গল্প- বৈঠকি
সর্বজ্ঞ
তপন তরফদার
সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা। সব পাড়াতেই ওই
দুয়েকটি মানুষ আছে যারা জন্মতিথি থেকেই
সর্বজ্ঞ। সব বিষয়ে জ্ঞানেন্দ্রিয় সোচ্চার। এরা জলের মত মিশে যেতে জানে। মোক্ষম
সময়ে মন্ত্রীর চাল দিয়ে কিস্তিমাত করে দিতে ওস্তাদ। সব মহল্লাতেই কম করে এক দু
পিস সবজান্তাদের দেখা পাওয়া যায়। সমস্যা
হয় যখন ভুলকেই ঠিক বলে চালিয়ে দিয়ে
নাম কিনতে চায়। আমি ও একজন সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা মার্কা ছেলে। তবে হাটে বাজারে তা প্রকাশ করিনা। আমি সি আই ডি ডিপার্টমেন্ট এর
করণিক, সব কিছুর খোঁজ রাখতে
হয়। কিন্তু খবর ওগলানো চলবেনা। আমি
চাকরির কথা সবসময় মাথায় রাখি। আমাদের কাজ
খবর সঠিকভাবে ওপরওয়ালেকে জানান। আমার বসরা কখনো খোলা মেলা হয়ে আমাদের সঙ্গে মেশেনা। এই অলিখিত নিয়ম গুলি সবই চাকরির স্বার্থে, ইংরাজিতে
বলে “প্রোটোকল”।
বর্তমান অফিসার জয়ন্ত ফাদিকার কিন্তু আমার
সঙ্গে বন্ধুর মতোই মেশেন এবং কথা ও বলেন। আমার মত ধুরন্ধর সর্বজ্ঞও কারণটা ধরতে পারলাম না। বসের চিন্তা ধারা
কিন্তু খুবই প্রগতিশীল। উনি ওই বস- কেরাণির ভেদাভেদ দুরে সরিয়ে আমার সঙ্গে গল্পগুজব করেন। আমাকে ওনার বাড়িতে
যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণও করলেন। কি করা উচিত। অনেক ভাবলাম বসের বাড়িতে গেলে জানাজানি
হবে। অফিসের অনেকেই বাঁকা কথা শোনাবে, “এখন তেল
মারতে বসের বাড়িতে ছুটছে। ঘোর কলি কাল।”
ওদের মুখ বন্ধ করতে পারবোনা। কথা বলার
জন্য ট্যাক্স দিতে হয় না। আমার সর্বজ্ঞ মন বললো ক্ষতি কি? একবার দেখাই যাক না। কোথাকার জল
কোথায় দাঁড়িয়ে যায়।
রবিবার
ছুটির দিন সূর্য্যটা সবে ডুবেও ডোবেনি। অকাশে তখনও চলছে এক অপরূপ
সুক্ষ্ম লাল সোনালী রঙের খেলা। এই সন্ধিক্ষণকেই আমার সর্বজ্ঞ মন বললো গোধুলি লগ্ন।
বসের বাড়ি যাচ্ছি একটু মিষ্টি না নিয়ে
গেলে ওই প্রটোকল ঠিক মত থাকেনা। আমার হাতে জলভরা কড়া পাকের সন্দেশের বাস্ক।
বসের বাড়িতে ঢোকার সামনের দেওয়ালটাই দেখার
মতো। এখনো সবুজের যুগ। গাছ লাগাও গাছ বাঁচানোর যুগ। প্রগতিপন্থী বস যুগের সঙ্গে
চলে। ঘরের সামনের দেওয়ালটা ঘন সবুজ রং করে নয় আগাছায় নয় দেওয়াল জুড়ে লাগানো হয়েছে
লেমনগ্রাস,রোজমেরি
হার্ব দিয়ে হার্ব গ্রিন ওয়াল। সুস্থতা ও সামাজিকতাার হার্ট থ্রব আমার বস। মনে পড়ে
গেল আজ ৫ই জুন বিশ্ব প্রকিৃত দিবস। তালেগোলে ভালো দিনেই প্রকৃতি প্রেমী বসের বাড়িতে
এসেছি। অতিসুখকর পরিবেশ।
দুধ সাদা কলিং বেলটা টেপা মাত্র শাড়ি পরা
মাথা ঢাকা বিরাট ঘোমটা দেওয়া এক মহিলা দরজা খুলে দিলো। বস বসার ঘর থেকেই বললো এ
ঘরে এসো। ঘরে ঢুকতেই নজরে পড়লো যামীনি রায়ের আঁকা মা ও মেয়ের রেপ্লিকা। বস প্রথমেই
বললো মিষ্টির কোনো দরকার ছিলনা। এরপর হাসি মাখা মুখে টুকটাক কথা শুরু হয়ে গেল।
কাঁসার বগি থালা ভর্তি ফুলকো লুচি কালোজিরে দেওয়া আলুর ছেঁচকি, বড়ো
বড়ো দুটি ছানার রাজভোগ। ছোট টেবিলটায়
নামিয়ে রাখলো সেই ঘোমটা দেওয়া মহিলা। আমার একটু কেমন খটকা লাগলো। প্রগতিশীল মানুষ
অথচ নিজের ঘরের মেয়েদের পর্দার অন্তরালে রাখেন। মন বলছে এ নিশ্চয়ই কাজের লোক অন্য
রাজ্য থেকে এনেছে যারা সবসময় ওই লম্বা
ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে। টিভি সিরিয়ালে দেখেছিলাম।
বস বললো খেয়ে নাও। ভালো লাগবে ও ভালোই
রান্না করে। মুখে কিছু বললাম না। মনে মনে বললাম ঠিকই ধরেছি কাজের লোক। কথা গড়গড়
করে এগিয়ে চলেছে। বস বলে বসলো তুমি বলেছিলে তবলা বাজাতে জানো। আমি জাঁতাকলে পড়ে
গেলাম। ছোটবেলায় তবলা কিছুদিন শিখে ছিলাম। ওই সর্বজ্ঞ হওয়ার জিন আমার শরীরে মনের
ঘোরে গল্প করে ছিলাম। সবজান্তাদের দলে আমি। নিজের ফেলা জালে নিজেই জড়িয়ে পরলাম।
ধামাচাপা দিতে বললাম এখন কোনো রেওয়াজ নেই।
জয়ন্ত ফাদিকার আমার বস,
আমাকে এক হাটে কিনে অন্য হাটে বিক্রি করার ক্ষমতা রাখে। বস বললো শুধু মাত্র ঠেকা দিলেই কাজ হবে। আমার মুখে বিরাশী
সিক্কার চড় পড়লো। কিছু উত্তর না দিয়ে ঘাড়টা কাত করতেই হলো। হারমোনিয়াম তবলা বস
লাল-সবুজ কার্পেটের উপর সাজিয়ে দিয়ে ডাকলো সুলগ্না -এসো।
আমি
অবাক হয়ে গেলাম মাথায় ঘোমটা দেওয়া মহিলাটি হারমনিয়ামে বসলো। আমার সবজান্তা
মন আগেই বলেছিল, এরা মুখে
প্রগতিশীল কাজে নয়। বাড়ির লোকজনকে সেই দাসীদের মত রাখবে মুখে বড়ো বড়ো বিপ্লবের কথা
বলে। সুল্গনা বসলো, হাত
জড়ো করে নমস্কার করলো। ঘোমটাটা একটুও সরলোনা। বসের এই সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের
জন্য বসের প্রতি একটা ঘৃণা জেগে উঠলো। সুলগ্না মামুলি সহজ “আলো আমার আলো” রবীন্দ্র
সংগীত ধরলো ওটা দাদরা তালের গান, আমি জানি। আমার বাজাতে কোনো অসুবিধা হলো না। গানটা সবে শেষ
হয়েছে এই সময় কলিং বেলটা বেজে উঠতে ধড়মড় করে
উঠতে গিয়ে বেকায়দায় তবলার
হাতুড়িটায় পা পড়ে যায়। পিছলে যায় শরীর। সুলগ্না চিৎ হয়ে বসেরই কোলে পড়ে যায়।
সুলগ্নার ঘোমটা খুলে গেছে। আমি একি. দেখছি,নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা।
হরোর সিনেমায় যেমন রাক্ষসী,
পেতনীদের দেখায় ঠিক সে রকম মুখ। ডান দিকের পোড়ানো মাংস থলথল করে ঝুলঝে নাকের
হাড়টায় লাল লাল ছোপ। আমি বাজি রেখে বলতে পারি অনেকেই এই ক্ষণেই জ্ঞান হারাতো।
আমার বস পরিস্থিতি সামলে নিয়ে বললো তুমি
কি ভাবছো। আমি উত্তর দেওয়ার আগেই বলতে শুরু
করলো- সুলগ্না ডি এ ভি স্কুলের শিক্ষিকা
ছিল। একদিন ওর সহকর্মীর স্বামী
স্কুলে ঢোকার সময় আ্যসিড ছোঁড়ে ওই
সহকর্মীকে মারার জন্য। সুলগ্না সহকর্মীকে
ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। সহকর্মী
রক্ষা পায়। সুলগ্নার মুখ ঝলসে যায়। ও আমার
থেকে দুরে সরে যায়। লুকিয়ে থাকে অমি যেন ওর সন্ধান না পাই। আমি আমার প্রেমিকাকে খুঁজে বার করি, বিয়ে করে
মনের সুখেই সংসার করছি।
আমি সর্বজ্ঞ হয়ে ও বোবা হয়ে গেলাম।
| বর্ষ বরণ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 29th Edition |
| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Bengali New Year, 2022 | April-June 2022 | Fifth Year Third Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post