বোষ্টমপাড়ার নিমাই ড্রাইভার
ডাঃ অরুণ
চট্টোপাধ্যায়
রাত তখন প্রায় বারটা। নন্দুর
দাদুর বুকটা কেমন কেমন করে উঠল। তারপরে হাঁচড়পাঁচড় খেতে লাগল। একটা টিয়াপাখি যেন
খাঁচার মধ্যে ডানা ঝাপটে যাচ্ছে। তারপরে শুরু হল প্রচন্ড যন্ত্রণা।
দাদুর পাশে শোয় নন্দু। দাদুকে
অস্থির হতে দেখে নন্দুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে উঠে গিয়ে তো মাকে আর বাবাকে ডেকে আনল।
ওরা বুকে অনেক মালিশ টালিশ করতেও কিছু হল না। ব্যথা বেড়েই চলল। রাতে কোনও
ডাক্তারকে পাওয়া মুশকিল। কী হবে এখন?
নন্দুর মা তো কেঁদেই ফেলল।
আসলে বুড়ো শ্বশুরকে সে খুব ভালবাসত। শাশুড়ি নেই। নন্দুকে খুব ভালবাসে তার দাদু।
নাতির সব কিছু দেখাশোনার ভার তার ওপর দিয়ে খুব নিশ্চিন্তে সংসারের কাজ করে যায়
নন্দুর মা।
কিন্তু এখন বেশ ভাল রাত। এমন
সময়ে গাড়িঘোড়া পাওয়া খুব মুশকিল। তাছাড়া বড় রাস্তা থেকে বেশ দূরে তাদের বাড়ি। কাছাকাছি
একটি মাত্র অ্যাম্বুলেন্স আছে। ফোন করে জানা গেল সে অন্য কলে গেছে।
এখন কী হবে? মাথায় হাত
সকলের। নন্দু বলল, ভোঁদাদাদাকে
বল না বাবা।
ভোঁদার একটা সাইকেল ভ্যান আছে।
কিন্তু সেই ভ্যান সে সূর্য ডোবামাত্র ঘরে তুলে দেয়। তার নাকি খুব ভূতে ভয়। নন্দুর
বাবা তার বাড়িতেই কড়া নাড়তে লাগল। কিন্তু ভোঁদার কোনও সাড়াশব্দ নেই।
অগত্যা আবার কড়ানাড়া। কিন্তু
কড়া তো দূরে থাক দরজাই ভেঙ্গে যাবার জোগাড় ভোঁদা দরজা খোলে না। ভেতর থেকে কোঁ কোঁ করে
বলছে, ভূত
আমার পুত শাকচুন্নী আমার ঝি—
বিরক্ত হয়ে নন্দুর বাবা বলল, এই ভীতুর
ডিমটাকে দিয়ে কিস্যু হবে না।
শেষে নন্দুর মাও বেরিয়ে
এসেছে। দরজায় ঠেলা দিতে দিতে বলছে, ও ভোঁদা, ভোঁদা বাপ
আমার। তোর দাদুর যে বুকের ব্যথা উঠেছে বাপ। একবার চল না বাবা লক্ষ্মীটি। টাকা তোকে
যা বেশি লাগে দোব। যা চাইবি তাই দোব। কেবল আজকের দিনটা উদ্ধার করে দে না বাপ আমার।
কিন্তু মায়েরও সব অনুনয় বিনয়
সার। ভেতর থেকে ভোঁদা শুধু গোঙাতে গোঙাতে বলছে, ওরে বাপ এ যে নিশির ডাক। ভূত পেত্নী
সব একসঙ্গে এসেছে। রাম রাম রাম রাম...
বাবা বলল, আ মল! রাত
সবে বারটা। তাতেই নিশির ডাকের ভয়ে দরজায় কুলুপ এঁটেছে। না একে দিয়ে কিছু হবে না চল
দেখি অন্য কী ব্যবস্থা করা যায়।
মা বলল, পচাকাকার
গাড়িটা পাওয়া যায় কিনা একবার দেখলে হয় না?
কিন্তু দুর্ভাগ্য পচাকাকার
গাড়ি এখন এক সপ্তা ধরে গ্যারেজে পচছে। কী একটা পার্টস নাকি পাওয়া যাচ্ছে না।
মেকানিক ছ্যাবলা বলেছে,
কাকু এই ছত্রিশ বছর আগের গাড়ির পার্টস এখন আর পাওয়া যাবে না। এখন সব ডিজিটাল
হয়ে গেছে না? দেশী
একটা আছে সেটা দিয়ে যদি চালান তো দেখেন। তবে সেটা দিয়ে ছ’মাস কি ছ’দিন যাবে
গ্যারান্টি দিতে পারব নি।
পচাকাকা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত
নিতে পারে নি। তাই গাড়ি এখন ছ্যাবলার গ্যারেজে পচছে। তলে তলে সে নাকি এটা কিলো দরে
বেচে দেবার ফন্দিতে আছে। পচাকাকা তো রেগে আছে খুব।
আর এত সাত কাহন শোনার সময় তো
নেই নন্দুর বাবারও। নন্দুর দাদুকে যে করেই হোক খুব তাড়াতাড়ি পাঠাতেই হবে
হাসপাতালে। পাগলের মত এদিক ওদিক পায়চারি করছে।
এমন সময় একটা গাড়ির শব্দ।
গাড়িটা ঠিক তাদের বাড়ির সামানেই দাঁড়াল বলে মনে হল। এ সময় আবার তাদের বাড়িতে কে? নন্দুর বাবা
বাইরে বেরিয়ে এল। গাড়িটা একটা অ্যাম্বুলেন্স। যাকে ফোন করা হয়েছিল সেই কোলকাতা
থেকে ফিরে এল নাকি? বাড়ির সকলের বুকে যেন বল এল।
ড্রাইভারের আসনে বসে যে লোকটা তাকে দেখে কেউ চিনতে পারল না। চেনার সুযোগও নেই।
কারণ আলো নেই সেখানে তেমন। তাতে আবার পেল্লায় বড় তোয়ালে নাকি কাপড় সে বেঁধে রেখেছে
মুখে।
গম্ভীর কিন্তু খটখটে একটা
স্বর ভেসে এল তার দিক থেকে,
এ বাড়িতে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে কাকে?
নন্দুর বাবা বলল, এই যে আমার
বাবাকে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে সিরিয়াস কন্ডিশন।
-বেশ স্ট্রেচারে পেশেন্টকে
তুলে আপনাদেরই বয়ে আনতে হবে কিন্তু। আর কোনও লোক নেই।
সবাই অবাক হয়ে দেখল
অ্যাম্বুলেন্সে আর কোনও লোক নেই। কী আর করা যায় সকলে মিলে স্ট্রেচারে শুইয়ে দাদুকে
অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হল। বাড়ির সবাই মোটামুটি উঠল। এমনকি নন্দুও ছাড়ল না। দাদুর
এমন অবস্থায় সে কিছুতেই দাদুকে ছেড়ে থাকতে পারবে না।
নন্দুর বাবা বলল, এটা কার
গাড়ি?
চালকের সীট থেকে গম্ভীর আওয়াজ
এল, এটা
অ্যাম্বুলেন্স। আপনারা ফোন করেছিলেন।
-কিন্তু ওরা যে বলল—
আর বেশি কিছু বলল না বাবা।
যাক বাবা পাওয়া গেছে এই যথেষ্ট। কিন্তু গাড়িটা হুড়হুড় করে প্রচন্ড গতিতে এগোচ্ছে।
এই মরেছে এ আবার কোথাও ধাক্কা না মারে। এমনিতেই রাস্তার যা দশা। তাতে মাঝরাত্তিরে
হঠাৎ একটা কুকুরটুকুর এসে পড়লেই বিপদ।
নন্দুর মা ফিসফিস করে নন্দুর
বাবাকে জিজ্ঞেস করল,
এত জোরে চালাচ্ছে কেন?
নন্দুর বাবা প্রশ্নটা করল
চালককে। সেই সঙ্গে বলল,
দেখ বাবা, আবার
যদি কিছু একটা হয় তো মহা বিপদ।
-কিছু হবে না। বললেন না খুব
সিরিয়াস কন্ডিশন তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে?
ড্রাইভারের দিকে আলো না
থাকলেও অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে মিটমিটে একটা আলো আছে। তাতে ড্রাইভারকে আবছা দেখা
যাচ্ছে। নন্দুর বাবা দেখল লোকটার মুখ একটা কাপড় দিয়ে ঢাকা। এত গরমে কাপড়ে মুখ ঢাকা
কেন? বেশ
অবাক হলেও কিছু বলল না।
এরপর অ্যাম্বুলেন্সটা যেন উড়ে
চলল। সবচেয়ে অবাক হল তারা তখন যখন দেখল হেলথ সেন্টারের পাশ দিয়ে গেলেও সেখানে থামল
না। নন্দুর মায়ের প্রায় কেঁদে ফেলার দশা। বলল, হ্যাঁ গো থামল না যে। এখন কী হবে?
অবাক শুধু নয় বেশ রেগে গেছে
নন্দুর বাবাও। একটু জোরে বলল, একি হেলথ সেন্টার তো পার হয়ে গেল। আমাদের পেশেন্ট রাস্তায়
মারা যাক এই কি তুমি চাও?
সামনে দিকে তাকিয়েই ড্রাইভার
বলল, এখানে
এমন সিরিয়াস কেসের চিকিৎসা করা যাবে না। আপনাদের পেসেন্টের কিচ্ছুটি হবে না। চুপ
করে বসুন তো।
-কিন্তু কোথায় নিয়ে যাচ্ছ
সেটা বলবে তো নাকি? খুব
অধৈর্য নন্দুর বাবা।
সবাই অবাক হয়ে দেখল লোকটা
নন্দুর বাবার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই অ্যাম্বুলেন্স সিটি হসপিটালের কম্পাউন্ডে
ঢুকে গেছে। কিন্তু এই হাসপাতালে পৌঁছতে অন্তত মিনিট পঁচিশ তো লাগার কথা। দিনে হলে
তো চল্লিশ মিনিটের কম নয়। মাত্র পনের মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেল এ কি জাদু নাকি?
ছেলেটা দারুন চালায় তো। একে
একটা বকশিস দিতেই হবে।
সবাই বয়ে বয়ে পেশেন্টকে নিয়ে
গেল। কাপড়ে মুখ ঢাকা দিয়ে ড্রাইভারও গেল সঙ্গে। রিসেপসন প্রাথমিক ভাবে জেনে বলল, দেখুন এ কেস
এখানে হবে না। আপনাদের কোলকাতায় নিয়ে যেতে হবে।
সকলের তো মাথায় হাত। এখন কী
হবে? এই
রাত। বাড়ির লোকগুলো কী করবে?
এগিয়ে এল ড্রাইভার। জিজ্ঞেস করল, কেন? হবে না কেন?
তার গলাটা আগের মতই খরা খরা।
নার্স বলল, এখন
হার্টের ডাক্তার কেউ নেই। সব ছুটিতে। একজন ছিলেন কিন্তু এইমাত্র তিনি একটা অপারেশন
সেরে বাড়িতে গেছেন। তাঁকে ডাকা মানা আছে। আপনারা অন্য জায়গায় যান।
বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে
রইল। সেই খরা খরা গলায় ড্রাইভার বলল, ওনাকে ডেকে দিন। ডাঃ বিশ্বাস খুব ভাল
ডাক্তার। তাঁকে কল করলেই তিনি আসেন।
-বললাম না তাঁকে ডাকা মানা
আছে। নার্স খুব উঁচু গলায় বলল এবার।
এবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।
মুখের ঢাকাটা খুলল ড্রাইভার। সবটা নয়। শুধু মুখের সামনেরটা। তার মানে শুধু নার্স
দেখতে পাচ্ছে তার মুখটা।
নার্স ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, আ আ আচ্ছা
আমি কল করছি।
কাঁপা হাতে সে মোবাইলের বাটন
টিপতে লাগল। তারপর কানে চেপে ধরল। আবার ডায়াল করল আবার। পরপর তিনবার। তারপর ঘাড়
নেড়ে ভয়ে ভয়ে বলল, সুইচ
অফ।
ড্রাইভার পেছনে ফিরল না। তেমন
খ্যারখেরে গলায় বলল,
চিন্তা নেই। আমি ডাক্তারকে নিয়ে আসছি।
তারপর সবাই দেখল সে একেবারে
ভ্যানিস। সবাই অবাক। নন্দুর বাবা ভাবল অ্যাম্বুলেন্স চালানোর মতই সব কাজ এমন ধাঁ
করে করে নাকি লোকটা?
সবাই রুদ্ধশ্বাস। নন্দুর মনে হল বেজায় ভয় পেয়েছে বেচারি নার্স। কিন্তু কেন এত
ভয় কে জানে। এই সামান্য ড্রাইভারটা কি খুব প্রতাপ আর প্রভাবশালী নাকি?
মিনিট পাঁচ কী দশ হবে।
ড্রাইভারের পেছনে পেছনে শশব্যাস্তে ডাক্তার এসে ঢুকল। তারপর শুরু হয়ে গেল যেন
যুদ্ধকালীন তৎপরতা। ঘন্টা দুয়েক পরে গলায় স্টেথো দুলিয়ে বাইরে এলেন ডাঃ বিশ্বাস।
বললেন, এখন
ঠিক আছে। আপনারা পেশেন্টকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। ওষুধ দিলাম লিখে সিস্টার বুঝিয়ে
দেবেন।
কথাটা বলে চাইলেন ড্রাইভারের
দিকে। সে চলল বোধহয় ডাক্তারকে তার বাড়ি পৌঁছে দিতে। নার্স একেবারে ওষুধ-টষুধ সব
বুঝিয়ে দিল। নন্দুর বাবা খুব নরম গলায় ধন্যবাদ দিতে গেল নার্সকে। নার্স যেন ভয়ে
কেঁপে উঠে বলল, না
না আমাকে নয় আমাকে নয়। দিতে হলে--
বলে সে তাকাল ড্রাইভারের
দিকে। খুব ভয়ে ভয়ে তাও আড়চোখে।
ফেরার সময় নন্দুর বাবা বলল, শুনেছি খুব
ভাল আর বিশ্বাসী ডাক্তার এই ডাঃ বিশ্বাস। নার্স নিশ্চয় চালাকি করে অন্য কার নম্বরে
ডায়াল করেছিল হয়ত।
খ্যারখ্যারে গলায় ড্রাইভার
বলল, চলুন
আর ভয়ের কিছু নেই।
মা তো খুব খুশি। বলল, কে বাবা
তুমি মাঝ রাত্তিরে এমন দেবতার মত উদয় হয়ে আমাদের উপকার করলে? তোমার ভাল
হোক বাবা। দীর্ঘজীবী হও।
উত্তর এল না। বদলে এল একটা
অদ্ভুত খটখটে আর খসখসে হাসি। সে হাসিতে কেমন ভয়ভয় করতে লাগল নন্দুর। এই ভয়ের যেন
একটা কারণ আছে তার মনে হল। আসার সময় এক সময় লোকটার মুখ থেকে কাপড় খুলে গিয়েছিল।
মুখটা দেখেছিল সে। অদ্ভুত ভয়ংকর একটা মুখ। ঠিক মনে করতে পারল না এমন ধরণের মুখ সে
আর কোথায় দেখেছে।
মাত্র মিনিট দশেকের মধ্যেই
যেন উড়ে উড়ে এসে বাড়ি পৌঁছে দিল লোকটা।
সবাই পেশেন্ট নামিয়ে চলে গেল।
একদম পেছনে ছিল নন্দুর মা। লোকটা সেই বিদিকিচ্ছিরি গলায় বলল, আমার নাম
নিমাই। ভয় নেই আবার যদি এমন দরকার পড়ে জানতে পারলে আমি ঠিক চলে আসব। কারোর কোনও
বিপদ হবে না।
বলেই লোকটা স্টার্ট দিল
গাড়িতে। আর চোখের পলক পড়ার আগেই চিহ্ন রইল না সে গাড়ির। নন্দুর মায়ের তো চক্ষু চড়ক
গাছ। নন্দুরও যেন কেমন ভয় ভয় করছে। সেই মুখটা দেখার পর থেকেই।
পরের দিন সন্ধ্যেবেলা দিব্বি
সুস্থ হয়ে বসে চা খাচ্ছে দাদু। নন্দুর বাবা খুব খুশি হয়ে তার মাকে বলল, শুনেছি ডাঃ
বিশ্বাস বিরাট বড় ডাক্তার। ভাবা যায় না নিমাই কী করে তাঁকে এনে চিকিৎসা করাল।
তারপর ওই নার্সটা? প্রথমে
তো তাড়িয়েই দিচ্ছিল। ভাগ্যি নিমাই ছিল।
একটু পরেই নন্দুর পাড়ার এক
বয়স্ক ভদ্রলোক নিতাই জেঠু এসে হাজির। ইতিমধ্যে দাদুর শরীর খারাপ আর হাসপাতালে
যাওয়া আবার সেখান থেকে ফিরে আসার কথা অনেকেই শুনেছে।
-কিন্তু জেঠুকে এক রাত্রের
মধ্যে সারিয়ে আবার বাড়ি পাঠিয়ে দিল এ তো বিশ্বাসই করা যায় না।
বললেন সেই ভদ্রলোক।
-আরে বাবা ডাঃ বিশ্বাসের মত
বড় ডাক্তারের হাতে পড়েছিলেন বাবা তাই তো নিতাইদা। নাহলে কী হত ভাবতেও পারি না।
-হ্যাঁ ভাগ্যি নিমাই ছিল। অমন
উপকারী ছেলে আর হয় না। নন্দুর মা উৎসাহের সঙ্গে গত রাতের সব কথা গল্প আকারে বলতে
লাগল। আর চা খেতে খেতে শুনে গেলেন নিতাই জেঠু।
-কী নাম বললে? নিমাই? অ্যাম্বুলেন্স
চালায়? জেঠুর
প্রশ্ন।
-হ্যাঁ ঠিক তাই। নন্দুর বাবা
খুব খুশি খুশি মেজাজে বলে ওঠে।
-ভগবান ওকে দীর্ঘজীবী করুন।
কী পরোপকারী ছেলে। মা বলতে থাকে।
-দাঁড়াও দাঁড়াও। হ্যাঁ নিমাই
বড় পরোপকারী ছেলে। সে তো থাকে সেই কাপ্তেন পাড়ায়। এখান থেকে তিন চারটে পাড়ার পরে।
রাত হোক বিরেত হোক ওকে একবার ফোন করলেই হবে। তোমার বাড়ির দরজায় ওর অ্যাম্বুলেন্স
ঠিক পৌঁছে যাবে। আর হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখান থেকে শুরু করে যত কিছু আছে সব সে
করে দেবে। কাউকে কুটোটি নাড়তে দেবে না। বলে এমনিতেই রুগীর বাড়ির লোক রুগীর চিন্তায়
আকুল হয়ে থাকে। সেই চিন্তার সময় নিজেরা কি করবে আর কি না করবে ভেবেই পায় না। তাই
একটু সাহায্য করে দি। কিন্তু-
ঘরে যেন একটা বোমা ছুঁড়লেন
জেঠু, কিন্তু
সে তো মারা গেছে আজ থেকে দশদিন আগে। কাল সে আসবে কী করে?
সবাই যেন স্তব্ধ। নন্দুর বাবা
বলল, তুমি
নিশ্চয় অন্য কোনও নিমাইয়ের কথা বলছ নিতাইদা।
-আরে বাবা না না।
অ্যাম্বুলেন্সের মালিক হয়ে সেটা চালায় সেই নিমাইয়ের কথাই বলছি আমি। লেখাপড়া বিশেষ
জানত না। বাবা পি-এফ গ্র্যাচুইটির টাকা থেকে তাকে এটা কিনে দিয়ে বলেছিল দ্যাখ
চাকরি তো জুটবে না। এখন এটা খাটিয়েও যদি কিছু রোজগার করতে পারিস। তা ছেলেটা যে বড়
ভাল এটা তুমি ঠিক কথাই বলেছ বৌদি। সত্যি সে খুব ভাল। এই অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ায়
খাটিয়ে সে বেশ পয়সা রোজগার করতে পারত। কিন্তু পরোপকারের নেশা তাকে তাড়া করেছিল।
ড্রাইভার রাখে নি। বলে ড্রাইভারকে যদি সর্বদা না পাই। রোগ কি আর অপেক্ষা করতে পারে? সে নিজেই
ড্রাইভারি শিখেছিল। খুব কম পয়সায় সে রুগীদের পৌঁছে দিত হাসপাতালে। আর বাকি তো সব
তো আগেই বলেছি বিকাশ।
ঘর পুরো নিস্তব্ধ। খানিকটা গা
ছমছমে ভয় আবার বেশ কিছুটা মন খারাপের জন্যেও বটে।
নন্দুর বাবা বলল, কিন্তু মরল
কি করে?
-ষড়যন্ত্র আর কি। আর একটা
আম্বুলেন্স আছে সেই বোষ্টমপাড়ায়। নিমাইয়ের পরোপকারের চোটে তার ব্যবসায়ে ঢিলে পড়ছিল
যে ইদানিং। তাই—
-তাই?
-ষড়যন্ত্র করে তার ব্রেকের
তার কেটে রেখেছিল। বোষ্টমপাড়ার মুখে যে কালভার্টটা আছে না সেখানে মারল ধাক্কা। পড়ল
নিচে বিরাট খালে। গাড়িটা দেওয়ালে লেগে চুরমার হয়েছিল আর সে পাঁক থেকে উঠতে পারে
নি। দম আটকে মারা গিয়েছিল। ভাগ্যি অন্য লোকটা ছিল না। নাহলে আরও একটা মরত।
নন্দুর এবার মনে পড়ল কালকের
ড্রাইভারটার মুখ। কেমন ছিল সেই মুখ?
একটা কংকালের মুখ। দাঁত বার
করে যেন সর্বদাই হাসছে খটখট করে। গভীর রাতে অ্যাম্বুলেন্সের হুটারের আওয়াজে ঘুম
ভেঙ্গে গেল নন্দুর। আবার এই মাঝ রাত্তিরে কার শরীর খারাপ হল? আচ্ছা এই
অ্যাম্বুলেন্সটা নিমাইয়ের নয় তো?
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আবার
সেই সঙ্গে মনের মধ্যে একটা ভাল লাগার ভাবও।
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post