অন্য
অ্যাডভেঞ্চার
শেলী
ভট্টাচার্য
Image Courtesy: Google Image Gallery |
“তুই ঠিক কী বলতে
চাইছিস বলতো?”
তনিকার প্রশ্নটা শোনার পরেও
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিল প্রিয়ল। ওর কপালে ফুটে উঠছিল গভীর কোনও এক পরিকল্পনার
কল্পরেখা। সরু চোখের দৃষ্টিতে দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট। চোয়াল শক্ত করে তনিকার দিয়ে চেয়ে
উত্তর দিল প্রিয়ল,
“একবার চেষ্টা করবই
আমি। এমন একটা হীরের মতো রত্নভান্ডার যখন আমার হাতে এসে পড়েছে, তখন তাকে আমি তুলে ধরবই সবার সামনে।”
বন্ধুর কথায় হাঁ হয়ে চেয়ে
থাকে তনিকা। প্রিয়লের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব আজ নতুন নয়। ও যে বরাবরই অন্যদের থেকে
আলাদা এক মানুষ, তা ও উপলব্ধি করতে পেরেছিল সাত বছর আগেই।
বলতে গেলে, সেটাই ছিল ওদের মজবুত বন্ধুত্বের মূল কারণ। নইলে
বর্তমান পৃথিবীতে বন্ধু শব্দটা এখন ভীষণ অস্বচ্ছতায় ঢাকা। অবিশ্বাসের ছোবল পদে
পদে।
তনিকাকে চুপ করে থাকতে দেখে
প্রিয়ল আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল
“মানুষকে টাইম ট্রাভেল
করানোর চেষ্টা করব আমি। তবে অন্যভাবে।”
চোখ বড় বড় করে, ভুরু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল তনিকা
“এসব কী বলছিস তুই?”
“দ্যাখ, এটা আমি কেন তুইও হয়তো বুঝতে পারছিস যে, পৃথিবীর আয়ু
আর বেশি বছর নেই। এমনিতেই আমরা ধ্বংসের মুখে বসে আছি। তার উপরে এই নতুন রোগ এসে
মানুষকে প্রায় পাগল করে দিয়েছে। কারণ যাকে সম্বল করে মানুষ তার সহজাত সমস্ত আনন্দ
থেকে দূরে সরে এসেছে, তার ব্যবহারের উপর রেস্ট্রিকশন জারি
করা হয়েছে। এটাই সুযোগ। এই সময় তাদের সামনে যদি আমি কিছু নির্মল আনন্দের রসদটুকু
হাজির করতে পারি, অন্তত চেষ্টা করি ...”
বলতে বলতে আনমনে থেমে গেল
প্রিয়ল। যতই দৃঢ় হোক ওর সংকল্প, যতই উদার হোক ওর ইচ্ছাগুলো,
তনিকা জানে এর কদর এখন পৃথিবীতে আর নেই। তাইতো আগের মহামূল্যবান
সৃষ্টিগুলোকে সংরক্ষণ করার নূন্যতম প্রয়াসটুকুও করেনি এখনকার মানুষ। ভাগ্যিস,
প্রিয়লের এক পরিচিত সূত্রে রায় মিউজিয়ামের হারিয়ে যাওয়া
রত্নভাণ্ডারের কিছু সম্পদ ওর হাতে এসে পৌঁছেছে।
প্রিয়ল চলে যাওয়ার পরে একনাগাড়ে
আকাশের দিকে চেয়েছিল তনিকা। পশ্চিম আকাশের ক্যানভাসে তখন দিন রাত্রির পালাবদলের
দৃশ্য চলছে। তনিকা ওর দাদুর কাছে গল্প শুনেছিল, বহু বছর আগে এই সময়
নাকি প্রকৃতিকে অপরূপ দেখতে লাগত। গৃহমুখী পাখিদের কোলাহলে গমগম করত আকাশ বাতাস।
কমলা আলোর রেণু ছড়িয়ে পড়ত পশ্চিমাকাশ জুড়ে। ভাবতেও অবাক লাগে তনিকার, এরকম সরস ভালোলাগার সম্ভারও ছিল তখন পৃথিবীর বুকে। এখনকার গাছপালাগুলো
কেমন যেন নিষ্প্রাণ। পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা সমস্ত জীবকে বৃষ্টির দেখা পাওয়ার জন্য
মাসের পর মাস অপেক্ষা করে থাকতে হয়। আধুনিকতার অত্যধিক চাপে বিষাক্ত বাতাস এখন
মাত্রাতিরিক্ত গরম। বাতানুকূল যন্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা এখন প্রায় সবসময়ই। শীতের
দেড় মাস মাত্র মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। তাও মুখে আল্ট্রা
লেয়ারের মাস্ক সেঁটে। তনিকার মনে হয়, এখন সমস্ত পৃথিবী যেন
মানুষের আধুনিকতার বিরুদ্ধে এক জোট হয়ে গেছে। অনিয়মিত বৃষ্টি, অপ্রতুল সূর্যালোক, শুষ্ক উষ্ণ বাতাস ... এসব যেন
তার ভয় দেখানোর এক একটা অস্ত্র।
এতকিছুর সম্মুখীন হওয়ার পরেও
মানুষ বিন্দুমাত্র বদলায়নি। স্বার্থপরতার ক্রম হ্রাসমান গণ্ডীর মধ্যে নিজেকে
দিব্যি ডুবিয়ে রাখে নিত্য। তাদের জীবনে একমাত্র সঙ্গী হল সুপার অ্যানড্রয়েড ফোন।
মানুষের জন্ম, মৃত্যু, এমনকি মৃত্যু
পরবর্তী কার্যকলাপের জন্যও সেই ফোনে অ্যাপ দেওয়া রয়েছে। সেখানে ডেটা এন্ট্রি করলেই,
কিছু রোবট এসে মৃত দেহের দাহ করার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। মানুষের মধ্যে
শোক, আনন্দ উভয় অনুভূতিই এখন বরফের মতো শীতল হয়ে গেছে। নিজের
সংকীর্ণতার বেড়িতে আবদ্ধ হয়ে গ্যাজেট নির্ভর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে মানুষ। এরকম
পরিস্থিতিতে ধুঁকে ধুঁকে এগোচ্ছিল সময়, ঠিক তখনই যন্ত্র
নির্ভর মানব সভ্যতাকে থমকে দাঁড় করিয়ে দিল ‘যান্ত্রব’ রোগটার দাপট।
দেশ বিদেশের বিজ্ঞানীদের
বক্তব্য, অতিরিক্ত অ্যানড্রয়েড ফোনের ব্যবহারের জন্যই নাকি এই রোগের
উৎপত্তি হয়েছে। অত্যধিক রেডিয়েশন একনাগাড়ে মানুষের স্মৃতিশক্তির উপর প্রভাব ফেলছে।
তাদের ঘুমের পরিমাণ কমে গিয়ে হজমের সমস্যা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, চোখের কর্নিয়াতে অদ্ভুত এক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অস্বচ্ছতার আস্তরণে ঢেকে
যাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি।
বিগত কয়েক মাসে এই রোগের হার
তুমুল হারে বেড়েই চলছিল। কতরকম প্রটেকটিভ গ্লাস আর রে প্রটেকশন গ্যাজেট আবিষ্কার
হল দু-তিন মাসের মধ্যে। কিন্তু সমাধান সূত্র বের করা গেল না। মানুষের স্মৃতিশক্তির
উপর চাপ পড়ায় সে অফিসের বা ঘরের দৈনন্দিন কাজের মধ্যে নিত্য ভুল করে চলেছে। কারও
কারও ক্ষেত্রে আবার রোগের প্রভাব এতটাই প্রকট হচ্ছে যে, নিজের একান্ত ব্যক্তিগত তথ্যও সে ভুলতে বসেছে।
এই পরিস্থিতিতে এক্সপার্টদের
সাজেশন একটাই, যতটা সম্ভব সুপার অ্যানড্রয়েড ফোন থেকে
দূরে থাকতে হবে। পাশাপাশি কমাতে হবে গ্যাজেটের ব্যবহারও। এই সমাধান সূত্র
সংবাদমাধ্যমে প্রচার হতেই মানুষ পাগলের মতো প্রলাপ বকতে শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে
রোগীর সংখ্যা এবং রোগের প্রভাবের পরিমাণ বাড়তে থাকায়, এখন
অবশ্য কিছুটা চেষ্টা করছে মানিয়ে নিতে। নিরুপায় হয়ে তাদের সারাক্ষণের সম্বল
ফোনটাকে দিনের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে চার থেকে ছয় ঘন্টা ব্যবহার করছে। যদিও
বিশেষজ্ঞরা এখন তার ব্যবহারের মাপকাঠি আরও কমিয়ে দিয়েছেন। ফলতঃ মানুষ বাকি সময়
দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নিজের মানসিক জগতের শূন্যতার মধ্যে। পরিবার কনসেপ্ট এখন খুব কমই
টিকে আছে। বিপুল জনসমুদ্রে সব বিচ্ছিন্নভাবে দীপের মতো বসবাস করে। তাই মনুষ্য সঙ্গ
বলতে গেলে, প্রায় কিছুই নেই। অবশ্য সেক্ষেত্রেও অনেক সমস্যা
ছিল। এখন দুটি মানুষের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কও গড়ে ওঠে না। সবকিছুই কেমন যেন
বিষাক্ত ঘৃণা, লোভ আর প্রতিশোধস্পৃহার জালে আবদ্ধ। নিজের মন
মতো না হলেই, অধৈর্য্য
আক্রমণ করে বসে মানুষ। প্রায় ছয় দশকের বেশি সময় ধরে ফোনের বিভিন্ন সাইটে একটানা
থ্রিলার দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে মানুষ। গান শোনা মানেও উগ্র রক সং ছাড়া তাদের
পছন্দ তালিকায় অন্য কিছুই থাকে না। সেই উত্তেজনা প্রবাহ মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে
এখন একটি অতি উত্তেজক অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। স্নিগ্ধ স্বাদের কোনও কিছুতে
এখন আর আনন্দই পায় না তারা। বিজ্ঞের মতো ভুরু উঁচিয়ে বলে এগুলোই নাকি ফিউচারিস্টিক
ম্যাটার। ভবিষ্যৎকে সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য যে, আরও কতরকম
সহজ সুন্দর উপায় থাকতে পারে, তা তাদের ধারণার বাইরে।
ভাবনার গভীরে ডুবে প্রিয়লের
কথা আবার উঁকি দিল তনিকার মনে। ও প্রশ্ন করছিল আজ
‘তুই তো দেখলি,
তোর মনে হয় না প্রায় দেড়শো বছরের আগের এই সৃষ্টিগুলোও ফিউচারিস্টিক
ছিল? কিন্তু কত সহজ সরল সুন্দর সেই দৃষ্টিভঙ্গি!’
একটুও ভুল বলেনি প্রিয়ল।
তনিকারও তাই মনে হয়েছে।
ওয়েব সাউন্ডের তীব্রতায় ভাবনা
থেকে বেরিয়ে এসে মুখ ফেরাল তনিকা। সুপার অ্যানড্রয়েডের স্ক্রিনে প্রিয়লের নাম ভেসে
উঠছে। মনে মনে ভাবল ও, এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেল ও ফিল্ম মেকিং অফিসে?
ওখানে ফাইনাল কথা হলে জানাবে বলছিল। ভাবনার মধ্যেই কলটা তুলল ও।
ওপাশ থেকে প্রিয়লের উচ্ছ্বসিত গলার স্বর ভেসে আসছে।
“তনু, দারুণ একটা খবর আছে রে। আমি ভাবতেও পারিনি এরকম একটা সুযোগ আমার হাতের
মুঠোয় চলে আসবে। তোকে বলেছিলাম না, ভালো কাজ করার ইচ্ছা এখনও
অনেকেরই আছে। হয়তো জনবলের অভাবে এগোনোর সাহস দেখাতে পারে না।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে
উত্তেজনায় আনন্দে রীতিমতো হাঁপাচ্ছিল প্রিয়ল।
অন্যদিকে তনিকার কৌতূহলে
অস্থির অবস্থা। ও হুড়মুড়িয়ে প্রশ্ন করল
“আরে হয়েছে টা কী বলবি
তো!”
“সত্যেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়কে চিনতিস তুই?”
“চিনব না কেন? দাদুর কাছে ওঁর লেখার অনেক প্রশংসা শুনেছিলাম। ওঁর অ্যাকাডেমি পুরস্কার
প্রাপ্ত বইটা দাদু অনেকবার পড়তেন। সেখানে লেখা একটা কথা আমায় খুব বলতেনও। আমার মনে
আছে এখনও,
‘যে কর্মযজ্ঞ বৃহৎ
স্বার্থে সংঘটিত হওয়ার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়, তাকে পুষ্টি
জোগান স্বয়ং মহাশক্তিমান।’
আমার কাছে এখনও ওঁর বেশ কিছু
বই সংগ্রহে আছে।
কিন্তু, তাঁর সঙ্গে তোর সুযোগের কী সম্পর্ক, তা তো বুঝতে পারছি
না।”
তনিকা বিস্ময়ে বলল।
“আমরা জানতামই না তাঁর
নাতি শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় একজন লেখক ও চিত্র পরিচালক।”
“তাই নাকি? কখনও নাম শুনিনি তো!”
“শুনবি কি করে?
থ্রিলার ময় বিনোদনের জগতে উনি যে অন্যরকম মানুষ। বৃহৎ স্বার্থে কাজ
করার বীজ সম্ভবত ওঁর রক্তে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। ছোটখাটো কিছু শর্টফিল্ম করেছেন
তিনি, যা সম্পূর্ণই ভিন্ন ঘরানার।
আজ যখন মিঃ ঘোষের অফিসে আমার
প্রস্তাব নিয়ে ঢুকছিলাম আমি, বাইরে থেকেই কিছু বাকবিতন্ডার
স্বর ভেসে আসছিল। ভেতরে ঢুকে আমি তো থ। এ কাকে দেখছি আমি! ভদ্রলোককে একবার
ন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখেছিলাম আমি। তাই মুখ চিনতাম। সেখানেও অবশ্য ওঁকে
নিয়ে তেমন মাতামাতি ছিল না। এককোণের চেয়ারে নিপাট সাদামাটা পোষাক পরে বসেছিলেন
ষাটোর্ধ ভদ্রলোক। ওঁর অতি সাধারণত্বই আমাকে অসাধারণ ভাবে আকৃষ্ট করেছিল সেদিন।
হাইটেক ইলিউমিনেসন টেকনিকে ঝকঝকে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেখানে। সম্মেলনের মঞ্চ
জুড়ে আতিশয্য আর আভিজাত্যের দুর্দান্ত নীরব লড়াই চলছিল উপস্থিত ব্যক্তিত্বগণের
মধ্যে। যেখানে এখন মানুষ তাদের পূর্ব পুরুষদের সমস্ত মূল্যবান শিক্ষা, সৃষ্টি, সৌজন্যবোধকে দলিয়ে উদ্ধত মস্তকে এগিয়ে চলেছে,
সেখানে এমন একজন গুণী অথচ বিনয়ী মানুষকে অবজ্ঞা করাটা তেমন কোনও
অস্বাভাবিকতা নয়।
আজও মিঃ ঘোষ কতকটা সেরকমই
ব্যবহার করছিলেন ভদ্রলোকের সঙ্গে। উঁচু গলায় বলছিলেন
‘আপনি কি আমায় পাগল
ভেবেছেন, এসব কাহিনিকে টাকা পয়সা দিয়ে ফিল্ম করার কথা ভাবব
আমি?’
আমি কিন্তু তখনই বুঝে
গিয়েছিলাম, আমার প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে কী আসতে চলেছে। কারণ, শুভেন্দুবাবুর কাছে অভিজ্ঞতায় আমি শিশু ও যোগ্যতায় চুনোপুঁটি। তাই ভেতরে
গিয়ে প্রস্তাবটা না দিয়ে বরং ফোর ডি স্ক্রিনের থিয়েটার হলটা একদিনের জন্য পেতে
পারি কিনা জিজ্ঞাসা করেছি।”
প্রিয়লকে থামিয়ে দিয়ে বিস্ময়ে
জিজ্ঞেস করল তনিকা
“ওখানে তো ফিল্ম
দেখানো হয়। তুই ওটা নিয়ে কী করবি? তাও আবার একা!”
“একা কে বলল তোকে?”
প্রিয়লের গলায় আনন্দের চাপা
উচ্ছ্বাস।
“মানে?”
প্রিয়ল বুঝতে না পেরে
জিজ্ঞাসা করল।
“শুভেন্দুবাবুর সঙ্গে
আমার কথা হয়ে গেছে। জানিস উনি বললেন, ওঁর দাদু সত্যেন্দ্রবাবুরও
প্রিয় পরিচালক ছিলেন মিঃ রায়। তাঁর মূল্যবান সৃষ্টিগুলো আমার কাছে দেখতে পেয়ে
শিশুর মতো আনন্দিত হয়েছেন তিনি। আমায় বলেছেন, আমার এই টাইম
ট্রাভেলের প্রজেক্টে উনি থাকবেন। আমি তোকে বলেছিলাম না, এখনও
পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাদের মধ্যে মূল্যবোধের অর্থ
বিকিয়ে যায়নি। শুভেন্দুবাবু তাদের কয়েকজনের নাম বললেন আমায়। তাদেরকে একত্রে ওঁর
টিম মেম্বারও বলতে পারিস। আরও বললেন, ওঁর যে স্টুডিও সেট আছে,
তাকে কাজে লাগাবেন।”
তনিকা আনন্দে বলে উঠল
“আমি যাব সেখানে। কবে
যাবি বল?”
“আমি ভাবছি, আর দেরি করব না। এখন মানুষের হাতে তাও একটু অবসর সময় আছে। এই রোগের ভয়
থাকতে থাকতেই, প্রজেক্টটাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসতে হবে।”
বন্ধুকে সমর্থন করে জোরের
সঙ্গে বলল তনিকা
“ঠিক বলেছিস। ওঁর
বাড়িটা কোথায় রে?”
“কলকাতা শহর থেকে একটু
দূরে, একটা গ্রামে।”
অবাক হয়ে প্রশ্ন করল তনিকা
“গ্রামে থাকেন?”
“বললেন, শহুরে হাওয়ায় নাকি ওঁর সমস্যা হয়। তাই আজ প্রায় তিন দশক ধরেই উনি ওদিকে
চলে গিয়েছেন। ওই গ্রামের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন উনি। এখন রিটায়ার্ড।
তুই তো জানিস, এখন মানুষের দুটো শ্রেণী, শহুরে আর গ্রাম্য। সত্তর
শতাংশেরও বেশি মানুষ এখন শহুরে। অর্থনীতিতে তীব্রভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ ছাড়া
গ্রামে কেউ সাধ করে থাকে না। আমার ভেবে অবাক লাগে, এমন
মানুষও থাকেন সেখানে।
শুভেন্দুবাবু বললেন, ওখানে নাকি যান্ত্রব রোগটার প্রভাব পড়েনি।”
“তাই নাকি? কিন্তু তা কিকরে সম্ভব?”
তনিকা বিস্ময়ে হতবাক।
“আমরা যে সংবাদমাধ্যম
থেকে সমস্ত খবর পাই, তাদের ওদিকে যাতায়াতই নেই। ওদেরকে মানুষ
বলেই হয়তো মনে করে না শহুরে জগৎ। তাই হয়তো শুভেন্দুবাবুর কথাগুলো আমাদের কাছে
বিস্ময়কর ঠেকছে। তবে ভদ্রলোকের কথায় যেন ম্যাজিকের মতো আকর্ষণ আছে রে। আমি তোর মতো
অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলাম। মৃদু হেসে রহস্যময় গলায় উনি বলেছিলেন, সেটা জানতে হলে একবার ওখানে আসতে হবে যে।”
অধৈর্য্য হয়ে বলে উঠল তনিকা
“এই শোন না। আমি আর
থাকতে পারছি না। প্লিজ কালই নিয়ে চল আমায় ওখানে।”
“বেশ, তুই বরং বুলেটিন স্টেশনে কাল চলে আয়। সকাল সাতটার মধ্যে আসবি, নইলে দেরি হয়ে যাবে কিন্তু।”
প্রিয়লের সঙ্গে কথা হওয়ার
পরেই ভয়েস এলার্মে টাইম সেট করল তনিকা। আগামীকাল ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে ওকে। রেডি
হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে বের হতে নইলে দেরি হয়ে যাবে। শহুরে মানুষদের কাছে ভোর পাঁচটা
হল মধ্যরাত্রি। তাই অ্যাপের ইমার্জেন্সি সেকশনে ঢুকে কার বুক করল তনিকা। মনে মনে
ভাবছিল ও, আজ রাতে উত্তেজনায় আদৌ কি ঘুমাতে পারবে ও?
হঠাৎই তনিকার মনে পড়ে গেল, ওঁর দাদুর কাছ থেকে প্রাপ্ত কিছু বইয়ের কথা। সেখানে ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম’
বলে একটা ছবি আঁকা গল্পের বই ছিল। ওটা তনিকার বরাবরই খুব প্রিয় বই।
দারুণ একটা বেড়াতে যাওয়ার কাহিনিকে রূপকথার মতো লেখা আছে সেখানে। পড়লেই মনে হয়,
এই বুঝি ও দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেতের বুক চিরে কু-ঝিকঝিক শব্দে
ট্রেনে করে ঘুরতে যাচ্ছে। এসব দৃশ্য অবশ্য ওর পক্ষে কল্পনা করাও শক্ত ছিল, যদি না বইটাতে গল্পের পাশাপাশি সেসব ছবি আঁকা থাকত। দাদুর সঙ্গে বসে একসময়
এই বইটা খুব পড়ত ও। পাশাপাশি দাদুর মুখে শুনত ওঁর ছেলেবেলার সময়ের গল্প। সেই
স্মৃতি মনে করলেই মুহূর্তে ম্যাজিকের মতো মন ভালো হয়ে যায় তনিকার। ও ভুলে যায়
শহুরে হিংসা, খুনোখুনি, স্বার্থপরতার
যন্ত্রণাময় জীবনের রোজকার দৃশ্যগুলোকে।
আগে বেড়াতে যাওয়ার আগের দিন এই
বইটা বের করে পড়ত তনিকা। আজ ওর খুব মন চাইছে, বইটা বের করতে।
রিমোট দিয়ে আলমারির লক খুলে বইটা বের করতে যায় ও। ঠিক তখনই একটা মেমরি চিপ ওর
পায়ের কাছে এসে পড়ে। নিচ থেকে ওটা কুড়িয়ে নিয়ে দেখে, ওর লেখা
‘অন্য অ্যাডভেঞ্চার’ গল্পটার মেমরি
ওটা। ও যে চুপিচুপি একটু আধটু লেখে, সেটা সাহস করে কাউকে
জানায়নি এখনও। হয়তো এখনকার দিনে এমন রূপকথার মতো গল্প শুনে লোকে ব্যঙ্গ করবে,
তাই মেমরি চিপটাকে এভাবেই রেখে দিয়েছিল। এখন তো বই বলে আর তেমন কিছু
হয় না। যার যে বই লাগে, সে তার মেমরি চিপ কিনে আনে দোকান
থেকে। তারপর সুপার অ্যানড্রয়েডে গুঁজে দেয়। বইগুলোর অডিও চলতে থাকে। খুব কম বই এখন
চিপের মধ্যে টেক্সট ফর্মাটে থাকে। বসে পড়ার ধৈর্য্য এখন মানুষের নেই বললেই চলে।
কী মনে করে চিপটাকে ওর সুপার
অ্যানড্রয়েডের সাইড এন্ট্রিতে ঢোকাল ও। মনে মনে ভাবল, কাল ওখানে যেতে যেতে পড়বে। সম্ভব হলে, শুভেন্দুবাবুকে
একবার দেখাবে।
ভোরের দিকে এমনিতে সুনশান
রাস্তাঘাট। তাই দেরি করে বের হলেও মোটামুটি টাইমে পৌঁছে যাবে, ভাবছিল তনিকা। গতকাল রাতে ঘুমই আসতে চাইছিল না ওর। এমনিতেই ও লেট রাইজার।
এত তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাসই নেই। তার উপর আজকের এই বিপুল উত্তেজনার প্রভাব।
সবমিলিয়ে দুটোর পরে ঘুম এসেছিল। প্রায় কাঁচা ঘুমটাই ভেঙে গিয়েছিল এলার্মের শব্দে।
সেটাও বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়েছিল ও। তাতেই দেরিটা হয়ে গিয়েছিল। এরপর হুড়োহুড়ি করে
তৈরি হয়েছে ও।
ভাবতে ভাবতেই বুলেটিন স্টেশন
সংলগ্ন চার্চটা ক্রস করল তনিকা। আরেকটু এগোতেই ওর কানে ভেসে এল ট্রেনের নাম ঘোষণার
ঘোলাটে শব্দ। প্লাটফর্মের ভেতরে ঢুকতেই চার নম্বর প্লাটফর্মের উল্টোদিকের লেসার
ডিসপ্লে বোর্ডের উপর নজর পড়ল তনিকার। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। তড়িঘড়ি ব্যাগ থেকে
বের করে দেখল, প্রিয়লের কল।
“হ্যালো, কোথায় তুই?”
“আরে আমার লেট হয়ে
গেছে। এই ঢুকছি। তুই শিগগিরই হীরক এক্সপ্রেসে চেপে পড়। আমি অনলাইন টিকিট বুক করে
নিয়েছি। তোরটা মেলে পাঠিয়েও দিয়েছি। চেক করে নে, ওখানে
প্লাটফর্ম নম্বর দেওয়া আছে। তুই উঠে পড়। আমি দৌড়ে এসে উঠছি।”
বলেই ফোনটা কেটে দিল প্রিয়ল।
তনিকা সবে ওকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, আর কত দেরি হবে ওর।
এমন সময় একজন ভদ্রলোকের রাশভারি গলার স্বর শুনতে পেল ও।
“হীরক এক্সপ্রেসে যাবে?”
ঝটিকায় মাথা ঘুরিয়ে নিল
তনিকা। সৌম্য চেহারার বয়স্ক একজন ওকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করছেন। হয়তো ওর পেছনেই
ছিলেন, ওর সঙ্গে প্রিয়লের কথা শুনেছিলেন।
মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ জানাল তনিকা। ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন
“আমিও যাব। চলো।”
বলে ডানহাত বাড়িয়ে দিয়ে প্ল্যাটফর্মটার
দিকে ইঙ্গিত করলেন।
ছুটির দিন বলেই সম্ভবত বেশ
ফাঁকা ছিল ট্রেনটা। কামরায় উঠে টুক করে একটা বসার জায়গাও পেয়ে গেল তনিকা। ভদ্রলোকও
এসে বসলেন ওর ঠিক পাশেই। ট্রেনটা ছাড়বে ছাড়বে করছিল, তনিকার
চোখমুখ ছেয়ে গেল উদ্বিগ্নতায়। ও টেনশনে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে শুরু করে দিয়েছে
ততক্ষণে। এমন সময় প্রিয়লের কল ঢুকল।
“আমি ট্রেন মিস করেছি
রে। তুই চলে যা। আমি পরের ট্রেনেই আসছি।”
তনিকার তো হতভম্ব অবস্থা।
সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় ও একা নেমে কী করবে, ভেবে অস্থির হয়ে
উঠল। ততক্ষণে ট্রেনের দরজাগুলো অটো ক্লোজ হয়ে গেছে। নামবারও আর উপায় নেই। ওর
চোখমুখের অবস্থা দেখে, পাশের ভদ্রলোক হাতের ইশারায় ওকে কাছে
ডাকলেন। কতকটা অযাচিতভাবেই প্রশ্ন করলেন “কোথায় যাবে তুমি?”
তনিকার ততক্ষণে খেয়াল হল, গ্রামের নামটাও প্রিয়লের কাছে জানা হয়নি। এদিকে ট্রেন চলতেই নেটওয়ার্কের
সমস্যা শুরু হয়ে গেল। ভদ্রলোক ওকে বললেন
“এত ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন? এই রুটের সব স্টেশন আমার চেনা। হল্লা, শুন্ডি,
হীরক, আমোদ ... সবগুলো। তুমি টিকিটে দেখো কোন
নাম লেখা আছে”।
তনিকার তখন খেয়াল হল, ফোনে টিকিটের স্ক্রিনটা অন করাই
আছে। ও দেখল আমোদ স্টেশনের নাম লেখা আছে টিকিটে। ও কোনওভাবে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল
“আমোদ”
“তাহলে তো কোনও সমস্যাই নেই।
আমিও নামব সেখানে। আমার বাড়ি হীরক স্টেশনের কাছে। কলকাতায় একটা কাজের জন্য
এসেছিলাম”।
ভদ্রলোকের কথায় কিছুটা
স্বস্তিবোধ করল তনিকা। চুপচাপ বসে জানলার দিকে চেয়ে রইল। মনে মনে ভাবছিল, প্রিয়লকে আজ পেলে আচ্ছা করে ওর পিঠে দু’ঘা বসিয়ে
দেবে। একটু সময়ের জ্ঞান নেই ছেলেটার।
এমন সময় তনিকার মনে হল, ওর লেখা অন্য অ্যাডভেঞ্চার গল্পটা বের করে পড়া যাক। সময়টা কেটে যাবে।
ওটা পড়ার মাঝেই ভদ্রলোক
তনিকাকে প্রশ্ন করলেন
“তুমি লেখালেখি করো?”
“কেন বলুন তো?” বেশ অবাক হয়ে পালটা প্রশ্ন করল তনিকা। এবার ভদ্রলোকের দিকে ঠিকমতো চেয়ে
দেখল ও, বেশ উজ্জ্বল
ওঁর চোখের নজর। সাদা ধুতি পাঞ্জাবির উপর খদ্দরের চাদর চাপানো। নিপাট সাদামাটা
পোষাকেও চোখেমুখে বেশ একটা রুচিশীলতার আভিজাত্য রয়েছে। কালো মোটা ফ্রেমের চশমায়,
ভদ্রলোককে আগেকার দিনের শিক্ষকের মতো লাগছিল। ওঁর আকর্ষণীয়
বাচনভঙ্গি তনিকাকে আলাপী করে তুলল।
“সাহিত্যকে ভালো না বাসলে
চলন্ত ট্রেনে বসে এমনভাবে লেখা খুলে আজকাল আর কেউ পড়ে না?” মৃদু হেসে বললেন ভদ্রলোক।
তনিকা লাজুক হেসে বলল
“খুব সামান্য! আপনি এদিকে কত
বছর হল?”
“অনেক বছর। তবে আজ আমোদে নামব
একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষে। ওখানকার শিল্পীরাই আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিল আমায়। আমিও একটু
আধটু লেখালেখি করি। আমোদ গ্রামের উপর একটা বড়সড় গল্পও লিখেছি। সেটাই মঞ্চস্থ হবে
আজ”।
ভদ্রলোক বিনয়ী গলায় বললেন।
“আপনি সাহিত্যিক?” বেশ উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল তনিকা।
“সেই অর্থে বলতে গেলে, গল্প উপন্যাস বা কবিতা এখন কমই লিখি। আগে লিখতাম। এখন দেশ বিদেশের ভালো
শিল্প সাহিত্য নিয়ে আর্টিকেল লিখি। আর ...!”
“আরিব্বাস। এতো দারুণ ব্যাপার”।
উত্তেজনায় বলে উঠল তনিকা।
ওর প্রশংসা শুনে ভদ্রলোক মাথা
নিচু করে লাজুক হাসিতে বললেন
“তেমন কিছুই নয়। তবে চেষ্টা
আছে কিছু অন্যরকম পরিবর্তন আনার। জন্মের পর জন্ম ধরে এই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি আমি”।
এবার যেন থমকে গেল তনিকা।
বলেন কী ভদ্রলোক। জন্মের পর জন্ম, মানে জন্মান্তরবাদ! তোতলানো
ভাষায় জিজ্ঞেস করল ও
“আপনি জন্মান্তরবাদের কথা
বলছেন?”
মাথা উপর নিচ করে মৃদু হাসলেন
ভদ্রলোক।
“আপনি এসব মানেন?”
“নিশ্চয়ই মানি। কর্ম থাকলে ফল
থাকবেই। আর তার ফলাফল জন্মান্তরেও থাকবে”।
দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন ভদ্রলোক।
“জাতিস্মর”
শব্দটা অস্ফুটে উচ্চারণ করে
ফেলল তনিকা।
“জাতিস্মর হলেও, ক’জন আর সেসব মনে রাখতে পারে! কতজন মুকুল হতে পারে!”
চোখ সরু করে ভুরু কুঁচকে
তাকিয়েছিল তনিকা। ভদ্রলোক কোন মুকুলের কথা বলতে চাইছেন? রায় মিউজিয়ামের সংগ্রহ থেকে পাওয়া সোনার কেল্লা চলচিত্রের মুকুল!
দ্বিধাগ্রস্ত সরে জিজ্ঞেস করল
ও
“আপনি কি সোনার কেল্লার কথা
বলছেন ...”
“ইয়েস, ইয়েস, দ্য ব্রেভ বয় মুকুল।”
উত্তেজনায় বলে উঠলেন ভদ্রলোক।
“আপনি বলতে চাইছেন,
আপনি সেরকমই জাতিস্মর?”
“বলতে পারো!”
রহস্যময় ইঙ্গিত দিলেন
ভদ্রলোক।
ভদ্রলোককে কিছুতেই কেন জানি
পাগল বলে মনে করতে পারছিল না তনিকা। এমন একজন সৌম্য চেহারার পরিচ্ছন্ন পোষাকে
অন্তত কোনও পাগল ঘুরে বেড়াতে পারে না। তাছাড়াও কেমন যেন একটা ম্যাজিক আছে ওঁর
কথায়। তনিকা ধীর গলায় জিজ্ঞেস করল
“আপনার মনে আছে,
আগের জন্মে আপনার বাড়ি কোথায় ছিল?”
“আমার বাড়ি ছিল মেহনতী
মানুষদের রাজ্যে। তবে সেখানে এখন আমার অনেক ছাত্র, ঠিক
এখানের মতোই...” বলতে বলতে জানলার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক।
হুড়োহুড়ি করে নিজের কাঁধের ব্যাগটাকে আঁটোসাটো করে নিয়ে বললেন “ট্রেনটা বোধ হয়
আমোদ স্টেশনে ঢুকে পড়েছে। আমাদের নামতে হবে।”
ট্রেনটা থামতেই হুড়োহুড়ি করে
তনিকা নেমে গেল ভদ্রলোকের সঙ্গে।
পরিচ্ছন্ন পরিপাটি একটি
স্টেশনে এসে নামল ওরা। তনিকা মুগ্ধ হয়ে দেখছিল, চারপাশটা। শহুরে
ঝকমকানি একেবারেই নেই এখানে। ভীষণ সাদামাটা সৌন্দর্যের মাধুর্য লেপ্টে রয়েছে
সর্বত্র। স্টেশন চত্বরটাও অদ্ভুৎ সুন্দর। লাল মাটির টাইলস পেতে সাজানো। নিখুঁত শৈল্পিক
কাজ করা বসার চেয়ারগুলোকে বিকালের আলোতে অপূর্ব লাগছিল। আরেকটু এগোতেই টিকিটঘরের
দিকে ওর চোখ পড়ল। তার দেওয়াল জুড়ে বাংলা সাহিত্যের বাঘা বাঘা লেখক লেখিকার হাতে
আঁকা সব ছবি লাগানো। এসব টিকিট ঘরের গল্প ও শুনেছিল দাদুর কাছে। স্টেশনের উপরের
লাইট পোস্টগুলো সব অভিনব গড়নের। একটি কলম আকৃতির তো আরেকটি তুলির মতো। রেলিংগুলো
রঙ পেন্সিলের আকারের রঙবেরঙের। চারদিকে চোখ বুলিয়ে ওর মনের মধ্যে বেশ আমোদ হল।
ভদ্রলোক ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন “হাঁটতে পারবে নাকি রিক্সা ধরব?”
চারপাশের প্রকৃতিতে কেমন যেন
আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল তনিকা। ও বেশ আমেজের সঙ্গে উত্তর দিল
“হেঁটেই চলুন। বেশ
লাগছে।”
স্টেশন চত্বর থেকে নেমে চওড়া
রাস্তা ধরতেই ওর খেয়াল হল, একটি গানের সুমধুর আওয়াজ দূর থেকে ভেসে
আসছে। কান পেতে ও শুনল গানটা
‘আহা কী আনন্দ আকাশে
বাতাসে ...’
অদূরে বাজারে বাজছিল গানটা।
ছোট ছোট দোকানপাটের সারি রয়েছে বাজারে। সেখানে গ্রামের সাধারণ পোষাক পরা সাদামাটা
চেহেরার মানুষগুলো বিবিধ পসরা সাজিয়ে বিক্রি করছে। মাটির তৈরি বিবিধ শৈল্পিক
শিল্পকর্ম, তাঁতের শাড়ি, ক্রুশ কাটার কাজ করা
রকমারি ঢাকনা, পর্দা, বেতের তৈরি সোফা,
চেয়ার, কাঠের তৈরি ঘর সাজানোর জিনিসপত্র।
কোথাও আধুনিকতার ছায়া মাত্র নেই। তনিকা মুগ্ধ হয়ে দেখছিল সবকিছু। ভদ্রলোকের কথায়
সম্বিত ফিরল ওর।
“এখানের সব দোকানপাট
স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকেই গড়ে দেয়। নিজেদের ঘরে তৈরি জিনিসপত্র নিয়ে এরা নিজেরাই
দোকানের মালিক হয়ে বসতে পারে। মধ্যবর্তী কোনও মানুষের উপর নির্ভর করতে হয় না।
এখানের বাজারেও চাষীরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষেতের ফসল বেচতে নিয়ে যায়। কোনও আড়তদার,
তোলাবাজ বা মহাজনের হুজ্জতি পোহাতে হয় না। ন্যায্য দামও পায়।
হাসিখুশি থাকে এদের পরিবার।”
তনিকা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল
কথাগুলো। এমন সময় ওর চোখে পড়ল একটা হাফ কলম আকারের সুদৃশ্য দ্বিতল বাড়ির উপর। তার
সামনে একটি ছোট্ট মন্দির। একভাবে সেদিকে চেয়ে থাকতে সেই মন্দিরের ভেতরের দেবতা
দৃশ্যমান হল। পা সমান আলখাল্লা পরা ইয়া বড় দাড়িয়ালা রবিঠাকুরের মূর্তি রয়েছে
ভেতরে। তার সামনে জ্বলছে প্রদীপ।
ভদ্রলোক বললেন
“এই বিল্ডিংয়েই নাটক
মঞ্চস্থ হবে। এখানকার সরকার সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য কলম বাড়ি নামক এই বাড়ি তৈরি করে
দিয়েছেন। এর পেছনে রয়েছে রঙ তুলি বাড়ি, তার পেছনে রয়েছে
সঙ্গীত বাড়ি, নৃত্যকলা বাড়ি। এখানকার সমস্ত শিল্পীরা এইসব
বাড়িতে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। সারা বছর বিবিধ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সকলকে আনন্দ
দেন। আর মানুষেরা টিকিট কেটে তাদের সেই অনুষ্ঠান দেখেন। এখানে টিভি বা অ্যানড্রয়েড
ফোনের মতো ইলেকট্রিক নির্ভর যন্ত্র নিষিদ্ধ। তাই আমোদপ্রমোদ বা সময় কাটানোর পদ্ধতি
বলতে এরা শিল্প, সাহিত্যচর্চা, নাটক
দেখাকেই বোঝে। বড্ড আন্তরিক এখানকার প্রতিটি মানুষ।”
এতক্ষণে তনিকার মনে একটা
তৃপ্তির বাতাবরণ তৈরি হয়ে গেছে। ওর মনে হল এখনও এমন জগৎ আছে, যেখানে শিল্প সাহিত্যের এতটা কদর আছে। শিল্পীদের নরম মনকে আদর যত্ন করে
বাঁচিয়ে রাখে প্রশাসন ও মানুষজন। এখানে আধুনিকতার কাঠিন্যে চাপা পড়ে যায়নি মনের
ভেতরের কোমলতা। ভাবতে ভাবতেই ওরা কলম বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। সেতারের হাল্কা
মূর্ছনায় ভেসে যাচ্ছিল মুহূর্তগুলো। সামনে দেখল, দাদুর মুখে
শোনা গল্পের মতো জগতের প্রতিচ্ছবি সাজানো রয়েছে। আগেকার দিনের নাটকের মতো পর্দা
ঘেরা বিশাল মঞ্চ। তার সামনে সারি সারি কাঠের চেয়ার পাতা। মুগ্ধ হয়ে অপলক চোখে
চেয়েছিল তনিকা। ঠিক তখনই বসন্তের বাতাসের মতো কলকলিয়ে ছুটে এল একঝাঁক কচিকাচা
ছেলেমেয়ে। ওর পাশের ভদ্রলোকের পায়ে হাত দিয়ে তারা একে একে প্রণাম করল৷ কেউ কেউ
জিজ্ঞেস করল
“মাস্টারমশাই কেমন
আছেন?”
ও নির্বাক হয়ে শুনছিল। এমন
সময় একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ এগিয়ে এসে মৃদু স্নিগ্ধ হাসিতে বললেন
“আসুন উদয়নবাবু। এত
দেরি করলেন কেন? পণ্ডিত মানুষ না আসলে কি কর্মযজ্ঞ শুরু করা
যায়?”
“বিশ্ব জোড়া ছাত্র
আমার। সব সামলে-সুমলে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল আর কী!”
সৌম্য হাসির ঝলক খেলে গেল
তনিকার ট্রেনের সহযাত্রীর মুখে।
স্টেজের সামনের চেয়ারে গিয়ে
বসল ওরা। ভদ্রলোক ওর দিকে ঝুঁকে ধীর গলায় বললেন
“এখানের মানুষের মধ্যে
এত আন্তরিকতা, ধৈর্য, শৈল্পিক মন,
গভীর অনুভূতি ... এসব কেন আছে জানো?”
তনিকা এতক্ষণের এতরকম
কার্যকলাপ দেখে কার্যত চুপ করে গিয়েছিল। ওঁ নিজেই উত্তর দিলেন
“অ্যানড্রয়েড ফোন নেই
বলে। কারণে অকারণে যন্ত্রের প্রতি সুবিধাভোগী মানসিকতা এখানে তৈরি হতে দেওয়া হয়নি
বলে। একটা দুটো বাটন প্রেস করে সবকিছু হাতের মুঠোতে চলে আসার ফলে, মানুষ প্রতিটি জিনিসপত্র এমনকি মানুষ ও তার গুণের মূল্যায়ন করতেও ভুলে
গেছে। ঝকঝকে আধুনিকতায় চাপা পড়ে যাচ্ছে মাটির কাছাকাছি মনগুলোর সারল্য, গভীরতা আর আন্তরিকতাগুলো।”
“কতক্ষণ এলেন?”
প্রশ্নটা শুনে চমকে তনিকার
দিক থেকে মুখ ঘোরালেন ভদ্রলোক। সেদিকে ফিরতেই, তনিকা হতচকিত হয়ে
গেল। এ কাকে দেখছে ও?
এতো মানিক বাবু। রায়
মিউজিয়ামে সংরক্ষিত যাঁর সৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা রত্নভান্ডার আছে প্রিয়লের কাছে, সেই সত্যজিৎ রায়।
তনিকার মাথায় তখন
যুক্তিবুদ্ধি ঠিক কাজ করছিল না। ও অবাক হয়ে দেখছিল, দুজনে বেশ
সুন্দর গল্পে মশগুল হয়ে গেলেন। মনে হল যেন কত জন্মের পরিচিতি। এমন সময় মঞ্চের
পর্দা সরে গেল। খুব চেনা চেনা ছন্দে শুরু হল নাটক। চরিত্রগুলোও যেন খুব চেনা
লাগছিল তনিকার কাছে। কিছুক্ষণ দেখার পর তনিকার খেয়াল হল, আরে
এতো প্রিয়লের সংগ্রহিত চলচিত্রের অংশ। এমন
সময় ওকে অবাক করে দিয়ে মঞ্চে মন ধোলাই
করার যন্ত্র উপস্থিত হল। তার মধ্যে গমগম স্বরে মন্ত্র উচ্চারিত হয়ে উঠল। ঘোলাটে
যান্ত্রব শব্দগুলো ঠিক বুঝতে পারছিল না তনিকা। সহসা মঞ্চের উপর সেই কচিকাঁচা
ছেলেমেয়েগুলো ছুটোছুটি করতে করতে এগিয়ে এল। সমবেত স্বরে বলল তারা
“দড়ি ধরে মারো টান,
যন্ত্র হবে খান খান।” একটা বিশাল অ্যানড্রয়েড ফোনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে
চলছিল টানাটানি। ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘নহি যন্ত্র, নহি যন্ত্র, আমি প্রাণী ...’ গানের
মিউজিক বাজছিল।
আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠে
দাঁড়াতে যাচ্ছিল তনিকা।
“ম্যাডাম, ম্যাডাম!”
ড্রাইভারের ডাকে ঘুম ভেঙে উঠে
বসল তনিকা। ভ্যাবাচেকা খেয়ে দেখল গন্তব্যে এসে পৌঁছেছে। স্টেশন চত্বরে নামতেই, প্রিয়লের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওর৷ উত্তেজনায় এগিয়ে গিয়ে তনিকা বলল
“আমরা কি আমোদ স্টেশনে
নামব?”
“তুই কিকরে জানলি?”
তনিকার চোখগুলো আরও বড় বড় হয়ে
গেল। রোমাঞ্চকর কিছু একটা যে হতে চলেছে, সেটা আন্দাজ করে ও
বলল
“আমি একটা দারুণ
অ্যাডভেঞ্চার করলাম এইমাত্র।”
“সেটা কি?”
প্ল্যাটফর্মের দিকে হাঁটতে
হাঁটতে জিজ্ঞেস করল প্রিয়ল। তনিকার আর তর সইল না। স্বপ্নের সবটুকু গড়গড়িয়ে বলতে
লাগল।
“ঠিক এরকমই একটা
পরিকল্পনা করেছিলাম আমরা সেদিন। শুভেন্দুবাবু বলছিলেন, ওর
লেখা জাতিস্মর উপন্যাসটার ছায়া অবলম্বনে আমার টাইম ট্রাভেল প্রজেক্টটাকে এডিট
করবেন।”
বলে তনিকাকে ফোনের চিপ থেকে
জাতিস্মর বইটা বের করে দেখাল প্রিয়ল। বইয়ের দ্বিতীয় পেজে লেখকের ছবি দেখে বিস্ময়ে
হতবাক তনিকা। এতো ওর স্বপ্নের সেই সহযাত্রী। তবে কি সত্যিই তিনি জাতিস্মর। রায়
মিউজিয়ামের রত্নভাণ্ডারের ম্যাজিকাল প্রভাব আজকের পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতেই কি হীরক
রাজ্যের উদয়ন পণ্ডিতের আবার জন্ম হয়েছে?
প্রশ্নগুলো তনিকার সারা শরীরে
রোমাঞ্চ সৃষ্টি করছিল। মনে মনে ভাবছিল ও, সত্যিকারের আমোদ
স্টেশনটা না জানি কেমন হবে!
️
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post