শ্রাবনী
গুপ্ত সরকার
ঊর্মিলের দাদু খুব নামকরা
চিত্রশিল্পী ছিলেন। এখনও বিবস্বান চৌধুরীর নাম শুনলেই লোকের চোখে সম্ভ্রম জেগে
ওঠে। কিন্তু কেবল তাঁর নাতি বলেই ঊর্মিলকেও দুর্দান্ত ছবি আঁকতে হবে এ কেমন অন্যায়
কথা! ঊর্মিল ক্লাস সেভেনে পড়ে। প্রথম পাঁচজনের মধ্যেই প্রতি বছর থাকে। ক্রিকেট আর
ব্যাডমিন্টন রীতিমতো ভালো খেলে। মজার ছড়া
লিখতে পারে অনায়াসে,
প্রচুর গল্পের বই পড়ে... আর পড়াশোনার জন্য যেটুকু আঁকা দরকার বেশ ভালোই পারে।
স্কুলের থেকে আর স্কুলের বাইরে যত ডিবেট আর আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় গেছে কোনটা থেকেই খালিহাতে ফেরেনি। তাও...
আসলে নতুন ড্রয়িং স্যার প্রথম
ক্লাসে এসেই বিবস্বান চৌধুরীর নাতি হিসেবে ওর নামটা জেনে ফেলেছেন তার থেকেই বিপদটা
আর পিছু ছাড়ছে না ঊর্মিলের। স্যার জোর করে ওকে বিভিন্ন কম্পিটিশনে নাম দিতে বলছেন, আরে ওর চেয়ে
শতগুণে ভালো আঁকে যারা তাদের বাদ দিয়ে ওর নাম দেওয়ার কথা ভাবলেই ভীষণ লজ্জা করছে।
আর প্রচন্ড টেনশনও হচ্ছে স্যার রেগে যাবেন ভাবলেই।
আজ শুক্রবার, আগামী
রবিবার বিকেল পাঁচটায় ‘ভোরের আলো’ ক্লাবে একটা ড্রয়িং কম্পিটিশন আছে। বিষয় ‘যেমন
খুশী আঁকো’। খুব ভয় করছে ওর। এতদিন যেখানে গেছে পুরস্কার নিয়ে ফিরেছে। আর এবার যে
কী হতে চলেছে মা সরস্বতীই জানেন কেবল।
শনিবার দুপুরে হাফছুটির পর
বাড়িতে ফিরে ঊর্মিল দেখল মা দাদুর ঘরটা তালা খুলে ঝাড়ামোছার কাজ করছেন। এই ঘরটা
সবসময়ে সুন্দর করে গোছানো থাকে। দাদুর আঁকা চমৎকার অয়েল পেন্টিং, জলরঙ, চারকোলের
ছবি ছাড়াও চাইনিজ ইংকের বেশ কিছু অসাধারণ ছবি দিয়ে পুরো ঘরটাই সাজানো। হাল্কা নীল
রঙের পর্দা, প্রতিদিন
মা টাটকা ফুল দিয়ে টেবিলের ফুলদানী সাজিয়ে দেন। দাদু আজ দুবছর হলো পৃথিবীর মায়া
কাটিয়ে চলে গেছেন। কিন্তু এই ঘরটায় এলে এখনও দাদুর গায়ের সেই মিষ্টি গন্ধটা পাওয়া
যায়।
জামাকাপড় পালটে, হাতমুখ ধুয়ে
ও দাদুর ঘরে এসে ঢুকতেই মা বললেন, “টেবিলে খাবার আছে, খা।”
“একটু থাকি না মা ঘরটায়। খুব
চিন্তা হচ্ছে তো রবিবারের কথা ভেবে। যদি দাদুভাই কোনো সাহায্য করেন।”
মা একটু হাসেন। “অত চিন্তা
করিস না, না
হয় পুরস্কার পেলি না,
তাতে কী এমন হবে?”
দাদুর আঁকার টেবিলের গায়ে
একটা ড্রয়ারের হাতল খুব সুন্দর দেখতে। কাঁচের ভেতর রঙিন ফুল ফুল। হাত বুলাতে
বুলাতে একটা টান দিতেই খুলে গেল। অনেক রকম তুলি, রঙ, বিভিন্ন রকমের কাগজ, পেন।
ড্রয়ারটা বন্ধ করতে যেতেই একটা পেন যেন আলাদা হয়ে সামনের দিকে গড়িয়ে এল। সুন্দর
লম্বাটে, সরু
আর চকচকে কালো রঙের পেনটা যেন হাসি মুখে ঊর্মিলের দিকেই চেয়ে দেখছে। কলমটা তুলে নিল ও। খুব সরু নিবের পেন। দাদু
চাইনীজ ইংকের ড্রয়িং করতেন এমন পেন দিয়ে। চাইনীজ ইংক ঊর্মিলের কাছেও আছে। মায়ের
অনুমতি নিয়ে কলমটা নিজের কাছে রাখল ঊর্মিল।
আজ রবিবার ড্রয়িং কম্পিটিশন।
সব জিনিস গুছিয়ে নিতে গিয়ে দাদুর সেই পেনটাও চাইনীজ ইংক ভরে সঙ্গে নিয়ে নিলো
ঊর্মিল। প্রচুর প্রতিযোগীর ভীড়। তার মধ্যে ফর্মের রিসিট দেখিয়ে নিজের জায়গায় বসে
পড়লো ঊর্মিল। মাপমতো কাগজ দিয়ে গেল সংস্থার তরফ থেকে। নিজের নাম, বয়স আর স্কুলের নাম লিখে ফেলল ও। একটু পরেই কম্পিটিশন
শুরু হলো। কি মনে হতে ও প্রথমেই ভেবে ফেলল দাদুর কলমটা দিয়েই আজ আঁকবে। একটা ছেলের
ঘুড়ি ওড়ানোর দুর্দান্ত ছবি ফুটে উঠলো সাদা কাগজের বুকে কালো আঁচড়ে। আকাশের দিকে
তাকানো ছেলেটার চোখে মুখে উদ্বেগ আর উত্তেজনার অভিব্যক্তি অসাধারণ লাগছে হ্যাঁ
ঊর্মিলের চোখেই। নিজের আঁকা থেকে চোখটাই সরাতে পারছে না ও। আসপাশে উদ্যোক্তাদের
ফিসফাস শোনা যাচ্ছে “হবে না, কার নাতি দেখতে হবে তো। উত্তরাধিকার বলেও তো একটা কথা আছে
নাকি!” বেশ লজ্জা করছে ঊর্মিলের। দাদুর কলমটাই হয়তো আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে ওর।
তাই ছবিটা এমন সুন্দর হয়েছে। প্রতিযোগিতা শেষ হতেই আঁকাটা জমা দিয়ে বাড়ির পথ ধরলো
ঊর্মিল।
রাতে পরের দিনের রুটিন
অনুযায়ী বইপত্র গোছানোর পর একটা সাদা পাতা আর পেনটা নিয়ে বসে গেল ঊর্মিল। একটা
চমৎকার হ্যাংলা বিড়ালের আশ্চর্য জীবন্ত ছবি, আড়চোখে মাছের দিকে চেয়ে ব্যাটা। হঠাৎই মা বলে উঠলেন “ওমা! এ তো একদম তোর দাদুর ধারার
আঁকা রে। খুব সুন্দর হয়েছে তো। তোর বাবা খুশি হবেন দেখলে। পেনটা যত্ন করে রাখিস আর
ব্যবহার করিস।” স্কুলে আজ আর পেনটা বার করাই হয় নি ঊর্মিলের। ক্লাস আর ক্রিকেট
ম্যাচ নিয়েই মেতে ছিল সারাদিন। বাড়ি ফিরে জলখাবারের পাট মিটিয়ে হঠাৎই মনে হলো
পেনটার কথা। একটা কিছু আঁকা যাক। কিন্তু পেনটা কোথায় গেল? স্পষ্ট মনে
আছে গতকাল রাতে স্কুলের ব্যাগেই রেখেছিল। সব বইখাতা, পেন্সিল বক্স, জ্যামিতি
বাক্স বার করে খুঁজেও পাওয়া গেল না দাদুর পেনটা। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল ঊর্মিলের।
রান্নাঘরে মা খুব মন দিয়ে একটা দারুণ রান্না করছিলেন ভেটকি মাছের। সোজা গিয়ে মাকে
সব কথা বলে ফেলল ঊর্মিল। “সে কি রে! কোথায় গেল? আহা বাবার হাতের অমন চমৎকার পেনটা, খুব খারাপ
লাগছে।” মায়ের কথায় চোখে জল চলে এল ঊর্মিলের। ওরই দোষ, স্কুলে নিয়ে
যাওয়ার তো কোনো দরকারই ছিল না। মাঝখান থেকে দাদুর স্মৃতিমাখা অমন সুন্দর কলমটা
হারিয়ে গেল।
বড্ড মন খারাপ নিয়ে প্রিয়
ভেটকি মাছের ঝোলটাও ভালো করে খেতে পারল না ঊর্মিল। ঘুমটাও ঠিকমতো হলো না। খালি
খালি অস্পষ্ট সব স্বপ্ন দেখে বারবার ভেঙ্গে যাচ্ছিল।
যতই মন খারাপ হোক স্কুলে তো
যেতেই হবে, কাজেই
স্নান খাওয়া সেরে পরের দিন স্কুলের দিকে রওনা হলো ঊর্মিল।
গেটের সামনেই বাহাদুরকাকার
ঘর। ওর দুটো ছেলেও এই স্কুলে পড়ে। খুব গুন্ডা, পড়াশোনায় মন নেই। বড়োটাকে চুপি চুপি
বিড়ি খেতেও দেখেছে ঊর্মিল। কোথায় পয়সা পায় কে জানে! কিন্তু বাহাদুর কাকা আর কাকি
খুব হাসিখুশি, ভালোমানুষ।
আজকে গেটেই ওকে এসে রতনবাহাদুর মানে বড়োভাই এসে ধরলো। ভীষণ ঘাবড়ানো, কাঁদো কাঁদো মুখ, ভাঙা বাংলায়
বললো মাফ করে দিতে। ও খুব ভুল করেছে। জিনিসটাও ফেরত দিতে চায় ভেবেছিল বিক্রি করে
কিছু টাকা পাবে। কিন্তু ও খুব ভয় পাচ্ছে এখন। কি আশ্চর্য! ওর হাতে দাদুর সেই কলম।
অন্যহাতে একটা কাগজ। তাতে একটা আশ্চর্য সুন্দর ছবি। ঊর্মিলের ব্যাগ থেকে রতনই
কলমটা নিচ্ছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ফাঁকা ক্লাস ঘর, বেঞ্চ, ঊর্মিলের ব্যাগের নিঁখুত ছবি আর
রতনের মিচকেপানা বদমায়েসি মাখা মুখ।
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল
ঊর্মিল। রতন এবারে কেঁদে ফেলেছে। বলছে ওকে দিয়ে কে যেন জোর করে এই ছবিটা কাল গভীর
রাতে আঁকিয়ে নিয়েছে। ভীষণ ভয়ে ভয়ে সারারাত জেগেই ছিল বেচারা। চোখের নীচে কালি পড়ে
গেছে, ফর্সা
টুকটুকে মুখে ফ্যাকাসে ভাব। ঊর্মিল বলল, “আমি কাউকে কিছু বলবো না রতন। তবে তুই
আর এমন করিস না। একটু পড়াশোনা করে কাকুর পাশে দাঁড়াতে হবে তো তোকে। আঁকা শিখবি? আমি তোকে শেখাবো।
শিউরে উঠলো রতন। না আঁকার
মধ্যে সে নেই। তবে সন্ধ্যাবেলা, না বোঝা পড়া বুঝতে চায় ঊর্মিলের কাছে। ঊর্মিল জানালো বাড়িতে
আলোচনা করে ও বলবে।
আজ বিকেলে আলো ঝলমল মুখে মাকে
সব কথা বলতেই মা বললেন,
“রোজ না, সোম
আর বুধবার রতনকে আসতে বলিস। আর একটু চোখ খোলা রাখিস, স্বভাব বদলাতে কিন্তু সময় লাগে।”
“হ্যাঁ মা, আমি ঠিক
খেয়াল রাখবো” বলেই ঊর্মিলের চোখ পড়লো দেওয়ালের গায়ে দাদুর ঝকমকে ছবিটার উপরে।
মুখের হাসিটা আরো চওড়া লাগছে না! কি জানি! ঊর্মিল মনে মনে বলল, “দাদু আমার
মাথার উপর থেকে আশীর্বাদের হাতটা তুমি সরিয়ে নিও না যেন কখনোই। আর যদি কখনোও ভুল
করি বুঝিয়ে, ধরিয়ে দিও সবসময়।” হঠাৎই মনে হলো
দাদুর গায়ের সেই মিষ্টি গন্ধটা এসে নাকে ঝাপটা দিলো। মনটা একদম ভরে গেল ঊর্মিলের।
দাদু ওর সঙ্গেই আছেন, থাকবেনও। এক সপ্তাহ পরে স্কুলে ড্রয়িং ক্লাসে বসে সুখবরটা
পেল ঊর্মিল। ওর সেই ঘুড়ি ওড়ানো ছেলের ছবিটা অনায়াসে জিতে নিয়েছে প্রথম
পুরস্কার।
আর রতন বাহাদুর তার ভাইকে
সঙ্গে নিয়ে প্রত্যেক সোমবার আর বুধবার সন্ধ্যাবেলা দিব্যি পড়া দেখে যাচ্ছে
ঊর্মিলের বাড়িতে এসে। হ্যাঁ, বিড়ি খাওয়া আর চুরি দুটোই একদম ছেড়ে দিয়েছে রতন। এটাতে
কিন্তু ঊর্মিল খুব খুশি।
বেশ
ReplyDelete