ফেলুদার
জন্মদাতা
ডাঃ অরুণ
চট্টোপাধ্যায়
Image Courtesy: Google Image Gallery |
যেকোন জিনিস ঐতিহাসিক হয় তখনই
যখন ইতিহাস তাকে ধরে রাখে। যুগ থেকে যুগান্তরে অনায়াসে সে হেঁটে চলে মানুষের
ভালবাসার স্মৃতির হাত ধরে। তেমনি অভূতপূর্ব এক সৃষ্টি হল ‘ফেলুদা’। এটি
শিশুকিশোরদের জন্যে সুগঠিত এক গোয়েন্দা চরিত্র যা ছোটদের তো বটেই মন কেড়ে নিয়েছে
আপামর বাঙ্গালীর শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে। ছোটদের কাছে রহস্য গল্প খুব প্রিয়।
সত্যজিৎ ছোটদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন তাদের মনপসন্দ এমন এক গোয়েন্দা চরিত্র যিনি
প্রায় সমস্ত ছোটদের মন আর প্রাণ ভরাতে প্রস্তুত। ফেলুদা দীর্ঘকায় সুপুরুষ, সাহসী আর
একগুঁয়ে, জ্ঞানী
আর অবশ্যই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিধর। আচারে ব্যবহারে সাধারণ অথচ অসাধারণ মেধা সম্মত
বিশ্লেষণ ক্ষমতা তাঁর। ছোটরা সাধারণত যাদু পছন্দ করে খুব বেশি। কারণ যাদুতে একটা
তাৎক্ষণিক মজা আছে। একজন সুদক্ষ যাদুকরের মতই ফেলুদা চট করে ধরে ফেলেন দুষ্টু
লোকেদের মতিগতি। আর করে ফেলেন তার সমাধান। অচিরে ধরা পড়ে যায়
চোর-ডাকাত-খুনী-গুন্ডা। গল্পের মধ্যে থাকে টান টান উত্তেজনা আর উন্মাদনা। তাই
ফেলুদা চরিত্রটি আর তার গল্পগুলো তো ছোটদের একেবারে হৃদয়ে গাঁথা হয়ে গেছে। তাঁর
সহকারী কে? না
সেও একজন কিশোর। মানে এও কিন্তু কিশোরদের মধ্যে একটি ইঙ্গিত দেওয়া যে কিশোররা ছোট
হলেও কিন্তু ছোট নয়। একজন সুযোগ্য আর সুদক্ষ গোয়েন্দার সহকারী সে হতেই পারে।
অর্থাৎ এই গোয়েন্দা কাহিনীগুলি যেমন ছোটদের জন্যে তেমনই ছোটদের দ্বারা। এগুলি
তাদের মন আর প্রাণের ঐশ্বর্য।
‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘হীরক রাজার
দেশে’, ‘গুপী
গাইন বাঘা বাইন’, ‘বাক্স
রহস্য’, ‘গোরস্থানে
সাবধান’, ‘বাদশাহী
আংটি’ ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’,
গ্যাংটকে গন্ডগোল ইত্যাদি ফেলুদার রহস্য সমাধানের কীর্তির তালিকা উজ্জ্বল আর
দীর্ঘ। ফেলুদার গল্পগুলি তাঁর লেখা হলেও বেশির ভাগ চলচ্ছিত্র নির্মিত হয়েছিল তাঁর
সুপুত্র সন্দীপ রায়ের পরিচালনায়। তবে এগুলির চিত্রনাট্য আর সঙ্গীত পরিচালনা ছিল
সত্যজিতের।
চলচ্চিত্রের এই প্রবাদপুরুষের
শততম জন্ম বছরে এসে শুধু যেন মনের মধ্যে ফেলুদার কথাটাই সর্বদা ঘুরপাক খায়। ফেলুদা
অসাধ্য সাধন করতে পারেন। তেমনি করতে পারেন তাঁর স্রষ্টা সত্যজিত। সাহিত্যে, শিল্পে, সঙ্গীতে, চলচ্চিত্রে
তাঁর অবিস্মরণীয় কর্মকান্ড দেখে শুধুই হতবাক হতে হয়।
গুপী আর বাঘার কথায় আসি। গুপী
বেচারির গান গাওয়ার কত শখ কিন্তু ক্ষমতা নেই একফোঁটা। তেমনি প্রাণের বন্ধু বাঘা পারত না বাজনা
বাজাতে। তাদের আপ্রাণ চেষ্টার ফসল শুধু লোকালয়ে লোকের তাড়া খেয়ে আঁদাড়ে পাঁদাড়ে
গীতবাদ্যের হাস্যকর চেষ্টা করা। অবশেষে বনের প্রান্তে। ঘন বনের গাঢ় অন্ধকারে ভূতের
রাজা স্বয়ং এসে দেখা দিলেন তাদের। গুপী আর বাঘার আন্তরিক প্রচেষ্টায় খুশি হয়ে
ভূতের রাজা তাদের তিনটে বর দিলেন। সুরহীন গুপী পেল সুর আর বাঘা পেল ঢোল বাজানোর
চমৎকার হাত। সে ক্ষমতায় ছিল যাদু মাখা। গান আর বাজনার সুরে মোহিত হয়ে সকলে থাকবে
শুধু নীরব নয় নিথরও বটে। একেবারে ‘নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু’। ফাউ হিসেবেও পেল এক
আশ্চর্য চটিজোড়া। যার সাহায্যে তারা ‘যথা ইচ্ছা তথা যাইতে পারত’। রাজার বরে তারা
‘যাহা ইচ্ছা তাহা খাইতে পারত’। কিন্তু মানুষ হিসেবে ছিল বড় খাঁটি ছিল এই
বন্ধুযুগল। এমন যাদুর ক্ষমতা তারা ভাল কাজে প্রয়োগ করেছিল কখনও খারাপ কাজে নয়।
খারাপের খারাপ আর ভালর ভাল করেছিল। তাইতো তারা পেল দুই সুন্দরী রাজকন্যা আর রাজ্য।
ভাল মানুষের পুরস্কার স্বরূপ। ছোটরাও তাদের মনের অগোচরে রোমান্স চায়। এইভাবে গুপী
বাঘার কাহিনীতে সত্যজিতের দাদু উপেন্দ্রকিশোর মিশিয়েছিলেন মিষ্টি রোমান্স আর
সুযোগ্য নাতি সত্যজিত তাকে চিত্রায়িত করেছেন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ চিত্রে।
রূপকথাধর্মী এই চিত্রের ভক্ত তো শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে প্রায় সবাই।
এই মোহিত করা চলচ্চিত্র দেখতে
দেখতে সকলেই যেন চলে চায় অপূর্ব সেই ইচ্ছাপূরণের দেশে। যেখানে সৎ আর সরল দুই মানুষ
তাদের সততার আর অন্যের ভাল করার ইচ্ছাকে ব্রত করে সব দর্শকের মনের ভেতরে ‘যথা
ইচ্ছা তথা যাইতে পারে’। শুধু তাই নয় ‘যাহা ইচ্ছা তাহা করিতেও পারে’।
দাদু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
আর বাবা সুকুমার রায় ছিলেন শ্রেষ্ঠ শিশু সাহিত্যিক। অর্থাৎ শিশুদের মনের চাহিদা
নিয়ে তাদের মনের মত করে গড়ে তুলতেন ছড়া, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ এইসব। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ
এসমস্ত ধর্মগ্রন্থাগুলিকে তাঁরা শিশু উপযোগী করে লিখেছিলেন। এই সমস্ত গল্পের মধ্যে
দিয়ে শিশুরা বিনোদনের সঙ্গে শিক্ষায় পেয়েছে প্রচুর। বাবা সুকুমার যেন আক্ষরিক
অর্থে জীবনভর শিশুই ছিলেন। শিশুদের সরলমতি মনের দিকে তাকিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন
তাঁর বিখ্যাত ‘ননসেন্স ক্লাব’। এর ছিল না মাথা ছিল না মুন্ডু। ছিল না কোনও ভাবার
অবকাশ। শুধু হাসি আর মজা দিয়ে সাজানো এই ক্লাবে সবাই উপভোগ করত ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’
–এর মজা। ‘হাসজারু’ আর ‘বকচ্ছপ’, ‘হাতিমি’ কিংবা ‘টিয়ামুখো গিরগিটি’ নিয়ে তিনি দিব্বি হাজির
হতেন শিশুদের কাছে। ‘হেড অফিসের বড়বাবুর খ্যাংরা ঝাঁটা গোঁফ’ ধরে মেরেছেন টান, ‘কাঠবুড়োকে’
দিয়ে গন্ধ শুঁকিয়েছেন এমন কি ‘চন্ডীদাসের খুড়োকে’ দিয়েও এমন কল বানিয়েছেন যা স্থান
নিয়েছে বাংলার প্রবাদে।
সেই সুযোগ্য পিতার সুযোগ্য
সন্তান হলেন সত্যজিত রায়। যিনি তাঁর পূর্বসুরীদের প্রতিভাকে অনায়াসে টেনে নিয়ে
গিয়েছিলেন আর ক্রমেই করেছেন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। শুধু তাই নয় সঞ্চারিত করেছেন
তাঁর উত্তর সুরীদের মধ্যে।
১৯২১ সালের ২রা মে, পিতা
সুকুমার রায়ের ঔরসে ও সুপ্রভা রায়ের গর্ভে কোলকাতায় সত্যজিতের জন্ম হয়। দাদু
উপেন্দ্রকিশোর আর বাবা সুকুমারের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অন্য অনেক জিনিসের
মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে জিনিসটি পেয়েছিলেন তা হল শিশুদের ভালবাসা আর শিশুদের সঙ্গে
শিশুদের মতই মিশে যাবার ক্ষমতা। বাবা সুকুমার শুধু কথার শিল্পী ছিলেন তাই নয় তিনি
একজন সুন্দর চিত্রশিল্পীও ছিলেন। তাই চিত্রশিল্পের প্রতি সত্যজিতের প্রথম থেকেই
টান ছিল মাত্রাতিরিক্ত। প্রেসিডেন্সিতে তিনি অর্থনীতি নিয়ে পড়া সত্ত্বেও বিখ্যাত
চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসুর চিত্রকলা সম্পর্কে আগ্রহী হন। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৩ এই তিন বছর
শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসুর চিত্রকলা নিয়ে পড়াশোনা করেন। অজন্তা ইলোরা প্রভৃতি
গুহায় ভাস্কর্য তাঁকে টেনেছে। পরবর্তীকালে এই অজন্তা ইলোরার পটভূমিকে কেন্দ্র করে
তৈরি করা তাঁর বেশ কিছু চলচ্চিত্রও আমরা দেখেছি। ছোটদের জন্যে নির্মিত ‘কৈলাসে
কেলেংকারি’ চলচ্ছিত্রে দর্শক এগুলি দেখে মোহিত হয়েছেন। তাঁর বেশির ভাগ চলচ্চিত্রই
ছিল ভ্রমণমূলক। অর্থাৎ গল্প এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে স্থান থেকে স্থানে ভ্রমণ
করতে থাকে। সোনার কেল্লা,
জয় বাবা ফেলুনাথ,
গ্যাংটকে গন্ডগোল,
কৈলাসে কেলেঙ্কারি ইত্যাদি অনেক। সুন্দর গল্পের মাধ্যমে তিনি বিশেষ করে ছোটদের
বেড়িয়ে নিয়ে এসেছেন কত নতুন নতুন জায়গায়। ছেলেদের শুধু শিক্ষাই হয় নি, তারা পেয়েছে
আনন্দ, সঞ্চয়
করেছে নতুন অভিজ্ঞতা,
বিস্ময়। সন্ধান পেয়েছে নিত্য নতুন কৌতূহলের। গল্পের মধ্যে দিয়ে কেউ যখন শিক্ষা
পায় তখন সে শিক্ষা তার মনে গেঁথে যায়। সে শিক্ষা সার্থক হয়ে ওঠে।
প্রথম কর্মজীবনে একটি বৃটিশ
বিজ্ঞাপন সংস্থার দপ্তরে তিনি জুনিয়র ভিসুয়ালাইজার হিসেবে যোগ দেন। চিত্রসজ্জার এই
কাজটি তাঁর মনে বেশ আগ্রহ আর প্রেরণাদায়ক
হয়। পরে যুক্ত হন ভারতীয় পুস্তক প্রকাশনা ‘সিগনেট প্রেসের সঙ্গে’। প্রকাশিতব্য
বইগুলির প্রচ্ছদ নির্মাণের কাজ স্বাধীনভাবে পেয়ে বেশ খুশিই হয়েছিলেন তিনি। মনের মত
এই কাজটি পেয়ে আর বিশাল সংখ্যক বইয়ের প্রচ্ছদ নির্মাণে্র মাধ্যমে তাঁর শিল্পকর্মের
প্রতি সকলের দৃষ্টিও আকর্ষিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ‘দা
ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ আর বিখ্যাত ব্যাঘ্র শিকারী জিম করবেটের ‘ম্যান ইটার্স অফ
কুমায়ুন’ উল্লেখযোগ্য বই দু্টির প্রচ্ছদ নির্মাণ ছিল সত্যজিতের উল্লেখযোগ্য একটি
কাজ।
১৯৪৭ সালে বেশ কিছু গুণী
ব্যক্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির’ প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর আর একটি
বিশাল কীর্তি। এখানে দেশী বিদেশী প্রচুর চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ তাঁর ভেতরের শিল্পসত্ত্বা তাঁকে চলচ্চিত্র
শিল্পের দিকে টেনে নিয়ে যেতে প্রেরণা দেয়। বিজ্ঞানের কৃতি ছাত্র বাবা সুকুমার
বিলেত থেকে আহরণ করে এনেছিলেন প্রিন্টিং টেকনোলোজির আধুনিক জ্ঞান আর তার প্রয়োগেই
করে উন্নত করেছিলেন পৈতৃক পুস্তক প্রকাশনা ব্যবসা ‘ইউ রায় এন্ড সন্স’ এর। বাবার
মতই সত্যজিত পেয়েছিলেন শিশু-প্রেম। তিনিও শিশুদের মন বুঝতেন। তাই উদ্ভট কল্পনার
জাল বুনে রচনা করেছেন কত কল্পবিজ্ঞানের গল্প এমন কি ভবিষ্যতে চলচ্চিত্রায়িতও
করেছেন। তাঁর এমনই অপূর্ব সৃষ্টি হল প্রফেসর শংকু।
শিশুরা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে
থাকতে ভালবাসে। কারণ প্রকৃতি বিশাল আর সে বাঁধনছাড়া। লাগাম শিশুদের একেবারে পছন্দ
নয়। তারা তাদের মনকে ছুটিয়ে নিয়ে যেতে চায় সর্বত্র। তাই তো গাছপালা, ফুলফল, পশু-পাখি, নদ-নদী, খাল-বিল, আকাশ-বাতাস
সকলের সঙ্গে খোলামেলা সখ্য শিশুদের। শুধু ছোটরাই নয়, বড়রাও কমবেশি প্রকৃতির ভক্ত। এই
প্রকৃতির লেখক বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনার চিত্ররূপ দিয়ে তিনি নির্মাণ
করলেন ‘পথের পাঁচালি’। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রযোজনায় ১৯৫৫ সালে নির্মিত তাঁর প্রথম
‘পথের পাঁচালি’ চলচ্চিত্রটি মন কেড়েছিল মানুষের বেশ ভালভাবেই। কাহিনীতে, আবহে, শিল্পে এই
চিত্রটি যেন সত্যিই উঠে এল গ্রাম বাংলার মাটি থেকে। দারিদ্র, সামান্যতা
আর প্রকৃতিই ছিল যার পটভূমি। এই চিত্রের শিল্প ভাবনা তাঁর নিজস্ব ছিল। ছবিগুলিও
তিনি নিজে এঁকেছিলেন। ছবিটি প্রথমে না হলেও পরে মারাত্মক রকমের সাফল্য পায় আর আজ
এক অবিস্মরণীয় চিত্র হিসেবে স্থান পেয়েছে।
পরের বছর থেকে প্রায় প্রতি
বছরই বেরোতে থাকে অপরাজিত,
পরশ পাথর আর জলসাঘর। ভাবতে অবাক হতে হয় এই প্রথম দিকের ছবিগুলিতেই তাঁর শুধু
চলচ্চিত্র ভাবনাই নয়,
সমাজ ভাবনাও কত পরিণত ছিল। মানুষ কত সহজে কত শক্ত জিনিস পেতে চায়। কারণ তারা
অলৌকিকতায় বিশ্বাসী। তাই পরশ পাথরে তারা বিশ্বাস করে যা লোহার মত কুৎসিত অদামী
জিনিসকেও মুহূর্তের স্পর্শে সোনার মত উজ্জ্বল আর দামী করে দিতে পারে। এ যেন না পড়ে
টুকলি করে প্রথম হওয়ার মত চিন্তা। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে আর তা মানুষের চোখের
সামনে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন সত্যজিৎ তাঁর পরশ পাথর চলচ্চিত্রে।
প্রধানত সাহিত্যাশ্রয়ী
চলচ্চিত্রই নির্মাণ করতেন সত্যজিৎ। তৎকালীন বাংলার সাহিত্য ছিল অত্যন্ত পরিপুষ্ট এক সামাজিক
দর্পণ। কিন্তু বইয়ের দুই মলাটের মধ্যে স্থান পাওয়া একটি কাহিনীগুলি পৌঁছতে পারে সীমিত সংখ্যক মানুষের হাতে।
চিত্রায়িত হলে সেটি এসে পড়ে হাজার হাজার মানুষের চোখে। চলচ্চিত্রে বাস্তব জীবনের
প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রতিবিম্বিত হয় প্রতিটি মানুষের চোখের সামনে। চোখের মধ্যে দিয়ে
চলে যায় অন্তরের গভীরে। উপন্যাসের মর্ম পুরোপুরি গ্রহণ করতে অক্ষম তাঁরাও
চলচ্চিত্রটি থেকে এর মর্মার্থ বা স্বাদ গ্রহণ করতে সমর্থ হতে পারেন। পরিচালকের অন্তর্দৃষ্টি আর বহির্দৃষ্টি যত বেশি
গভীর আর পরিচ্ছন্ন হবে ততই চলচ্চিত্রের মর্মার্থ গ্রহণে সমর্থ হবে দর্শকেরা।
সত্যজিৎ রায় ছিলেন এমন এক উচ্চ স্তরের পরিচালক।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তাঁর খুব
পছন্দের বিষয় ছিল আর তাই তাঁর চলচ্চিত্রে পন্ডিত রবিশংকর, বিলায়েত খাঁ, আলি আকবর
খাঁর সেতার, সরোদ, বেহালা
প্রভৃতি আবহসঙ্গীতে ব্যবহার করেছেন। গ্রাম্যদৃশ্যে এসেছে ভাটিয়ালি বা পল্লীগীতি
আবার গৃহের আভ্যন্তরীণ বা সামাজিক পটভূমিতে ব্যবহৃত হয়েছে সুমধুর রবীন্দ্রসঙ্গীত।
সঙ্গীত শুধু ভালবাসাই নয়,
সঙ্গীত সৃষ্টিতেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ‘পথের পাঁচালি’, ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’, ‘পরশ পাথর’
চলচিত্রগুলিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ছিলেন পন্ডিত রবিশংকর। ‘জলসাঘর’-এ বিলায়েত
খাঁ, ‘দেবী’-তে
ছিলেন আলি আকবর খাঁ। কিন্তু ‘তিন কন্যা’ থেকে তাঁর নিজের সঙ্গীত পরিচালনা শুরু।
তারপর থেকে নিজের সব ছবিতেই তিনি নিজে সঙ্গীত পরিচালনা করেন।
দীর্ঘাকার সুপুরুষ সত্যজিতের
দেহের উচ্চতার মতই বিশাল তাঁর চলচ্চিত্র সৃষ্টির মান। ‘অপুর সংসার’, ‘তিন কন্যা’, ,’দেবী’, ‘মহানগর’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘অভিযান’, ‘নায়ক’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘অরণ্যের
দিনরাত্রি’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘অশনি সংকেত’, ‘জন অরণ্য’, ‘সতরঞ্জ কা
খিলাড়ি’, ‘ঘরে
বাইরে’, ‘শাখা
প্রশাখা’, ‘চারুলতা’, ‘আগন্তুক’, ‘গণশত্রু’, ‘ঘরে বাইরে’
ইত্যাদি হল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আগেই বলেছি তাঁর মনের একটা
বিশাল একটা জায়গা দখল করে ছিল ছোটরা অর্থাৎ শিশু আর কিশোররা। ভালবাসার ছোটদের
জন্যেই কলমও তুলে নিয়েছিলেন তিনি। ঝুলি ভরে উঠেছিল নানা স্বাদের গল্পের বিপুল সম্ভারে। মজা, আনন্দ, আর উল্লাস
কি না ছিল সে গল্পের মধ্যে?
আর ছিল একরাশ কৌতূহল। ছিল রোমহর্ষক মাদকতা।
আগেই বলেছি বাবা সুকুমার
বিজ্ঞানের কৃতি ছাত্র ছিলেন। সত্যজিৎ নিজে অর্থনীতি পড়েছেন আর শিল্প আর সঙ্গীত
সৃষ্টি করেছেন। তবু বিজ্ঞানের যাদুর প্রভাব ছিল তাঁর মধ্যে। কল্পবিজ্ঞান হল কল্পনা
দিয়ে গড়া এক বিজ্ঞান যা এখনও আসে নি কিন্তু আসতে পারে। তাই কল্পবিজ্ঞান অনেকেই
ভালবাসে। ছোটরা তো বটেই। কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী লিখলেন ‘প্রফেসর শংকুকে’ নিয়ে।
তাতেই ছোটরা একেবারে মাত হয়ে গেল। এমনই তাঁর লিখনশৈলী।
সারা জীবন ধরে চলচ্চিত্রকে
আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকা সত্যজিৎ পুরস্কারও পেয়েছিলেন প্রায় সারা জীবন ধরেই। তাঁর বহু
আলোচিত চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালি’ বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র পুরস্কারে পুরস্কৃত হওয়া
ছাড়াও অর্জন করে ‘দাদাসাহেব ফালকে (১৯৮৪)’ পুরস্কার। ৩য় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
(১৯৫৫), সপ্তম
বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৫৭), ১ম সান ফ্রান্সিসকো আন্তর্জাতিক
চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৫৭)। তিনি মোট ৩৫টি জাতীয় চলচ্চিত্র পেয়েছিলেন। ‘পথের পাঁচালি’
তো বটেই, তাছাড়া
‘অপুর সংসার’, ‘চারুলতা’, ‘গুপী গাইন
বাঘা বাইন’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘আগন্তুক’
শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্ম,
‘জলসাঘর’, ‘অভিযান’
ও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ পেয়েছিল দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। এছাড়াও বহু জাতীয় ও
আন্তর্জাতিক শুধু পুরস্কারই নয় অসামান্য খ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি সারা জগৎ জোড়া।
পেয়েছেন বিভিন্ন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলচ্চিত্র বিষয়ে সাম্মানিক ডক্টরেট
সম্মান।
সব পুরস্কারের উল্লেখ এই স্বল্প
পরিসরে করা সম্ভব নয়। তেমনি শুধু পুরস্কার দিয়েই বিচার করা যায় না এমন এক বিশাল
প্রতিভার।
একবার পদ্মশ্রী আর দুবার
পদ্মভুষণ ছাড়াও ১৯৯২ সালে তিনি পান ভারতের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’। প্রথম
ভারতীয় চলচ্চিত্রকার হিসেবে সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২) বিশ্ব চলচ্চিত্রের সব চেয়ে
সম্মানজনক পুরষ্কার ‘অস্কার’ জিতে নেন। ভারতীয় হিসেবে এ গর্বের ভাগ তাঁর সঙ্গে
আমরা অনায়াসে ভাগ করে নিতে পারি।
১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিল তিনি আমাদের সকলকে
কাঁদিয়ে তিনি পাড়ি দিলেন না ফেরার দেশে। তার কিছুদিন আগে অসুস্থ শয্যাশায়ী সত্যজিৎ
এই পুরস্কার পান। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তাই তাঁর এই অর্জনে
বাঙ্গালী হিসেবে আমরা ভীষণ ভাবে গর্ব বোধ করতে পারি।
️
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post