সুপ্রিয়া
মণ্ডল
"চুড়ি নেবে চুড়ি, কী গো মেয়ে? এই দেখো, লাল, নীল হরেক
রকমের কাঁচের চুড়ি আছে", মেলার দোকানি হেঁকে বলল।
ছোট্ট মেয়েটা বাবার কাছে জুলুজুলু চোখে আবদার করতেই বাবা পকেট থেকে টাকা বের করে কিনে দিলেন এক গাছা লাল রঙের চুড়ি। সেই চুড়ি পরে মেয়েটার চোখে-মুখে সে কী আনন্দ! যেন পৃথিবীর সবথেকে দামি জিনিস ওর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যেন পুরো মেলাটাই তার কেনা হয়ে গেছে, ও আর কিচ্ছু চায়না।
কিন্তু মেলা থেকে ফেরার সময়েই লরির ধাক্কায় প্রাণে বেঁচে গেলেও মেয়েটা চিরতরে হারালো বাবাকে। লাল রঙের কাঁচের চুড়িগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে থাকলো রাস্তায়। বাবার মৃতদেহের রক্তের সাথে লাল কাঁচের চুড়ির গুঁড়ো মিশে জায়গাটা আরো লাল হয়ে গেলো। লাল রঙে একটা ভয় ধরলো ওর মনে। সেই থেকে মেয়েটা আর কোনোদিন মেলায় যায়নি, চুড়িও পরেনি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা বড়
হতে থাকলো। বয়স আঠারো পেরোতেই কিছু মাস পরে বাবাহারা মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলো। গায়ে
উঠলো লাল বেনারসী, হাতে
উঠলো লাল পলা, সাদা
শাঁখা, নোয়া, মাথায় লাল
সিঁদুর। সে আপত্তি জানাতে পারলো না কারোর কাছে যে, লাল রঙের কিছুই সে পরবে না, জাঁকিয়ে
ধরা ভয় থেকেও পারলো না বেরোতে। মেয়েটার স্বামী একজন ভারতীয় সেনা, বছরের
বেশিরভাগ সময়টাই সে থাকে বাইরে, আর মেয়েটা ঘরে একা। তবুও সে যখন আসতো হারিয়ে যাওয়া সব খুশি, আনন্দ কোথা
থেকে যেন তার কাছে চলে আসতো। বিয়ের পর মেয়েটা আবার গেলো মেলায়। চারিদিকে কত আলো, হৈ চৈ, ছোট বাচ্চার
চিৎকার, হাসির
ফোয়ারা, আরও
কত কী! আর চুড়ির দোকান। রং-বেরঙের চুড়ি। মেয়েটার স্বামী ওকে উপহার দিলো লাল
কাঁচের চুড়ি, পরিয়ে
দিলো ওর দুই হাতে। মেয়েটা না বললেও স্বামী একরকম জোর করেই পরালো। এত ভালোবাসা ও
রাখবে কোথায়, সেকথা
ভেবেই কূল পেলো না মেয়েটা! মেলা থেকে নিরাপদেই ওরা বাড়ি ফিরে এলো। কোনো বিপদের
মুখোমুখি না হওয়ায় মেয়েটা নিশ্চিন্ত হলো। তিনদিন পরে স্বামী বিদায় নিয়ে সীমান্তে
চলে গেলে মেয়েটা চুড়িগুলো খুলে যত্ন করে তুলে রাখলো আলমারিতে। মন খারাপ হলেই বের
করে পরতো সেই চুড়িগুলো,
চোখের সামনে চুড়ি-পরা হাত দু'টোকে তুলে দেখতো; সেই ঝন্ ঝন্
কাঁচের আওয়াজ, সেই
ভরা হাত। ধীরে ধীরে ওর ভয় কাটতে লাগলো, ঠিক করলো আবার সে যাবে মেলায় স্বামী
ফিরে এলেই।
কিন্তু এত সুখ ওর কপালে সইলে তো! মেয়েটা যখন ভবিষ্যতের সোনালি স্বপ্নে বিভোর, সূর্যদেব যখন তার রক্তিম আভা পশ্চিম আকাশে ছড়িয়ে অস্ত যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, ঠিক সেই সময়েই এলো অভিশপ্ত খবরটা। স্বামী তার শহিদ হয়েছে! বছর যেতে না যেতেই মেয়েটা হারালো তার স্বামীকে। ওর মাথা থেকে মুছে ফেলা হলো লাল সিঁদুর, গায়ের শাড়ি খুলে পরানো হলো সাদা থান, আর হাতের লাল পলা, শাঁখা যা কিছু ছিল সব ভেঙে ফেলা হলো। মেয়েটা নির্বাক, নিষ্পলক তাকিয়ে রইল ভাঙা পলা, শাঁখার দিকে।
স্বামী চলে যাওয়ার প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। কয়েকদিন পরেই ওদের বাড়ির কাছে মেলা বসবে, তার প্রচার চলছে মাইকে। মেয়েটা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে শুনছিল। হঠাৎ কী মনে হলো, আলমারি খুলে ও বের করে আনল মেলা থেকে স্বামীর কিনে দেওয়া সেই লাল রঙের কাঁচের চুড়িগুলো। দরজা বন্ধ করে দুই হাতে ভর্তি করে পরল চুড়ি, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে শুনল কাঁচের চুড়ির শব্দ, জানালার কাছে গিয়ে আপনমনে হেসে উঠলো খিলখিল করে। মেয়েটা এখন সবসময় লাল চুড়িই পরে থাকে, শতচেষ্টা করেও কেউ খোলাতে পারেনি ওর হাত থেকে।
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post