হিমশীতল জলে
তপন তরফদার
Image Courtesy: Google Image Gallery
মানুষ মরে যায় মাটিতে বা
আগুনে পুড়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়। অনেক জড় বস্তু চুপচাপ থাকলেও মৃত হয়ে যায়না। কখন যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে কেউ
জানেনা। গল্পের যাদুকর আন্ত্যন চেখভ বলেন
প্রতিটি ধূলিকণার গল্পকথন আছে। পাড়ার ওই লাইটপোষ্টটা, বকুল গাছটা, হলুদ-কালো
পাড়ার নেড়ি সারমেয়টির ও নিজস্ব কাহিনী আছে, গল্পকথন আছে। আবার গল্পে “টুইষ্ট”ও
আছে। যারা জানার ঠিকই জেনে নেয়।তারা লাইটপোষ্টের সঙ্গে গল্পগুজব করে সময় কাটাবার
সময় নেই। যারা পাগলামি করে সময় কাটায়, তারাই কালির আঁচড়ে ওদের মর্মকথা বা
ব্যথায় ব্যথিত হয়। হিমঘর থেকে তুলে এনে অনুসন্ধান করে, সময়ের অপচয়
করে কিনা তা সময়ই বলবে।
এই মনমর্জিয়া বৃদ্ধাশ্রমে বেশ কয়েক বছর
কেয়ারটেকারের কাজ করে মুখ দেখলেই বলে দিতে
পারি, কি
ছিলেন, কেন
এখানে এসেছেন। ইদানীং কিন্তু ওই সিনেমায়
গল্পে যা দেখায়, বাড়ির
লোকজন জঞ্জালের মতো এখানে ফেলে দিয়ে যায় তা কিন্তু সর্ব ক্ষেত্রে সত্যি নয়। ছায়া
দস্তিদার নিজের উদ্যোগে ছেলের বিয়ে দিয়ে অষ্টমঙ্গলার দিনে নিজেই চলে আসেন
মনমর্জিয়ায়। পুত্রবধু কাকলি নিজে এসেছিল
ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ছায়াদেবী ফিরে গেলেন না, উপরন্তু বললেন, বৈদিক যুগে এই বয়সে বানপ্রস্থে যেতে
হতো জীবনকে উপভোগ করতে। শিখা ঘোষ দে, কয়েক বছর হলো এখানে এসে সবার ভোল
পাল্টে দিয়েছেন। শিখার রুপের বহ্নি শিখা এখনো জ্বালিয়ে দিতে পারে। কিছু মানুষ
মানবদেহে কি যন্ত্রপাতি নিয়ে জন্মায়, যার কোনো ক্ষয় হয়না। শিখার শিখা এখনো
দীপ্তিমান। বয়স এখানে একটি সংখ্যা মাত্র।
শিখাদেবী
নিজেরা আনন্দে থাকবেন বলে ছোট-খাটো অনুষ্ঠান, পুজো-পার্বণ শুরু করলেন। পুরুষ যতোই সিংহ হোক, ওই সুন্দরী
ললনার কাছে নেংটি ইঁদুর। শিখার মুখ থেকে শুধু
নির্দেশ নির্গত হওয়ার অপেক্ষায়। ভাগ্যিস ওদের জীবন-সঙ্গিনীরা ধরাধাম ত্যাগ
করেছেন, না
হলে “মনমর্জিয়া”তে প্রতিদিনই কুরুক্ষেত্র হত। সিনিয়র সিটিজেনরা এখানে যে উদ্যমে
উদ্যোগী হয়ে যা কাজ করে তা অনেক যুবা-পুরুষের কান কেটে নেবে।
শিখা দে
সরস্বতী পুজোর উদ্যোগ নিয়েছেন। সাফল্যমন্ডিত হয়েছে। স্কুলের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীর মত
সেজেগুজেই অঞ্জলি দিয়ে পাত পেড়ে পংক্তি
ভোজ খেয়েছে। সন্ধ্যায় ভালোবাসার দ্বৈতগান, দ্বৈতআবৃতি, নাটকের
সংলাপে জমজমাট অনুষ্ঠান। বাঙালির ভ্যালেনটাইনসডে সরস্বতী পুজার দিন তা প্রমাণ করে
দিল।
আক্ষেপের
বিষয় ছায়াদেবী যিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে
আনন্দে বানপ্রস্থের জীবন কাটাবেন বলে এসেছেন তিনি কিন্তু নিজের ছায়াবৃত্ত থেকে
বেড়িয়ে আসেননা। মহাজাগতিক সূত্র অনুযায়ী
এক আকাশে দুটো সূর্য থাকতে পারেনা। সেই জন্যই কি ছায়াদেবীর এই পদক্ষেপ। ঠিক বুঝতে
পারিনি। বুঝলাম প্রতিমার নিরঞ্জনের পরে।
এই সময়ে
গোধুলিরই দেখা মেলেনা। দুপুরের পরই ঝুপ করে প্রভাকর প্রভা বন্ধ করে দেয়। অন্ধকার
করে দেয় ধরিত্রী। সরস্বতীকে ধুনুচি নাচ দেখিয়ে ভাসান দেওয়া হবে। নাচ চলছে তো
চলছেই। এত এনার্জি, এত
প্রোটিন কোথা থেকে আসছে কে জানে। রাত হলেও অসুবিধা হবেনা। বৃদ্ধাশ্রমেই সুসজ্জিত
পুকুর আছে। আবাসিকরা বাতায়ন থেকেই দিঘির সৌন্দর্যের স্বাদ ফুলের ঘ্রাণ, গ্রহণ করে।
কনকনে শীতের রাত।প্রতিমা নিয়ে পুকুরে আমাকেই নামতে হবে।
প্রদীপ্ত
হাজরা পাইলট ছিলেন। সবসময় বিদেশের গল্পগুজবে খই ফুটান। অনেক জানে, অনেক খেয়েছে, অনেক
কিছু করেছে, ভাগ্যের পরিহাস না এটাই নিয়তি যার
জন্য এখানে থাকতে হচ্ছে। উনি কথার কলাকৌশলে সুন্দর উপস্থাপনা করেন। সবাই শোনে। হাজরা স্যার বলতে শুরু করলেন – “হিমাহিত জলে জাপানে এক বিরাট উৎসব হয়। যার নাম হাদাকা
মাতসুরি বা নগ্ন পুরুষদের উৎসব। স্রেফ একফালি ন্যাকড়ায় যতটুকু না হলে নয়, ততটুকুই
লজ্জা নিবারণ করে হাজারো জাপানি পুরুষ এদিন হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা জলে নামেন। পশ্চিম জাপানের ওকায়ামার
সাইদাইজি মন্দিরে হয় এই উৎসব। হাজরা স্যারের গলায়
যাদু আছে। সবাই সন্মোহিত। চোখ বড়োবড়ো করে বলেন মজার কথা কি জানেন? শিখারানী বলেন, বলুন বেশি
রহস্য করবেন না। হাজরা স্যার শুরু করলেন, পুরোহিতের ছোঁড়া লাঠি পাকড়াতে
ছোট্ট জলাশয়ের মধ্যে অসংখ্য লোকের হুড়োহুড়ি।
এই উৎসব
অন্তত ৫০০ বছরের পুরনো। হাজারদশেক মানুষ ধর্মীয় এই অনুষ্ঠান পালন করেন কনকনে হিম
জলে স্নান করে। তবে বিষয়টা স্রেফ বরফ জলে স্নান করা নয়। আহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে
ষোল আনা। তাই পরনের ন্যাকড়ায় নিজের রক্তের গ্রুপ লিখে জলে লাফাতে হয়। আচমকা আহত
হলে যেন রক্ত নিয়ে গন্ডোগোল হয়না। হাদাকা
মাতসুরিতে যোগ দিয়ে পুরো অক্ষত শরীরে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। ঠেলাঠেলিতে কপাল ফুলে
যাওয়া, হাত
পা ছড়ে যাওয়া তো সামান্য ঘটনা। পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুও হয়েছে বহু। কিন্তু দেড় ইঞ্চি
ব্যাস আর আট ইঞ্চি লম্বা ওই পবিত্র লাঠিকে কব্জা করতে প্রাণসংশয় হলেও পিছপা নন
জাপানিরা। তাঁদের বিশ্বাস,
পুরোহিতের ছুঁড়ে দেওয়া ওই লাঠি যে পাকড়াও করবে, তার ভাগ্য
খুলে যাবে। অতএব? হাজারদশেক
মানুষ জলে ঝাঁপান। আচমকা নিভে যায় আলো, মন্দিরের ওপর থেকে পুরোহিতরা শুরু
করেন রহস্যময় মন্ত্রপাঠ। ওপর থেকে ঢেলে দেওয়া হয় হিমশীতল পবিত্র জল আর লাঠি।
ভিড়ের চোটে শ্বাসরোধ হয়ে আসা স্বাভাবিক। আকাশ থেকে ছিটকে পড়া লাঠি ধরতে
অন্ধকারেই লাফিয়ে ওঠেন অসংখ্য প্রায় নগ্ন মানুষ। শুরু হয় হুড়োহুড়ি। হাতে পেয়েই
নিস্তার নেই, একসঙ্গে
যুঝতে হবে অসংখ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে, সৌভাগ্যের আশায় সবাই চেষ্টা করছেন
লাঠিটি কেড়ে নেওয়ার।প্রাচীন জাপানিরা বিশ্বাস করতেন, যে ওই লাঠি
শেষ পর্যন্ত নিজের সঙ্গে রাখতে পারবেন, তাঁর ক্ষেত শস্যে ভরে যাবে। যন্ত্রণা
ভুলতে অনেকে নেশা করে যোগ দিতে আসতেন উৎসবে। এখন অবশ্য নেশা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন আর আগের মত
শস্যের সম্ভাবনা নিয়ে মানুষ উৎসাহী নন। এবারেই এক যুবক হাতে লাঠি পেয়ে একগাল হেসে
বলেছেন, ঈশ্বর
উপহার পাঠিয়েছেন, এবার
নিশ্চয়ই গোলগাল, সুস্থসবল
বাচ্চা হবে। ছায়াদেবী কখন ছায়ার মায়ায় মিলিয়ে গেছেন লক্ষ করিনি।
শান্তির জল
ছিটাবার জন্য মঙ্গলঘটে জল ভরে শিখাদেবীকে দিয়ে, আমি সাঁতার কাটতে থাকি। আবাসিকদের
এবার শীত লাগছিল, যে
যার ডেরায় ঢুকে পড়েছে। ছায়াদেবী জানলা দিয়ে আমাকে চিৎকার করে বলছেন ঠান্ডায় জলে
কেন। উঠে পড়ুন অসুখ হবে। ওনার হাড়হিম আর্তনাদে বুঝতে পারলাম এই ঠান্ডা জলের কোনো
ইতিহাস আছে। আমাকে জানতেই হবে, দেরি করলে এই মানসিক অবস্থান পাল্টে যাবে। আমি সিধে উনার
ঘরে ঢুকে নাড়ুগোপালের মূর্তি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা
করলাম, কাউকে
বলবোনা। আপনি আমাকে বলে মন হালকা করুণ। উনি কিছুতেই বলবেননা। আমিও নাছোড়বান্দা।
মুখ খুললেন।
“তখন ক্লাস
টুয়েলভে পড়ি। আমাদের স্কুলে সরস্বতী ঠাকুর দেখতে এসে অর্নিবান আমাকে ইশারায় বুঝিয়ে
দেয় আমার সঙ্গে প্রেম করবে। আমার খুব রাগ হয়। শুনেছিলাম কোনো এক সিনেমায় নায়িকা
তার প্রেমার্থীকে বলেছিল,
শীতের রাতে সারারাত পুকুরের ঠান্ডা জলে ডুবে থাকলে প্রেমিকা হবে। আমরা থাকতাম
বালি দুর্গাপুরের সমবায় পল্লীতে। পল্লীর মাঝখানে ডিম্বাকৃতি এক ঝিল। ঝিলের চারধারে
বসতি। অনেক ঘাট, অনেক
বাড়ির নিজস্ব ঘাট আছে। সরস্বতী পুজো ওই ঝিলের জলের উপর হয়। লাইট দিয়ে সাজানো হয়।
সে এক অপরুপ দৃশ্য। হরিদ্বারের হর কি পৌড়ির থেকেও সুন্দর। মজা করে অর্নিবানকে
ফিশফিশ করে বলি সারারাত আমাদের ঘাটের সরস্বতী ঠাকুরের কাছে ডুবে থাকলে আমাকে পাবে।
রাত একটা,আমি জানলা
দিয়ে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যাই। ইশারায় বলতে থাকি উঠে যাও, বাড়ি যাও। মা বলে এত রাতে জানলায় কেন, শুয়ে পড়।
পরদিন শুনতে পাই অর্নিবানের নিউনিমোয়া হয়েছে। ব্যান্ড বাজিয়ে বিসর্জনে বেরুবে। খবর
আসলো অর্নিবান মারা গেছে। কাউকেই কিছু
বলতে পারিনি,
সারাজীবন চুপচাপ হয়ে গুমরে মরেছি, আমি প্রেমের
লোভ দেখিয়ে হিমায়িত করে খুন করেছি।
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post