তৃতীয় জন্ম
মানসী
গাঙ্গুলী
"আমার ছেলে জয়ের আজ উপনয়ন অর্থাৎ দ্বিজত্ব প্রাপ্তি, তার মানে ওর দ্বিতীয় জন্ম। তাই কি? জয়ের দ্বিতীয় জন্ম তো আগেই হয়েছে আমার কাছে এসে,তবে কি এটা ওর তৃতীয় জন্ম হবে? জয়কে পেয়ে আমি এখন হাসি,সংসারেও আমার বেশ মন হয়েছে। মাঝে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম,কারো সাথে কথা বলতে ভাল লাগত না,খেতে দিলে খেতাম,না দিলে খেতেও চাইতাম না। মুখের হাসি আমার মিলিয়ে গিয়েছিল সেই কবে। বুকের ভেতর তোলপাড়। মুখের হাসি সবাই দেখতে পায় কিন্তু বুকের ভেতরের তুমুল ঝড়ের খবর রাখে কজন? তবু কেউ কেউ যে রাখে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হল কল্যাণ, আমার স্বামী। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তাহলে তো আমি ভাগ্যবান,না ভাগ্যবতী আর কি!" বারান্দায় দিন শেষের আবছা আলোয় একাকী বসে ভাবে রমা। অসহ্য গুমোট গরমের পর আজ খুব এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে। কল্যাণ নিচে ডেকরেটর,ক্যাটারারদের কাজের তদারকি করছে,আত্মীয় স্বজনরা সব গল্পগুজবে মত্ত,ভোর থেকে সব জোগাড়যন্তর করে ক্লান্ত রমা একাকী একটু বারান্দায় গিয়ে বসে। এই এলোমেলো হাওয়ায় তার নিজের এলোমেলো জীবনের কথা রমার মনে পড়ছে খুব।
ভাবছে ও,"এত কিছু কি
একজন মানুষের সঙ্গেই ঘটতে হয়! কি ছিল সেদিন আমার! আমি যে শূন্য হয়ে গিয়েছিলাম
একেবারে”। তবে ছিল, ছিল,কল্যাণ ছিল সর্বদা
আমার পাশে ছায়ার মত,বটবৃক্ষের
মতো আগলে রেখেছিল আমাকে,ভালবাসায়
জড়িয়ে রেখেছিল। তবুও শূন্যতা যে পূরণ হয়নি আমার। ভেবেছিলাম,এই শূন্য
বুকে হাহাকার নিয়েই বাঁচতে হবে চিরকাল। অবসাদে কত সময় মৃত্যুর কথা ভেবেছি তখন,মৃত্যুকে
আপন করে নিতে চেয়েছি,পারিনি
কেবল কল্যাণের জন্য। কল্যাণ যে আমাকে নিয়েই বাঁচে। ওকে একা করে দেবার কোনো অধিকার
আমার নেই সে যতই হাহাকার থাকুক আমার বুক জুড়ে। আর তাই তো কল্যাণকে আঁকড়ে আমার
জীবনে আজ আবার ছন্দ ফিরে এসেছে। কল্যাণও মনোকষ্টে ভুগত কিন্তু আমার এই অবসাদের
জন্য কষ্ট পেত আরো বেশি"। অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে খুবই নামডাক তার,স্কুল থেকে
এসে একটু চা-জলখাবার খেয়েই বসে পড়ত ছাত্র পড়াতে। পড়া এবং পড়ানো তার নেশা,ওই নিয়েই
আনন্দে সদা ব্যস্ত থাকত সে,রমা
থাকত সংসার নিয়ে। মা-মরা মেয়ে শ্বশুরবাড়ি এসে শাশুড়িকে মা বলতে পেরে খুব খুশি
হতো। ও তো কখনও মা বলে কাউকে ডাকেনি,ওর একমাস বয়সেই যে ওর মা মারা যান,তাও আবার
ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায়। এ নিয়ে রমার মনে দুঃখও ছিল খুব,মায়ের একটা
সাদাকালো ছবিতেই ওর মাকে দেখা,সে ছবিও তেমন স্পষ্ট নয়,আবছা। তাই মাকে ও চিনলই না,আর দিদিরাও
তখন ছোট,তাদের
কাছেও মা আবছা,অস্পষ্ট।
সেসময় ঠাকুমা সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন দেশের বাড়িতে বীরভূমের গ্রামে। সেখানে আলো নেই,তাই রাতে
ছোট বাচ্চাকে নিয়ে শুতে হয় বলে বিছানার কাছেই লম্ফ জ্বালিয়ে রেখে শুয়েছিলেন
ঠাকুমা। সেই লম্ফ থেকে মশারিতে আগুন ধরে যায়,খুব বেশি না পুড়লেও ওই ছোট্ট শিশু
রমার দেহের কিছু অংশ পুড়ে যায়। বাবা তাই আর গ্রামে ফেলে রাখেননি তাকে,নিয়ে
এসেছিলেন বাড়িতে,বেড়ে
উঠতে লাগল দিদিদের তত্ত্বাবধানে। ঠাকুমাকে বাবা বলেছিলেন,"মা তুমি বরং
আমার কাছে থাকবে চল,সবাই
মিলে আমরা রমাকে ঠিক বড় করে ফেলব"। ঠাকুমা রাজি হননি,বলেছিলেন, "তোদের ঐ ইঁট
কাঠ পাথরের শহরে গিয়ে আমি থাকতে পারব না বাবা,সবুজের মাঝে না থাকলে আমার দম বন্ধ
হয়ে যাবে। তুই তোর মেয়ে নিয়ে চলে যা। আমি যখন যত্ন করে রাখতেই পারলাম না তোর
মেয়েকে কোনমুখে আর আমার কাছে রাখার কথা বলব বল?সে জোর আমার কোথায়?"এ ঠাকুমার
অভিমানের কথা যদিও তবু রমার বাবার কিছু করারও ছিল না। শহরে কিছু হলে ছোট বাচ্চার
চিকিৎসা সম্ভব,গ্রামে
তা নয়,তাই
শেষমেষ নিয়েই এলেন ছোট্ট রমাকে নিজের বাড়ি। বড় দিদিটার সংসার আর ভাই-বোন সামলাতে
গিয়ে পড়াশোনা আর হয়ে উঠল না। সবাই বড় হলে দিদির বিয়ে হল,অশিক্ষিত
বলে অজ পাড়াগাঁয়ে তাকে বিয়ে দিতে হল। এতই দূরে,যাতায়াতের এতই অসুবিধা সেই মায়ের
মতো দিদি তার হারিয়ে গেল বহুদূরে। ভাই-বোনেদের বিয়ের সময় কয়েকদিনের জন্য আসতে
পেরেছিল কেবল। বাকি ভাই-বোনেরা সবাই অল্পবিস্তর লেখাপড়া শিখেছে। বাবা স্কুল
শিক্ষক ছিলেন কিন্তু ছেলেমেয়েরা কেউ গ্র্যাজুয়েশনের উর্দ্ধে উঠতে পারেনি। এক এক
করে সব বিয়ে হল। এক দাদা বাদে সবার বিয়ে বাবা-ই দিলেন। ওদের বাকি দুই বোনের বাড়ি
বাবার বাড়ি থেকে দুদিকে,তবে
কাছেই। সবাই যে যার সংসার নিয়ে সুখেই ছিল,বাবাও রিটায়ারমেন্টের পর ছাত্র
পড়ানো নিয়েই সময় কাটাতেন। মাঝে মাঝে ওরা দুই বোন একসঙ্গে প্ল্যান করে বাবার
বাড়ি গিয়ে থাকত।
বিয়ের দু'বছর পর রমার
ফুটফুটে এক ছেলে হল। বাবা আদর করে নাম দিলেন 'জয়', বললেন,"এ ছেলেকে যে দেখবে তারই হৃদয়
এ জয় করে নেবে"। তাই 'জয়'
হলো ছেলের নাম। ভাগ্যি ছেলে হয়েছিল,নাহলে যে কি হত,ভাবতেও রমা
শিউরে ওঠে। শাশুড়িমা তো কোনোদিনই মা হয়ে উঠতে পারলেন না,হতেও চাননি।
মা- মরা রমাকে নানারকম অত্যাচার করেছেন,সঙ্গে ছিল ওর আইবুড়ো ননদ। রমা কষ্ট
পেত,কাঁদত
কিন্তু কল্যাণের কাছে কিছু বলত না। হাজার হোক,তার মা,এসব জানলে
তার ভাল লাগবে না। তাই মনের মাঝে গুমরে মরত। তবে কল্যাণ কিছুটা বুঝতে পারত আর তাই
নানাভাবে রমার ক্ষতে প্রলেপ দেবার চেষ্টা করত,এটাই ছিল রমার শান্তি। ছেলে না হলে
যে বাপের বাড়ি বসিয়ে দিয়ে আসবেন বলেছিলেন শাশুড়িমা একথাও সে বলেনি কল্যাণকে,তবে
সারাক্ষণ নিজে চাপের মধ্যে থাকত। তাই ছেলে হওয়ায় সে স্বস্তি পেয়েছে আর জয় তার
ঠাকুমাকেও জয় করে নিয়েছে অনায়াসে,ঠাকুমার বড় প্রিয় সে।
জয় একটু বড় হলে স্কুল শুরু
হল আর ছোট থেকেই সে পড়াশুনায় খুব ভাল ফল দেখাতে লাগল। সবাই খুব খুশি। অঙ্কে সে
খুব ভাল। সবাই বলে অঙ্কের মাস্টারমশায়ের ছেলে তো,তাই। জয় স্কুলে ভাল রেজাল্ট করতে করতে
বড় হতে লাগল,খেলাধুলায়ও
কত প্রাইজ তার। বাড়িতে সর্বদা খুশির হাওয়া। এক এক করে বোর্ডের পরীক্ষায় স্কুলের
মধ্যে সেরা রেজাল্ট করে জয় কলেজে ভর্তি হল ম্যাথস অনার্স নিয়ে। দুটো বছর পর
থার্ড ইয়ার থেকে জয়ের শরীর খারাপ হতে শুরু করল। প্রায়ই জ্বর হত তবু তাই নিয়েই
ও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হল বিএসসি ফাইনাল পরীক্ষায়। এমএসসি তে ভর্তি হল যখন তখন
কলকাতায় হোস্টেলে থাকতে হত। প্রায়ই অসুস্থ হলে রমা কলকাতায় বড় ডাক্তার দেখাতে
বলেছিল,"আমিও
যাব ডাক্তারের কাছে চল,জিজ্ঞেস
করব,এতদিন
ধরে অসুস্থ হয়েছিস,সুস্থ
হচ্ছিস না কেন? কি
হয়েছে তোর?"ছেলে
আশ্বস্ত করে বলেছিল,"আমি
দেখিয়ে নেব মা,তোমাকে
আসতে হবে না"। ডাক্তার দেখালে তিনি ভাল বোধ করেন না,নানারকম
টেস্ট দিলে ধরা পড়ে ব্লাড ক্যান্সার। জয় খুব মুষড়ে পড়ে তবু বাবা-মাকে কিছু
জানায় না। বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে ভেলোরে দেখাতে যায়। সেইমতই চিকিৎসা চলে তবে
তার ভেলোরে যাওয়ার ব্যাপারেও বাবা-মাকে কিছু জানতে দেয় না। বন্ধুরা কেউ কেউ
বাড়িতে জানাতে বলেছিল,উত্তরে
জয় বলেছিল,"বুঝিসই
তো আর বেশিদিন নয়,তাই
যে কদিন না জানানো যায়। এরপর তো সারাজীবন কাটবে ওঁদের চোখের জলে,আমার স্মৃতি
বুকে নিয়ে"। এর উত্তরে বন্ধুদের বলার কিছুই ছিল না,বস্তুত
তারাও বড় মনোকষ্টে ছিল। মনে মনে একাই লড়ছিল জয় রোগের সঙ্গে। কখনও ছুটিতে বাড়ি
গেলে রমা বলত,"তোর
চোখ মুখ শুকনো,শরীর
ক্ষীণ,কি
হয়েছে বাবা তোর?"
ব্যস্ত হয়ে পড়ত রমা,লোকাল
ডাক্তারকে দেখাতে চাইত। জয় হাসত,বলত,"অনেক
বড় ডাক্তার দেখিয়েছি মা,তেমন
কিছু নয়,পড়াশুনার
চাপে অমন শুষ্ক দেখাচ্ছে,পড়া
শেষ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে",রমা ভাবত হবেও বা।
এমএসসিতেও জয় ফার্স্ট ক্লাস
ফার্স্ট হলে তার বাবা পাড়ায়,স্কুলে মিষ্টি খাইয়ে বেড়ান। এরই মধ্যে ভেলোরে দেখানোর ডেট
পড়লে সে "ক'দিনের
জন্য বন্ধুরা মিলে বেড়াতে যাচ্ছি" বলে ভেলোরে যায়। ডাক্তাররা তাকে আর সেখানে
যেতে বারণ করেন,তাদের
আর কিছু করার ছিল না তখন,যে
কদিন তার নির্ধারিত পরমায়ু সে ক'দিনই আর তার মেয়াদ। সেবারে যাতায়াতে জয়ের শরীরে খুব ধকল
হয়,বাড়ি
ফিরে সে বিছানা নেয়। কল্যাণ লোকাল ডাক্তারকে কল দিলে তিনি দেখে আশা ছেড়ে দেন,কদিন
বিছানায় পড়ে থেকে বাবা-মা-ঠাকুমা সবার চোখের সামনে দিয়ে সবাইকে ছেড়ে জয় চোখ
বোজে চিরতরে। এরপর তার বন্ধুদের কাছে রমা-কল্যাণ জয়ের রোগের কথা,তার ভেলোরে
যাবার কথা সব জানতে পারে। ছেলের শোকে রমা পাগলপারা,তার মধ্যে শাশুড়ির বাক্যবাণ,"জন্মেই মাকে
খেয়েছে এবার ছেলেকে খেল,রাক্ষসী
কোথাকার"। রমার কানে কিছুই পৌঁছত না। কল্যাণও শোকে উদ্ভ্রান্ত। কত মানুষ তাকে
বলেছিল,'গর্ব
করার মতো ছেলে হয়েছে তোমার', সে গর্ব আর সে ধরে রাখতে পারল কোথায়! স্কুল,টিউশন সব
বন্ধ তার। শোকে বাড়ির চেহারা থমথমে। রমা শোকে পাথর আর তার শাশুড়ির বিলাপ,অহরহ রমাকে
গালাগাল। সবাই বাড়িতে যেন কলের পুতুলের মত চলাফেরা করত সেসময়। স্কুলের শিক্ষকরা
বাড়ি এসে কল্যাণকে কাজে যোগ দিতে বলেন,তাতে তার মন ভালো থাকবে বলে। সেইমতো
সে আস্তে আস্তে কাজে ডুব দেয়। প্রথমদিকে মনোযোগ দিতে পারছিল না,পরে সামলে
নিয়েছিল সে। পড়ানো নিয়েই সব ভুলে থাকার চেষ্টা করত আর রমাকে দেখত,কেমন করে
তাকে শান্তি দেওয়া যায় তার তখন একটাই চিন্তা। রমার কষ্টটা কল্যাণকে কষ্ট দিত
বড্ড বেশি।
রমার বাবা তাঁর কাছে কিছুদিন
ওকে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন কিন্তু ও কোত্থাও যেতে চাইত না। মেজদিদি মাঝে মাঝে
একেকদিন আসত,কাছে
বসত,গায়ে
মাথায় হাত বোলাত,রমার
চোখের কোণটা বুঝি একটু চিকচিক করে ওঠত কিন্তু একটাও কথা বলত না সে। দেখতে দেখতে
কটা বছর কেটে গেছে,এর
মধ্যে রমার বাবা ও শাশুড়ি দুজনেই গত হয়েছেন। রমা তখন প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলত,সংসারের
কাজকর্ম করত কিন্তু মুখে তার হাসি ছিল না। বন্ধু-বান্ধবের পরামর্শে কল্যাণ রমাকে
নিয়ে ঘুরতে বেরোত,না
কাছেপিঠে নয়,বিভিন্ন
তীর্থস্থানে,পাহাড়ে,সমুদ্রের
ধারে,শুধু
ওরা দু'জন,আর কেউ নয়।
এ তো প্রমোদ ভ্রমণ নয়,সমব্যথী
দুজনের শান্তির খোঁজ। সমুদ্রের ধারে চুপচাপ দুজনে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা।
কল্যাণেরও একটু শান্তি লাগত তাতে। সুযোগ পেলেই রমাকে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ত।
দুজনেরই বয়স বাড়তে লাগল,রমার
প্রায় পঞ্চাশের কাছে আর কল্যাণের পঞ্চাশের ওপারে,চুলে রুপালি রেখা। কল্যাণ তখন ছুটি
পেলেই রমাকে নিয়ে তীর্থে ঘুরে বেড়াত,মন্দিরে মন্দিরে নিয়ে যেত রমাকে।
রমা উদ্ভ্রান্তের মতো পথ দিয়ে যেত তবু এভাবে বাইরে বেরিয়ে বেরিয়ে মনটা কিছুটা
শান্ত হয়েছিল তার যদিও মায়ের কোল খালি করে সন্তান চলে গেলে কোনও মায়ের মুখে
হাসি আসে না। দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর পার হয়ে গেল জয় ওদের ছেড়ে চলে গেছে। এবারে
কল্যাণ রমাকে নিয়ে বেনারস গেল। গঙ্গায় নৌকো করে বিভিন্ন ঘাট পরিদর্শন করে
দশাশ্বমেধ ঘাটে উঠার সময় একটি শীর্ণকায় বছর পাঁচেকের ছেলে রমার কাপড়ের আঁচল ধরে
টান দেয়। রুক্ষ চুল,মলিন
বসন,হাত
পেতে পয়সা চায়। রমা খানিকক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে 'জয়' বলে ডেকে
ওঠে। কল্যাণ হতবাক, ছেলেটিও
হতবাক। রমা বলে,"সেই
চোখ,সেই
চাউনি"। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারা যায়,"ছেলেটির বাবা-মা কেউ নেই,বুড়ি
ঠাকুমা ছিল,সেও
মারা গেছে"। আরও জানা গেল হিন্দিতে কথা বললেও সে বাঙালি,নাম মিন্টু,বাংলাও বলতে
পারত। রমা ওর গায়ে মাথায় হাত বোলায়,ওকে সঙ্গে নিয়ে দোকানে গিয়ে জামা
জুতো কিনে দেয়,সাবান-শ্যাম্পু
কিনে হোটেলে নিয়ে গিয়ে ভাল করে চান করিয়ে
জামা কাপড় পরিয়ে দেয়,দিব্যি
সুন্দর লাগছিল তখন মিন্টুকে। কল্যাণও যেন মিন্টুর মুখে জয়ের প্রতিচ্ছবি দেখে। ওরা
মিন্টুকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল বাড়িতে,প্রথমে ও ভীষণ হকচকিয়ে গিয়েছিল
কিন্তু ওদের ভালবাসা পেয়ে সেও বেশ খুশি। বাড়িতে এনে আদরে,যত্নে,কদিনেই
মিন্টুর চেহারার পরিবর্তন হল। রমা ওকে মিন্টু নাম ভুলে যেতে বলেছিল,তখন থেকে ওর
নাম জয়।
অনেকদিন পর রমাকে খুশি দেখল
কল্যাণ,মিন্টুও
জয় হয়ে খুশিতে রইল ও বাড়িতে। ওর কথায় একটু হিন্দি টান ছিল,বাংলার
সঙ্গে কিছু হিন্দিও বলে ফেলছিল মাঝে মাঝে। রমা ওকে যত্ন করে খাওয়াত,সাজাতো, পড়াতো,কিন্তু শুধু
খাইয়ে-পরিয়ে রাখলে তো চলবে না লেখাপড়াটাও শেখার দরকার। দুবেলা ওকে নিয়ম করে
পড়তে বসাত,কখনও
বায়না করলে কোলে নিয়ে আদর করত। কল্যাণ দেখত রমা নতুন জয়কে পেয়ে খুশিতে রয়েছে আর
মিন্টুও জয় হয়ে,নতুন
মা-বাবা পেয়ে খুব খুশি ছিল। এসব দেখে সেও খুশি ছিল। মনোযোগ দিয়ে স্কুলে পড়াত,বাড়িতে
টিউশন করত আর রমা জয়কে পড়াত,আঁকার মাষ্টার রেখেছিল বাড়িতে,আঁকা শেখাত,সাঁতারে
ভর্তি করে দিয়েছিল। এ যেন তার নিজেরই সেই ছোট্ট জয়। বাড়ির পরিবেশ মিন্টু ওরফে নতুন
জয়ের আগমনে স্বাভাবিক হয়ে উঠল। সবাই দেখত একটা অনাথ শিশু মা-বাবা পেয়ে কত খুশি,নাহলে তো
পথে পথে ভিক্ষে করেই কাটত তার,হয়তো বা বড় হলে চোর ডাকাতও হয়ে যেতে পারত। রমার খুশি দেখে
এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলত না কেবল সেই ছোট ননদ যে রমার পিছনে লাগত,তার এই 'রাস্তার
ছেলে'কে
নিয়ে আদিখ্যেতা করা একদম পছন্দ হত না। এই নিয়ে দু-পাঁচটা কথা বলায় কল্যাণ তাকে
খুব ধমকেছিল,বলেছিল,"এসব করবার
জন্য এ বাড়িতে আসবি না। রমা খুব ভাল মেয়ে,যখন খুশি আসবি,ও তোদের
যত্ন করবে কিন্তু ওর পিছনে লাগলে আমি সেটা মেনে নেব না।"
রমা জয়কে নিয়ম করে খুব ধৈর্য
সহকারে পড়াশুনো শেখাতে লাগল। তার অক্ষর পরিচয় ছিল না মোটেই,কিন্তু রমা
তাকে অল্পদিনের মধ্যেই স্কুলে দেবার উপযুক্ত তৈরি করে ফেলেছিল। মিন্টু ওরফে জয়ও
খুব তাড়াতাড়ি সব শিখে ফেলতে পেরেছিল। তাই ছ'বছরে না পারলেও সাতবছর বয়সে ওরা ওকে
ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে দেয়। যদিও বার্থ সার্টিফিকেট না থাকায় একটু অসুবিধায়
পড়তে হয়েছিল,কল্যাণ
ছোটাছুটি করে সব ব্যবস্থা করে ফেলে আর তার নিজের স্কুলেই ভর্তি করে ওকে।
মিন্টুও জয়ের মতোই
পড়াশুনায় ভাল হয়ে উঠতে লাগল। রমা ওকে খুব সাবধানে রাখার চেষ্টা করত, সবরকম রোগের
টিকা,ইঞ্জেকশন
যা যা ছিল সব দেওয়াতো। এ জয়কে সে আর হাতছাড়া,কোলছাড়া করতে চায় না। রমার দৃঢ়
বিশ্বাস তার জয়ই আবার জন্মে তার কাছে এসেছে,নাহলে গঙ্গাঘাটে এত লোক থাকতে তারই
কাপড় ধরে কেন টেনেছিল ও! কল্যাণ ভাবে রমা ওর ভাবনা নিয়ে খুশি থাকুক। এভাবেই জয়
বড় হয়ে উঠলে ১৩ বছর বয়সে তার উপনয়নের দিন স্থির হয়। সেবারে জয়ের উপনয়নে ঘটা
করতে পারেনি ওরা,দিন
স্থির হবার পরই রমার শ্বশুরমশাই বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যাওয়ায় নমো নমো করে
জয়ের উপনয়ন হয়েছিল,এ
নিয়ে চাপা ক্ষোভ ছিল ওর মনে। এবার তাই ও ঘটা করবে ঠিক করেই রেখেছিল। আইবুড়োভাত
থেকে বাড়িতে আত্মীয়-কুটুম্ব। রমার বড়দি,সেও এখন প্রায় বুড়ি,সবাই এসেছে।
তিনদিন পর দন্ডিঘর থেকে বেরিয়ে দন্ডি ভাসালে সেদিন পাড়া-প্রতিবেশী,আত্মীয়
কুটুম,বন্ধু-বান্ধব
সকলের নিমন্ত্রণ। এ'কদিন
রোজই বাড়িতে উৎসব চলবে। সন্ধ্যে ঘোর হল,আঁধার ঘনিয়েছে,সারা বাড়ি
আলো ঝলমল করে উঠল,রমা
বর্তমানে ফিরে এল। দন্ডিঘরে জয়ের খবর নেবার জন্য,আত্মীয়স্বজনদের চায়ের ব্যবস্থা করার
জন্য ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। এত আলোর মাঝে এখন ওর মুখখানিও খুশিতে ঝলমল
করছে।
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post