ঝিলমিলের
পিসেমশাই
শ্রাবনী
গুপ্ত সরকার
অলঙ্করণঃ বর্ণালী গাঙ্গুলী |
ঝিলমিল বেশ মিষ্টি, ছটফটে, বুদ্ধিমতী
মেয়ে। সারাদিন প্রশ্ন করে করে সবাইকে অস্থির করে দেয়। আর খেলাধূলা, বাগানে
ঘোরা, পড়াশোনার ফাঁকে ওর তুমুল আগ্রহ গল্প শোনার। ঝিলমিল এমনিতে
মাথার দুষ্টু বুদ্ধিগুলোকে শুধু দুপুরে মা ঘুমিয়ে পড়লেই কাজে লাগায় একটু আধটু।
কাজেই খুব ভয়াবহ কিছু করে না। আচার চুরি আর গেট খুলে রাস্তার মোড় পর্যন্ত একা একা
হেঁটে আসা ছাড়া। হ্যাঁ, ‘লেফট হ্যান্ড সাইড’ ধরেই
হাঁটে কিন্তু একাই।
তবে ঝিলমিলের গল্প শোনার নেশায় বাড়ির বড়রা
অস্থির। মা সারাদিন কাজকর্ম করে যখন ওকে
খাওয়াতে বসেন, তখনই নাট্যারম্ভ হয়। খেতে
বিশেষ করে ভাত, মাছ, তরকারি
খেতে একদম পছন্দ করে না। একগ্রাস ভাত মুখে নিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে, তারপর
এক সময় উঠে গিয়ে মিনি বিল্লির সামনে মুখ খালি করে চলে আসে। ঝিলমিলকে খাওয়াতে বসিয়ে
সমানে গল্প বলতে হবে। সে আবার আগে শোনা হলে চলবে না। রোজ নিত্য নতুন গল্প পাওয়া
যাবে কোথায়? এদিকে ঝিলমিল এখনো অত ভালো
পড়তে শেখে নি যে নিজেই পড়ে নেবে। কোনোদিন মা,
কোনোদিন ঠাম্মা, কোনোদিন
কাম্মা গল্প বলেন, প্রচুর ভেবেচিন্তে। আজ
উমনো ঝুমনোর গল্প ঠাম্মা বললেন তো,
কাম্মা কাল বলবেন টুনটুনির
গল্প।এভাবেই চলতে থাকে...
সবচেয়ে হাঁড়ির হাল মায়ের নিজের ছোটবেলার গল্প
থেকে শুরু করে ঠাকুরমার ঝুলি... ভান্ডার প্রায় শেষ। রাতে বাবা রামায়ণ, মহাভারতের
গল্প বলেন মেয়ের খাওয়ার সময়টাতে।
শীত পড়েছে ভালোই রান্নাঘর নানা শাকসবজি, পিঠে
পায়েসের ধুম। কিন্তু ঝিলমিল মর্জি হলে তবেই একটু মুখ খুলবে। এত সব শৌখিন খাবার, কেক, প্যাস্ট্রি
তবুও চলে, কিন্তু হাজার ভালো সবজি,
মাছ, মাংস
দাও মেয়ে ভাত খাবে না।
প্রতিবছর ক্রিসমাসের ছুটিতে বার্ণপুর থেকে
ঝিলমিলের পিসি সপরিবারে আসেন তাঁর বাপের বাড়িতে। পিসি, পিসেমশাই
আর ওনাদের দুই ছেলেমেয়ে এলে খুব মজা হয় ঝিলমিলের। পিসেমশাই যদিও একটু রাগী রাগী
মতো, কিন্তু দেখতে খুব সুন্দর। সাহেবী কেতার মানুষ, বিলেত
ফেরত ইঞ্জিনিয়ার। কথায় কথায় ইংরেজী বলেন বলে ঝিলমিলের একটু ভয় ভয় করে। কিন্তু
ফুটফুটে সুন্দরী মিষ্টি পিসিমণি আর টুটুল,
মিমিল দুই ভাই বোনকে খুব
ভালো লাগে ওর।
পুরো শীতের ছুটিটা চিড়িয়াখানা, নিক্কো
পার্ক, ইকোপার্কে বেড়ানো,
বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামে
তারা ভরা আকাশ দেখা, হুট করে পিকনিক করা আর দল
বেঁধে হৈ চৈ করে সিনেমা দেখা। কি মজা,
কি মজা!
শুধু পিসেমশাই একটু গম্ভীর গলায় যখন ডেকে
ইংরেজীতে কথা বলেন, একটু বুকের মধ্যেটা
গুরুগুরু করে ওর। নন্দদুলাল রায় বিলেত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার হলেও নামটি নিয়ে একটু
বিব্রত। কি আর করা যায়! জন্মের সময় তো বোঝা যায় না, ছেলে
বড়ো হলে কী হবে! কাজেই পিতৃদত্ত নামটিকে ছেঁটে এন.ডি.রয় হয়ে আছেন আর কি! দুর্ধর্ষ
রেজাল্ট, কেরিয়ার, চমৎকার বাংলো এবং উদাত্ত
মনের অধিকারী মানুষটির দম্ভ বলে বস্তুটি নেই মোটেই। হ্যাঁ একটু মুডি এই যা!
একদিন রাতে মায়ের হাতে খেতে বসে খুব জ্বালাচ্ছে
ঝিলমিল। বাবা আর পিসেমশাই গল্প করছেন কিনা। তাই মা আগের শোনা সুখু দুখুর গল্প
বলছিলেন, ওর মোটেই পছন্দ হয় নি,
দেখে শুনে আসরে নামলেন
পিসেমশাই। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সাহিত্যের প্রতি কোনো অবজ্ঞা তিনি দেখান নি কখনোই।
এইটুকু পুঁচকি খুকিকে গল্প বলা আর কি এমন কাজ! জমিয়ে বসলেন শালটা ভালো করে গায়ে
জড়িয়ে।
কিন্তু কি মুশকিল মেয়েটা ছোট্ট হলেও প্রচুর
গল্প শুনে ফেলেছে তো এই বয়সেই। দেশী,
বিদেশী স্টকের যে গল্পই
শুরু করেন মিঃ এন.ডি.রয় ঠিক দুলাইন শুনেই মাথা দুলিয়ে দুষ্টু হেসে মিষ্টি গলায় বলে
উঠছে, “এটা জানি তো পিসেমশাই।”
মনে মনে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন মি. রয়, একটু
অপমানিতও লাগছে। এইটুকু বাচ্চা মেয়ে শোনে নি এমন একটি গল্পও জানেন না তিনি! হ্যান্স
অ্যান্ডারসন, গ্রীম ব্রাদার্স, অস্কার
ওয়াইল্ডও কলেজে পড়া দাদার কাছে শোনা ঝিলমিলের। সেলফিস জায়ান্টের গল্প তো এক লাইন
বলতেই ধরে ফেলেছে। গল্পটা সত্যিই জানে কিনা পরীক্ষা নিতে গিয়েও ঝামেলার একশেষ। সব
বলে দিচ্ছে। মায়ের হয়েছে মহা মুশকিল,
খুব হাসিও পাচ্ছে, চেপে
রাখতে হচ্ছে আর ক্রমেই তেতে ওঠা নন্দাই-এর মুডের কথাও ভাবছেন কাজেই টেনশন হচ্ছেও
বটে।
অবশেষে খুব কম করে ত্রিশটা গল্প বলার অক্ষম
প্রচেষ্টা চালিয়ে মি. রয় শুরু করলেন ‘অ্যান্ড্রোক্লিস অ্যান্ড দ্য লায়ন’ ঝিলমিলের
চোখ চকচকিয়ে উঠল—নতুন গল্প! পিসেমশাই তাঁর সমস্ত নৈপুণ্য ঢেলে সুন্দর করে রোমান
ক্রীতদাসদের কষ্ট, বনে অ্যান্ড্রোক্লিসের
সঙ্গে আহত সিংহের সাক্ষাৎ, সিংহের পায়ের কাঁটা তুলে
অ্যান্ড্রোক্লিসের প্রত্যাবর্তন। কলোসিয়ামে মুখোমুখি যুদ্ধের সময়ে সিংহটির
ক্রীতদাসের পায়ের কাছে গড়াগড়ি দেওয়ায় স্তম্ভিত দর্শকমন্ডলী। পরিশেষে
অ্যান্ড্রোক্লিসের মুক্তিলাভ পুরোটাই জীবন্ত করে বললেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব।
ছেলেমেয়েদের কখনোই গল্প বলতে হয় নি,
এই প্রথম কাজটি করে নিজের
কথন দক্ষতায় তিনি বেশ অবাক আর ঝিলমিল খাওয়া শেষে দুপাটি ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে ছোট্ট
ছোট্ট হাতে তালি দিচ্ছে। খুব পছন্দ হয়েছে পিসেমশাইয়ের বলা বিদেশী গল্প। “কাল থেকে
রোজ তুমি বলবে তো রাত্তিরে খাওয়ার সময়ে?”
মনে মনে আঁতকে ওঠেন
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আবার!!! কালকেই কলেজ স্ট্রিট গিয়ে বেশ কিছু শিশুপাঠ্য সাহিত্যের
বই কিনে আনতেই হবে। নইলে মান রক্ষা করা ভার। ছুটি শেষ হলে সপরিবারে ফেরার সময়
ঝিলমিলের ছলছলে চোখের দিকে তাকিয়ে পাঁচটা চমৎকার গল্পসংগ্রহ উপহার দিলেন পিসেমশাই।
“পরের বছর তুই কিন্তু আমাকে পড়ে শোনাবি বলে গেলাম। তাড়াতাড়ি পড়তে শিখে যা।” চোখ
মুছে হাসিমুখে সবাইকে বিদায় জানায় ঝিলমিল।
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post