টাইগার
হিলের ভোরের সূর্য
সম্পা
দত্ত দে
টাইগার হিলের সোনা রোদ্দুর ছুঁয়ে আছে কাঞ্জনজঙ্ঘার বরফ সাদা শরীর।
নরম সোনা রোদের সোনালী আলোর আভা। আহা কি অপূর্ব দৃশ্য। সবাই নাকি দেখতে পায়না। মেঘ এসে যদি ঢেকে দিয়ে যায়। সূর্য লুকিয়ে থাকবে মেঘের আড়ালে। কেউ কেউ সাত বার টাইগার হিলে সূর্য ওঠা দেখতে গিয়ে দেখতে পায়নি। তবে আমরা দেখতে পাব। মনের ভেতর অনিশ্চয়তার প্রচন্ড অস্থিরতা হয়ে চলছে আমার। পুজোর ছুটি পড়তেই মন পালাই পালাই করছে। আগমনীসুরে "শিশিরে শিশিরে শারদ আকাশে ভোরের আগমনী" শিউলি ফুল ঝরছে টুপটুপ। ফুলের বিছানা বিছিয়েছে মাটির পেলব নরম হাতের ছোঁয়ায়। এবার মন টানছে টাইগার হিল। টাইগার হিলে সূর্য ওঠা না দেখলে এ জন্ম বৃথা যাবে। উত্তর বঙ্গের এতটা কাছে থেকে এতো সুন্দর একটা দৃশ্য দেখা থেকে বিরত থাকব। না না সে হয়না। অতএব ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে দু'হাজার আঠারো'র ত্রিশে অক্টোবর পুজোর ছুটিতে চললাম সপরিবারে দার্জিলিং সফরে। শীত একটু একটু করে আসছে। ভোরের দিকে ঠান্ডা এসে আদরের স্পর্শ দিয়ে যায়। সকাল সকাল বোলেরো চেপে একছুটে শিলিগুড়ি। আগে থেকেই ভাগ্নের গাড়ি হাজির ছিল তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডের সামনে। পরিমল হোটেলে ভাত খেয়ে আবার পাহাড়ি পথে ছুটলাম। মন ছুঁয়ে আছে ভাললাগার আবেশে। জানলা দিয়ে দেখছি একটু একটু ক'রে খাদ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। পাহাড়ের চূড়ায় রোদ মেঘের খুনসুটি চলছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সাদা কুয়াশার চাদর। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড় পাক খেতে খেতে গাড়ি এগিয়ে চলছে। গাড়ির ভেতরে বসে ছোটদের আনন্দ সাথে সমান তালে গান চলছে। ননদের ছেলে ব্লগ করার জন্য ছোট ছোট ভিডিও গ্ৰাফি করছে মোবাইল ফোনে।
ঝাউ ,পাইন, দেবদারু,গাছ
স্বাগত জানাতে ব্যস্ত আমাদের মত সব ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের। গভীর খাদ দেখে ভয় আর
রোমাঞ্চকর পরিবেশ। পাহাড়ি ফুল, প্রজাপতি, রডোডেনড্রন, রংবেরঙের
অর্কিডের মেলা বসেছে যেন। শীত একটু একটু ক'রে শরীরের ভেতরে ঢুকে
পড়ছে। সোয়েটার গায়ে জড়িয়ে নিলাম সবাই। ছোট ছোট ঘরবাড়ি গুলো কাছে আসতেই
ড্রাইভার ভাই বললেন ঐ যে ঘন বাড়িঘর দেখছেন ওটাই দার্জিলিং শহর। মন ভাল হয়ে গেল।
অবশেষে চলে এলাম প্রকৃতির সৌন্দর্যের অধিকারী শৈলরানী দার্জিলিং।
গাড়ি থেকে নেমে সামনেই আমাদের থাকার জন্য
হোটেল। হোটেলের নাম "হোটেল ব্রডওয়ে" । আরো চোখ আটকে গেল একটা নাম চোখে
পড়তে। হোটেলের নামের নীচের লেখা "কোচবিহার রোড" মন অজানা ভাললাগায় ভরে
উঠল। দার্জিলিং এ এসে কোচবিহারের নাম। নিজের জায়গা নিজের জন্মস্থান বলে কথা। পরে
জেনেছি “কোচবিহার রোড"' নামকরণ কি জন্য করা
হয়েছিল।
হোটেলের আতিথেয়তা পেয়ে আমরা খুব খুশি। পুরো খাওয়া দাওয়াতে পুরো বাঙ্গালীয়ানা। খাওয়ার শেষে শেষ পাতে রসগোল্লা পান্তুয়া। দার্জিলিং পৌঁছতে আমাদের বেলা তিনটে বেজে গেল। সেদিনের মত খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম দার্জিলিং ম্যাল, নেপালীকবি ভানুভক্ত অডিটোরিয়াম হল, আরও সাইট সিন দেখতে।
হোটেলের ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে
পড়লাম। পরদিন সকালে আবার সেই মনোরম দৃশ্য দেখার অপেক্ষায়। একটু চাপা উত্তেজনা
অনুভব করছি। ঘুম ঠিক হচ্ছে না। বারবার ভেঙে যাচ্ছে। রাত আড়াইটায় নাকি রওনা হতে
হবে। একটু বিরক্তি প্রকাশ করলাম কর্তার উপর। এসেই কিনা পরদিন টাইগার হিলে সূর্য
ওঠা দেখা। তিনি বলেন কিনা যদি আকাশ মেঘলা থাকে,
তবুও তো পরদিন থাকল।
ভাগ্নে বলল টেনশন কোরো'না একদম,
ভোর চারটায় গাড়ি বলেছি।
পাঁচটা আটান্ন মিনিটে সূর্য ওঠে। আমরা ঠিক
সময়েই পৌঁছে যাব। আমি তিন চারবার গেলাম কোনো চিন্তা নেই। ভাগ্নে ইঞ্জিনিয়ার,
পোষ্টিং দার্জিলিংএ।
ঘুম চোখে কর্তামশাই বায়না ধরেছেন তিনি
আরামের ঘুম নষ্ট হতে দিতে পারবেন না। আমি রাত তিনটার সময় চুপিচুপি উঠে রুমের লাইট
না জ্বালিয়ে রেডি হয়ে গেছি। ভাগ্নের তোড়জোড়ে কর্তা তৈরী হয়ে গেলেন। সবাই
গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে একেরপর এক গাড়ি ছুটছে পাহাড়টা'র
মাথায়। কুয়াশা মাখা রাস্তায় একটু ব্যতিক্রম হলে গাড়ি খাদে। মনে হচ্ছে
পাহাড়িয়া বিয়ের বরযাত্রী গাড়ি। অন্যরকম অনুভুতি। গাড়ির ড্রাইভার হিন্দিতে
বলছে –“রাস্তে পর দেরি মত করনা। জলদি ব্যয়ঠ জলদি উতর যানা। নহী তো ফাইন লগ
যায়েগা”। দার্জিলিং শহরে রাস্তার উপর গাড়ি দাঁড়িয়ে
আছে দেখলেই জরিমানা আদায় করে নেয় পুলিশ প্রশাসন।
আমারা পাঁচটায় পৌঁছে গেলাম। নীচ থেকে টাইগার হিলের উপরে হেঁটে হেঁটে উঠছি। অনেক উপরে বুকের ভেতর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পা ভেঙে আসছে ।গলা শুকিয়ে কাঠ। সবাই দলছুট। কয়েক হাজার মানুষ এভাবে এগিয়ে চলছে একটি মুহূর্তের সাক্ষী হতে। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই। মানুষের মিছিল। এভাবেই একসময় উঠে এলাম উঁচু সমতল ভূমি তে। কত মানুষ দেশ বিদেশের মানুষের ঢল। সবাই জায়গা খুঁজে দাঁড়িয়ে আছি। পৌনে ছয়টার অপেক্ষায়। ডানদিকে সূর্য ওঠার মাহেন্দ্রক্ষণ বামদিকে চির তুষার শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন অর্ধশায়িত সমাহিত বুদ্ধদেবের প্রতিরূপ। কাঞ্চনজঙ্ঘা সম্পূর্ণ আকাশ জুড়ে বসে আছে। শুধুই মুগ্ধতা। চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছিলাম না।বেলা বাড়তেই ঘন আকাশী নীলের মাঝে শ্বেতশুভ্র আরো অপূর্ব সুন্দর হয়ে উঠছে। সবার চোখ পূর্ব দিকে আকাশের দিকে। গভীর এক আলোকিত আলোকোজ্জ্বল রশ্মি দ্যূতি ছড়াচ্ছে।" বাজল তোমার আলোর বেণু" মা মহামায়া আবির্ভূত হচ্ছেন ত্রিনয়নের জ্যোতি ছড়িয়ে। অদ্ভুত এক শিহরণ জাগাচ্ছে শরীরে ও মনে।আকাশ পরিষ্কার ঝকঝকে। কমলা রঙের বিয়ের কুসুম সূর্য একটু একটু ক'রে উঁকি দিচ্ছে। "ওম জবা কুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ম মহাদ্যুতিম"
চারিদিকে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত আনন্দ।
সবাই চিৎকারে চিৎকারে জানান দিচ্ছে তাদের ব্রাক্ষ্ম মুহুর্তের সাক্ষী থাকার
অভিজ্ঞতা। আস্তে আস্তে ডিমের কুসুমের আভা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। দুধ সাদা
কাঞ্চনজঙ্ঘা ভোরের সূর্যের নরম আলোয় সোনার প্রলেপ মাখিয়ে সোনা রঙে রঙিন হয়ে
গেছে। এতো সুন্দর একটা দৃশ্য দেখে কিছু ক্ষণ আগে নীচ থেকে উপরে উঠে আসার কষ্টদায়ক
অনুভূতি কোথায় যেন এক মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল।
আমার সেল্ফি ক্যামেরায় তোলা মুহূর্তে মেখে
নিমার প্রাণভরে টাইগার হিলের নরম সোনা রোদ্দুর। আজীবন রেখে দিয়েছি স্মৃতির প্রাপ্তির ঝুলি ভরে।
টাইগার হিলে সূর্য ওঠা আর শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা না হলে আফশোষ থেকে যেত
চিরকাল।
ছবিঃ লেখিকা
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post