনেছি !
প্রাচীন কোনও ভাষা কী ? এটাই কী তবে মিশরীয় যমরাজ ওসিরিশের দরবার? এখানেই কী তবে
আমার মর্ত্যের ভাল বা মন্দ কাজের হিসাব হবে ?
দুজন লোক আমাকে ধরে সুবিশাল
দাঁড়িপাল্লাতে বসিয়ে দিল। আমি পালাবো কী - অক্টোপাসের মত এক সরীসৃপ আমাকে আটকে
রেখেছে।
মন্ত্র পুতের মত আমি বসে আছি।
মাথায় বিশাল মুকুট পরা সারা গায়ে উল্কি আঁকা একটা ভয়ংকর দেখতে একটি লোক আমার দিকে
এগিয়ে আসছে। তার হাতটা যেন ক্রমশ লম্বা থেকে লম্বতর হয়ে যাচ্ছে। হাতের অগ্রভাগে
নখগুলো আরও বড়ো হয়ে যাচ্ছে। আমার হৃদয়টাকে বুকের ভেতর থেকে বার করে নিল সে।
আর্তনাদ করব কী - আমার মুখের মধ্যে বিশালাকায় এক কুচকুচে কালো মাকড়সা ঢুকে গেল।
তখনও যেন হৃদয়টা স্পন্দিত হচ্ছে। বসিয়ে দিল আরেকটি ছোট দাঁড়িপাল্লায় আমার হৃদয়।
আঃ... আঃ... আঃ... আঃ...
চিত্কার করে উঠলাম আমি। ঘেমে নেয়ে
একাকার হয়ে ঘুম ভেঙে গেলো আমার।
এমন অদ্ভুতুড়ে স্বপ্নের অর্থ কী ?
তবে কী প্রাচীন মিশরীয় মুখোশটা এর জন্য দায়ী ?
৪
আমি যখন প্রত্নতাত্ত্বিক ডাঃ
বিষ্ণুগোপাল আচার্যের বাড়িতে ঢুকলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা সাত ঘটিকা। যথারীতি উনি
স্টাডিরুমে একরাশি বইয়ের পাহাড়ের মধ্যে বসে আছেন। আমার স্বর্গীয় পিতৃদেব ইতিহাসের
প্রফেসর হওয়ায় ওনার সঙ্গে অনেক দিনের সখ্যতা ছিল। পুরানো
দিনের চশমা আর কাঁচাপাকা দাঁড়ি গোঁফের জঙ্গলে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। ভদ্রলোকের অগাধ পাণ্ডিত্য।
কিন্তু কোন অহঙ্কার ছিল না। উনি আমার সঙ্গে বন্ধুর মত কথা বলতেন।
আমাকে দেখেই বসতে বললেন। আমার
নতুন সংগৃহিত মিশরীয় মুখোশটি নিয়ে অনেকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখলেন। তারপর আতস-কাঁচ কি সব
দেখলেন। কতগুলি পুরানো হলুদ পাতা যুক্ত বইয়ের পাতা খুলে দেখলেন। তারপর অবাক হয়ে
বললেন, এই মুখোশ তুমি কোথায় পেলে ভায়া ? আমি বললাম, চীনাপট্টির পুরানো এক কিউরিও-র
দোকানে নিলামে কিনেছি। চোরাই মাল কিনা জানি না।
উনি চিন্তিত মুখে বললেন, আমি যদি
ভুল না বুঝি, এই মুখোশটি ঐতিহাসিক ও দুস্প্রাপ্য। সমস্ত পৃথিবীতে আর মাত্র একটি এই
ধরণের মুখোশ আছে, তাও মিশরের কায়রোর মিউজিয়ামে। এই মুখোশটির হাঁড়ির মত আকৃতি আর
উপরের শৃগালের প্রতিকৃতি দেখে মনে হচ্ছে এটা মিশরীয় মৃত্যুর দেবতা অনুবিসের মুখোশ।
ভয়ের ব্যাপারটা হল, একমাত্র প্রাচীন মিশরীয় পুরোহিতরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময়
অর্থাৎ মানুষের মৃত্যুর পর যেসব আচার-অনুষ্ঠান হত, সেসময় এই মুখোশ ধারণ করত।
আমি মন দিয়ে শুনে বললাম, এই মুখোশ
অন্য কেউ লাগালে কি হবে ? আমি যে এই মুখোশটা একবার ধারণ করেছি, সেটা বেমালুম চেপে
গেলাম। উনি একটু ভেবে বললেন, ইতিহাস বলছে, তার ফল হতে পারে মারাত্মক। কারণ
'অনুবিস' ছিল মৃত্যুর পরের জীবন, মায়া জাল আর কালো তন্ত্র মন্ত্রের দেবতা।
পুরোহিতরা বিশেষ দেহশুদ্ধির পর এই মুখোশ ধারণ করত। অন্য কেউ এই মুখোশ পড়লে রুষ্ট
হতে পারেন অনুবিস, যার ফলে তিনি পারলৌকিক আত্মাদের জীবন্ত করে আমাদের পৃথিবীতে
ফেরত নিয়ে আসতে পারেন।
৫
তুঝে ছেড়ে
হাওয়া চঞ্চল...
মহব্বত তুমসে শিখি হে...
রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিল
মিউজিক্যাল কলিং বেলের শব্দ। এত রাতে আবার কে এলো ? মন্দিরা কোলকাতার বিলাস বহুল ফ্ল্যাটে
তখন একা। ডিজিটাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সে। সময় ডিসপ্লে করছে রাত সাড়ে এগারো । ভিউয়িং গ্লাস দিয়ে দেখল সে। আজকাল কাউকে বিশ্বাস নেই।
দরজার বাইরে তখন দাঁড়িয়ে মন্দিরার
বাবা। নামকরা টী কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার বিমল সিনহা। তাড়াতাড়ি কালকে রাতের
পার্টির উচ্ছিষ্ট জিনিসপত্র মানে খালি বোতল, বিয়ারের ক্যান, পিজ্জা, প্যাটিস,
চিকেন লল্যিপপ সবই সরিয়ে ফেলল সে। কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করলে এইসব গেট-টুগেদার
পার্টি না করলে চলে না। সবাই বলবে মিডিল-ক্ল্যাস মেন্টালিটি।
মন্দিরা অবাক হয়ে বলল, আরে,
ড্যাডি। তোমার তো কালকে আসার কথা ছিল ! মিঃ সিনহা বললেন, আরে বুবলি, তোর ফ্ল্যাটে
আসতেও পার্মিশন নিতে হবে নাকি ? এত্তো বড় হয়ে গেছে আমার ছোট্ট বুবলি মা ?
তারপর মিঃ সিনহা যোগ করলেন, আসলে
গভর্নমেন্ট টী বোর্ড এর সাথে মিটিংটা ক্যানসেল হয়ে গেছে। ভাবলাম দার্জিলিং গেস্ট
হাউসে থেকে কী হবে ? তাই চলে এলাম তোর এখানে।
- তা ভালোই করেছ। কিছু খেয়েছ কী ?
না কি অনশন করে রয়েছ এতো রাত অবধি ?
- আমার ছোট্ট বুবলি মা থাকতে আর
আমার চিন্তা কী ?
এই বলে মন্দিরার মাথায় হাত বুলিয়ে
দিয়ে বললেন মিঃ সিনহা, মা আমায় একটু তোর হাতের স্পেশাল গাজরের হালুয়াটা খাওয়াবি
ক্ষীর মেরে। অনেকদিন তোর হাতের রান্না খাইনি। রান্নার
হাতটা তুই তোর মার মতই পেয়েছিস।
মন্দিরা ছোট্ট থাকতে মা মারা
গেলেও আর বিয়ে করেননি মিঃ সিনহা। যদি মন্দিরার ঠিক মত দেখাশুনা না হয়। মেয়েকে
এতোটাই ভালোবাসতেন তিনি।
মন্দিরা ব্যস্ত হয়ে বলল, একটা ফোন
তো করতে পারতে। দেখি আবার ফ্রীজে মিল্ক আছে কিনা ! তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও।
অনেক দূর থেকে জার্নি করে এলে। এসিটা আমি অন করে দিলাম ড্রইং রুমের।
গাজরের হালুয়াটা বানিয়ে নিয়ে
ড্রইং রুমে এসে একটু অবাক হলো মন্দিরা। কোথায় আবার গেল ড্যাডি ? ওয়াশ রুমে নেই তো
? ঠান্ডা জল আনতে ফ্রীজের দিকে এগোল সে। ফিরে এসে দেখে ড্যাডি এসে গেছে।
- কোথায় আবার চলে গিয়ে ছিলে ?
তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। নইলে আবার হালুয়াটা ঠান্ডা হয়ে যাবে। কেমন হয়েছে বোল কিন্তু।
খুব তাড়াহুড়ো করে বানিয়েছি। এতক্ষণ না খেয়ে কেউ থাকে! মা থাকলে এমন অনিয়ম তুমি
করতে পারতে ?
- তুই তো আমার মা ! তুই থাকতে
আমার চিন্তা কী ? ফ্যান্টাস্টিক হয়েছে মা ! আর একটু দিবি মা ? কবে আবার এই জগতের মায়া ছেড়ে
পরলোকে চলে যাব, যাবার আগে আমার বুবলি-মার ভালোবাসা জড়ানো গাজরের হালুয়া মন ভরে
খেয়ে নি !
- ড্যাডি ভালো হচ্ছে না কিন্তু।
তুমি আজ আবার ছাইপাশ স্কচ্ গিলে এসে উল্টোপাল্টা বকছ ।
- সোনা মা আমার। আমার একটা কথা
রাখবি মা। মরার আগে আমাকে দেওয়া শেষ প্রতিশ্রুতি।
- ড্যাডি এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি
হয়ে যাচ্ছে !
- না বুবলি, আমায় বলতে দে মা।
অনির্বাণ ছেলেটা মনের দিক থেকে বড়ো ভাল। তুই ওকে ক্ষমা করে দিস। বড্ড একা ছেলেটা।
কিন্তু তোকে ভীষণ ভালোবাসে। ওকে তোর জীবন সাথী করে নিস। যদি এই বুড়োর কথা একটু
ভাবিস মরার আগে।
- তুমি আবার সেন্টিমেন্টাল ব্ল্যাকমেইল শুরু করলে ? দাঁড়াও, আমি
একটু আসছি কিচেন থেকে।
কিচেন থেকে এসে মন্দিরা অবাক হয়ে
দেখল ড্রইং রুমে কেউ নেই। ওয়াশ রুমেও কেউ নেই। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল
কেউ নেই। ড্যাডিকে কেমনযেন অন্যরকমের মানুষ লাগছিল আজকে, কিছুতেই তাকে এতদিনের
অভিজ্ঞতায় মেলাতে পারছিল না মন্দিরা। কিছু একটা গন্ডগোল আছে। কিন্তু কি সেটা ?
কিছু না বলেকয়ে কোথায় চলে গেল ড্যাডি ? নিচের নেপালী ওয়াচম্যান কে ফোনে ধরলো সে...
- নেহী ম্যাডাম ! আপকে উধার তো
কোই আদমি নেহী আয়া। হাম তো ডিউটি ছোড়কে কিধার ভি নেহী গয়া !
৬
সকাল থেকেই মাথাটা ভারি ভারি
লাগছিল। কাল রাতে তো কোন পার্টিও ছিল না, তাও যে কিসের হ্যাংওভার অনেক ভেবেও কোন কুল
কিনারা পেলাম না। আমি কোলকাতার প্রথম শ্রেণীর বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রের জার্নালিস্ট
অনির্বাণ সরকার। আমার লেখাকে কোলকাতার অনেক কেউকেটা ব্যক্তি সমীহ করে চলে। অথচ
কিছুতেই মনে পড়ছে না কাল রাতের কোন কথা।
ব্রেইনের মেমারী সেলগুলো যেন
ঘুমিয়ে পড়েছে।এতো দেরিতেই বা আমি কি করে উঠলাম ? আরে, তাইতো আমার মোবাইলটা কোথায়
গেল ? এতোক্ষণে তো মোবাইলে অ্যালার্ম বাজা উচিত ছিল। প্রায় দুপুর হয়ে এল। নাঃ, মোবাইলটা
আগে খুঁজে বার করতেই হবে। আমার আঁতেল প্লাস মাকাল ফল
বস্ না জানি কতবার ফোন করে করে খিস্তি দিয়েছে। সেক্রেটারীকে দিয়ে আমাকে
টার্মিনেশান লেটার ধরানো খালি বাকি!
কি ভেবে নিজের অজান্তেই টিভিটার
রিমোট চিপে দিলাম। বাঙলা খবরের চ্যানেল দেওয়াই ছিল। আমি ফ্রেস হতে হতে শুনতে
পেলাম...
"বিশিষ্ট সাংবাদিক
অনির্বাণ সরকার কাল রাত থেকে নিজের বাড়ি থেকে রহস্যজনকভাবে উধাও। দার্জিলিং থেকে
শিলিগুড়ি আসার রাস্তায় এক মর্মান্তিক পথ দূর্ঘটনায় টী এস্টেটের জেনারেল ম্যানেজার
বিমল সিনহা কাল রাত থেকে নিখোঁজ। নিজস্ব সংবাদদাতার মতে, রাত প্রায় ন'টার সময়
চারজনকে নিয়ে গাড়িটি বৃষ্টিতে পিচ্ছিল পাহাড়ী রাস্তায় টাল সামলাতে না পেরে গভীর
খাতের মধ্যে পড়ে যায়। খারাপ আবহাওয়ার জন্য পুলিস এখনো কারো ডেড বডি উদ্ধার করতে না
পারলেও, কারো বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে..."
হঠাত্ করেই মোবাইল ফোনটা উদ্ধার
হলো ড্রেসিং টেবল থেকে। ভাইব্রেট করা রয়েছে। বত্রিশটা মিস্ কল। আমি তো বিশাল
ভিভিআইপি দেখছি। মনে পড়েছে একটু একটু...
কাল রাতে মুখোশটা নিয়ে নাড়াচাড়া
করছিলাম। ভাবছিলাম একবার মুখোশটা মুখের উপর লাগিয়ে দেখবো। কী আছে
ঐ মুখোশে ? কেন সবাই এত ভয় পায় ?
তারপর...তারপর...সব ব্ল্যাংক। মুখোশটা গেল কোথায় ? রাতে আমি বা কোথায় ছিলাম? ঐ আবার
মোবাইলটা ভাইব্রেট হচ্ছে। যা ভেবেছি তাই, আমার জিগরী দোস্ত সৈকতের কল।
- কোথায় ছিলি মাইরি ? সারা রাত ? এদিকে তো তোর বস
আমাদের পাগল করে দিচ্ছে। কিরে শুনতে পারছিস না ? কালা হয়ে গেলি নাকি অনির্বাণ ?
আমি সৈকত বলছি...
- হ্যালো , বল সৈকত।
- তোর না আজকে প্রেজেন্টেশন ছিল।
গুরু কোন রূপবতি কন্যার চক্করে ছিলেন কাল রাত্রে ? শোন...মন দিয়ে। অনিমেষ তোর নামে
থানায় মিসিং ডায়েরি করেছে। তুই ভুল ভাল একটা স্টোরিলাইন বানিয়ে একটা ডক্টর
সার্টিফিকেট বাগিয়ে জলদি অফিস চলে আয়। অবশ্য যদি তোর চাকরিটা লাগে, তাহলেই... !
- সকাল সকাল খিস্তি বের করাস না
তো মুখ থেকে। কার মুখ দেখে যে উঠেছি আজকে !রাতের ঘটনা কিছুই মনে নেই। একদম
ব্ল্যাংক,
তুই একটু ম্যানেজ কর। আমি আধা ঘন্টার মধ্যে আসছি ভাই। তুই একটু ম্যানেজ কর।
- টিভিতে নিউজটা শুনেছিস ? তোর
মন্দিরার বাবা কালকে একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। সব নিউজ চ্যানেলে দেখাচ্ছে।
- দাঁড়া দেখছি। ছেড়ে দিলাম।
আবার কার যেন ফোন আসছে। চাকরিটা
বোধহয় আর থাকলো না ! স্ক্রিনের দিকে না দেখেই ফোনটা ধরলাম।
- তুমি কী এখুনি একবার আমার সাথে
দেখা করতে পারবে প্লিজ - খুব আর্জেন্ট। যত তাড়াতাড়ি পারো তুমি...মন্দিরার গলার সেই
দৃঢ়তা যেন ভেঙে চুরমার করে দিয়ে গেছে কেউ...নইলে সে এভাবে বিনতি করবে অনির্বাণকে!
- কাকুর কী খবর ? কিছু খবর পেলে
কী ?
- জানি না।
আমি কিচ্ছু জানি না। তুমি আসতে পারবে কিনা বলো।
- টেনশান কোর না। আ'য়াম অন দ্য
ওয়ে। শুধু গাড়িটা বের করতে যতটুকু সময় লাগে...
মানুষের প্রায়োরিটি যে কত তাড়াতাড়ি
বদলে যায় ! এখন আমার কাছে মন্দিরার কাছে পৌঁছানোটাই সবচেয়ে জরুরী। নিমেষে চাকরির
কথা ভুলে গেলাম।
গাড়িটা বের করতে গিয়ে অবাক হয়ে
গেলাম। ইঞ্জিনটা এখন গরম। রাতে গাড়ি নিয়ে বেরলাম কখন ? অথচ কিছুই মনে নেই ! এমনটা
আগে কখনো হয়নি।
আরো অবাক হয়ে গেলাম এই দেখে যে,
অদ্ভুত দর্শন মিশরীয় মৃত্যুর দেবতা অনুবিসের মুখোশটা আমার গাড়ির ফ্রন্টসীটে বসে
যেন মুখ ভেঙচাচ্ছে আমায়। যেন বলছে, কিরে কেমন দিলাম বল !
| Aleekpatamagazine.blogspot.com |
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post