শ্যামাপ্রসাদ
সরকার
আর একদিন পর থেকেই এ বৎসরের
মতো কার্তিকী কৃষ্ণপক্ষের শুরু। আর সেই রোরুদ্যমানা ভয়াল অন্ধকারেই আসন্ন
বহুকাঙ্খিত দীপাবলির মহাপূজার ক্ষণটি।
এর একটি মাস আগে থেকেই
পিতৃলোকের আরাধ্য দেহাত্মাগণ তাঁদের বংশজদের উত্তরণ ঘটাতে এই মর্ত্যভূমিতে অবতরণ
করেন আর তাদের হাতে তিলাঞ্জলির পিপাসা নিবারণের পর বংশধরদের ইহজীবনটি ধন্য করেন।
এবারে কিন্তু মাসাধিককালের অন্তে তাঁদের উন্মার্গগমনের সেই পরম সময়টি ক্রমেই যে
উপস্থিত তা তো আর কারো অজানা নয়!
মধ্যরাত এখন অতিক্রান্ত।
বাতাসে কার্তিকের ঈষৎ শৈত্য মৃদুমন্দ আভাসে জানিয়ে দিচ্ছে এবারে আদিত্যদেবের
অতিপরিচিত সেই দক্ষিণায়ণটির ক্রমপ্রাবল্য।
এদিকে এক পর্ণকুটিরের সামনে
সুরধ্বনিময় গঙ্গার বুকে কান পাতলে ক্রমে আবার যেমন একটি নতুন জোয়ারস্রোতের কলস্বর
শোনা যাচ্ছে বটে আবার সেই গৃহকর্তাটি অন্য রাতগুলির মত এ রাতেও একেবারে বিস্রস্ত, সুপ্তিহীন,বিনিদ্র ও
অটলগম্ভীর। মহানিশার এই বিছানায় সুষুপ্ত সব প্রতিবেশী আর পরিবারের লোকজনদের কথা
বরং আজ থাক।
এখন আমাদের ওই গৃহকর্তা স্বয়ং
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে নিয়েই ক্রমে অগ্রসর হওয়াই ভাল।
একদা তিনিও নবদ্বীপরত্ন
শ্রীচৈতন্যের সহপাঠী ছিলেন বলে শ্লাঘা বোধ করেন। যদিও সে মহাযুগ এখন ইতিহাসের কোলে
মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে,
যখন তিনি, রঘুনন্দন
শিরোমণি, রঘুনন্দন
ভট্টাচার্য ও শ্রী গৌর একই টোলে নানা জটিল শাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন আর বহু তাত্ত্বিক
বিতর্ক বাঁধিয়ে তাবড় সব পূর্বতন নৈয়ায়িকদের দর্পচূর্ণ করতেন এই শান্তিপুর-নবদ্বীপে
অবস্হান করে। চোখ বুজলে এককালে যে তাঁরও সেই বহ্নিসদৃশ কিশোর গৌরহরির মধ্যে যে
একটা প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল তা যেন আজও বিস্মরণে তিনি অক্ষম।
পরবর্তীকালে তাঁর সতীর্থটি
বৃন্দাবনাশ্রিত সখীভাবে কৃষ্ণভজনের পথে গেলে, দুজনের মধ্যে আদর্শগত মনোমালিন্য হয়
ও কৃষ্ণানন্দ তখন শাক্ত পথ অবলম্বন করেন। অবশ্য প্রিয়বন্ধু গৌরের এই নতুন
শ্রীচৈতন্যরূপটি যদিও তিনি একদা রামকেলীর আসরে দূর থেকে একবার দেখে অশ্রুমার্জনা
করে নীরবে ক্ষমা চেয়ে এসেছেন নিজে, শেষ পর্যন্ত দূরবর্তী দর্শকের আসন
থেকেই।
***
গত নিশাকালটি মনোরম হলেও তিনি
এখন বড়ো উতলা। তিনি আসলে মনের মধ্যে কেবল খুঁজে চলেছেন নিভৃত সমর্পণের আদর্শ সেই
পরমআরাধ্যা অতিগূহ্য চিন্ময়ীর মাতৃস্বরূপটি।
যা বহু কঠিন শাস্ত্রমন্থনেও
সেই রূপটি যে এখনো তাঁর নিজেরই অধরা।
আসলে চৈতন্য-পরবর্তী যুগে, যখন
ধীরে-ধীরে বৈষ্ণব-আধিপত্য কমে আসছে স্বয়ং ভিত্তিভূমি নবদ্বীপে, তেমনই এক
সময়ে সাধক হিসাবে আত্মবিকাশ "আগমবাগীশ কৃষ্ণানন্দে"র।
বাংলায় শক্তিচর্চাও তখন
বিক্ষিপ্ত, অধোগামী।
হাল ধরতে এলেন আগম-নির্গম সব তন্ত্রের সারাৎসার যাঁর ধমনীর মধ্যে সেই তিনিই।
বিভিন্ন তন্ত্রশাস্ত্র ঘেঁটে, রচনা করলেন ‘তন্ত্রসার’। লোকে তখন থেকেই "
আগমবাগীশ" বলে তাঁর কাছে গুরুজ্ঞানে প্রণত হয়।
কিন্তু মেজাজটি আর সাধকোচিত
বশে নেই। থেকে থেকেই অকারণ অস্হির লাগছে বড়োই।স্বয়ং চিদানন্দস্বরূপা রূপপ্রকাশের
খেলাটিতে কি তবে সত্যিই তাঁর প্রতি নিছক অনুদার?
মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হয় এযাবৎ
চর্চিত সেই শাস্ত্রবাক্যগুলি। আজ অজানিতেই সেগুলিকে সর্বতঃ ব্যর্থ বলেই তবে কেন
মনে হচ্ছে কৃষ্ণানন্দের?
একটু ধীরগতিতে এসে তিনি সেই
পূণ্যসলিলা গঙ্গোদকে পাদস্পর্শ করলেন। তারপর কিঞ্চিৎ স্বচ্ছতোয়ার ধারা হাতে তুলে
এবার যেন নিজের মাথায় ছিটিয়ে আত্মশুদ্ধি করলেন।
নাহ্ ! তাঁর যে আর আজকাল
নিদ্রাই যে আর আসেনা। অথচ স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী ব্রাহ্মপ্রত্যূষে নিদ্রাভঙ্গের পরই
তো সেই কাঙ্খিত মাতৃমূর্তিটি প্রকট হওয়ার কথা। তারই প্রলোভনে যে কত রাত তিনি
বিনিদ্র আর অপেক্ষমান সেটা আর কাকেই বা তিনি বলবেন?
শাক্ত তন্ত্রে এখনো পর্যন্ত
মহাশক্তিযন্ত্র ও ঘটে আরাধনা হলেও দেবীর মাতৃস্বরূপটি সবারই অজানা। স্বয়ং তিনিও কি
পারবেন এতদিনপরে সেই অভ্রংলিহ কারুণিকের দেবীরূপটিকে একবার চাক্ষুষ করতে?
পূবদিকে শেষরাতের মায়াময়
স্নিগ্ধতা কাটিয়ে এবার অরুণোদয় ক্রমআসন্ন। এ যেন আরও একটি ব্যর্থতম দিনের উদ্ভাস !
হায়! আক্ষেপ করে ওঠেন সাধক
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। গত পক্ষকালের মত এই রাত্রিটিও বিফল হল তবে!
নিরন্তর তন্ত্রসাধনায় তিনি
বুঝেছেন যে সাধারণ মানুষ নিরাকারের পূজা ও তার মর্ম সঠিকভাবে বুঝবে না। অতএব
মৃণ্ময়ী মূর্তিতেই এবারে হোক দেবীর আরাধ্যা রূপের প্রকাশ।
***
ঈষৎ মনস্তাপের সাথে তিনি
নবোদিত সদ্যোজাত ক্ষীণ রশ্মিসম্পন্ন সূর্যকে অভ্যাস মতো একবার প্রণাম করলেন। তারপর
আচমনের জন্য সামান্য জল তাঁর কন্ঠস্পর্শ করল সভক্তিভরেই।
তাহলে! সেই ছদ্মরূপা মহাশক্তি
আজও তবে তাঁর কাছে ধরা দিলেন না ! আর একপক্ষকাল পরেই তো অমাবস্যা। দেবী ভগবতী কি
তার আগে একটুও এই অধমসাধকটির ওপর সদয়া হতে পারেন না?
মধ্যবয়স্ক বৃষস্কন্ধ
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্থির করলেন এবারে এই ব্যর্থ অসহায় মনুষ্য দেহটিকে তবে না হয়
এজন্মের মত সেই মুক্তকেশী করালবদনাকেই নিজের হাতে প্রণামীর জন্য দিয়ে আসবেন আগামী
মহাপূজার শেষে, অমাবস্যাটি
বিগত হলেই।
***
তন্ময় সাধকের পথে হঠাৎই গোচর
হয় এক নিম্নবর্ণীয়া গোপবধূ। তার ডান পা একটি বারান্দার ওপর তোলা, আর বাঁ পা
মাটিতে। ডান হাতে তার কিছু গোময়ের স্তুপ আর বাম হাতটি উঁচুতে তুলে ঘুঁটে দিতে সে
এখন উদ্যত সীমানার বেড়াটির গায়ে।
রমণীটির কুঞ্চিত মেঘকালো
চুলটি আলুলায়িত ও একঢাল,
যদিও পরণে তার কোনওভাবে পরিধান করা একটি ছোট শাড়ি তবুও সেই শ্যামবর্ণা প্রায়
প্রায়উলঙ্গিনী পরমাপ্রকৃতিটি অত ভোরে স্বয়ং কৃষ্ণানন্দকে দেখে লজ্জায় জিভটি কেটে
আবার সঙ্গে সঙ্গেই পিছন ফিরে দাঁড়াল।
কৃষ্ণানন্দ স্বয়ং এ দৃশ্যে
অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।
কিন্তু কে যেন অলক্ষ্যে বসে
তাঁর প্রতি অট্টহাস্য করে বিদ্রুপ করে বলছে " রে মূর্খ! এই তো সেই আরাধ্যা
চিন্ময়ী স্বরূপা রে! যার ধ্যানে বসলে তুই নিজেই মুগ্ধকন্ঠে বলিস্ তো,
- ঘোরদ্রংষ্ট্রাং করালাস্যাং
পীনোন্নতপয়োধরাম্।।শবানাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং
হসন্মুখীম্।সৃক্বদ্বয়-গলদ্রক্ত-ধারা-বিষ্ফুরিতাননাম্।।
ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং
শ্মশানালয়বাসিনীম্।
বালার্ক
মণ্ডলাকার-লোচনত্রিতয়ান্বিতাম্।।
দন্তুরাং
দক্ষিণব্যাপি-লম্বমান কচোচ্চয়াম্।শবরূপ-মহাদেব-হৃদয়োপরিসংস্থিতাম্।।
শিবাভির্ঘোররাবাভিশ্চতুর্দ্দিক্ষু
সমান্বিতাম্।মহাকালেন চ সমং বিপরীত রতাতুরাম্।।সুখপ্রসন্নবদনাং
স্মেরানন-সরোরুহাম্।
এবং সঞ্চিন্তয়েৎ কালীং
সর্ব্বকাম-সমৃদ্ধিদাম্"
হঠাৎ তাঁর মনোজগতে এক
অসীমপরিবর্তন ধেয়ে আসছে যেন। কৃষ্ণানন্দের মুখের স্মিত হাসিতে এখন বিশ্বজয়ী
সাধকপ্রবরের এক নবঅনুরাগের ক্রমউন্মেষ।
আহা! এই তো সেই বহুপ্রতীক্ষিত
তাঁর মাতৃকার চিন্ময়ী আনন্দস্বরূপার স্বরূপটি। রূপকের আড়ালে যিনি তো সদাই
ভক্তকল্পতরু।
ধন্য আজ নিশাবসান! আর
তদ্বজনিত প্রকাশমানা আজকের পরম ব্রাহ্মমুহূর্তকালটি!
তাঁর দুটি চোখে ততোক্ষণে নেমে
এসেছে ভক্তির অশ্রুধারা। বিগলিত কন্ঠে সুরধ্বনীর তীরে শুয়ে আভূমি প্রণত হন তিনি, আর
মন্দ্রকন্ঠে উচ্চারণ করেন দক্ষিণাকালিকার প্রতি পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের সময়ে সেই
বহুচর্চিত ও উচ্চারিত মহামন্ত্রটি -
"আয়ুর্দ্দেহি যশোদেহি
ভাগ্যং ভগবতি দেহিমে।পুত্রান্ দেহি ধনংদেহি সর্ব্বান্ কামাংশ্চ দেহিমে।।
দুর্গোত্তারাণি দুর্গে ত্বাং সর্ব্বাশুভ-নিবারিণি।ধর্ম্মার্থমোক্ষদে দেবি নিত্যং
মে বরদা ভয়।। কালি কালি মহাকালি কালিকে পাপহারিণি।ধর্ম্মকামপ্রদে দেবি নারায়ণি
নমোহস্তুতে।।"
বেশ অভাবনীয়ভাবেই স্বয়ং
চিন্ময়ীকে আজ প্রত্যক্ষ করেছেন শেষপর্যন্ত। এবারে কালাকালের ভাবতরঙ্গে সেই
রূপটিকেই ভবিষ্যতের জন্য মৃন্ময়ী আকার দিয়ে যেতে হবে। তাঁর আয়ুষ্কালটি এবার গত
হলেও এই রূপেই দেবী চিরদিন ধরা থাকবেন।
আগমবাগীশের ঐশী সাধনার
শেষপর্বটি আজ বড়োই যে মধুর সমাপনে চিরউজ্জ্বল হয়ে রইল।
বিগলিত কৃষ্ণানন্দ অবশেষে
সানন্দে আজ তাঁর কুটিরের পথে পা বাড়ালেন।
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post