মানসী
গাঙ্গুলী
Image Courtesy: Google Image Gallery
দীর্ঘ ৩৫ বছর চাকরির পর অবসর গ্রহণ করলেন সমীরবাবু। আর তার পরপরই লকডাউন হয়ে যায়। হঠাৎ করেই বাড়িতে বন্দী হয়ে গেলেন তিনি। অবশ্য তিনি একা নন, দেশশুদ্ধ সকলে। সারাদিন বাড়িতে। রোজ অফিস যাওয়ার অভ্যাসটা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল। কি করে যে সময় কাটে! দমবন্ধ হয়ে আসে তাঁর। টিভি দেখা ধাতে নেই কোনো কালে। তবে খেলা দেখতেন বরাবরই। এখন কেবল খবরটুকু দেখেন মাঝেমধ্যে। আজকাল টিভির দরকারই তো আর পড়ে না। হাতে একটা মোবাইল ফোন আর একটা ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে দুনিয়া মুঠ্ঠি মে। ওই ফোনটাই আজকাল একটু ঘাঁটাঘাঁটি করেন। আর নেশা একটা আছে বটে, তা হল সকালের চায়ের সঙ্গে টা হিসাবে রোজের খবরের কাগজ। তা এই কোভিড সিচুয়েশনে তাও বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। কার হাত ঘুরে কী এসে হাজির হয়! যতটা সাবধানে থাকা যায়। দুজনে থাকেন, একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সে থাকে ভিন রাজ্যে। প্রয়োজন হলেও ছুটে আসতে পারবে না। আর এই লকডাউনে তো কেউই কোথাও যেতে পারছে না। এই সময় আসার জন্য মেয়ের টিকিট তো কাটাই ছিল ফ্লাইটে। নাতির স্কুলের পরীক্ষা হয়ে যাওয়ায় বাপেরবাড়ি এসে কিছুদিন কাটাবে ঠিক করেছিল। তো সে টিকিট ক্যান্সেল হয়ে গেল। না টিকিট ক্যান্সেল হল না, ওদের আসাটা ক্যান্সেল হল। টিকিটের টাকা জমা পড়ে রইল সংস্থার ঘরে। পরে আসা-যাওয়ায় এডজাস্ট হবে। ভেবেছিলেন মেয়ে এলে এই অবসরকালে ভালো কাটবে কটাদিন। নাতিটাকে নিয়ে দোকানবাজার যাবেন, পার্কে খেলতে নিয়ে যাবেন। তা সব আশা জলাঞ্জলি।
এদিকে রিটায়ারমেন্টের পর
আয়ের উৎসমুখ বন্ধ হওয়ায় একটু হিসাব করে চলতে হচ্ছে। এতদিন একদিকে পাইপলাইন
দিয়ে ঢুকেছে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়েছে, তাই অতশত হিসাব করতে হয়নি। দুজনের
সংসার সামলেও শখ, সাধপূরণে
কোনো অসুবিধা হয়নি কোনোদিন। হঠাৎ করে আয়ের উৎস বন্ধ হওয়ায় আয়ব্যয়ের ব্যালেন্স রাখা
সমস্যা হয়ে উঠছিল ক্রমে। কারণে অকারণে খিটিমিটি বেধে যাচ্ছিল। সম্পর্ক আগে ভালোই
ছিল দুজনের মধ্যে। রিটায়ারমেন্টের পর খুব ঘুরে বেড়াবে এসব কতই প্ল্যান করেছিল
দুজনে মিলে। কিন্তু হঠাৎ ডাকা এই লকডাউনই যত নষ্টের মূল। বর্তমানে সে সম্পর্ক
প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। এতদিন সমীরবাবুকে অফিসে পাঠিয়ে সারাদিনের দায়ে রত্নাদেবী
ফ্রি থাকত আর এখন? “এটা
দাও, ওটা
দাও, আমার
এটা কোথায়, ওটা
কোথায়?” তার
সঙ্গে আছে মুহুর্মুহু চা। অফিসে বারেবারে চা খাওয়ার একটা বদ অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে
সমীরবাবুর। আর সেটা যে রত্নার বিরক্তির কারণ হতে পারে এ তো তিনি ভাবতেও পারেন না।
বলেই ফেলেন গিন্নীকে,
“চা করায় কী পরিশ্রম লাগে? জলটা গরম করে চা-পাতাটুকু তাতে ফেলে দিলে চা তো আপনাআপনিই
হয়। তাতেও বিরক্তি!” এই বিরক্তি দেখলে
আবার সমীরবাবুর মাথা গরম হয়ে যায়। নিজে রান্নাঘরে গিয়ে চা করার বৃথা চেষ্টাও যে
করেননি তিনি তা নয়। কিন্তু সেখানে কিছুই তিনি খুঁজে পান না। ও এরিয়াটায় কোনোদিন
যে তার পা পড়েনি আগে। আর তখন রত্নাকে জিজ্ঞেস করতেই হয়, “চা কোথায়, চিনি কোথায়, সাঁড়াশি
কোথায়?” আর তাই নিয়ে লেগে যায় আরও বচসা।
রত্না বলে, “ক্ষ্যামা
দাও আমায়। ওখানে ঢুকে আর ছয়ছেঁচুড়ি করতে যেও না, আমিই করে দিচ্ছি চা”। এ যেন সেই
মনসাদেবীকে চাঁদসদাগরের বাঁ-হাতে পুজো দেবার মত। সমীরবাবুকে অভক্তির চা-টুকু গিলতে
হয়। গলা দিয়ে নামতে চায় না, আবার নেশাও কাটে না চা না খেলে। এদিকে বাইরেও দোকানপাট বন্ধ, উপায় নেই যে
বাইরে গিয়ে চা খেয়ে আসবেন। বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকা মানেই অশান্তি। কিন্তু লকডাউনে
বাড়ি থেকে বেরোবার উপায় নেই। একমাত্র সহজ রাস্তা হল বাজার। এতে কারও কিছু বলার
নেই। তাই রোজ বেশ কিছুটা সময় বাজারের ছুতোয় বাইরে কাটিয়ে আসেন তিনি। তার ফল ফলল
অচিরেই।
কোভিড আক্রান্ত হলেন সমীরবাবু। এতদিন বাজার বাদে
বাকি সময় গৃহবন্দী ছিলেন এবার ঘরবন্দী হলেন। বাড়িতে কোভিড রুগী থাকায় কাজের
লোকেদের ছুটি দিতে হয়েছে। সবটাই রত্নাকে করতে হয়। চাপ পড়েছে তার ওপর। একে এই ক’মাসে
সম্পর্ক তলানিতে, তার
ওপর ঘাড়ে রাজত্বের কাজ। বাজারের দায়িত্বটুকুও চাপে তার ওপর। বয়স তো তারও
হয়েছে। সবদিক সামাল দিতে হিমশিম অবস্থা। আর যত কষ্ট হয়, যত অসুবিধা
হয়, রাগ
তত গিয়ে পড়ে তার স্বামীর ওপর। আবার কথায় কথায় মেয়েকে ফোন করে সব জানানোর একটা
বদ অভ্যাস আছে রত্নার। সমীরবাবু জানেন তা, বারণ করেন মেয়ের সঙ্গে বলতে। বলেন, “ওর নিজের
একটা সংসার আছে, বাচ্চা
আছে, এই
লকডাউনে বাচ্চাদের ঘরে আটকে রাখা কতটা কঠিন, আর তাছাড়া প্রত্যেকেরই সংসারের একটা
ঝামেলা থাকে। মিছিমিছি ওকে ব্যতিব্যস্ত কোরো না”। সে কে শোনে কার কথা। সমীরবাবুর
এই রত্নাকে চিনতে বড় অসুবিধা হয়। আগে অফিস থেকে ফিরলেই এক গ্লাস জল নিয়ে সামনে
হাজির হত। কখনও বা বলতো,
“ আজ তোমাকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে।” তাতে হাজার ক্লান্তিও উধাও
হয়ে যেত নিমেষে। হাতমুখ ধুয়ে এলেই
চা-জলখাবার। মাঝেমাঝেই নতুন নতুন জলখাবার করে রাখত। সমীরবাবু হাসতে হাসতে বলতেন, “অভ্যাসটা
খুব খারাপ করে দিয়েছ,
রাস্তায় আসতে আসতে মনে হয় আজ তুমি কী করে রেখেছ”। দুজনেই হেসে উঠতেন তাতে।
সমীরবাবু ভাবেন, “তাহলে
কী টাকাপয়সাই সব সুখের চাবিকাঠি? এর বাইরে কী আর কিছুই নেই? কষ্টে রেখেছি তা তো নয়, একটু হিসাব
করে চলতে হয় এই যা। আর শখ,
আহ্লাদ করে খরচ করতে এখন ভয় হয়। তাছাড়া শখ করার উপায়ও তো নেই, সারাদিন ঘরে
বসে কী শখই বা মেটাবে?
এদিকে বয়স হচ্ছে,
কার কখন কী হয়,
তাই টাকাপয়সা হাতে থাকা দরকার। তাতে বুকে বল ভরসা থাকে। চাকরিকালীন কিছু হলে
তো অফিসই সব খরচ দিত কিন্তু অবসরকালে তো আর পাব না! পাব, তবে
সামান্যই। এটা তো রত্নার বোঝা উচিত।”
কিন্তু রত্নাদেবী কিছুই যেন
বুঝতে চান না। সমীরবাবুর কোভিড হলে দুশ্চিন্তা, ভয় সব ছাপিয়ে তার মধ্যে বিরক্তিটাই
দেখা যায় বেশি। মেয়েকে ফোন করে বলেন, “তিনি তো রোগের অছিলায় ঘরের দরজা
বন্ধ করে আইসোলেশনে রইলেন। যত দায় যেন আমার।” মেয়ে এমনিতেই বাপভক্ত। তার ওপর
বাবার এরকম শারীরিক অবস্থায় মায়ের এই মানসিকতা তার ভাল লাগে না। তাছাড়া অতদূর
থেকে সে সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকে। মাকে সে তাই রীতিমতো বকাবকি করে। “চারিদিকে
মৃত্যু-মিছিল চোখে পড়ে না তোমার? বাবার বয়স হয়েছে, কত কী-ই তো হতে পারে। কাছে গিয়ে
সেবা করতে বলছি না তোমায়,
সেটা এই রোগে সম্ভবও নয়। তাই বলে অসুস্থ মানুষটার প্রতি একটু সহানুভূতিও
থাকবে না তোমার?” রত্নাদেবী
বলেন, “সবই
তো করছি, বাকি
আর কী রাখছি বল দিকিনি “। কিন্তু কীভাবে যে তিনি করছেন তা তো আর অতদূর থেকে মেয়ে
দেখতে পাচ্ছে না। ঘরে তো ঢোকেনই না, তা নিয়ে এ পরিস্থিতিতে কিছু বলারও
নেই কিন্তু বাইরে থেকেও জিজ্ঞেস করেন না “কেমন আছো তুমি? টেম্পারেচার
দেখেছ? কিংবা
অক্সিমিটার দিয়ে স্যাচুরেশন লেবেলটা দেখো”। এটুকুই তো। তা না, খাবার দেবার
সময় হলে দরজা একটু ফাঁক করে খাবারের থালাটা ঠেলে দেন ঘরের ভেতর। সমীরবাবুর রোগের
যন্ত্রণার থেকেও রত্নার এমন আচরণে যন্ত্রণা হয় বড় বেশি। ভাবেন, “এর চাইতে
খাবারের থালাটা বাইরে রেখে দরজায় টোকা দিয়ে বলে যেতে পারত। আমি নাহয় ও চলে গেলে
দরজা একটু ফাঁক করে থালাটা নিয়ে নিতাম”। এ যেন বড় তাচ্ছিল্য মনে হয় সমীরবাবুর।
দিনের পর দিন এই তাচ্ছিল্য মন থেকে মেনে নিতে পারেন না তিনি। রোগটা তার ক্রমে জটিল
হয়। বাড়াবাড়ির পর্যায়ে। জামাই ওখান থেকেই হসপিটালের ব্যবস্থা, অ্যাম্বুলেন্সের
ব্যবস্থা করে দিল। হসপিটালে যাবার সময় তিনি হেঁটেই উঠলেন অ্যাম্বুলেন্সে। রত্না
বাড়িতে একা থাকবে, মনে
তার দুশ্চিন্তা। পিছন ফিরে একবার দেখতে গেলেন তাকে। একটু আশ্বাস দিতে চাইলেন যেন, “ ঘাবড়িয়ো না, আমি ফিরে
আসব। এই ভাইরাস দূর হলে আমরা দু’জন শুধু বেড়িয়ে বেড়াব।”
কিন্তু এ তিনি কী দেখলেন! দেখলেন, রত্না
দরজায় জল ঢালছে! আপদ বিদায় করছে! বিমর্ষ মনে তিনি চললেন হসপিটালের পথে। ক্রমে তার
আরও অবনতি হতে লাগল। কোনো ওষুধেই রেসপন্ড করছিল না। আসলে বাঁচার ইচ্ছেটাই চলে গেলে
রোগটা বড় কঠিন হয়ে যায়। তাকে ফেরানো দুষ্কর হয়ে যায় তখন।
কিছুদিন পর ভিন রাজ্য থেকে
মেয়ে অনলাইনে ভিডিওতে বাবার শেষকৃত্য দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
️
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post