অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Thursday, April 15, 2021

বড় গল্প-অপরাজিতা - কৃশানু কুন্ডু

 

অপরাজিতা

কৃশানু কুন্ডু


  

 পৌষ মাসের ঠান্ডায় যখন ছোট্ট অনু শ্বশুরবাড়ি এলো তখন কে জানতো যে এতো নতুন কথা, এতো নতুন গল্প তৈরি হবে। ছোট্ট অনু তো জানতই না, এতো যে ব্যাবসা সামলানো ওর বড়ো ভাশুর, এত জ্ঞানী ওর শ্বশুরমশাই, এতো পূজো  আচ্চা জানা শ্বাশুড়ী, ননদ, জা, তারা কেউই কিছু জানত না। অনু তো এটাও জানত না যে বর জিনিসটা ঠিক কি, ওর বর কে? বিয়ের দিন ওর থেকে বেশ কিছুটা লম্বা একটা ছেলে পাশে দাঁড়িয়ে মন্ত্র বলেছিলো বটে, এমনকি ওর সাথে সাথে আগুনের চারপাশে ঘুরেও ছিলো, পালকির পাশে হেঁটেছিলো, নৌকোতেও পাশেই ছিলো। ওই বোধহয় বর। বর যে কে তাতে অনুর বয়েই গেছে। সারাদিন খেতে দেয় নি কেউ। সব মিটে যাবার পর একটা বৌ এসেছিল এক থালা খাবার নিয়ে। ও নাকি ওর বড় ননদ। হাতে করে খাইয়ে দিল। বেশি খেতে পারলো না অনু। একটু মিষ্টি খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।

 

বরের সাথে দেখা হলো ফুলশয্যার রাতে। সে দিনও প্রচুর ধকল গেছে অনুর। সেই সকাল থেকে কত নিয়ম, কত্তো লোক। পুতুলের মতো সেজে সারাদিন কেটে গেলো, কখনও ওর কোলে তো কখনও তার কোলে। মা তো ছিলোনা কোনোদিনই। বাবাকে দেখতে না পেয়ে খুব কষ্ট হচ্ছিলো অনুর। কিন্তু সেটা অনেকটা কেটে গেলো বড়ো ননদের আদর পেয়ে। নিজের মেয়ের মতো আগলে রেখেছিলেন অনুকে তিনি। অনুর শুধু মনে হচ্ছিলো, এখানে নদীর ঘাট কত দূরে? আম গাছ আছে এখানে? পুরনো মন্দির না থাকলে লুকোচুরি খেলবে কোথায় ? খেলবেই বা কার সাথে? ওর সাথে তো মইদুল, হারান, টুকটুকি ওরা কেউ আসেনি। পুতুলও তো দিলোনা কেউ।

 

বড়ো ননদ ওকে একটা ফুল দিয়ে সাজানো খাটে শুইয়ে দিয়ে যাবার পর, ও প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলো। সেই সময় সেই ছেলেটা, যে নাকি ওর বর, সে এলো ঘরে। ননদ শিখিয়ে দিয়েছিলো, বরের কথা শোনা, তাকে ভালো রাখা, এটাই অনুর কাজ। কিন্তু খুব ভয় করছিলো অনুর তাই ঘুমের ভান করে পড়েছিলো। সেই ছেলেটা এসে, ওর মুখের খুব কাছে মুখ এনে, আলোটা তুলে ওকে দেখছিলো। পিট পিট করে চোখ মেলেছিলো অনু। ছেলেটা সরে গিয়ে একটু গম্ভীর গলায় বলল, "ওঠার দরকার নেই, শুধু নিজের পুরো নাম বলতে পারবে?" অনু উঠে বসে বলল, "আমার নাম টিকলি।" বর বলল, "টিকলি? সবাই যে বলল তোমার নাম অনু?" এবার বড়ো করে জীভ কেটে অনু বলল, "অনুই তো, ভালো নাম অনুপমা দেবী। টিকলি তো টুকটুকি ডাকে। তোমার নাম কি?" ছেলেটা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, "আমার নাম তোমার মুখে আনতে নেই, জাননা?" তারপর একটু থেমে বলল, "আমার নাম শ্রী গৌরনারায়ণ রায়, তোমার শ্বশুরমশাই, আমার পিতা, তার নাম শ্রী হেমেন্দ্রচন্দ্র রায়, আমার সব চেয়ে বড় দাদার নাম, শ্রী অতুল্যচন্দ্র রায়, জেনে রাখা ভাল। আমি পড়াশোনা করি ঢাকায়। চলে যাব কদিন পরে। তুমি এই বাড়িতেই থাকবে, বাবা মায়ের কথা শুনবে, তাদের সেবা করবে। তারা ছাড়া এবাড়িতে অনেক লোক আছে। আমার দিদি কুন্তলা, দাদারা, বৌদিরা, সবার কথা শুনবে। বাকিদের আস্তে আস্তে চিনে যাবে। ভাল থেকো। যদি বাড়ির কথা মনে পড়ে তো কাউকে বলো, বাড়ি যাবার ব্যবস্থা করে দেবে কিন্তু রোজ রোজ বোলো না, তোমার বাড়ি অনেক দূরে, বার বার যাওয়া হয়ে উঠবে না। তা ছাড়া এখন থেকে এটাই তোমার বাড়ি।" এই বলে বেরিয়ে গেল সে। বরটা একদম ভাল না, কেমন শক্ত মত, এই ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো অনু।

 

কিছুদিন পরেই গৌর ঢাকা চলে গেল। অনুর জীবনে খুব একটা ছাপ পড়ল না তাতে। ন বছরের অনুর দিন কেটে যেতে লাগল তার বড় ননদের আদরে, বাড়ির অন্য বাচ্চা মেয়েদের সাথে পুতুল খেলে আর জানলা দিয়ে দূরের পদ্মার দিকে তাকিয়ে বাবার কথা ভাবতে ভাবতে। এ ভাবেই দিন গড়িয়ে যেতে লাগল। শীতের ঠান্ডা হাওয়া পেরিয়ে আস্তে আস্তে ডেকে উঠল বসন্তের কোকিল। আর ক দিন পরেই মাটির রং বদলে হয়ে গেল তামাটে। চাঁদপুরের এই বাড়ি,পদ্মা, মেঘনা, দুই নদীর কোলে, তাই বর্ষার মেঘ যখন দেখা দিল তখন বাড়িতে মজুত করা হল পরের ক মাসের রসদ। পদ্মা, মেঘনা ফুলে উঠলে আর বাড়ি থেকে বেরনোর জো থাকবে না। ঝড়, জল, সাপ, ব্যাং এই নিয়ে কেটে গেল আরও ক মাস। দেখতে দেখতে জল নেমে গিয়ে আবার ডাঙ্গা বেরিয়ে এলো আর পেঁজা তুলোর মত সাদা মেঘের বজরা ভেসে যেতে লাগল আকাশে। পদ্মা, মেঘনার ধারে গয়নার মাঠে মাথা দোলাতে লাগল সাদা কাশফুল। মহা আড়ম্বরে বাড়িতে দুর্গাপুজো হল। নতুন শাড়ি, জামার চেয়েও বড়ো পাওয়া ছিলো বাবার তাকে দেখতে আসা। অনুকে দেখাচ্ছিলও সাক্ষাৎ মা দুগ্গার মতো। কপালে সিঁদুর, পায়ে লাল আলতা, হাতে বাবার দেওয়া পুতুল, দেবী যেন সিংহের পিঠ থেকে নেমে বাড়িময় দৌড়ে বেড়াচ্ছিলেন। অনু মহানন্দে ঘুরে ঘুরে বাবাকে দেখাচ্ছিল বৈঠক খানা, গোপাল জিউর মন্দির, একতলা, দোতলা, তার ঘর, কুন্তলা দিদির ঘর, ছাদে পায়রার ঘর, বাড়ির পিছনে আমবাগান, পুরনো শিবমন্দির আর তার পুতুলের বাক্স। অষ্টমীর অঞ্জলীর পরে, মন্দিরের দালানে, বাড়ির বাকি মেয়েদের সাথে, গরিব দুঃখীদের খাবার পরিবেশন করছিলো অনু আর অবাক নেত্রে তার দিকে তাকিয়ে পাশাপাশি বসে ছিলেন অনুর বাবা হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য আর তার শ্বশুরমশাই, হেমেন্দ্রচন্দ্র রায়। এইটুকু মেয়ের এই অন্নপূর্ণা রূপ, গরিব ব্রাহ্মণ ও ধনী ব্যবসায়ীর তফাৎ ঘুচিয়ে দিয়েছিলো। হেমেন্দ্রচন্দ্র মনে মনে ভাবছিলেন, গরিবের মেয়ে ঘরে এনে কোনো ভুল তিনি করেননি। ওদিকে বাড়ির পুজো হলেও বাড়ি ফেরার সুযোগ হয়নি গৌরের। তার মায়ের কয়েক ফোঁটা চোখের জল ছাড়া তাকে কারও খুব একটা মনেও পড়েনি। তার নাকি অনেক পড়া। গোরা সাহেবদের স্কুলে পড়ে সে। সে কৃতি ছাত্র, ছুটি হলেও তার সাহেব শিক্ষকের অনুরোধে ঢাকাতেই থেকে যেতে হয় তাকে।

 

একাদশীতে অনুকে কাঁদিয়ে বাবা বিদায় নিলেন। কিন্তু শ্বশুরমশাই তাকে কোলে তুলে নিলেন, জিজ্ঞাসা করলেন সে কি কি জানে, কি কি শিখেছে ছোটবেলায়। অনু তাকে অ, , ১ থেকে ১০, সবই শুনিয়ে  দিল। হেমেন্দ্রচন্দ্র বিধান দিলেন যে পড়াশোনা যেন শেখান হয় তাকেও। শ্বাশুড়িমা হৈমবতি দেবী এতে খুব খুশি না হলেও, কি আর করা ? আর তা ছাড়া তার নিজের মেয়ে কুন্তলাও তো কিছু পড়াশোনা করেছে। তিনি কুন্তলাকে বলে রাখলেন অনেক খেলা হয়েছে, এবার থেকে কিছু রান্নাবান্নার কাজও যেন শেখে অনু।

 

পুজোর পর পরই আবার শীতের পরশ নেমে আসতে থাকে চাঁদপুরে। ঘাসের মাথায় শিশিরের ফোঁটা, দিনের আলো যেন এক হালকা চাদর বিছিয়ে দেয় বাংলাদেশের ঘন সবুজের উপর। সন্ধে নামে ঝুপ করে আর ঝিঁ ঝিঁ র ডাকে ভরে যায় তারায় ভরা রাতগুলো। দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেল অনুর শ্বশুরবাড়িতে। বরকে দেখেছিলো সেই ফুলশয্যার রাতে, কয়েক মুহূর্তের জন্য, মনেই পড়েনা তাকে।

 

পড়া, খেলায় দিন, কুন্তলাদিদির গল্প আর আর চাঁদের বুড়ির রাত। গ্রীষ্ম , বর্ষা , শরৎ , শীত , ঘরের কাজ শেখা , রান্নাবান্না শেখা, পুতুল খেলা, কুন্তলা দিদির স্নেহ আর শ্বশুরমশাইয়ের আশকারা আগলে রেখেছিল অনুকে। বছরের মাঝে গ্রীষ্মের ছুটিতে, পুজোতে, এ বছর এসেছিল গৌর, ভাল মন্দ জানা ছাড়া তেমন জানা শোনা হয় নি। এক দিন রাতে গৌর আর ও কি কথা বলে জিজ্ঞাসা করেছিল কুন্তলাদি, অনু বলেছিলো, "কেন, আমাদের গ্রামের গাছে পেত্নির গল্প বলছিলাম গো, তা উনি তো ঘুমিয়েই পড়লেন।" তাই শুনে দমকে দমকে হেসেছিলো কুন্তলাদিদি।

 

আরও এক বছর পার হওয়ার পর এক বর্ষার সন্ধ্যায় ঝড়, জল পেরিয়ে হঠাৎ আসল গৌর। এবার নাকি থাকবেও কিছুদিন। এমনিতে কুন্তলা দিদির সাথেই রাতে শুতো অনু কিন্তু গৌর এলে অন্যরকম ব্যবস্থা হতো। গৌর কিছুক্ষন কথা বলে, অনু ঘুমিয়ে পড়লেই চলে যেত। কাকভোরে উঠেও কোনদিনই গৌরকে দেখতে পায়নি অনু। সেবার অনুকে গৌর ওর পড়াশোনার কথা জিজ্ঞাসা করায় অনু বেশ গর্ব করেই শুনিয়েছিলো যে সে বাংলায় লিখতে ও পড়তে আর ইংরাজিতে পড়তে শিখে গেছে। অঙ্কও শিখেছে একটু একটু হেমেন্দ্রচন্দ্রর কাছ থেকে। গৌর বেশ খুশি হল বলে মনে হল অনুর। গৌড় বলল, "পড়াশোনা খুব দরকার, নইলে আমাদের মাথা তুলতে দেবে না এই দেশের শাসকরা। জানো আমাদেরও আর পড়তে দিতে চাইছে না ঢাকায়, বলছে আমরা নাকি কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তুলব তাই আমাদের আর পড়তে দেয়া যাবে না।  বাবামশাই তাই ঠিক করেছেন এবার আমি কলকাতায় পড়ব। আর বছর বছর আসা হবে না।" অনু মনে মনে ভাবলো, "কমু কি?" কিছু না বুঝলেও মাথা নেড়ে গেলো সে। শুধু এটুকু মনে থাকলো যে গৌরের সাথে দেখা এবার আরও কম হবে।

 

হঠাৎ যেমন এসেছিলো, তেমনই গৌর একদিন চলে গেল। শাশুড়ী খুব কান্নাকাটি করলেন, বললেন, "ওই পোড়ারমুখী আসার পর থেকেই আমার ছেলেটার আসা কমে গেছে।" খুব কাঁদল অনুও, কেন যে কান্না পেল তা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। হেমেন্দ্রচন্দ্র নিজের স্ত্রীকে একরকম বকা দিয়েই বললেন, "অদৃষ্টের দোষ এই ভাবে ওর মাথায় চাপিও না।"

 

আবার দিন কাটতে লাগল আগের মতই কিন্তু এগারো বছরের অনু বুঝতে লাগল যে পুতুলখেলা, হাসি, পড়া, এই বাড়ি, দালান, উঠোন, গয়নার মাঠ, পদ্মার ঘাট, এর বাইরেও অন্য একটা পৃথিবী আছে যার সম্বন্ধে অনু কিছুই জানে না। পড়াশোনায় তার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। বছর ঘুরতে না ঘুরতে ইংরাজিতে ও অঙ্কে সে বেশ পারদর্শি হয়ে উঠল। হেমেন্দ্রচন্দ্র নিজের ব্যবসার, জমিজমার হিসাবও একটু একটু বোঝাতে লাগলেন অনুকে।

 

মানুষ দিন রাতের পরিধিতে আটকে থাকে, চন্দ্র সূর্য চলে নিজেদের ছন্দে। দেখতে দেখতে পার হয়ে যেতে লাগলো মাস, গুনতে গুনতে বছর। ছোট্ট অনু এখন আর অতটাও ছোট নয়। আঙুলের বারোটা ক পার করে সে এখন তেরোর দোরগোড়ায়। চমকে ওঠা আর ভীত, সন্ত্রস্ত প্রতিবাদের মধ্যেই একদিন রজঃস্বলা হল অনু। জীবন সম্বন্ধে নতুন জ্ঞান জন্মাল তার। এখন আর সে কুন্তলাদিদির সাথে শোয় না। নিজের ঘর, নিজের গয়না নিয়ে জন্মালো আগ্রহ। পুতুল খেলা, পুকুরপাড়ে কচ্ছপের গর্ত খোঁড়া এখনও তার প্রিয় কিন্তু তার সাথে যোগ হয়েছে দেশ বিদেশের বই পড়ার নেশা। শশুরমশাইয়ের বইয়ের আলমারি যেন সাত রাজার ধন। তার মনের মনিকোঠায় বাসা বেঁধেছেন ভানুসিংহ স্বয়ং, আবার দূরদেশ থেকে কখন তার চিন্তায় ঢুকে পরে কিট্স্, শেলী। কখনও বা দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে দূরে আর মনে থাকে ওথেলোর একাকিত্ব। পড়ার সাথে সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে লেঠেল সর্দারের কাছ থেকে একটু লাঠিখেলা, ঘোড়ায় চড়া এসবও শিখেছে অনু, কে জানে কখন কি কাজে লাগে? গৌর আসে অনেকদিন পরে পরে। খুব বেশি কথা হয়না তাদের। সে তার পড়ার কথা শোনায়, কখনও বলে কলকাতার কথা। কিন্তু এতো বড়ো শহর, এতো গাড়ি, ঘোড়া, ট্রাম, বাস, ঠিক বোধগম্য হয় না অনুর। অনুও একবার আলমারির কোনায় পাওয়া একটা সংস্কৃত বই নিয়ে মানে জানতে চেয়েছিলো গৌরের কাছে কিন্তু গৌর গীত গোবিন্দ দেখে কেমন গম্ভীর মুখে চলে গিয়েছিলো। কিছুই বোঝেনি অনু। তারপর থেকে অনু শুধু শোনে, বিশেষ শুধায় না কিছু।

 

পুরুষমানুষ চিরকালই অদ্ভু, এক বস্তা রাগ আর বাকি সময় শুধু গোমড়া মুখে থাকা। তবুও গৌ যখন চলে যেত তখন অকারণেই মনখারাপ লাগতো অনুর। গল্প, কবিতা, হাঁ করে আকাশের দিকে চেয়ে বসে থাকা, কিছুই ভালো লাগতো না। এমনকি মকবুল মিয়াঁর নৌকোয় করে মেঘনার চরে বেড়াতে যেতেও ইচ্ছে করতো না। সবকিছুই যেন কেমন খালি খালি, সব আছে তবে যেন কিছুই নেই। এদিকে দিন বড়ো হতেই দেশে যেন উঠলো গরম হওয়ার ঝড়। সে হাওয়া যেন সব জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। তার উত্তপ্ত ঝাপটা থেকে পার পেলনা গ্রাম বাংলার এই শান্ত, স্নিগ্ধ গ্রামটিও। গ্রামের লোকেদের মনে যেন বাজছে এক অদৃশ্য দামামা। মাথা চারা দিচ্ছে দূরের অনেক কিছু পেতে গিয়ে কাছের সব কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়।

 

এমনসময় বাড়িতে এলো যতীন। যতীন কুন্তলাদিদির দেওর। যতীনও ঢাকায় পড়াশোনা করত কিন্তু এখন সে আর পড়ে না। আস্তে আস্তে অনু বুঝতে পারল কোন কারণে কুন্তলাদিদিকে তার শ্বশুরবাড়িতে কেউ পছন্দ করে না, তাই তারা কুন্তলাদিদিকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে, একমাত্র যতীনই তার সাথে সম্পর্ক রাখে, ঠিক যেন ছোট ভাইটি তার। যতীন এলে খুশির রোল ওঠে কুন্তলাদিদির মনে। তাকে কি খাওয়াবে, কোথায় শোয়াবে এই নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পরে দিদি। বাড়িতেও যতীনের খুব খাতির। সে যে কুন্তলাদিদির শশুড়বাড়ির লোক। শুধু গম্ভীর থাকেন অনুর শশুরমশাই। উনি যেন কুন্তলাদিদির শশুবাড়ির কাউকেই ঠিক মেনে নিতে পারেননা। কোনো এক অজানা অপমান প্রকাশ পায় তার চোয়ালের শক্ত গঠনে।

 

প্রথমবার যতীনের আসাটা হঠাৎ হলেও তারপর থেকে মাঝে মাঝেই বাড়িতে আসতে লাগল যতীন। আলাপ হয়েছিল প্রথম বারেই। সহজ, সাবলীল ব্যবহার ছেলেটির। যতীন অনুর চেয়ে দু, তিন বছরের বড় হলেও বেশ ভাব হয়ে গেল যতীনের সাথে। বাড়িতে তারা সামনা সামনি কথা তেমন না বললেও, তাদের দেখা হয়ে গিয়েছিলো পুরনো শিব মন্দিরের ধারে, অনু যেমন লুকিয়ে একা একা ঘুরে বেড়ায়, তেমনই এক সময়ে। যতীন অনুর সাথে কথা বলে যে বেশ খুশি হয়েছিলো, তা তার আগ্রহ থেকেই পরিষ্কার বুঝেছিলো অনু। বাকিরা এর কি মানে করে এই নিয়েই অনুর মনে ছিলো চিন্তা। যতীনের তখন এসব দিকে মন দেওয়ার সময় নেই কিন্তু অনুকে ভালো লেগেছিলো তারও। মনে হয়েছিলো অনু মেয়ে হয়েও কত কিছু জানে, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের আগুনরঙা গল্প করতে গিয়েও বিপ্লবীদের কার্যকলাপ ও দেশের অবস্থা নিয়ে অনুর জ্ঞান তাকে মুগ্ধ করে। অনু এসবই জেনেছিলো তার শ্বশুরমশাইয়ের পুরোন দৈনিক বসুমতি, অমৃতবাজার পত্রিকা আর ক্যালকাটা গ্যাজেটের পাতা থেকে।

 

যতীনের আসা যাওয়া আর গৌরের না থাকার শূন্যতা, এই নিয়েই কেটে গেলো অনুর  পৃথিবীতে আরও এক বছর। বাড়ির ছোটদের সাথে খেলা, পড়াশোনা, দিন কাটছিলো ভালই অনুর। শুধু মাঝে মাঝে গৌরের কথা খুব মনে পড়ত। খবর নিয়মিতই আসত যে সে ভাল আছে কিন্তু স্বল্পপরিচিত এই রহস্যময় ছেলেটির সাথে যে তার কোন একটি অদৃশ্য বন্ধন আছে তা বেশ বুঝতে পারত সে। নিজের অজান্তেই তার অপেক্ষায় থাকতো অনু। চারপাশে ছড়িয়েও ছিল গৌরের অস্তিত্বের নানান চিহ্ন। তার ব্যবহৃত চশমা, ছোটবেলার খেলনা দূরবীন, ফ্রাঙ্কলিন মার্ফির টেবিল ঘড়ি, সবেতেই যেন গৌরের ছোঁয়া, তার গন্ধ। কিন্তু গৌর যেন তার বাসা বেঁধেছিলো অনুর মনের কোনো অনধিগম্য কোনে, যেখান থেকে তাকে বার করা অনুর অসাদ্ধ।

 

আস্তে আস্তে যতীনের নানা কাজের কথা কানে আসছিলো অনুর। সে নাকি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিপ্লবীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে, নানান ভাবে বিপ্লবের বার্তা ছড়িয়ে দেয় মানুষের মধ্যে। পুলিশের নজরে সে এখনও পড়েনি। পড়লে হয়তো এবাড়িতে ঢোকা তার দুষ্কর হয়ে পড়বে। এতে অনুর মনে যতীনের প্রতি একটা আলাদা জায়গা তৈরী হয়েছিলো। সে স্থান কি শুধুই প্রশংসার, ভালোলাগার না ভালোবাসার? সে প্রশ্নের উত্তর অনুর কাছে ছিলোনা। ছিলো শুধু একটা সখ্যতা, একই উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাওয়ার এক অদম্য উদ্দম। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যতীনের সব কাজই অনুকে ছাড়া ছিলো অপূর্ণ ।

 

একদিন যতীনদার সাথে পদ্মার পাড়ে ঘুরতে ঘুরতে বেলা হয়ে এসেছিলো। যতীনদা মায়াবী গোধূলির আলোয় কোন ভূমিকা ছাড়াই অনুর হাতের উপর আলতো করে হাত রাখল। এত অবাক হয়েছিল অনু যে কিছুই বলতে বা করতে পারছিলো না। কপালের ওপর নেমে আসা অবাধ্য চুলগুলোকে সরিয়ে যতীন বলল, "তোমাকে আমার ভাল লাগে অনু , তুমি এই চিঠিটা নাও, তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকব। বলেই চলে গেল যতীন। আসন্ন সন্ধের আবছা আলোয় চিঠিটা খুলে অনু দেখল তাতে একটা কবিতা লেখা রয়েছে,

 

তুমিই আমার বনের পলাশ,

 

তুমিই ভোরের আলো ।

 

তুমিই আমার শরৎ আকাশ - 

 

বর্ষা মেঘের কালো।

 

তোমাতে আমার ফেনিল সাগর,

 

তোমাতে আমার ঊষা ।

 

তোমাতে আমার জীবন পূর্ণ -

 

নতুন দিনের আশা ।

 

ভালো লাগল অনুর। এ এক নতুন অনুভূতি। বুকের মধ্যে যেন একটা ঢাকের বাজনা, এক অজানা চঞ্চলতা। রাতে ঘুম  এলোনা  অনুর। অনেক ভাবল। পরের দিন যতীনদা বলল, "অনু , আমি চলে যাচ্ছি, কাজে যাচ্ছি, কর্তব্য পালন করতে যাচ্ছি, তোমার উত্তর পেলে ভালো হতো। অনু বলল, "যতীনদা, তোমার এগুণ আছে তা তো জানতাম না। তুমি সত্যি প্রতিভাবান, কিন্তু যার আদর্শ দেশ তার অন্য দিকে মন দেওয়ার সময় এটা নয়। তাছাড়া এ কখনই সম্ভব নয়, না, সমাজের জন্য নয় গো। ও বাধা তুমি মানো না আমি জানি। কিন্তু বাধাটা আমার, গৌরের সাথে আজ অবধি আমার ভাল করে কথা হয়নি কিন্তু এটা বুঝেছি যে মানুষটার প্রতি আমার একটা টান আছে। তার আছে কিনা , ঠিক জানিনা, তবে আমার আছে, তাই তোমাকে আমার ভাল লাগলেও এ আমি পারব না। তাই তুমি আমার চিরদিনের সখা, আর আমার মনে হয় তাই ভাল। সব সম্পর্ককে নাম দেওয়ার কি দরকার আছে। যতীন আর কিছু বলেনি। শুধু যাওয়ার আগে বলেছিলো, "তাহলে সখা, ওই কথাই রইল, এ সম্পর্ক কিন্তু চিরদিনের।"

 

দু বছর পেরিয়ে অনু তখন ষোল। একদিন খবর এলো গৌর ফিরে আসছে। তার পড়াশোনা  সম্পন্ন হয়েছে। এ বার সে পারিবারিক ব্যবসায় যোগদান করবে। এবার আর কথার খেলাফ হলো না। কদিনের মধ্যেই গৌর ফিরে এলো। বড়ো হয়ে গেছে গৌর। গালে হালকা দাড়ি, উচ্চতায় বৃদ্ধি ও সর্বোপরি, এক স্বাভাবিক গাম্ভীর্য। গৌর আসার পর এক ঘরে, এক বিছানায় শুলেও দুজনের মধ্যে একটা দূরত্ব বজায় থাকল। দুটো মানুষ যারা নিজেদের সব থেকে কাছাকাছি হলেও, দুজনে দুজনকে চেনে না ।

 

এরই মধ্যে একদিন খবর এলো তাদের এক মহালের চাষীদের খুব বিপদ। হঠাৎ গঙ্গার পার ভাঙ্গায় তাদের গ্রাম তলিয়ে যাচ্ছে, তাদের সামান্য বাড়ি ঘর নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য দরকার। এরকম ঘটনা প্রত্যেক বছরই ঘটে, নতুন কিছু নয়। প্রত্যেক বার অতুল্যচন্দ্র লোক পাঠিয়ে চাষীদের সাহায্য করেন কিন্তু এবার গৌর এ খবর শুনেই অস্থির হয়ে পড়ল। তার  কাছে এ ঘটনা নতুন। মানুষের এতো বড়ো বিপদে সে দূরে দাঁড়িয়ে দেখে কি করে? সঙ্গে কিছু লোক নিয়ে গৌর একাই বেরিয়ে পড়ল তাদের মহালের উদ্দেশ্যে।

 

এদিকে গৌরের একা বেরিয়ে যাবার খবরে বাড়িময় হুলুস্থুলু পড়ে গেল । তার শ্বাশুড়ী কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন এবং পূর্বের মতই সব দোষ যে অনুর এই বলে হা হুতাশ করতে লাগলেন । হেমেন্দ্রচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে অতুল্যচন্দ্রকে পাঠালেন গৌকে ফিরিয়ে আনতে । অনু স্বভাব অনুযায়ী চুপ করেই থাকল, লুকিয়ে রইল ঘরের এক কোণে । কিন্তু তার মন বড়ো অস্তির হয়ে উঠল । বুকের মধ্যে আছড়ে পড়তে লাগল ভরা বর্ষার পদ্মার অগুনতি ঢেউ । তা কেন সে ঠিক জানেনা । এই কি ভালোবাসা ? কিন্তু এ তো কাব্য নয়। তার মনে পড়ল যে গৌরের কিছু হলে, তার নিজের কি হবে ? তার কি আর এ বাড়িতে স্থান হবে ? কিন্তু সে অবাক হল যে তার নিজের জীবনের চিন্তা গৌরের চিন্তার সামনে নগন্য মনে হল । এমনও মনে হল গৌরের কিছু হলে ওই পদ্মার জলেই সে নিজেকেও বিসর্জন দেবে । কেন ? সে তো গৌরকে ভাল করে জানেও না । তবে কেন ?

 

পরের দিন খবর এলো দুর্যোগ কেটে গেছে। গৌর ও অতুল্যচন্দ্র সন্ধের মধ্যেই ফিরে আসবেন। ফিরেও এলেন তারা ঠিক সন্ধের মুখে, আকাশভাঙা বৃষ্টির মধ্যে। বারান্দায় বসে তারা হেমেন্দ্রচন্দ্রকে সমস্ত বিবরণ দিলেন। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে অনু শুনতে পেলো একটি বাচ্চা মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে প্রায় তলিয়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল গৌরের। গোপাল জিউয়ের কৃপায় এ যাত্রায় বেঁচে গেছে সে। গৌর ঘরে ফিরলে নিজেকে আর আটকাতে পারল না অনু। কোন কথা বিনিময়ের প্রয়োজন দুজনের মধ্যে পড়ল না। গৌরকে পালঙ্কর উপর বসিয়ে তার মাথা মোছাতে মোছাতে দু চোখের বাঁধ ভেঙে গেল অনুর, নিজের অজান্তেই গৌরও জড়িয়ে ধরল তাকে।

 

এর পর কেটে গেছে আরও বছরতিনেক। গৌর এখন পুরোপুরি ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। অনু ও গৌরের জীবন বদলে গেছে অনেক খানি। তাদের জীবনে এসেছে তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। বাড়ির কুলদেবতার নামে ছেলের নাম গোপালচন্দ্র ও মেয়ের নাম উমা। গৌর ব্যবসার কাজে বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরে থাকে। উত্তর বঙ্গের নানান জেলায় তাদের কাঠের ব্যবসার দেখাশোনা তারই দায়িত্ব। সে কাজ নিয়ে তাকে মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ ঘুরে বেড়াতে হয়। তা ছাড়া নানা কোম্পানির কাগজ নিয়েও নিজের একটা কারবার ফেঁদেছে গৌর। সেই নিয়ে মাঝেমাঝেই তাকে কলকাতায়ও যেতে হয় ।

 

অনুর জীবনেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। সে এখন পুরোপুরি গৃহিনী। সেই উড়নচন্ডী, ডানপিটে মেয়েটা এখন আর নেই। তার জায়গা নিয়েছে এক গলা অবধি ঘোমটা টানা, গয়না পরিহিত, আলতা পরা এক পূর্ণবয়স্ক মহিলা যে তার বেশিরভাগ সময় কাটায় রান্নাবান্নার ব্যবস্থা দেখে। দিন কেটে যায় তার ছেলেমেয়ের পিছনে দৌড়ে, শ্বশুর শ্বাশুড়ির নানা চাহিদা সামলে ও বিকেলে জা, ননদদের সাথে ছাদে গল্প করে। তার আশা ছিল গৌর ফিরে আসার পরে শ্বাশুড়ীর চোখে সে আর এতো বিঁধবে না কিন্তু তা হয়নি। উল্টো সে যেন সব কাজেই তার জা দের থেকে পিছনে। তাই যেন তাকে পদে পদে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সে সব নিয়ে চিন্তা করে না অনু। চিন্তা তার অন্য জায়গায়। গৌরকে নিয়ে সে খুবই চিন্তায় থাকে। দেশের অবস্থা ভাল নয়। ইংরেজ পুলিশের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গন্ডগোল রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের মানুষের মধ্যে একটা চাপা রাগ একটা হিংস্র শ্বাপদের মত লেজ আঁচড়াচ্ছে। ভয়টা সেখানেই। ধনী, ব্যবসায়ী পরিবার হিসাবে তাদের পরিবারের খুব নাম ডাক। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়োজনে লুন্ঠন এক সাধারণ ঘটনা। তাছাড়া অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেকে সোজাসুজি ডাকাতিতে নাম লিখিয়েছে। বাড়ির ছেলেদের মধ্যে একমাত্র গৌরই বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। তাই বাড়ির সুরক্ষার জন্য যত লেঠেল, বন্দুক, বাড়িতে মজুত করা হয়, ততই আশঙ্কা বাড়ে অনুর।

 

শ্রাবণের শেষ যেরকম ঝড়ের আশঙ্কায় উথালপাথাল থাকে, কালো মেঘে ঢেকে থমকে থাকে আকাশ বাতাস, শুধু দিন কেটে যায় কোন নিশ্চিত অথচ অদেখা ভয়ে, সেরকম ভাবেই এগিয়ে চলল কালের কাঁটা। কখনও যতীনের কাছ থেকে খবর আসে যে অপহরণ করা হতে পারে গৌরকে, কখনও খবর আসে যে হামলা হতে পারে তাদের বাড়ির উপর। কিন্তু সেরকম ঘটনা হওয়া খুব কঠিন কারণ বাড়ি এবং গৌরের যাতায়াতের পথ, দুটোই খুবই সুরক্ষিত। অর্থের বিনিময়ে লোকবল ও অস্ত্রের কোন অভাব নেই তাদের। তাছাড়া গৌর তাকে এও জানিয়েছে যে সে কলকাতায় নিজের ব্যবসা তৈরী করেছে অনেকটাই দেশের স্বার্থে, তার ব্যাঙ্ক থেকে ইংরেজদের টাকা চালিত করা হয় নতুন এক ফৌজ তৈরির জন্য আর সে শক্তি ঠিক সময়ে যখন প্রকাশ পাবে, ইংরেজকে এ দেশ ছাড়তেই হবে। সাধারণ স্বাধীনতার সৈন্যরা তা না জানলেও, তাদের নেতারা জানে, তাই তার উপর কোন বিপদ নেমে আসার আশঙ্কা অমুলক। কিন্তু অনুর মনে মনে কোনো অজ্ঞাত কারণে কু ডাকতেই থাকে।

 

কিছুদিনের মধ্যেই সারা পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। এই বাংলাদেশ, যা যুদ্ধের আগুন থেকে বহু দূরে, সেখানেও প্রভাব পড়ল কিন্তু অন্যভাবে, আরও গভীরে, আরও মূলে, মানুষের নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার অধিকারটুকুও ছিনিয়ে নিলো ইংরেজ। তাদের যুদ্ধের প্রয়োজনে নিমেষে শূন্য হল গোলার ধান, থালার অন্ন। অনাহারে মরতে লাগল মানুষ, হাজারে হাজারে, লাখে লাখে। যারা অনাহারে মরল না তারা মরল ধারাল অস্ত্রের কোপে, অন্নের খোঁজে হাতিয়ার তুলে নেওয়া বুভুক্ষু মানুষের হাতে। সে এক বড় বিপদের সময়।

 

অগ্রহায়ণের শেষে যখন ঘাসের উপর জমে থাকে শিশিরবিন্দু, আশপাশের গ্রামগুলোতে অন্ধকার নামে ঝুপ করে, সময়ের আগে, রাত একটু বাড়লেই নিভু নিভু হয়ে আসে বাতি, সদরদরজার দু পাশে ঘুমে ঢুলতে থাকে পাহারাদার, সেরকমই এক রাতে, যখন বাড়ির সবাই ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল হৈ হৈ শব্দে। ডাকাত পড়েছে  বাড়িতে, কোন প্রতিরোধই টিকবে না এদের সামনে। গুলি, গোলা চললেও ক্ষুধার্ত মানুষের কি আর মৃত্যুভয় থাকে? মৃত্যু যে তার শয়নসঙ্গিনী। তারা বাড়ির ছেলেদের বাইরে এনে পিছমোড়া করে বাঁধল, ছাড় পেলেন না বৃদ্ধ হেমেন্দ্রচন্দ্রও। বাড়ির মেয়েদের গলা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হল গয়না, বাদ গেল না বাড়ির আলমারি, সিন্দুক। কিন্তু সবকিছুর শেষে খোঁজ পড়ল গৌরের। গৌর কে কোথাও পাওয়া গেল না। হেমেন্দ্রচন্দ্রকে জেরা করে জানা গেল গৌরকে তিনি গোয়ালন্দ পাঠিয়েছেন ব্যবসার কাজে। বাড়ির অনেকেই এ কথায় অবাক হলেন কারণ গত সন্ধ্যাতেও গৌর বাড়িতেই ছিলো।

 

পরের দিন ক্ষতির হিসাব করে দেখা গেল ক্ষতি অনেক হলেও অপূরণীয় নয়। শুধু যখন এই ঘটনার জন্যেও অনুকে ও তার দুর্ভাগ্যকে দায়ী করল তার শ্বাশুড়ীমা তখন দেখা গেল চুপ করে রয়েছেন শুধু তার শ্বশুরমশাই। অনেক গঞ্জনা শুনেও অনু মুখ খুললো না। শুধু সে ও তার শশুরমশাই জানতেন যে এ কোন সাধারণ ডাকাতি ছিলোনা। এর উদ্দেশ্য ছিল ডাকাতির আড়ালে এদেশীয় কিছু স্বার্থপর রাজনৈতিক দলের গৌরকে গুম করে অনেক টাকা বন্ধক চাওয়ার চক্রান্ত। যথাসময়ে গৌর গোয়ালন্দ থেকে ফিরে এলো। সে নাকি ডাকাতির দিন সন্ধ্যায় তাদের স্টিমবোটে চড়ে যাত্রা করেছিল পদ্মার বুকে, সন্ধ্যার পর পরই। তাকে যে বাড়ির বাইরের বৈঠকে, পাটিতে জড়িয়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল তা জানতেন শুধু হেমেন্দ্রচন্দ্র, আর জানত অনু। সে না জানলে এ যাত্রা রক্ষা পেত না গৌর। ঠিক সময়ে খবর পাঠিয়েছিলো যতীন, আর পাটিতে জড়িয়ে গৌরকে লুকিয়ে রাখার বুদ্ধি ছিলো অনুরই।

 

গৌর এ ঘটনার পরই কলকাতায় যাওয়া আরও বাড়িয়ে দিল এবং ঠিক সে যেমন বলেছিলো, আর কোন আক্রমণ হল না তার বাড়ির বা তার উপর। কিন্তু যুদ্ধের দামামা শান্ত হতে না হতেই, মাথা চাড়া দিল আরেক বিপদ। সারা ভারতবর্ষের জন্য যা খুশির খবর ছিলো, এতো বছরের, এতো রক্তের প্রতিদান, তার কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ঘনিয়ে এলো বিপদের কালো মেঘ। একবার ঠিক হল পুরো বাংলা হয়ে যাবে পূর্ব পাকিস্তান, হায় হায় করে উঠল হিন্দু দেশবাসী, আবার কদিন পরে ঠিক হল বিভক্ত হবে বাংলা, মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলা যাবে পাকিস্তানের কবলে, হিন্দু  পশ্চিম হবে ভারতবর্ষ। একই ভাবে বিভক্ত হলে সিলেট, ভারতবর্ষের আসাম প্রদেশ হল উত্তরাংশ, পাকিস্তানের সাথে থাকল দক্ষিণ ভাগ।

 

হেমেন্দ্রচন্দ্রের আদেশে ঠিক হল একে একে পশ্চিম বাংলার দিকে রওনা হবে পরিবারের সবাই। সবার আগে গৌর ও তার পরিবার, সে কলকাতায় পৌঁছিয়ে তাদের কলকাতার বাড়ি বাসযোগ্য করে তুলবে। সাথে সাথে সংস্কার হবে তাদের কুমোরটুলির বাড়ি, কারণ জ্ঞাতি, আত্মীয় মিলিয়ে সবার ঠাঁই হবে না ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে। সেই মত পৌঁছেই কাজে লেগে গেল গৌর।

 

দিন ঘনিয়ে এলো, মাঝ রাতে দাসত্ব মুক্তি হল কোটি কোটি মানুষের, আকাশ রেঙে উঠল আতশবাজির আলোয়। কিন্তু আতশবাজির আলো যখন মিলিয়ে গেল, ততক্ষণে দিগন্ত ছেয়ে ফেলেছে হানাহানির আগুন আর তাতে ঝলসে যাওয়া মানুষের মাংসের গন্ধ। পুড়ছে তখন বাড়ি, ঘর, দালান, দেউড়ী। প্রাণের দায়ে দৌড়ে পালাচ্ছে মানুষ আর তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে কাটছে মানুষরূপী কিছু নরপিশাচ, রাস্তায় বয়ে যাচ্ছে রক্তের গঙ্গা।

 

অনেক কষ্টে কলকাতায় পৌঁছলেন অতুল্যচন্দ্র ও তার পরিবার। সঙ্গে গৌরের মা, কিছু তাদের বাড়িতে থাকা জ্ঞাতি ও কাজের লোকজন। না, হেমেন্দ্রচন্দ্রকে আর এদেশে আনা যায়নি। তাদের বাড়ি ছাড়ার কিছুদিন আগেই হেমেন্দ্রচন্দ্র দেহ রাখেন। তাঁকে তার ভিটে মাটি থেকে আলাদা করা ছিলো নিয়তিরও অসাধ্য। কোন খবর পাওয়া যায়নি অনুর বাবা বা তাদের গ্রামের কারও। আর একজনকেও আর কখনও খুঁজে পায়নি অনু আর গৌর। অনুর আদরের কুন্তলাদিদিকে আর কখনও দেখতে পাবে না তারা। কলকাতায় আসার পথে হামলা হয়েছিল তাদের উপর। অনেককেই আর পাওয়া যায়নি সে রাত্রির পর, কুন্তলাদিদি তাদেরই একজন।

 

জীবন অনেক সময়ই অনেক কিছু নিয়ে নিয়েও, কোন কিছু দিয়ে যায় তার বদলে। এরকমই একজন ভগবতী। ভগবতী কে? কোন গ্রামে তার বাড়ি? প্রতিহিংসার আগুনে ছাখার বাংলাদেশে তা ভাবার সুযোগ আর ছিলোনা। অনু শুধু জানতো যে সেই অমাবস্যার রাতে যদি সে আশ্রয় না দিতো তাহলে এই পনেরো ষোলো বছরের মেয়েটিও হতো কালরাত্রির বলি। ভগবতীকে সে সঙ্গে রেখে দিলো। এরকম সময়ে এক অচেনা যুবতীর দায়িত্ব নেওয়া কতটা বিপদজনক গৌর তা জানলেও অনুর কোনো কাজে সে আপত্তি করতো না। বরং তার মনে এক বিশ্বাস ছিল যে অনুর সব সিদ্ধান্তই কোনো না কোনো ভাবে সঠিক প্রমাণিত হবে।

 

অনেক কিছুই অন্যরকম হওয়া উচিত নয় , কিন্তু বাস্তবে তা সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে দেখা দেয়। কলকাতা তার নিজের দেশ হয়েও যেন এক অন্য পৃথিবী। রক্তে রাঙানো দিন যেন কাটতেই চায় না। ময়রা স্ট্রীটের বাড়ি এখন লোকে পরিপূর্ণ। কিছু চেনা, বেশিরভাগই অচেনা কিন্তু কাউকে এই অবস্থায় বাড়ি ছাড়তে বলা চলে না। লোক বেশি হয়ে যাওয়ায় গৌর, অনু তাদের ছেলে মেয়ে আর ভগবতীকে নিয়ে কুমোরটুলির বাড়িতে উঠে এলেন। দাঙ্গা কিন্তু কলকাতায় থামল না। বাঁচার জন্য বাড়ির ছেলেরা দিন রাত অস্ত্রহাতে বাড়ি পাহারা দিল। কিন্তু বাড়ির তিনতলার বারান্দা থেকে দেখা দৃশ্য অনু কোনদিন ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না। রাত থাকতে ঘুম ভেঙে যেত অনুর, ঘুমের মধ্যেও সে শুধু তাদের চাঁদপুরের বাড়িই দেখত। কিছু একটা হারিয়ে যাওয়ার মত মনে হত তার, কখনও মনে হত সে নিজেই হারিয়ে গেছে আর ছোট্ট, নয় বছরের অনু কিছুতেই বাড়ির রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। এ গলি, ও গলি ছুটতে ছুটতে ঘুম ভেঙে যেত তার। এরকমই এক কাকভোরে দরজা খুলে বারান্দায় যেতেই তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল কুমোরটুলির মাঠের লোহার রেলিংগুলোর উপর। রেলিঙের উপর কালো কালো ওগুলো কি? আবছা আলোয় অনু ছিটকে পিছিয়ে গেল বারান্দার কার্নিশ থেকে। এ যে মানুষের দেহ, রেলিঙে গাঁথা, রক্ত গড়িয়ে কালো হয়ে রয়েছে মাঠের ধারের মাটি।

 

গান্ধীজির কলকাতায় আসা, কবিগুরুর করুন প্রার্থনা ও নানা করণে আস্তে আস্তে নিভে গেল আগুন। কিন্তু এটাও বোঝা গেল যে এ আগুন নিভে গিয়েও ফুরিয়ে যাবে না , ধিকি ধিকি জ্বলবে আর মাথা তুলবে যখন তখন আর নেবে তরতাজা জীবনের বলি।  নানান উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে অনুর জীবন। চোখের সামনের খোলস থেকে আরম্ভ করে মানুষের মনের গভীরের হিংসা, সবই দেখা দিচ্ছে একদম সামনে। পূর্ব বঙ্গে তারা যে অন্য রকম ভাবে বাংলা ভাষা বলে, তা এতদিন বুঝতেই পারেনি অনু, ছোটবেলা থেকে নানা খবরের কাগজ পড়া সত্ত্বেও মনে হয়নি, "আচ্ছা, আমরা তো এভাবে কথা বলি না।" এখানে কখনও দুধওয়ালা, কখনও রোজকার দরকারের কিছু বলতে গেলেই এখানকার লোক মুচকি হাসে, কখনও বা তারা বুঝতেই পারে না সে কি বলছে। এই তো সেদিন অনু তাদের বাড়িতে কাজ করতে আসা একজন পরিচারিকাকে বলল, "তর হইয়া গেলে দুয়ারটা টাইনা দিয়া যাস, আমি পরে দিয়া দিমু ," তাই শুনে সে হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলল। অনুও কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে নিজেই হেসে চলে এসেছিল। আরও এক বড় পরিবর্তন নিজেদের মাটির অনেক কাছে নেমে আসা। এখন আর তারা চাঁদপুরের মস্ত ব্যবসায়ী পরিবার নয়, তারা উদ্বাস্তু। তাদের যা কিছু শুধু এই কয়েকটি সম্পত্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ, না আছে তাদের জমিজমা, না আছে দালান, না আছে নাটমন্দির, না আছে বাগান। কয়েক দিনের মধ্যে তারা হয়ে উঠেছে নিতান্ত সাধারণ। যারা একসময়ে তাদের হয়ে কাজ করত, তারা হয়ে উঠেছে একই বাড়িতে বসবাসকারী প্রতিবেশি।

 

কিছুদিন পরে অতুল্য ও গৌর মিলে ঠিক করল যে তারা কলকাতা ছেড়ে চলে যাবে। পূর্ব বঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছিলো কলকাতায়। বেড়ে চলেছিলো খাবার, জল, প্রত্যেকদিনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা। তাছাড়া যুদ্ধপরবর্তি কলকাতায় খুব সহজ ছিল অস্ত্রের আনাগোনা তাই পাল্লা দিয়ে বারছিল চুরি, খুন, রাহাজানি। এসবের চেয়েও অসুবিধা ছিলো যাদের সাথে এতদিন কোন রকম সম্পর্ক ছিল না, তাদের সাথে নিজেদের জীবনকে ভাগ করে নেওয়া। এক সুবিশাল অট্টালিকায় বসবাস করার পর নিজেদের জীবনকে কয়েকটি ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা।

 

অতুল্যচন্দ্র নিজের স্ত্রী, তিন পুত্র ও তিন কন্যা নিয়ে পাড়ি দিলেন মালদহের উদ্দেশ্যে। সেখানে চালের ব্যবসা দেখাশোনার জন্য অনেক দিন আগে থেকেই তাদের পরিবারের একটি বাড়ি ছিলো। সেটি এখনো অক্ষত, কোনো উদ্বাস্তু সেখানে গিয়ে ওঠেনি। তেমনই তীর্থস্থান হিসাবে বিখ্যাত নবদ্বীপের কাছাকাছি, লক্ষীগঞ্জে তাদের একটি বাসা ছিল। সেটির উদ্দেশ্যেই রওনা হল অনু, গৌর, তাদের ছেলে মেয়ে, ভগবতী ও অনুকে অপছন্দ করা তার শ্বাশুড়ীমা। শুরু হল অনুর জীবনের এক নতুন অধ্যায়, অনু থেকে অনুপমা দেবী হয়ে ওঠার গল্প।

 

নতুন জীবনযাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া যেখানে উপায় নেই, সেখানে মানিয়ে নিতেও বোধহয় বেশি সময় লাগে না। অনু ও গৌরও তাই তুলনামূলকভাবে সহজেই এই জীবনে অভস্ত হয়ে উঠল। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চলে কাঠের ব্যবসা আর মুর্শিদাবাদের সালারে চালের কল, এই নিয়ে গৌরের ব্যাস্ততার শেষ ছিলো না। তাছাড়া কলকাতায় তার স্থাপন করা অন্নপূর্ণা ব্যাংকের কারবারও ফুলে ফেঁপে উঠেছিলো। আর অনুর দিন কাটে ছেলে মেয়ে সামলে আর শ্বাশুড়ীমার যার পর নাই অসন্তুষ্টি নিয়ে। এ বাসাতে আলাদা ঠাকুর মন্দির নেই, আছে শুধু উঠোন পেরিয়ে একটি ছোট ঠাকুর ঘর, তাও রান্নাঘরের পাশে, তাই নিয়ে শাশুড়িমায়ের দুঃখের শেষ ছিল না। তাছাড়া মাছ আনতে হলে সদর দিয়ে ঢুকে উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে হয়, এ এক অসহ্য অন্যায়, তার জন্যেও যেন তার বৌমাই দায়ী। সময় মত বাড়িতে সন্ধ্যারতি না হওয়া, ঠাকুরঘরে ঢোকার আগে ছোঁয়া লাগা, অশুচি হওয়া, এ নিয়ে কথা অনুপমাকে রোজই শুনতে হত। অনুপমা সবরকম কটু কথা হেসে সামলাত। গৌরকে বলার কথা তার একবারও মনে হয়নি। কাকে বলবেন? মায়ের কথার উপর কথা বলা গৌর শেখেনি তা অনুপমা জানত। তাছাড়া এইবয়েসে মা তো আর নতুন কিছু শিখবেননা। আর তারা যদি ঝগড়া করে তো শ্বাশুড়ী যাবেন কোথায়। সব জেনেশুনেই তার শ্বাশুড়ী ছোটছেলের সাথে এসেছেন, অতুল্য, বা তার অন্য ছেলেদের সাথে নয় তা অনুপমা বুঝত। ভাইয়ে ভাইয়ে সে ভাব ভালোবাসা এদেশে আর সম্ভব নয়। বেঁচে থাকার সংগ্রাম যে এখানে অনেক অনেক কঠিন, অনেক বেশি বাস্তব। বৃদ্ধা মা যে অনেকের কাছেই এক অভাবনীয় বোঝা।

 

সময়ের ঘোড়া কারও জন্য থেমে থাকে না। বিশেষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেরিয়ে গেলো বছর দশেক। গৌরের ব্যবসা এখন চলছে বেশ ভালোই। বেড়েছে প্রতিপত্তি, পরিবারও হয়েছে আগের চেয়ে বড়ো। গোপাল আর উমা দুজনেই এখন কিশোর, কিশোরী। আর অনুপমার কোল আলো করে এসেছে আরও দুই মেয়ে আর এক ছেলে। মেয়েদের নাম দেওয়া হয়েছে বিজয়া আর বিমলা, ছেলের নাম মহেন্দ্রচন্দ্র। গৌরকে আজকাল অনেক সময় কাটাতে হয় কলকাতায়। তার ব্যাংকের ব্যবসা বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাঙ্ক বড়ো হতে হতে এমন আকার ধারণ করেছে যে গৌরের একার পক্ষে সে সামলানো বোধহয় আর সহজ হবে না। তাছাড়া দেশের সরকারও আর বেসরকারি ব্যাঙ্কের কাজকারবার ভালো চোখে দেখছে না। পশ্চিম থেকে আসা অনেক ধনী ব্যবসায়ীদের নজরও পড়েছে ব্যাঙ্কের উপর। সরকার ব্যাঙ্কটি কিনে নিতে চায় জলের দামে। অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে গৌরকে সরকার ব্যাঙ্ক অধিগ্রহণ করলে। কিন্তু যদি পশ্চিমি ব্যবসায়ীদের কাছে বেচতে হয় তাতে সাময়িক লাভ হলেও দেশের ও দশের কাছে ঋণী হয়ে যাবে গৌর। এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই একদিন কলকাতায় কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে সাক্ষাতের জন্য রওনা হলো গৌর। ট্রেনে আসতে আসতে ঠিক করলো এই সঠিক সময়। এদের জানিয়ে দেওয়া ভালো যে ব্যাঙ্ক সে সরকারকেই দিয়ে দেবে। এই সিদ্ধান্তে আসতে পেরে মনে এক শান্তি বোধ করছিলো গৌর। এতদিন এই চিন্তা তার রাতের ঘুমে বিশেষ ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলো। অনুপমা তার অস্থরতা দূর করার জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেও, যদি সব খুলে বলতে পারতো তবেই হয়ত এর বিহিত হতো। কিন্তু কোনোদিনই যে ব্যবসার কথা অনুপমাকে বলেনি গৌর। কেমন যেন বাঁধতো তার, অনুপমা তো একাই প্রায় সবদিক সামলায়। তার মাথায় কি আরও চিন্তা চাপানো যায়?

 

সেদিন অনুপমার সন্ধে থেকেই মন ভালো নেই। রাতে গৌর ভালো করে ঘুমায়নি। সকালবেলা কোনো রকমে দুমুঠো মুখে গুঁজেই বেরিয়ে গেলো। সেই নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। কখন ফিরবেন গৌর? কত রাত হবে তার? কে জানে সারাদিন পেটে কিছু পড়বে কিনা? তার অজানা আশংকার মেঘ আরও পুঞ্জীভূত হলো যখন সন্ধ্যারতির প্রদীপ দমকা হাওয়ায় বার বার নিভে যেতে লাগলো। আর সহ্য করতে না পেরে শাশুড়িমার কথা অগাহ্য করে, ভগবতীর হাতে সন্ধ্যার সব কাজের ভার দিয়ে শুয়ে পড়লো অনুপমা। কিন্তু বিপদ যখন আসে, তখন তাকে আটকায় কে? সন্ধ্যা কেটে রাত, রাত পার হয়ে ভোরের আলো ফুটলো কিন্তু গৌড় ফিরলো না। দিন বাড়ার সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়লেন গৌরের মা। কিন্তু অনুপমা কঠিন পাথরের মতো হয়ে থাকলো। পাড়ায় যারা চেনাজানা তাদের কয়েকজনকে ডেকে পুলিশে খবর দেওয়া হলো। পুলিশ বাড়িতে এসে নানা খোঁজখবর করে গেলো বটে কিন্তু কোনো আশার আলো দেখাতে পারলো না। অনুপমা আশায় আশায় ছিল যে দিনের কোনো এক সময়ে ঠিক গৌরের গলা শোনা যাবে, "কইগো দরজাটা খোলো, আর কতক্ষণ দুয়ারে দাঁড় করিয়ে রাখবে?" একে একে কলকাতা, মালদহ, সালার, ডুয়ার্স সবজায়গাতেই খবর করা হলো কিন্তু কোথাও কোনো খোঁজ পাওয়া গেলোনা। পুলিশের কাছে খোঁজ করলেই তারা কোনো না কোনো অছিলায় বাড়িতে আসতে চায় কিন্তু তাদের নজর ভালো নয়। বাড়ির মেয়েদের দিকে তারা ভালো চোখে তাকায় না তাই অনুপমা পুলিশের কাছে খোঁজ করা বন্ধ করে দিলো। গৌরের গলার স্বরের জন্য দিনের পর দিন কান পেতে অপেক্ষা করলো অনুপমা কিন্তু কে জানত যে সেই সৌভাগ্য এ জীবনে তার আর হবেনা।

 

এই ঘটনার পরে বিপদের ঢেউ বার বার আছড়ে পড়তে লাগলো অনুপমার জীবনে। গৌরের যাবার পর অতুল্যচন্দ্র এসেছিলেন তাদের বাড়িতে কিন্তু তা গৌরকে খুঁজে আনার জন্য নয়, কলকাতার ও মালদহের বাড়ি নিজের নামে লিখিয়ে নেওয়ার জন্য। আইনি সাহায্য নিতে পারতো অনুপমা কিন্তু সে দৌড় ঝাঁপ করতে গেলে তার ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা কে করবে? সরকারও উপস্থিত হলো সাক্ষাৎ বিপদস্বরূপ তার দোরগোড়ায়। ব্যাঙ্কের কাজের জন্য সরকারের ঘরে নাকি অনেক দেনা ছিল গৌরের। জমানো টাকা থেকে তার ভর্তুকি না করলে এই বাড়িও থাকবে না তাই তাও বিসর্জন দিতে হলো অনুপমাকে। ডুয়ার্সের কাঠের মিলের দখল নিলো তাদের ম্যানেজারবাবু। সেখান থেকে কোনো উপার্জনের আশাও হলো বন্ধ। শুধু সালার থেকে বিন্দুমাত্র টাকা আসতে লাগলো মাসে মাসে।

 

এমন সময়ে তার উপর করা উপকারের প্রতিদান দিলো ভগবতী। অনুপমাকে অবাক করে সেলাইয়ের কাজ ধরলো সে। সেই উপার্জন থেকে কোনোক্রমে চললো ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ। অনুপমা শক্ত হাতে সংসারের সব দিক পরিচালনা করা আরম্ভ করলো। রোজকার বাজার থেকে আরম্ভ করে সালারের চালের কলের হিসেব, একাই সব দিক দেখতে শুরু করলো সে। একদিনের ধনীর দুলাল হয়ে উঠলো দৈনন্দিনের পথিক। কিন্তু এই সংগ্রাম বড়োই কঠিন। শাশুড়ির নানা অভিযোগ, ছেলেমেয়েদের আবদার, তাদের পড়াশোনা, গোপাল জিউয়ের সেবার খরচ, সব মেটাতে অনেকসময়ই বিফল হতে লাগলো অনুপমা। তার জীবনে সবসময়ের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ালো একাতিত্বের আড়ালে ফেলা চোখের জল ও হতাশা। পরনের কাপড় হলো মলিন, মুখে চোখে নেমে এলো ক্লান্তির অন্ধকার।

 

কিন্তু না, অনুপমা একদিন ঠিক করলো হেরে যাওয়ার মেয়ে সে নয়। তার কাছে এ গৌরের তার পরীক্ষা নেওয়া। তার দৃঢ় বিশ্বাস গৌর ফিরে আসবে। যেমন সিঁথির সিঁদুর সে মুছে ফেলেনি, রেনি বৈধব্যের বেশ, তেমনই এ পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হবেই। কিছুতেই হারবে না গৌরের কাছে। ভগবতীর সেলাইয়ের কাজকেই হাতিয়ার করে নিলো অনুপমা। সে লক্ষ্য করেছিল, এই অভাবের সময়ে ঘরে ঘরে অবিবাহিত বা বিধবা, অবাঞ্ছিত মেয়েদের উপস্থিতি। তারা কেউ দিন কাটায় কোনো জ্ঞাতির সংসারে, মুখ বুজে অপমান সহ্য করে, কেউ বা বাধ্য হয় বিপথে যেতে। কেউ বা আত্মহত্যা করে মুক্তির পথ বেছে নেয়। অনুপমা নিজের শেষ পুঁজি দিয়ে বাড়িতে একটা সেলাইয়ের কারখানা খুললেন। নবদ্বীপের তাঁতের কাপড় বিখ্যাত। সেই কাপড় তাঁতিদের কাছ থেকে অল্প দামে কিনে, ব্লাউ, জামা তৈরী করে বাড়ি থেকেই বিক্রি করা শুরু হলো। সেলাইয়ের কাজ করত স্ব ইচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে আসা মেয়েরা। যা উপার্জন হতো তা দিয়ে সেই মেয়েদের আশ্রয় ও খরচা চলতে লাগলো। শুরু হলো শাশুড়ির নামে হৈমবতী মহিলা আশ্রম। বিরোধ যে আসেনি তা নয়। অনেক কথা শুনতে হলো অনুপমাকে। কিন্তু সব বিরোধ, লোকের কথা, আইনি বাঁধা সে অতিক্রম করলো ব্যক্তিত্বের জোরে। আস্তে আস্তে গোপাল জিউয়ের অপার কৃপায় দাঁড়িয়ে গেলো তার সাধের আশ্রম।

 

ষাটের দশক পার হয়ে এসে গেলো সত্তরের জ্বলন্ত দশক। সময়ের নিয়মে হৈমবতী দেবী দেহ রেখেছেন। তার আশীর্বাদে অনুপমার আশ্রম হয়েছে অনেক বড়ো। অনেক পথ পেরিয়ে এখন ব্যবসা মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। তার কাপড় এখন শুধু এই ছোট্ট গঞ্জের আশপাশে নয়, সুদূর কলকাতাতেও যায়। ভগবতী এখন আর আশ্রিত নয়, নিজের পছন্দ করা পাত্রকে বিয়ে করে সে চলে গেছে নিজের সংসার করতে। আবার একটু একলা হয়ে গেছে অনুপমা। বয়সও তো আর থেমে নেই। নিজেই অবাক হয়ে দেখে কানের পাশের লম্বা চুলগুলোয় ধরেছে রুপোলি রং। গোপাল এখন কলকাতায় কলেজে পড়ে, উমা কাছেই নবদ্বীপের কলেজে।  মহেন, বিজয়া, বিমলারাও আর ছোট্টটি নেই। তারাও এখন উঁচু ক্লাসে পড়ে। সেদিন দুপুরে, খাওয়াদাওয়ার পর সবে হিসেবের খাতা নিয়ে বসেছে অনুপমা তখনই সদর দরজার কড়া নাড়লো কেউ। দোর খুলে দিলো নিচের কেউ আর তার কাছে খবর এলো যে নিচে এক সাধুবাবা এসেছেন। গলায় কাপড়টা জড়িয়ে অনুপমা নিচে এসে দাঁড়ালেন। সাধুবাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে তাকে ঘুরিয়ে দেখালেন গোপাল জিউয়ের মন্দির। সাধুবাবা যৎসামান্য ভিক্ষা নিয়ে যাওয়ার আগে অনুপমাকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। মাথায় হাত দিয়ে অনুপমাকে চমকে দিয়ে বললেন, "শক্ত হ মা, আরও শক্ত হ, সামনে বড়ো কঠিন সময়। গোপালজিউ তোর সাথে আছে, তুই থামিস না। আর তোর কপালে বৈধব্যযোগ নেই। সিঁথির সিঁদুর কখনও মুছিসনা।" সবাইকে চমকে দিয়ে সাধুবাবা বেরিয়ে চলে গেলেন। অনুপমা শুধু ভাবছিলো সাধুবাবাকে এতো চেনা চেনা লাগছিলো কেন? সাধুবাবার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের কাটা দাগটা চোখে ভেসে উঠলো অনুপমার। এ দাগ সে বহু বছর আগে দেখেছে, অনেক যোজন দূরে, পদ্মার পারে এক ফেলে আসা গোধূলিতে।

 

অসময়ে কেউ সদরের কড়া নাড়লে বড়ো উতলা হয়ে পড়ে অনুপমা । সেদিনও অপরাহ্নের একটু পরে, কেউ কড়া নাড়লো খুব জোরে। সদর খুলে দেখা গেলো কড়া নেড়েছে পুলিশ। তারা এসেছে গোপালের খোঁজে। গোপাল নাকি দেশবিরোধী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত। গোপালকে নাকি বেশ কিছুদিন যাবৎ তার হোস্টেলে আর পাওয়া যাচ্ছেনা। তাই তারা খোঁজ করতে এসেছে বাড়িতে। গোপালকে না পেয়ে পুলিশ সেদিনের মতো চলে গেলেও তাদের আসা যাওয়া লেগেই রইলো। গোপালের নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা জানার পর থেকে অনুপমার চোখের জল আর বাঁধ মানলো না। অনেক খোঁজ করা সত্ত্বেও গোপালের খোঁজ পাওয়া গেলোনা কোথাও। কয়েকদিন পরে শুধু আলুথালু বেশের এক যুবক বাড়িতে একটা চিঠি ফেলে দিয়ে গেলো। গোপালের চিঠি, সে লিখেছে সে ভালো আছে তবে তাকে পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে হচ্ছে তাই কোথায় আছে তার খোঁজ সে দিতে পারবে না। প্রচন্ড উৎকণ্ঠায় দিন কাটতে লাগলো অনুপমার ।

 

এর কিছুদিন পরে যা আশংকা ছিল তাই হলো সত্যি। গোপাল ফিরলো বটে তবে নিথর দেহ হয়ে। সত্তরের দশকের অগুনতি বলির একজন হয়ে সে পাড়ি দিয়েছে অচিনপুরের পথে। অনুপমা আবার হারিয়ে গেল নিরাশার অন্ধকারে। সন্তান হারানোর ব্যাথা এক মায়ের পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। গোপালকে হারানোর অপ্রত্যাশিত আঘাত সামলাতে পারলো না অনুপমা। অপ্রকৃতিস্থ, অসুস্থ হয়ে পড়লো সে। সংসার, আশ্রম, ব্যাবসা তার ভেসে যাওয়ার জোগাড় হলো। তার ছেলেমেয়েরা বুঝে উঠতে পারলো না কি ভাবে এই বিপদ থেকে তারা রক্ষা পাবে। কলেজে পড়া উমাকেই ধরতে হলো সংসারের হাল। কলেজের পড়ার সাথে সাথে প্রচুর গৃহশিক্ষকের কাজ করা শুরু করলো উমা। ছোট ভাইবোনদের মানুষ করা, মায়ের দেখাশোনা,  ব্যাবসা চালানো সবই একা করতে শুরু করলো সে। ধীরে ধীরে কেটে গেলো আরও বেশ কিছু বছর। অনুপমা এখনও স্বাভাবিক হয়নি কিন্তু উমার এই যৌবন বিসর্জন দেওয়া সে আর দেখতে পারছিলো না। নিজের খোলস ছেড়ে আবার বেরিয়ে এলো অনুপমা। আগের মতো না হলেও আবার ব্যবসার কাজে মন দিলো সে।

 

একদিন হঠাৎ বাড়িতে আগমন হলো এক তরুনের, নাম সুধীর রঞ্জন গাঙ্গুলি। কোনো ভনিতা না করে জানাল যে তার বাড়ি দিনাজপুর জেলার নবীগঞ্জ অঞ্চলে, পেশায় সে রায়গঞ্জ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। কি কারণে তার আগমন এ প্রশ্নে কিছুক্ষণ সময় নিলো সুধীর। অনুপমার মনে হলো সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে ছেলেটি। এক গেলাস জল খেয়ে মাথার ঘাম মুছে সে যা জানালো তাতে অনুপমার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। সুধীর বললো যে সে উমাকে বিবাহ করতে চায়। উমা তাকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক কি না তা সে জানে না। তার কারণ উমা ও সুধীর একই ট্রেনে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছে ঠিকই কিন্তু তাদের মধ্যে আজ অবধি কোনো কথাবার্তা হয়নি। তবে সুধীর শুধু এটাই জানে যে কবার তাদের দেখা হয়েছে, দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থেকেছে অপলকে। বার বার উমার খোঁজে একই ট্রেনে ছুটে গেছে সুধীর আর উমাও যেদিন সে আসতে পারেনি সেদিন ট্রেনে না উঠে থেকে গেছে স্টেশনে। পরের ট্রেনে উঠেছে দুজনে একসাথে। কথা বলেনি কেউই, শুধু তাকিয়ে থেকেছে একে অপরের দিকে।

 

অনুপমার ইচ্ছা হলো তখনই উমাকে ডেকে সব কথা জিজ্ঞাসা করার কিন্তু সে গেছে শান্তিপুরে দোকানিদের কাপড় দিতে। সুধীরের বাড়িতে কে কে আছে, নাম ঠিকানা সব লিখে নিয়ে তাকে কদিন পরে আসতে বললো অনুপমা। সেদিন সন্ধ্যায় উমা বাড়ি ফেরার পর কথা হলো মা, মেয়েতে। উমা সোজাসুজি জানালো যে নাম না জানলেও অনুপমা কার কথা বলছে তা সে বুঝেছে তবে বিয়ে করার কথা সে ভাবতেও পারেনা। অনুপমাকে ও তার ভাইবোনেদের একা ফেলে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। তার সংসারের জন্য উমা নিজের জীবন বিসর্জন দেবে এ কখনওই হতে পারেনা। মা মেয়েতে প্রায় ঝগড়াই হয়ে গেলো। এদিকে উমা সুধীরের রায়গঞ্জের বাড়ির ঠিকানায় চিঠি লিখে বসলো যে এ বিয়েতে সে রাজি নয়। ফল যা হওয়ার তাই হলো। সুধীর আবার এসে উপস্থিত হলো বাড়িতে। উমাকে রাজি করাতে সে সবকিছু করতে প্রস্তুত। উমা জানালো যে সুধীরকে তার বিশেষ পছন্দ তবে মা, ভাইবোনদের ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। সুধীরও রণে ভঙ্গ দেওয়ার ছেলে নয়। সেও জানিয়ে দিলো যে উমার জন্য সে চাকরি ছেড়ে এখানে এসে থেকে নতুন চাকরি খুঁজবে। মেয়ের দায়িত্বজ্ঞান ও ব্যক্তিত্ব দেখে অনুপমার গর্বে মন ভোরে গেলো। দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে যার পর নাই খুশির আভা ছড়িয়ে পড়লো তার মুখে। অনুপমা এবার ঘরে ঢুকে উমার সব আপত্তি নস্যাৎ করে সুধীরের কাছ থেকে তার দেশের বাড়ির ঠিকানা চেয়ে পত্রমারফত তাদের সব কথা জানালেন। যা ভাবা গেছিলো তাই হলো। ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলের বিয়ে অব্রাহ্মণের ঘরে হতে পারে না। এই কথা সুধীরের পিতা নিজে এসে অনুপমাকে জানিয়ে গেলেন। এও বললেন যে উমা নিশ্চই ভালোমানুষ দেখে তার ছেলেকে ফাঁদে ফেলেছে। সব অপমান অনুপমা মাথা পেতে সহ্য করলো। মেয়ের হবু শ্বশুর বলে কথা। ভাগ্যিস সে সময় উমাকে বাড়ির বাইরে পাঠাতে পেরেছিল অনুপমা নইলে সুধীরের আর বিয়ে করা হতোনা। সব অপমানের শেষে শুধু একটিই কথা বলেছিলো অনুপমা, "ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণ তো আমি জানিনা গাঙ্গুলিমশাই, তবে কি জানেন ওদের দেখা করিয়েছে গোপালজীউ। তার ইচ্ছা আটকানোর আমি বা আপনি কে ?" যথাসময়ে উমা আর সুধীরের বিবাহ সম্পন্ন হলো, সুধীরের পিতামাতার অমতেই। একই বাড়িতে তাদের রাখতে রাজি হলোনা অনুপমা। কাছেই একটা বাড়ি ভাড়া করে উমা আর অনুপমা বাধলো তাদের সংসার। কিছুদিন পরে কাছেই কৃষ্ণগরের কলেজে চাকরিও পেয়ে গেলো সুধীর। অনুপমার হাত থেকে আশ্রম আর ব্যবসার ভারও সম্পূর্ণভাবে নিয়ে নিলো উমা ।

 

শান্তির এক দশক প্রায় কাটিয়ে দিলো অনুপমা। দেখতে দেখতে বিয়ে হয়েছে বিজয়ার। উমা ও সুধীরের কোল আলো করে এসেছে এক ছেলে ও এক মেয়ে। কৃতি ছাত্র মহেন পাড়ি দিয়েছে দূর বিদেশে, অনেকদিন পর পর তার একটি করে চিঠি আসে। নাতি, নাতনি নিয়ে তার এখন ভরা সংসার। ওদিকে বিমলাও পড়াশোনায় মহেনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সেও পড়াশোনা করতে পাড়ি দিয়েছিলো দিল্লি। সেখানেই পড়াশোনা শেষ করে অধ্যাপনা শুরু করেছে। এমন সময়ে একদিন ঝন ঝন করে বেজে উঠলো বাড়ির নতুন টেলিফোন। টেলিফোন রাখার পর চিন্তার রেখা আবার জেগে উঠলো অনুপমার কপালে। সেদিনই তিনি সুধীরকে ডেকে পাঠালেন আর পরের দিনই রওনা দিলেন দিল্লির উদ্দেশ্যে। উমা, বিজয়ারা জানতেই পারলো না অনুপমা এতদিন পরে বাড়ি থেকে কেন বেরোলেন ।

 

কদিন পরে বিমলাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন অনুপমা। বিমলা অন্তঃসত্ত্বা, তার বিবাহ যদিও হওয়া সম্ভব হয়নি। তার সন্তানের পিতা তাকে গ্রহণ করতে চায়নি কিন্তু বিমলা তার সন্তানকে জন্ম দিতে বদ্ধপরিকর। এক্ষেত্রে তার মায়ের উপরই ভরসা রেখেছে বিমলা। অনুপমার সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্তও সময় লাগেনি। ওই যে, গোপাল জিউয়ের ইচ্ছে। তার উপরে কথা বলে কার সাধ্যি? ধীরে ধীরে বিমলার গর্ভে বড়ো হতে থাকলো তার সন্তান। এমনিতেই এ বাড়ির অনেক বদনাম, তার সাথে যোগ হলো নানা নতুন কুৎসা। সমাজ যে সবসময় মেয়েদেরই করেছে সব কালিমার জন্য দায়ী। কিন্তু পূজার পদ্মপাতায় কুৎসার দাগ লাগে না। যথাসময়ে বিমলার কোলে এলো মিষ্টি একটি মেয়ে। অনুপমা নাম রাখলো রাধিকা ।

 

এই অব্দি পড়ে মুখ তুলে তাকালো রাধিকা। বিমলা আর মাস্তুতো ভাই পার্থর চোখে খুব একটা উৎসাহ চোখে পড়লো না। বিমলা বললো, "তুই তোর দিদুনের গল্প লিখবি তোর প্রথম বইতে, কেউ পড়বে? আমার কথা শোন, আজকাল ফেমিনিজমের যুগ। এখনকার মেয়েদের নিয়ে লেখ, তারা কিকরে ছেলেদের টেক্কা দিচ্ছে তা লেখ।" পার্থও এবার যোগ দিলো তার মাসির কথায়। "দেখ, দিদুন ইস ওয়ে এহেড অফ হার টাইম, মানছি কিন্তু মডার্ন মেয়েদের আইকন হতে হলে তাদের সাথে কানেক্ট করতে হবে। তোর গল্পে রগরগে কলেজ রোম্যান্স নেই, আন্ডারডগ স্টোরি নেই, পাব হপিং নেই, সিগারেট খাওয়া নেই, কর্পোরেট কেরিয়ার নেই,কেমন যেন সেকেলে। এ কিন্তু বিক্রি হবেনা বলে দিচ্ছি । এটা ফেমিনিস্ট স্টোরি নয়।" রাধিকার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। অনেক কষ্টে দিদুনের কাছে থেকে তার জীবনকে গল্পের গতে বেঁধেছে সে। তার মন বলে যে যুগে ফেমিনিজম বলে কোন কনসেপ্টই ছিল না, সে যুগে তার জীবন দিয়ে একা ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট চালিয়ে গেছে তার দিদুন । সে উপরের ঘরে দিদুনের কাছে গেলো। কিছু না বলে বিছানায় শুয়ে থাকা অনুপমার রুপোলি চুলগুলোয় আঙ্গুল বুলিয়ে দিলো সে। অনুপমা শুধু বললো, চিন্তা করিস না, গোপাল জিউ সব ঠিক করে দেবে।"

 

মাস ছয়েক পরের এক শীতের সকালে রাধিকার আইফোনটা তারস্বরে বেজে ঘুম ভাঙিয়ে দিলো তার। প্রকাশকের ফোনটা ঘুম চোখে সেরেই দোতলায় দিদুনের ঘরের দিকে ছুট লাগালো রাধিকা। সবার আগে দিদুনকে বলা দরকার যে তার বইয়ের সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে। চাহিদা অনুযায়ী প্রকাশকের বুক মনে হচ্ছে আরও নতুন এডিশন করতে হবে। এমনকি ইংরিজিতে অনুবাদও হতে পারে তার বই। অনেক ডাকেও কিন্তু সেদিন সাড়া দিলোনা অনুপমা। চেনা গন্ডির বাইরে, গয়নার মাঠ পেরিয়ে, পদ্মা মেঘনার সাথে, দূর আকাশেরও ওপারে, তার গৌরের খোঁজে পাড়ি দিয়েছে সে।

 Download ALEEK PATA Mobile APP

DOWNLOAD ALEEK PATA ANDROID APP

। নববর্ষ-১৪২৮| Aleekpata.com |
  |ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|Bengali New Year Issue, 2021 | April -July 2021| 
| Fifth Year  First  Issue |27 th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |

No comments:

Post a Comment

Please put your comment here about this post

Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান