সত্যজিতের
কলমে সাধারণ মানুষ
শ্রাবণী
গুপ্ত সরকার
মনে হয় জন্ম
থেকেই দাদার কল্যাণে, মা আর বাবার আনুকূল্যে বাড়িতে সন্দেশ আসত
প্রতিমাসেই। তারই মলাটে সদ্য অক্ষর পরিচয়ের পরে সত্যজিৎ রায়ের নামটি জানা। সেখান
থেকেই শুরু, না, খুব ছোটদের জন্য উনি কলম ধরতেন না। চমৎকার মনোময়, বুদ্ধিদীপ্ত, হৃদয়াবেগে আর্দ্র গল্পগুলো মূলতঃ কিশোর
পাঠ্য।
তাঁর গল্পে
নিপাট ভালোমানুষরাও একদম সাদামাটা সরল উপস্থিতি নিয়ে অনায়াসে এসে আমাদের মনের
সবটুকু জয় করে নেয়। তাঁদের নাম, খ্যাতি, বুদ্ধির
দীপ্তি নাই বা রইলো, হৃদয়ের ছোঁয়া উষ্ণ করে তোলে পাঠকের মন।
সাধারণ বাঙালি পাঠক দিব্যি নিজেদের মুখ দেখতে পান এসব চরিত্রের দর্পণে। অন্যরকম
একটা সিক্ততায় মনের মাটি ভিজে ওঠে।
আমি অল্প
কয়েকটি এমন চরিত্রের কথা একটু মনে করাতে এলাম। প্রথমেই ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট গল্পের
নিশিকান্তবাবু। নিপাট ভালোমানুষ। বুদ্ধিমান, কিন্তু কূটবুদ্ধি
নেই। ভালোবাসেন প্রকৃতি আর শুভচিন্তা ছেয়ে থাকে তাঁর মধ্যবিত্ত নির্লোভ মনে।
ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগানের অচেনা গাছের ফলে কামড় বসানোর আগে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের
ছবিতে একটা প্রণাম ঠুকে দেবভোগ্য ফলের আস্বাদ পেয়ে কোথায় চুপচাপ স্বার্থ হাসিল
করবেন, তা না সবাইকে বলে টলে খাইয়ে দাইয়ে নিজেই বৃত্তের
বাইরে চলে গেলেন বেচারি ভদ্রলোক। এমন জীবনে কখনো হয় নি, এইরকম
নিরীহ বাঙালি আছেন? গল্পের শেষে ম্যাকেঞ্জি ফ্রুটের প্যাকিং
কারখানা থেকে চেয়ে আনা টিনের কৌটোয় তাঁর নিজের হাতে সংগ্রহ করে আনা আশ্চর্য গুণ
সমৃদ্ধ একটি চমৎকার টাটকা ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট দেখার বর্ণনায় মনের তারে কেমন একটা
আশ্চর্য মোচড় লাগে।
‘লোডশেডিং’
গল্পে ফণীবাবু ভুল করে অন্য ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েন। তারপর চোর আসে, আরও নানা কান্ডের পরে তিনি বোঝেন ভুল করে পড়শীর ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিলেন।
কিন্তু নিজের ফ্ল্যাটে গিয়ে কারেন্ট আসার পরে আবিষ্কার করেন পুরোনো ছাতার বদলে
দিব্যি চমৎকার নতুন ফ্যাশনেবল ছাতাটি পড়শীর থেকে তাঁর কাছে চলে এসেছে। কি
কান্ড!
ফটিকচাঁদের
হারুণদা ওস্তাদ জাগলার, চমৎকার বুদ্ধিমান আর সপ্রতিভ একটি
আদ্যোপান্ত মনকাড়া চরিত্র। কিন্তু বাড়ি পালানো, লেখাপড়া না
শেখা, বস্তিবাসী সাধারণ মানুষ। সে গুণী, হৃদয়বান, নির্লোভ এবং স্বার্থ বোধহীন, স্মৃতিভ্রষ্ট ফটিকচাঁদকে অনায়াসে কাছে টেনে নিয়ে কি সুন্দর স্বার্থহীন
ভালোবাসায় ভরে দেয়। ধনী ঘরের আজন্ম সুখে লালিত কিশোরকে আশ্চর্য অ্যাডভেঞ্চারারের
সন্ধান দিয়ে চির বিরহী করে তোলে। ফটিকচাঁদ আর কী কখনও বাবলু হয়ে উঠবে পুরোপুরি?
অসাধারণ
গল্প ‘বৃহচঞ্চু’। অবাক হতে জানেন না তুলসীবাবু কিন্তু আমরা শিহরিত হই, জুরাসিক যুগের ভয়াল পাখী যখন দন্ডকারণ্যে ডিম ফুটে বেড়িয়ে তুলসীবাবুর পিছু
ধরে। প্রদ্যোতবাবুর অনুসন্ধিৎসায় চঞ্চুর প্রাগৈতিহাসিক উৎস জেনেও তিনি অবাক হন না।
এমনকি বৃহচঞ্চুর আশ্চর্য বুদ্ধি, মাংসাশী স্বভাব, শক্ত নখওয়ালা পা, ধারালো ঠোঁট, হিংস্র হলুদ চোখ দেখেও। পড়শী তড়িৎবাবুর হুলো হত্যার পর, চঞ্চুকে দন্ডকারণ্যে ছাড়তে গেলেন
তুলসীবাবু। দন্ডকারণ্যে আশ্চর্য হিংস্র প্রাণীর প্রাদুর্ভাবের খবর পড়ে আবারও গিয়ে
চঞ্চুর মাংসের আসক্তি নিজের বুদ্ধিতে দূর করলেন সাধারণ মানুষ তুলসীবাবু। সরল না
হলেও মধ্যবিত্তের শুভবুদ্ধি কি সুন্দর জিতে গেল।
এবার আমার
অন্যতম প্রিয় গল্পটির কথা বলে ইতি টানি। ‘অসমঞ্জসবাবুর কুকুর’ কি মিষ্টি!
হাসিমারায় বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে একা মানুষ অসমঞ্জসবাবু একটা বন্ধুত্বপূর্ণ
স্বভাবের সুন্দর কুকুরছানা কিনে আনলেন কমলালেবু কিনতে গিয়ে। ব্রাউন রঙের ছানাটির
নাম দিলেন ব্রাউনি, বিলিতি নামের প্রতি তাঁর বড় আকর্ষণ। খুব
বুদ্ধিমান ব্রাউনির বিশেষ বৈশিষ্ট্য সে হাসতে পারে এবং বুদ্ধিদীপ্ত হাসি। কুকুরের
হাসি বিষয়ে জানতে গিয়ে বেচারি অসমঞ্জসবাবু বড়োই অপ্রস্তুত হলেন। তারপরে যখন গোপন
করবেন ভাবলেন তখনই আকস্মিকভাবে ডগ লাভার পিলু পোচকানওয়ালার সামনে হেসে উঠল
ব্রাউনি। ব্যস বাড়িতে এল রিপোর্টার। কাগজে হাস্যমান কুকুরের খবর পড়ে সবার আগ্রহের
অত্যাচারে ছুটির দিনে বাড়ি ছাড়লেন অসমঞ্জসবাবু হ্যাঁ সঙ্গী সেই ব্রাউনিই। কাহিনীর
শেষে মার্কিন ধনকুবেরের লোভের হাতছানি অগ্রাহ্য করে ব্রাউনির হাসির অর্থ বুঝে তাকে
কোলে টেনে নিয়ে আরও একবার এই সাদামাটা মানুষটি বুঝিয়ে দিলেন ভালোবাসা পণ্য হয় না।
হাজার বুদ্ধিমান, অনন্যসাধারণ চরিত্রগুলোর পাশে এই সাধারণ,
সরল, নির্লোভ, স্নেহপ্রবণ,
সবাইকে বিশ্বাস করা, অবহেলিত, অপমানিত চরিত্রগুলি সত্যজিৎ রায়ের যাদু কলমে বড়ো কাছের আর মনকাড়া বলে মনে
হয় আমার।
️
চমৎকার লেখা। অসাধারণ বিশ্লেষণ। একদম আমাদের মনের কথা।
ReplyDelete