ভ্রমণ কাহিনী
পূর্বঘাটের ইয়ারকাদ
সুমি দত্তগুপ্ত
অনেক বছরের আসা
যাওয়া তামিলনাড়ু রাজ্যে। আমার শহরের মতোই ঘুরে বেড়াই তামিলনাড়ুর বিভিন্ন শহরে। গতানুগতিক
চেনা গতিপথ রামেশ্বরম, কন্যাকুমারিকা, পন্ডিচেরি,
কাঞ্চিপুরম, মহাবলীপুরম ঘুরেও শেষ হয় নি আমার
এই রাজ্য পরিক্রমা, ছুটে গিয়েছি ত্রিচি, থানজাভুর, য়েলাগিরি, কোটাগিরি,
তুতিকোরিন আরও কতো জায়গায়। দ্রাবিড় সংস্কৃতির সাথে আমার আত্মিক
বন্ধন আরও নিবিড়,দৃঢ় হয়েছে। স্বজনবন্ধুরা
ঠাট্টা করে বলেন, হোমল্যান্ড, আবার কবে
যাচ্ছো?
অক্টোবর এলেই
আর বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না। শরতের ওই ঝকঝকে নীল আকাশ, সাদা পুঞ্জ মেঘ, হঠাৎ করে এক পশলা বৃষ্টি সবকিছুর
মধ্যেই কেমন একটা পালাই পালাই ভাব, মোটামুটিভাবে সারা
ভারতবর্ষের আবহাওয়া এইসময় ভালো থাকে।
এমনই এক শরতের দুপুরে, ননদের বাড়ী বেঙ্গালুরু থেকে,
ডাবল ডেকার উদয় এক্সপ্রেসে, সালেমের উদ্দেশে
যখন রওয়ানা হলাম তখন ঘড়িতে সোয়া দুটো বাজে । সুন্দর ঝকঝকে ট্রেন, প্যান্ট্রি কার থেকে কফি, স্ন্যাক্স নিয়ে গল্প করতে
করতে, একটু ন্যাপও নিয়ে, রাত নটার একটু
আগেই নেমে পড়লাম সালেম স্টেশনে। ঝকঝকে স্টেশন, রিটায়ারিং
রুমে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম, ততক্ষণে গাড়ী ঠিক হয়ে গিয়েছে,
অতঃপর যাত্রাশুরু ইয়ারকাদের পথে।
আলো ঝলমলে স্টিল
সিটি সালেম ছাড়িয়ে পাহাড়ে ওঠা শুরু হল।
দুধারে জঙ্গল, কখনও কখনও রাতের আঁধারে
বুনো ভালুক, শেয়াল হরিণ গাড়ির সামনে এসে যেতে পারে, আমাদের ড্রাইভার ইউসুফ ভাই সেই গল্পই বলছিলেন, যদিও অন্ধকারের মধ্যে
কোনও জ্বলজ্বলে চোখ খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করেও পেলাম না, জানেন।
সবার ভাগ্যে কি শিকে ছেঁড়ে? পাহাড়ি পথ, যেতে যেতে বুনো ফুলের গন্ধ পাচ্ছি, সুন্দর রাস্তা,
রাস্তার দুধারে ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল, পুটুস ফুলের
ঝাড় হয়ে আছে, উঠছি, মাঝে মাঝেই
হেয়ারপিন বেন্ড। সালেম থেকে ইয়ারকাদ মাত্র 28 কিলোমিটার
কিন্তু তাতেই কুড়িটা হেয়ার পিন বেন্ড। তাই যাদের অলটিচুড সিকনেস আছে, তাদের এই ঘনঘন হেয়ারপিন বেন্ডে একটু সমস্যা হতে পারে।
ইয়ারকাদ জনপ্রিয় ভিড়ে ঠাসা শৈলশহর হিসেবে প্রসিদ্ধি পায় নি একথা ঠিক, কিন্তু আস্তে আস্তে সপ্তাহান্তের ভ্রমণে, গাড়ী নিয়ে বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, কাছেপিঠের শহরগুলো থেকে আসা মানুষের সংখ্যা কিন্তু এখন বাড়ছে। শহরের জনকোলাহল, থেকে অনেক দূরে শান্ত, সমাহিত জনপদ ইয়ারকাদ, জীবন এখানে থমকে গিয়েছে। শান্ত, নিস্তরঙ্গ সেই জীবন।
শৈলশহর ইয়ারকাদের
প্রতিষ্ঠা ১৮২০ সালে সালেম শহরের জেলা কালেক্টর ডেভিড ককবার্ণের হাতে। তিনি
প্রথমেই ওখানে চা, কফি, কমলা,আপেল, ন্যাসপাতির চাষ শুরু করেন। তাকেই এই শৈলশহরের
প্রাণপুরুষ বলা হয়। ১৮৪০ সালে পাহাড়ে কৃষিজমি বাড়তে থাকে, নতুন
করে শুরু হয় এলাচ, দারু চিনির চাষ। কফি বাগিচা বাড়তে থাকে, সম্পন্ন মানুষেরা কফি বাগান কিনতে শুরু করেন। যদিও আধুনিক ইয়ারকাদ প্রাণ পায়
১৮৪২ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির তদানীন্তন গভর্নর থমাস মনরোর হাতে।
কিন্তু ইয়ারকাদের
ইতিহাস আরও প্রাচীন। ইয়ারকাদের
5 কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত প্রাচীন মন্দির অন্তত সেই কথাই বলে। প্রস্তুর যুগের নিদর্শন এখানে
পাওয়া গিয়েছে।
ইয়েরি বা ইয়ের
তামিল শব্দ, অর্থ লেক, আর কাদু বা কাদ কথার অর্থ জঙ্গল। ইয়ারকাদ শহরকে ঘিরে রেখেছে
ইয়ারকাদ লেক, চারপাশে তার ঘন সবুজ বনানী, দূরে শেভারয় পাহাড়। শহরের কোলাহলে যখন শরীর, মন ক্লান্ত, তখন এই দূষণহীন, শান্ত, নির্জন এই শৈল শহরে আপনি নিশ্চিত অবসর
পাবেন।
কড়া শীত পড়ে
না ইয়ারকাদে, তবে যারা গরমের হাত থেকে নিস্তার পেতে চান,
তারা অনায়াসেই চলে আসতে পারেন এখানে। সারা বছর অল্প ঠান্ডা, ঝিরঝিরে বৃষ্টি, কফি বাগিচার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া,
কমলার বাগান, দুপাশে ইউকালিপটাসের দীর্ঘ সারি,
বাতাসে এলাচ, দারুচিনির সুবাস, বাড়িগুলোর আপেল বাগান, ফলন্ত ন্যাসপাতি গাছে, ঝুলে থাকা রসালো ন্যাসপাতি,
অক্টোবর মাসে কফি বাগানে লাল টুকটুকে কফি ফলের ভারে ঝুলে থাকা গাছ,
কফি ফুলের সুবাস। একর, একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এস্টেট, সম্পন্ন গৃহস্থের খামারবাড়ি,
লেক থেকে অনেকখানি আঁকাবাঁকা চড়াই ভেঙ্গে প্যাগোডা পয়েন্টে
সূর্যাস্ত দেখতে যাওয়ার সময় দুপাশে পরিত্যক্ত সাহেব বাংলো, প্যাগোডা
পয়েন্টে দাঁড়িয়ে অলস বিকেল কাটানো, কাছের কিয়োস্কে দাঁড়িয়ে
কফি, ভুট্টাসেদ্ধ খাওয়া, গড়িয়ে গড়িয়ে
সন্ধ্যা নামে পাহাড়ের বুকে, কমলা সূর্যটা কমলা রঙের বলের মতো
হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে নীল পাহাড়ের বুকে, আঁধার নামে পাহাড়ে,
ফিরতি পথে, গ্রামের দক্ষিণী স্থাপত্যে গড়ে ওঠা
শেভারয় মন্দির দেখে রিসোর্টে ফেরা। প্যাগোডা ছাড়িয়ে আরেকটু এগিয়ে এসে দেখি,
ছেলেদের পায়ে তখনও ফুটবল। গুমফার গেট বন্ধ হয়ে গেছে, সন্ধ্যার প্রার্থনা সারা, গ্রামে সরকারী ভ্যান চাল,
ডাল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বিকিকিনি চলছে,
সংসারী মুখের ভিড় গাড়ির চারপাশে, পাহাড়ি পথ
বেয়ে হাঁটা উৎরাইয়ের পথে, দোকানি বাড়ীর মধ্যেই গাজর, শালগম, ফুলকপি বাঁধাকপি, সেলারি
পাতা, পালংশাক, টোম্যাটোর পসরা সাজিয়ে
বসেছে, ছোট চায়ের দোকানে আড্ডা চলছে, প্রতিদিনকার
সুখ দুঃখের কথা, হাতে চায়ের কাপ, বেকারীর
বিস্কুট, আরও এগিয়ে দেখতে পাই বাড়িতেই বেক করা কেক বিস্কুট
নিয়ে ছোট্ট আয়োজন নিজেরই বাড়ীর বারান্দায়।
পেছনে ঘন্টা ধ্বনি শুনে দেখি একাকী অরণ্যে ছোট্ট ঘোড়া হেঁটে
চলেছে, এগিয়ে চলি, দেখি মস্ত বড়ো ফার্ম
হাউসের সামনের অংশ জুড়ে ক্যাফে, পুরোদস্তুর ইংরেজি খানা
মিলবে আবার দক্ষিণী দোসা, উত্তাপম ও আছে বইকি। রিসোর্টে ফিরে
রুটি, ডাল ফ্রাই, মিক্সড ভেজ, আর চিকেন কারী খেয়ে, সারারাত বৃষ্টির রিমঝিম শুনতে
শুনতে কখন ঘুমের দেশে চলে গিয়েছি নিজেই জানিনা। পরদিন সকালে গাড়ী বলা আছে,
শৈলশহর পরিক্রমায় বেরোবো।
প্রথমেই লেক, সদ্য বর্ষা গিয়েছে, লেক জলে টইটুম্বুর, লেকের জলে দীর্ঘ ছায়া গাছের,জলে অপেক্ষমাণ বোট, শান্ত, নির্জন ইয়েরকাদকে আরও গভীরভাবে প্রত্যক্ষণের
জন্য কিছুক্ষণ লেকের জলে ভেসে বেড়ানো যায়। লেক থেকে এবার ইকো ট্যুরিজম পার্ক,
ঘন জঙ্গল, কিচিরমিচির কত পাখির ডাক, গাছের আড়াল থেকে সুমধুর স্বরে শিস দিয়ে চলেছে অজানা পাখি, কুবোপাখির কুব কুব ডাক, এগিয়ে চলেছি ভিউ পয়েন্টের
দিকে, যে ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে দূরে সেভ্রয় পাহাড়ের বিয়ার্স
কেভ (দুটো শিলা প্রস্তুরের এমন অবস্থান দেখে মনে হয়, ভালুকের
গুহা), হঠাৎ কিচির
মিচির শব্দ, না পাখির ছানার নয়, বিরাট
জায়গা জুড়ে টেন্ট করা হয়েছে, স্কুলের ইলেভেন টুয়েলভের এর
ছেলেমেয়েরা ক্যাম্প করে আছে, নিজের ছেলেবেলার কথা, স্কুলের সাথে বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে পড়ে। ওখান থেকে বেরিয়ে, পরের গন্তব্য লেডিস সিট, জেন্টস সিট। অনেকটা চড়াই, সবুজ গাছে ঢাকা, রেইন ট্রি র জঙ্গল পেরিয়ে লেডিস সিট,
দুটো পাথর এমনভাবে রাখা যেন মনে হয়, ব্যাক রেস্ট
সহ একটা চেয়ার, চেয়ারে বসে আরেকটা পা সামনের পাথরে দিয়ে গল্প
করুন দুজনে, কেউ তাড়া দেবে না, শুধু
পাহাড়ি গাছেরা আপনাদের গল্পকথার নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবে। দূরে দেখা যাবে সালেম
শহরটা, ভাগ্য সদয় হলে, ঝকঝকে আকাশ
থাকলে, মেট্টুর বাঁধ ও দেখা যাবে। পাশাপাশি জেন্টস সিট দেখা শেষ হলেই,
গেটের সামনে আইস ক্রিম, ম্যাগি, চা, কফি
দিয়ে গলা একটু ভিজিয়ে নিয়ে, এবার হোলি
ট্রিনিটি চার্চ, কাছেই মন্টফোর্ড স্কুল, বিরাট প্লে গ্রাউন্ড, ঘন সবুজ ঘাসে ঢাকা, লাল টুকটুকে বাস্কেট বল খেলার বাস্কেট, শিশু যীশুকে
কোলে নিয়ে মা মেরি হাসিমুখে আপনাকে স্বাগত জানাবে, এরমধ্যেই
হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়া বৃষ্টি, স্কুলের ভেতরেই অনাথ আশ্রমের দাওয়ায়
আশ্রয় নিলাম, একদম নিস্তব্ধ, একটা পিন
পড়ার আওয়াজ ও শোনা যাবে, স্টেশনারি জিনিসপত্র নিয়ে স্কুলের
সামনে এসে দাঁড়ালো একটা ভ্যান, তখন জিনিসপত্র নামানো চলছে
বৃষ্টির মধ্যেই, ঘন সবুজ গালিচার মতো মখমলি ঘাসের ওপর ঠিক যেখানে
আকাশটা নেমে এসেছে, সেখানেই নীল পাহাড়ের সারি। বৃষ্টিটা একটু ধরলো, দেরী না করে চার্চের দরজায়।
ছোট্ট শহরের চার্চ, বৃষ্টি ধোয়া আঙিনা পেরিয়ে গির্জার প্রবেশদ্বারে সাদা ডেইসি
ফুলের ঝাড়, ছিমছাম, শান্ত প্রার্থনা ঘর,
গথিক স্ট্রাকচার, লাল, নীল,
হলুদ কাঁচের জানলা, প্রার্থনা ঘরে দু দন্ড বসে
থাকতে ইচ্ছে করে, কোথাও সময়ের ভ্রূকুটি নেই, স্পট দেখার হুড়োহুড়ি নেই, অখণ্ড অবসর, দূরে ভেসে আসছে, স্কুলের বাচ্চাদের কোলাহল, এবার উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটা শুরু, দল বেঁধে হেঁটে
আসছে স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়েদের দল, হাসতে হাসতে হাত
নেড়ে যায়। স্কুল ছুটির পর, গল্প করতে করতে হাঁটা, ভালো লাগে দেখতে, আরও কিছুদূর হাঁটি হোমমেইড
চকোলেটের সন্ধানে, বাড়ীর বারান্দায় ছোট্ট চকোলেটের দোকান, বিক্রেতা বাড়িতে তৈরী চকোলেট
টেস্ট করান, কিছু কিনি, এমন কিছু ভালো
মানের নয়, লোক্যাল ডেলিকেসি হিসেবেই কিনি। এবার পাহাড়ি পথে কিছুক্ষণ নিজের সাথে
নিজেরই হারিয়ে যাওয়ার পালা। সংবিত ফিরতেই, তাড়াতাড়ি রিসোর্টের পথে, কাল সকালেই চেন্নাই ফেরা।
নির্জনতায় দু
দন্ড পরিবারের সাথে কাটাতে যারা ভালোবাসেন, তারা দুদিনের জন্য
আসতেই পারেন ইয়ারকাদ। তবে, একটা কথা, এখানে
এসে কেউ ধ্যানগম্ভীর হিমালয়ের সন্ধানে যাবেন না, কোনও জনপ্রিয়
শৈলশহরের সাথে তুলনায় যাবেন না, পূর্বঘাট, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার নিজস্ব বর্ণ, গন্ধ আছে,
তাই নিয়েই তারা স্বতন্ত্র।
আপনি যদি স্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী হন, বৈচিত্রের
সন্ধানী হন, তাহলে একটুও দেরী না করে বেরিয়ে পড়ুন, নিরাশ হবেন না।
| বর্ষ বরণ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 29th Edition |
| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Bengali New Year, 2022 | April-June 2022 | Fifth Year Third Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post