ভয়ঙ্কর সারান্ডায়
সঞ্চারী
ভট্টাচার্য্য
Image Courtesy: Google Image Gallery
|প্রথম পর্ব|
সুখরঞ্জন বাবু একজন ফরেস্ট
রেঞ্জ অফিসার, বন জঙ্গল নিয়েই তার কারবার, বন্যপ্রাণী, তথা জঙ্গলের রক্ষণাবেক্ষণ ওনার
দায়িত্বের মধ্যে পড়ে,সরকারি চাকরি, ফলে
বদলি লেগেই আছে কিন্তু মধ্যপ্রদেশের সারান্ডায় বদলি হওয়ার ঘটনাটি তার মনে
বিশেষভাবে আলোকপাত করেছিল। বনে জঙ্গলে থাকার অভ্যেস তার বহুদিনের।
প্রত্যক্ষভাবে কিংবা
পরোক্ষভাবে দেখা বহু ঘটনাই তার জীবনে দাগ কেটেছিল,তবে তার জীবনে দেখা সবথেকে বড়
অলৌকিক ঘটনাটি ঘটেছিল সারান্ডার জঙ্গলে। যার বর্ণনা তিনি কোনদিন কাউকে দিতে
পারেননি, কারণ সেই ঘটনাটি ছিল যুক্তিতর্কের উর্দ্ধে।
উনিশশো বত্রিশ সাল,মধ্যপ্রদেশের
সারান্ডায় বদলি হয়ে এলেন সুখরঞ্জন তালুকদার,সহজ সরল মানুষ,সাহস এবং সততা দুইই তার
স্বভাবে বিদ্যমান, দুদিন হল এসে উঠেছেন সারণ্ডার ফরেস্ট রেঞ্জ এর সরকারি বাংলোতে, পশু
শিকারের একেবারে বিরোধী তিনি, যেকোনো জায়গায় গেলেই প্রথম কাজ জঙ্গল টা ভালো করে
টহল দিয়ে নেওয়া, প্রতিটি প্রাণীর শারীরিক অবস্থার নিরীক্ষণ করা, শুধু বন্য
আধিকারিক বললে ভুল হবে-ছোটখাটো পশু চিকিৎসকও বলা যায় তাকে। ফলে যেখানেই তিনি বদলি
হয়ে যান না কেন, অনেকের কাজের সুরাহা হয়ে যেত।
একদিন বিকালে বাংলোয় বসে আরাম
করছেন, হঠাৎ তাঁর এক বন্ধু এসে হাজির, তিনিও তারই মত একজন ফরেস্ট
রেঞ্জ অফিসার, তবে সুখরঞ্জন বাবু দায়িত্বে আসবার পর তার বদলির নির্দেশ
পাকাপাকিভাবে বরাদ্দ হয়ে গেলো, কিন্তু যাবার আগে একবার বন্ধুর সাথে দেখা করতে এলেন
নীলকান্ত বাবু।
“এই জঙ্গল টা বড়
অদ্ভুত সুখরঞ্জন, আমার অভিজ্ঞতা বড় বিচিত্র, এই জঙ্গলে একটা বুনো জানোয়ার আছে”-
সাক্ষাতের একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে কথাটি পাড়লেন নীলকান্ত বাবু-জঙ্গল
সম্পর্কে তার করা মন্তব্য গুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিচিত্র ছিল এটিই।
সুখরঞ্জন বাবু কথাটি শুনেও না
শোনার ভান করলেন।
“দু একটা বুনো
খেঁকশিয়াল ছাড়া এখনো তেমন কিছু নজরে পড়েনি, এর চেয়ে ভয়ঙ্কর কোন জন্তু আছে বলে
মনে হয়না”- বললেন সুখরঞ্জন বাবু।
কথাটি শুনে নীলকান্ত বাবু কোন
জবাব দিলেন না।
“আচ্ছা, বুনো জানোয়ার বলতে তুই ঠিক কি বলতে চাস?”- মাথা
চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞাসা করলেন সুখরঞ্জন বাবু, কথাটার গুরুত্ব তেমন না দিলেও
অন্তর্নিহিত অর্থ কে একেবারে উড়িয়ে দিতে পারলেন না সেই মুহূর্তে।
“নিজের চোখে দেখলে
হয়তো বুঝবি। যার যার বিশ্বাস তার তার কাছে। সবার যুক্তিও এক নয় আবার সবকিছু কে
দেখার ধরনও এক নয় “। - অকপটে বললেন
নীলকান্ত বাবু।
“তোর যত সব উদ্ভট
কল্পনা”- সুখরঞ্জন বাবুর মুখে ব্যঙ্গের হাসি।
খুব একটা অবাক হলেন না
নীলকান্ত বাবু, তবে এই কথাটি বলবার পর সুখরঞ্জন বাবুর কাছ থেকে তিনি এমন
প্রত্তুত্তরটিই আশা করেছিলেন- ফলে কথা না বাড়িয়ে তিনি বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন, এক
কাপ কফি কোনরকমে শেষ করেই বললেন,
“আজ তবে উঠি সুখরঞ্জন!
সাবধানে থাকিস”- কথাটি শেষ করেই হন হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন নীলকান্ত বাবু।
|দ্বিতীয় পর্ব|
বিষয়টি নিয়ে সারারাত ভাবলেন
সুখরঞ্জন বাবু, নীলকান্ত বাবুর এমন বিচিত্র আচরণ তাকে যথেষ্ট উদ্বেলিত করে তুলেছিল,
নিঃসঙ্গতাই যখন সঙ্গী তখন একাই বিষয়গুলির মীমাংসা করতে হবে- এমনটাই নিজেকে বোঝাতে
লাগলেন তিনি, পরিবার-পরিজন ফেলে জঙ্গলে আসা।
সরকারি চাকরির তকমাটা গায়ে
লেগে গেলেও কাজটা অনেকটাই দুঃস্বপ্নের মতো, বন্য জীবজন্তুর সাথে একই জায়গায়
বসবাস করা, তবুও নিজের পেশা কে তিনি কোনদিন খারাপ চোখে দেখেননি-তাই মনে মনে ভাবলেন, বুনো জানোয়ারের অর্থটা নিজেই খুঁজে বার করবেন।
পরের দিন সকালে রোজকার অভ্যেস
মত সুখরঞ্জন বাবু জঙ্গল এলাকায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন, বন্যপ্রাণী
এবং বনানীর ইতিকথা তার পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা, তাই নিজের চোখে দেখে ধারণা করা টাই তার
কাছে সবথেকে বড় মনে হলো। কোন একজন সঙ্গী কে সঙ্গে নিতে পারতেন, তবে তার উদ্দেশ্য
ছিল জায়গাটা ঘুরে দেখা, বনের পশুপাখিরাও নাকি কথা বলে, গাছগাছালি ও নাকি মানুষের উপস্থিতি টের পায়।
এমনটাই ধারণা ছিল তার, মোটের
ওপর পায়ে হেঁটে বেড়াতে সুখরঞ্জন বাবুর জুড়ি নেই, চলার পথে যা কিছু চোখে পড়তো
সেগুলো মনের খাতায় টুকে নেওয়া ছিল তার স্বভাব। একজন প্রকৃত প্রকৃতিবিদ এর নাকি
এমনটাই আচরণ হওয়া উচিৎ।
সেদিন সকালে ওনার যা নজরে
পড়ল তা অন্যান্য দিনের সাধারণ অভিজ্ঞতার থেকে অনেক আলাদা। ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটি
জলাধারের পাশে মসৃণ পাথরের ওপর শুয়ে রয়েছে বছর পনেরোর একটি মেয়ে। স্নিগ্ধ রোদে
নিজের ফর্সা সুন্দর শরীরটা রাজকীয় বিলাসে শুকিয়ে নিচ্ছে-সদ্য স্নান এর কারনে ওর
ভিজে চুল দুভাগ করে মাথার সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে, গাঢ় কালো রঙের মণি দুটো চিতা বাঘের
মত দপ দপ করে জ্বলছে, অলস অথচ তীক্ষ্ণ সতর্ক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সুখরঞ্জন বাবুর
দিকে, এ যেন এক অপ্রত্যাশিত অপচ্ছায়া। এমন আবিষ্কার তার দ্বারা এর পূর্বে কোনদিন
হয়নি। মেয়েটিকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত হয়ে
পড়লেন তিনি। এই মেয়ে টি এল কোথা থেকে? গভীর জঙ্গলের মধ্যে
সে কি করছে?
এখানে আসবার পর তিনি শুনতে
পেয়েছিলেন স্থানীয় কোন এক ব্যক্তির বাচ্চা রাতবিরেতে গায়েব হয়ে গেছে, এই
মেয়েটি সে নয় তো? কিন্তু সেটা তো নিতান্তই একটা বাচ্চা ছিল, এমন
বড়োসড়ো কিশোরী নয়। অতশত না ভেবে তিনি মেয়েটিকে প্রশ্ন করেই ফেললেন,
“তুমি কে গো? কি করছো ওখানে?”
“দেখে কি মনে হচ্ছে?”
“না আমার মনে হল তাই
প্রশ্ন করলাম”। কেন, দেখে বুঝতে পারছ না রোদ পোয়াচ্ছি!”
“থাকো কোথায়?”
“কেন”?
“আহা, বলোই
না ক্ষতি কি?”
“এই জঙ্গলেই থাকি। জঙ্গল
টা দারুন সুন্দর”- মেয়েটির কণ্ঠস্বরে সামান্য উৎসাহের
ছোঁয়া।
“কিন্তু রাতে থাকো
কোথায়?”
“মানে?”
“ঘুমাও কোথায়?”
“তা জেনে আপনার কি হবে?”
“বললাম তো এখানেই থাকি,
এখানেই খাই, এখানে ঘুমাই”
“তোমার পরিবারে কে কে
আছেন”? “আমার কেউ নেই, দিনরাত্রি আমি এই জঙ্গলেই কাটিয়ে দি।
তাছাড়া রাতে তো আমি ঘুমাই না, তখনই আমার সব থেকে বেশি কাজ পড়ে”
একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি
সুখরঞ্জন বাবুর মনে জায়গা করে নিতে লাগলো। তার মনে পড়ল নীলকান্ত বাবুর বলা
কথাগুলি। তিনি বেশ ভালই বুঝতে পারলেন একটা রহস্যের সমাধান কে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে
সেটা কৌশলে তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর সমাধান তাকে করতেই হবে।
“তুমি কি খাও?” “কাঁচা মাংস আমার খুব প্রিয়”- খুব ধীরে ধীরে মেয়েটির শব্দগুলো উচ্চারণ করলো। যেন প্রতিটি শব্দের স্বাদ
জিভে পরখ করে দেখে নিল সে, মেয়েটির আচরণ বড়ই অদ্ভুত। ক্রমাগতভাবে মেয়েটি তার
দৃষ্টিশক্তিকে তীক্ষ্ণ করে তুলতে লাগল। তবুও এর রহস্য উদঘাটনই এখন তার কাছে সবথেকে
গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
ভয় না পেয়ে সুখরঞ্জন বাবু
আবার প্রশ্ন করলেন। তবে এবারের প্রশ্নে মেয়েটি বেশ বিরক্ত বোধ করলো।
“কিসের মাংস?” “যখন জানতে চাইছো তখন সবটাই খুলে বলি, এই বনে যত
জীবজন্তু দেখছো সবার মাংসের স্বাদ আমি নিয়ে নিয়েছি, কেউই বাদ পড়েনি, খরগোশ,
বুনো মুরগি, হাঁস, ছাগলের ছানা সবকিছুই- এমনকি মানুষের এক আধটা
বাচ্চাকাচ্চাও, আসলে রাতে ওদের বাড়িতে বন্ধ করে রাখে কিনা! আর সেই সময়টাতেই আমি
শিকারে বেরোই, শেষ মানুষের বাচ্চা খেয়ে দেখেছি প্রায় মাস দুয়েক এর ওপর হয়ে গেল।”
কথাটা শোনা মাত্রই সুখরঞ্জন
বাবুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জড়ো হল, হঠাৎ মনে পড়ে গেল স্থানীয় আধিকারিকটির
কথা, যার বাচ্চা গায়েব হয়েছিল, এই ঘটনা ঠিক দু মাস আগেই ঘটেছিল, মেয়েটি যা বলছে
তার সাথে কি এই ঘটনার কোন যোগসূত্র আছে? ভাবতে ভাবতে ঘামটা
মুছলেন তিনি।
তবে শেষ মন্তব্যের তামাশা
টুকু গায়ে না মেখে তিনি আলোচনাকে শিকারের প্রসঙ্গে নিয়ে আসতে চাইলেন।ভাবলেন
মেয়েটিকে এবার একটু অন্যরকম ভাবে প্রশ্ন করা যাক,
“তুমি মানুষের বাচ্চা
ধরে খাও বলছো? - কিন্তু এ কথা কে বিশ্বাস করবে? এই এলাকায় মানুষের বাচ্চা ধরা অত সহজ নয়”।
“হাহাহাহাহাহাহাহাহা-
আমার পক্ষে সব সহজ, রাতে আমি চার পায়ে শিকার ধরি”।- এরকম একটা রহস্যময় উত্তর পাওয়া গেল।
“তারমানে তুমি কুকুর
নিয়ে সঙ্গে শিকারে বেরোও তাইতো?” - অনিশ্চিত সুর টানলেন
সুখরঞ্জন বাবু।
মেয়েটা ধীরে ধীরে উঠে
দাঁড়ালো, এক অপার্থিব চাপা হাসিতে ফেটে পড়লো চারদিক। সেই হাসিতে কিছুটা হিংস্র ছাপ
কি সুখরঞ্জন বাবুর নজরে পড়ল?
“কুকুর কেন? রাতের বেলা কোন মানুষও বোধ হয়
আমার কাছে আসবার জন্য ছটফট করবে না”।- বলে হাসল মেয়েটি।
সুখরঞ্জন বাবু ক্রমে অনুভব
করতে লাগলেন, এই অদ্ভুত কথার মেয়েটির মধ্যে নিঃসন্দেহে
অলৌকিক কোন রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, ভাবলেন স্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে বিষয়টি নিয়ে
আলোচনা করে দেখতে হবে।
“আবার পরে কথা হবে
তোমার সঙ্গে”- বলেই সুখরঞ্জন বাবু স্থান ত্যাগ করলেন।
সেদিন রাতে স্থানীয় লোকজন কে
ডেকে তিনি তার বাংলোতে একটি বৈঠকের আয়োজন করলেন। ফরেস্টের দেখাশোনা করেন যারা সেই
সমস্ত লোকগুলির কেউই এই বিষয়ে কোন সমীক্ষা দিতে পারলেন না। ফলে সুখরঞ্জন বাবুর
চিন্তাটা আরো বেড়ে গেল। অনেকের মতে এমন হুলিয়ার কোন মেয়েকে তারা কোনদিন এই
জঙ্গলে দেখেনইনি। ফলে জটিলতার কোনো মীমাংসা করা গেল না।মনে মনে ভাবলেন মেয়েটির
সাথে দেখা হলে আরো কথা বলতে হবে। তাকে জানবার আর কোন উপায় যে অবশিষ্ট নেই!
|তৃতীয় পর্ব|
পরের দিন আবার ওই পথেই গেলেন সুখরঞ্জন
বাবু, ঠিক একই জায়গায় আবিষ্কার করলেন মেয়েটিকে। আজকে মেয়েটিকে আগের দিনের থেকে
অনেক বেশি রুক্ষ সূক্ষ্ম মনে হল। সুখরঞ্জন বাবু ঠিক করলেন মেয়েটিকে সঙ্গে করে তার
বাংলোয়ে নিয়ে যাবেন।
“তুমি কি করছ?” “রোজ রোজ একই প্রশ্ন কেন করো? দেখতে পাচ্ছো না রোদ পোয়াচ্ছি”। “তুমি আমার সাথে আমার বাড়ি যাবে”? “তোমার বাড়িতে
নিয়ে যাওয়ার চেয়ে তুমি হয়তো আমাকে এখানেই রেখে যেতে চাইবে”- মেয়েটি বলল,
সুখরঞ্জন বাবুর ওই পরিপাটি
করে সাজানো বাংলোটি এই বুনো মেয়েটির উপস্থিতি কল্পনা করতেই ভয় পায়। বাড়িটির
সাথে মেয়েটি যে একেবারেই বেমানান। সব কিছু জানাচেনা পর তার মনে হলো মেয়েটিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া
সমীচীন হবে না ,
“তুমি না গেলে জোর করে
নিয়ে যাব”-বললেন সুখরঞ্জন বাবু । একবার কথার কথা বলে দেখতে চাইলেন মেয়েটির
অভিব্যাক্তি কেমন হয়!
জোর শব্দটি শোনা মাত্রই
মেয়েটি বিদ্যুতের দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। কথাটা বলা যেন অপরাধসূচক লেগেছে তার। চোখের
নিমিষে মেয়েটি তার সামনে এসে দাঁড়াল। সুখরঞ্জন বাবু মুহূর্তে চমকে উঠলেন, কোন
সাধারণ মানুষের গতিবিধি এমনটা হতে পারে কি? একটা ভোঁদড়ের পক্ষে
এরূপ কার্যকলাপ স্বাভাবিক হলেও একটা মেয়ের পক্ষে, তার মনে
হলো, এ আচরণ রীতিমত বিভ্রান্ত করে দেওয়ার মতন।
মেয়েটি রক্তচক্ষু নিয়ে তার
দিকে তাকিয়ে।এতক্ষণ তার চেহারার মধ্যে যে বিনম্র ভাবটি চোখে পড়ছিল এখন তা আর নেই,
অনিচ্ছাসত্ত্বেও এক পা পিছনে গিয়ে পিছলে পড়ে গেলেন সুখরঞ্জন বাবু। আগাছা ভরা
পিছল পুকুরের পাড়ে প্রায় শেওলা ভর্তি। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই উপরে উঠতে
পারলেন না তিনি। তার এরূপ অবস্থা দেখে মেয়েটি আবার হাসলো। এবারের হাসিতে কর্কশ
হিংস্র ভাব অত্যন্ত প্রকট। কিন্তু পরমুহুর্তেই বিস্ময়কর মেয়েটি প্রায় বিদ্যুৎ
ঝলকের মতো একটা বুনো ঝোপের ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুখরঞ্জন বাবু পরিত্রাণের
আশায় চিৎকার করতে লাগলেন। প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার,
ঠিক এই সময় কিছু বন্য আধিকারিক ওই পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন, তারা সুখরঞ্জন বাবুর
চিৎকার শুনে সেদিকে ছুটে এলেন এবং তাকে অনেক কষ্টে উদ্ধার করলেন। তাদের মধ্যে থেকে
একজন সুখরঞ্জন বাবু কে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন,
“স্যার আপনি এখানে কি
করছেন?” “কেন জঙ্গলের এদিকটায় আসা
নিষেধ নাকি?”- একটু জোর গলায় প্রশ্নটি করলেন সুখরঞ্জন বাবু”
না মানে এদিকটায় আমরা তেমন কেউ আসি না, অনেকে
বলে নাকি!”- কথাটি বলেই থমকে গেলেন সেই আধিকারিক। সুখরঞ্জন বাবু আর কথা বাড়ালেন
না। তিনি শুধু একটা কথাই বললেন, “ আশ্চর্য! কি অদ্ভুত একটি
জন্তু”- জামা প্যান্ট থেকে শ্যাওলা এবং নোংরা কাদা ঝাড়তে ঝাড়তে মন্তব্য করলেন
সুখরঞ্জন বাবু। তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়ল নীলকান্ত বাবুর কথা, “ তোদের জঙ্গলে একটা বুনো জানোয়ার আছে”।
আধিকারিকরা তাকে সঙ্গে নিয়ে
বাড়ির দিকে রওনা হলেন। যাওয়ার পথে আধিকারিকদের মুখে এই বন্য কিশোরীর সম্পর্কে
অনেক অবাস্তব কথা শুনতে পেলেন তিনি। এই ঘটনা গুলির সাথে গ্রামের বাসিন্দার বাচ্চা
চুরি যাওয়ার ঘটনার কোন মিল রয়েছে কিনা তা মনে-মনে যাচাই করে দেখতে লাগলেন।
বাড়িতে ঢোকা মাত্রই তার
মাথাটা ঘুরে গেল- ঘরের আসবাবপত্র কেমন যেন ছড়ানো-ছিটানো। কেউ যেন এসেছিল। তার
প্রভাব বেশ স্পষ্ট। কিন্তু জঙ্গলে এই বাংলোর হদিশ কে পেল! এছাড়া বাড়ির বাইরে
সিকিউরিটি গার্ড থাকে,জিনিসগুলো কোনরকমে গুছিয়ে রাখলেন সুখরঞ্জন বাবু ।
|চতুর্থ পর্ব|
জঙ্গলে শিকার এর সংখ্যা বাড়তে
লাগলো, লোকজনের খামার থেকে গৃহপালিত পশু চুরি যাচ্ছিলো। বন্য জীবজন্তু গায়েব
হচ্ছিলো। পাহাড় থেকে ভেড়ার ছানাগুলোকে কারা যেন তুলে নিয়ে যাচ্ছিলো-এই নালিশ তার
কানে এলো।
একি করে সম্ভব ! এই বুনো
মেয়েটি একটা চতুর শিকারি কুকুর নিয়ে সত্যিই কি শিকার করে বেড়াচ্ছে? ও আগের দিন বলেছিলো, “চার পায়ে” শিকার ধরে। কিন্তু
আবার এরকম অদ্ভূত ইঙ্গিত ও দিয়েছে যে, কোন কুকুর ও ওর সঙ্গে
আসতে চাইবে না। তার ওপর আবার রাতে, ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে রহস্যময়। গত মাসের ঘটে
যাওয়া বিভিন্ন লুটপাটের ঘটনাগুলো তার মনে দুশ্চিন্তার মেঘকে আরো গাঢ় করে তুলল।
ঠিক সেই সময় এক আগন্তুক ঘরে
এসে ঢুকলো তার। লোকটি বাচ্চা চুরি যাবার ব্যাপারটা নিয়ে সুখরঞ্জন বাবুকে কিছু তথ্য
দিলেন। তিনি বললেন,
“দুমাস আগে যে
বাচ্চাটি চুরি গেছিলো, সেটি কোন সাধারণ কারণে নয়, ছেলেটির মা
বরাবরই বলে এসেছেন, বাড়ির পিছনে পাহাড়ের দিক থেকে তিনি একটি
আর্ত চিৎকার শুনতে পেয়েছিলেন । ঠিক সেই দিনই তার বাচ্চাটি চুরি গেছিল। পাহাড়ের
কোণে বিভিন্ন প্রান্তে খোঁজখবর লাগানোর পরেও বাচ্চাটির হদিস মেলেনি।”“ কিন্তু এই ঘটনাটি আপনি আমাকে বলছেন কেন?”“ তার পিছনে
মস্ত বড় কারণ আছে দাদাবাবু। আমি দুদিন ধরে আপনাকে জঙ্গলের ঐদিকে যেতে দেখেছি, ওই
জায়গাটিতে সচরাচর কেউ যায় না,ওই জায়গাটি নাকি তার আস্তানা, আঁতুড়ঘর ও বলতে পারেন”। “ তুমি কার
সম্পর্কে বলছো? আমিতো তোমাকে কারুর ইঙ্গিত দিইনি”। “ সে আপনার ঘরেও আসবে বাবু, অত মেলামেশা করবেন না, আপনি আমাকে চিনবেন না, আমি
পাশেই গ্রামে থাকি, আপনাকে সাবধান করে দেওয়া আমার কর্তব্য ছিল, আসলাম”।
সমস্ত কিছু বিষয়টিকে আরও
জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছিল, সুখরঞ্জন বাবুর কাছে সমগ্র বিষয়টি ধোঁয়াশায় পরিণত
হচ্ছিল, বারবার তার মাথার মধ্যে একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল, তাহলে সবকিছুর মূলে কি
ওই বুনো মেয়েটিই জড়িত? এটি নিতান্তই অবিশ্বাস্য ব্যাপার, কিন্তু ওই বুনো
মেয়েটি ওরকম শিউরে ওঠা ভয়ঙ্কর মন্তব্য না করলেও পারত যে, মাস
দুয়েক আগে সে শেষ মানুষের বাচ্চার মাংস খেয়েছে, ঠাট্টা করেও এ ধরনের বুক কাঁপানো
মন্তব্য করা ঠিক নয়।
সেদিন রাতে এক ভয়ঙ্কর আর্ত
চিৎকার শুনতে পেলেন তিনি। জঙ্গলের গভীরে কোন নেকড়ের আর্তচিৎকার, জঙ্গলের
নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে তার কানে এসে বিঁধছিলো। কোন সাধারন নেকড়ের চিৎকার ছিল না
সেটি- পরের দিন সকালে তার বাড়ির সামনে বেশ কিছু লোম পড়ে থাকতে দেখলেন তিনি, ভালো
করে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন সেটি কোন নেকড়ের লোম নয়,তাহলে এটি কি ছিল? বাকি আধিকারিকদের ও এই বিষয়টির সাথে পরিচিত করাতে চাইলে কেউই তেমন কোন
সঠিক উত্তর দিতে পারল না।
বিষয়টি আরো বেশি গুরুগম্ভীর
হয়ে গেল তার কাছে। স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে তার আবিষ্কারের কথা সবাইকে বলে বেড়ানোটা
সমীচীন মনে করলেন না সুখরঞ্জন বাবু।
বিষয়টি নিয়ে তিনি সকলের
সাথে আলোচনা করতে চাইলেন না। এই রহস্যের উদ্ঘাটন করা কঠিন হলেও সাধারণ মানুষের
মধ্যে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই তাঁর পদ নিয়ে সন্দেহ করতে পারেন, এমন
সম্ভাবনাও রয়েছে যে, হারানো ভেড়া ও গৃহপালিত পশুর জন্য তার
বাড়িতে মোটা আকারের ক্ষতিপূরণের বিল এসে হাজির হবে, সেদিন রাতে ঠিক করে কিছু
খেতেও পারলেন না সুখরঞ্জন বাবু।
পরের দিন সকালে প্রাতঃরাশের
সময় সুখরঞ্জন বাবু স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, গতকালের ঘটনার
অস্বস্তিকর অনুভূতি তার মন থেকে পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি, তিনি ঠিক করলেন, একটি গাড়ি নিয়ে পাশের শহরে যাবেন। আপাতত কয়েকদিনের জন্য নীলকান্ত বাবু
সেই শহরেই একটি হোটেলে উঠেছেন, তার সাথে বিগত দিনে ঘটে যাওয়া সমস্ত বিষয়গুলি
পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে আলোচনা করাটা দরকার মনে করলেন তিনি। সত্যি সত্যি কি দেখে
নীলকান্ত বাবু সেদিন মন্তব্য করেছিলেন, “ তোদের জঙ্গলে একটা
বুনো জানোয়ার আছে”। এর আসল তথ্য তাকে খুঁজে বার করতেই হবে।
|পঞ্চম পর্ব|
রওনা হতে যাবেন এমন সময়
দেখলেন ড্রইংরুমে গদি আঁটা সোফার ওপরে স্বাভাবিক সৌষ্ঠবে নিখোঁজ বিশ্রামের ভঙ্গিতে
হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে জঙ্গলের সেই বন্য মেয়েটি। শেষবার তিনি যেমন দেখেছিলেন, তার চেয়ে ওর শরীর এখন শুকনো তবে সাজ-পোশাকে অন্য কোনও পরিবর্তন নজরে পড়লো
না। সুখরঞ্জন বাবুর দিকে তাকিয়ে মেয়েটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছু যেন বোঝাতে চাইছিল।
তার প্রতিটি ইঙ্গিতই যথেষ্ট রহস্যময়।
“কোন সাহসে এখানে এসেছ”
- ভয়ঙ্কর সুরে প্রশ্ন করলেন সুখরঞ্জন বাবু ।
“ভাবলাম জঙ্গলে একা
থেকে আর কি হবে? এছাড়া তুমি তো বলেছিলে জঙ্গলে একা না থাকতে!”-
শান্ত স্বরে মেয়েটি বলল।
মেয়েটিকে দেখে আজকে আর দয়া
করতে ইচ্ছে করলো না তার। মেয়েটির এমন আকস্মিক আবির্ভাবের কারণ কি? তা বুঝতে পারলেন না তিনি।
“আমায় এখন বেরোতে হবে।
তুমি আপাতত যাও” -বলেই মেয়েটিকে হাত ধরে বার করে দিলেন সুখরঞ্জন বাবু।
মেয়েটি কিছু বলল না। সুখরঞ্জন
বাবু পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, “আমি না থাকলে এখানে আসবে না আর
কোনদিন”।
বাংলোর বাইরে আসতেই চোখের
নিমিষে অন্ধকারে গায়েব হয়ে গেলো সেই মেয়েটি। এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে কোন মানুষের
পক্ষে চোখের আড়াল হওয়া সম্ভব? গাড়িতে যেতে যেতে বারবার তার
একটা কথাই মাথায় আসছিল, মেয়েটির চালচলন সত্যিই ভীষণরকম অদ্ভূত, শুধু তাই নয়,
আজকে হঠাৎ মেয়েটি তার বাংলোয় এসে যেভাবে আরাম করছিল সেটাও বড্ড অবাক
করে দেবার মতোই ব্যাপার। কিন্তু মেয়েটি বাংলোয় এলো কিভাবে? ঘটনা
অনেক হলেও কোথাও না কোথাও যোগসূত্রের কেন্দ্রবিন্দু ঐ মেয়েটিই, এমনটাই মনে হতে থাকলো তার।
পথে যেতে যেতে হঠাৎ তার
গাড়িটা থমকে দাঁড়ালো। সুখরঞ্জন বাবু দেখলেন গাড়ির সামনে কেউ যেন দাঁড়িয়ে
রয়েছে। গাড়ির হেডলাইটের আলোটা গিয়ে পড়েছে তার মুখে, তিনি দেখে চমকে উঠলেন- সেই
বন্য মেয়েটি দাঁড়িয়ে, তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অজস্র নেকড়ে। নেকড়েগুলো গোঁ
গোঁ শব্দ বার করছে। যেন তীব্র প্রতিবাদের সুর ভেসে আসছে তাদের গলার স্বর এর মধ্যে
দিয়ে। কোন সত্যকে লুকোতে চাইছে তারা। আর তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে এই মেয়েটি, সুখরঞ্জন
বাবু তাদের তোয়াক্কা না করে সজোরে গাড়ি চালিয়ে সেখান দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
আবার কোনো নতুন ভয় গিরে ধরল
তাকে, সুখরঞ্জন বাবু যা দেখেছেন তা এতই অস্বাভাবিক যে, সত্যি কারের কোনো সুস্থ মানুষ তাকে প্রকৃত ঘটনার মর্যাদা দিতে চাইবে না। নীলকান্ত
বাবুর বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেলো।
নীলকান্ত বাবু তাকে দেখেই বুঝলেন
পূর্বের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলির সত্যতা যাচাইয়ের স্বার্থেই সুখরঞ্জন বাবুর আগমন
ঘটেছে। তাই তিনি অবাক হলেন না, সুখরঞ্জন বাবু বড্ড তাড়া নিয়ে সেদিনকে গেছিলেন। রাতটা
ওখানে কাটানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। নীলকান্ত বাবুকে তিনি পূর্বে ঘটে যাওয়া
সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিলেন। কিছু অধরা সত্যের কথা জানতে চাইলেন তার কাছে।
নীলকান্ত বাবু বললেন, “ তোর ওখান থেকে যেদিন চলে আসি তার আগের দিন সন্ধ্যায় তোদের বাগানের দরজার
কাছে কতগুলো আগাছা ঝোপের আড়ালে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখছিলাম অস্ত যাওয়া
সূর্যের মিলিয়ে আসা আলো, হঠাৎ এক নগ্ন কিশোরীকে নজরে পড়ল,ভাবলাম হয়ত গ্রামেরই
কোন বাসিন্দা। আশেপাশের কোন পুকুরে স্নান করতে এসে থাকবে, মেয়েটিও খোলা পাহাড়ের
উপরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছিল, হাবভাব ভীষণই অদ্ভূত মনে হয়েছিল মেয়েটির। ওর
দাঁড়ানোর বন্য ভঙ্গি আমাকে মুগ্ধ করেছিল, আমি কিছু না বুঝেই মেয়েটির পিছু নিলাম,
মেয়েটির খুব কাছাকাছি এসে তাকে ডাকতে যাব, ঠিক সেই সময়
মুহূর্তেই সূর্য অস্ত গেল পাহাড়ের আড়ালে। সমস্ত কমলা ও গোলাপি রং সামনের
প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকে মুছে গেল- পড়ে রইল ধূসর ঠান্ডা ছায়া। আর ঠিক সেই সময়ই ঘটল
এক আশ্চর্য ঘটনা, মেয়েটি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল”।
“অদৃশ্য হয়ে গেল মানে?”-
উত্তেজিতভাবে জানতে চাইলেন সুখরঞ্জন বাবু।
নীলকান্ত বাবুর স্থির দৃষ্টি
সন্দেহটা আরো বাড়িয়ে দিল”। সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার ছিল সেটাই। খোলা
পাহাড়ের ঠিক যে জায়গাটায় এক সেকেন্ড আগেও মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছিল, এখন সেখানে দাঁড়িয়ে একটা বিশাল নেকড়ে, গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, সদন্ত
চকচক করছে, হলদে চোখ দুটো নৃশংসতায় ভরা, ভাবতে পারছিস”- কথাটা শেষ করেই ভয় পেয়ে
কাঁপতে থাকলেন নীলকান্ত বাবু।
কিন্তু সুখরঞ্জন বাবুর মনের
মধ্যে তখনও সাহসের শেষ শিখাটি জ্বলন্ত হয়ে রয়েছে,উনি এসব অবান্তর কথায় বিশ্বাস
করতে পারলেন না। কারণ মেয়েটিকে স্বচক্ষে তিনি দুদিন দেখে এসেছেন, বন্য মেয়েটিকে ‘মানুষ নেকড়ে’ আখ্যায় ভূষিত করা চলে না, ওই
মুহূর্তেই তিনি স্থান ত্যাগ করলেন, গাড়ি নিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে ফিরতে লাগলেন।
|ষষ্ঠ পর্ব|
মেয়েটির সত্যতা অন্বেষণে
তিনি আরো আগ্রহী হয়ে উঠলেন। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সজোরে গাড়ি চালাতে লাগলেন, এমন
সময় গাড়িটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল, চারিদিকে ঘন জঙ্গল। সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের
মায়া ভেদ করে সামনে এসে দাঁড়ালো একটি হিংস্র বাঘ। সুখরঞ্জন বাবুর সঙ্গে একটি
লাইসেন্স প্রাপ্ত রিভলবার সব সময়ই থাকতো, কিন্তু বাঘের আয়তন এর কাছে তার
রিভলবারটি ছিল ক্ষুদ্র, বন্য এই বাঘের কাছ থেকে রেহাই পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে
কিনা সেই মুহূর্তে বুঝতে পারছিলেন না তিনি, ওই বাঘের সাথে আরো কিছু বাঘ এসে জুটল, তিন
চারটে বাঘ মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার গাড়ির উপরে।
ঠিক সেই সময়ই কারোর হিংস্র
চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলেন, যা বাঘের গর্জনের চেয়েও মারাত্মক। চোখের সামনে দেখতে
পেলেন মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছে- গাড়ির হেডলাইটের আলো টি এসে পড়ল মেয়েটির মুখে, সুখরঞ্জন
বাবু ভয় এবং আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন- তিনি দেখলেন মেয়েটির অর্ধেক শরীর নেকড়েতে
পরিণত হয়েছে, আর বাকিটা ধীরগতিতে পরিবর্তনশীল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ
চেহারা বদলে গেল। এখন সে কোন মেয়ে নয়, জলজ্যান্ত একটি
নেকড়ে।
নেকড়েটিকে দেখামাত্রই বাঘের
দলগুলি ক্রমাগতভাবে পিছনের দিকে সরে যেতে লাগলো। গাড়ির চারপাশটা ঘিরে রেখেছিল
তারা। নিমিষের মধ্যে স্থান ফাঁকা করে চলে গেল। নেকড়েটি গাড়ির সামনে তীব্রভাবে “উউউউউউ”-
বলে চিৎকার করেই জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল। সুখরঞ্জন বাবু তখনও ভয়েতে থরথর করে
কাঁপছেন, সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত।
খোলা পাহাড়ের বুকে নেকড়ের
আর্তচিৎকার যেন জঙ্গলের পরিবেশকে জীবন্ত করে তুলল, পরিবেশ থেকে সমস্ত রং পলকে
অদৃশ্য হয়ে গেল, একি দ্রুত কাঁপুনি দিয়ে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক প্রকৃতির বুকে জাঁকিয়ে
বসল। সুখরঞ্জন বাবুর কানে এল এক তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার, জঙ্গল যেন ক্রমাগতভাবে তার
কাছে অপরিচিত হয়ে উঠতে লাগলো।
|সপ্তম পর্ব|
️
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post