কুয়াশা
সান্ত্বনা
দাস
অলংকরণঃ বর্ণালী গাঙ্গুলী |
শীত এসেছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে
মধুমিতা, গাছের পাতাগুলো খসে পড়ছে টুপ টুপ করে। হলুদ বর্ণ পাতাগুলো
এলোমেলো উড়তে থাকে, দু'একটা
এসে পড়ে মধুমিতার মাথায় মুখে আবার সরে যায়। শরীরে একটা শীতের শিহরণ লাগে ওর। এই
পাতা ঝরা বিকেল তারপর রাত রজনীগন্ধার মিষ্টি সুবাস ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে। একটু
পরেই কুয়াশা নামবে একটু একটু করে। রাস্তার আলোকস্তম্ভের আলোগুলোতে যেন গ্রহণ লাগছে, আবছায়া
হয়ে আসছে সেগুলো।কুয়াশারা নেমে এসেছে
মধুমিতার জানালার ওপর। রোজকার মতো অভিসারে এসেছে ওরা। মধুমিতা জানালাটা
খুলল তারপর ভিজে জানালায় তর্জনী দিয়ে ছবি আঁকতে লাগল, ফুটে
উঠল মানুষের মুখ অবয়ব। মধুমিতা করপোরেট অফিসে চাকরি করে। ছুটি বেশী পায় না।
সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যায় এইটুকু সময় তার
একান্ত নিজস্ব। তাই জানালা দিয়ে কুয়াশাদের ঢুকতে দেয় মধুমিতা আর ভিজে
জানালায় ছবি আঁকে তার রোজ স্বপ্নে দেখা কোন এক অচেনা মুখ।
মধুমিতার বন্ধু শিবানী বছরের শেষে আট
দিনের একটা ছুটি নিয়ে ঘুরে আসার ইচ্ছায়
মধুমিতাকে এসে বলল "চল না ঘুরে আসি,
বিভাসদের দেশের
বাড়িতে অনেক গাছ আছে,পুকুর আছে
তাছাড়াও সাজান বাড়ি ভাল লাগবে ", বিভাস ওর স্বামী। মধুমিতার মা বললেন "ও খুব ঠান্ডা লাগায় জানালা খুলে, কুয়াশায়
ভিজে যায় একটু দেখো। "
ওরা রওনা হল একদিন শীত ভোরে যখন পাখীরা ডানা ঝাপটে শিশির ঝরাচ্ছে পালক থেকে ,সূর্যের রক্তিম আলো ঊষার অবগুন্ঠনের আড়ালে চকিত দৃষ্টিলোভা সেই সময় ওরা যাত্রা করল সেই ছুটি কাটানোর অভিলাসে। পাঁচ ঘন্টার যাত্রা পথে হাসি আনন্দে কাটল কিছুটা পথ, এক জায়গায় বিভাস বলল "অনেকক্ষণ গাড়ি চালালাম এবার চা খাওয়া যাক "।নামল ওরা গাড়ি থেকে। রাস্তা সরু হয়ে এসেছে, কিছুটা ভাঙ্গা চোরা অর্থাৎ শহর ছেড়ে শহরতলীর পথ। চা খেয়ে আবার চলল গাড়ি। দু'পাশে নারকেল বাগান, কলা গাছের সারি, নানা রকমের পাখী দেখতে দেখতে ওরা চলল। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষল। একটা বিড়াল রাস্তা পার হচ্ছে। দাঁড়াল গাড়ি দু'মিনিট, আবার চলল। অবশেষে পৌঁছল দেশের বাড়ি। জায়গার নাম মতিঝিল। সুন্দর সাজান বাড়ি। বিরাট আম বাগান নারকেল বাগান,একদিকে গোলাপ ঝাড় পিছনে পুকুর। সারাদিনের ক্লান্তি চলে গেল ওদের। ঘুরে ঘুরে জায়গাটা ওরা দেখল তারপর খাবার খেয়ে রাতে শুতে গেল। খোলা মাঠে তির তির করে কুয়াশা নামল। মধুমিতা মাঝরাতে জেগে উঠল। কে যেন ডাকছে নাম ধরে। ও উঠে জানালার কাছে গেল,
জানালাটা
অল্প খুলতেই কুয়াশারা ওকে ছুঁয়ে গেল। ওর চোখে মুখে মৃদু স্পর্শ পেল ঠান্ডার।
তর্জনী দিয়ে জানালার গায়ে ভিজের ওপরে ও অস্পষ্ট একটা ছবি আঁকল ওর স্বপ্নে আসা একটা
মুখ, কিছুটা অবয়ব। হাত বাড়িয়ে কুয়াশা ছুঁয়ে নিল। কখন আবার
শয্যায় গেল। রাত ভোর হল।
তিনদিন কাটার পর শিবানী আর বিভাস চুপি চুপি
ওর ঘরে এল। পিছন থেকে দেখল জানালার কাঁচে ওর দু'বছর
আগে অ্যাকসিডেন্টে মারা যাওয়া দাদার মুখ
আঁকা, ভিজের ওপরে। কিন্তু দাদাকে মধুমিতা দেখেনি শুধু কানে শুনেছে
খুব সাধারণ চাকরি করা ছেলে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, তাতেই
না করেছে মধুমিতা। শিবানীর দাদা অপূর্ব
দেখেছে মধুমিতাকে দূর থেকে। তার কিছুদিন পরেই মারা গেল দাদা। কিন্ত দাদার মুখ ও
আঁকল কি করে! ও তো চেনেনা তাকে। পরদিন ওরা গাড়িতে উঠল ।ফেরার পালা। খানিকটা
যাওয়ার পর আবার একটা বিড়াল। এপার থেকে ওপার। হয়ত কাকতালীয়। ঝাঁকানি দিয়ে গাড়ি
থামল। মধুমিতা গাড়ির সীটে মাথা রেখে চোখ বুজল শিবানীর শত ডাকেও আর চোখ খুলল না।
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post