অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



"অলীক পাতা নববর্ষ সংখ্যা ১৪৩১ প্রকাশিত, সমস্ত লেখক -লেখিকা এবং পাঠক -পাঠিকাদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা..."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Friday, May 6, 2022

পুরাণ- চির নতুন - চিরন্তনী সীতা - দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

 পুরাণ- চির নতুন

চিরন্তনী সীতা

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

Image Courtesy: Google Image
     

    জনম দুখিনী সীতা - রামায়ণে সীতাকে এইভাবে মহাকবি বাল্মিকী বর্ণনা করেছেন। চব্বিশ হাজার শ্লোক বিশিষ্ট রামায়ণে আদিকবি শ্রী রামচন্দ্রকে নিয়ে যত শ্লোক রচনা করেছেন তার মধ্যে সীতার সম্বন্ধে সামান্য শ্লোক ব্যয় করেছেন অথচ সীতা রামায়নের মুখ্য চরিত্র বলে আমার মনে হয়। কারণ সীতার আগমন পৃথিবীতে যদি না হতো তাহলে রামায়ণ মহাকাব্যই রচিত হত না। সীতার অনুষঙ্গ হিসেবে রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্রের সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর জন্মের আগে বা পরে যে যে ঘটনাগুলি সংঘটিত হয়েছিল সবগুলি সীতাকে কেন্দ্র করে। সীতা জনম দুখিনী, জনক রাজনন্দিনী, রামময় প্রাণ - বিধাতার এক অপূর্ব সৃষ্টি। যুগে যুগে তিনি ধরণীর ধূলিতে আবির্ভূতা। তাঁকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী অশুভ শক্তির হাত থেকে পরিত্রান পেয়েছে।                          

     ত্রেতা যুগের ঘটনা। দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র মহামুনি কুশধ্বজ। কুশধ্বজের বেদ মন্ত্রের তপস্যায় এক কন্যার জন্ম হয়। বেদমন্ত্রের তপস্যায় কন্যার সৃষ্টি হতে কুশধ্বজ নাম রাখেন বেদবতী। অপরুপা সুন্দরী কন্যা শৈশব অবস্থা থেকেই বেদমন্ত্রের ধ্বনিতে ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হতে থাকে। বিবাহের সময় আগত দেখে কুশধ্বজ একদিন বেদবতীকে তার কোন ইপ্সিত আকাঙ্ক্ষা আছে কিনা পাত্র নির্বাচন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করাতে বেদবতী উত্তর দেন চতুর্ভুজ নারায়নকে অন্তরে স্বামী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। তার উত্তরে কুশধ্বজ যৎপরোনাস্তি আনন্দ লাভ করেন। এদিকে বেদবতীর রূপলাবণ্যের সৌরভ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। বহু রাজা, শ্রেষ্ঠী, গন্ধর্ব, দেবতা, অসুরেরা  তাঁকে বিবাহের আশায় ছুটে এসেও বিফল মনোরথে হয়ে ফিরে যেতে লাগলেন। অসুররাজ শম্ভু ক্রুদ্ধ হয়ে এক অমানিশায় আশ্রম আক্রমণ করে কুশধ্বজকে হত্যা করেছিল। কিন্তু আশ্রমের মধ্যে বেদবতীকে খুঁজে না পেয়ে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যায়। বেদবতী এরপর সেই নির্জন পর্বত কন্দরে অরণ্য মধ্যে একাকী নারায়ণের তপস্যায় নিবিষ্ট হলেন। ক্রমে ক্রমে তার মস্তকের দীর্ঘ কেশরাশি জটাজালে পরিণত হয়ে কাঁধ বেয়ে কোমর পর্যন্ত নেমে এলো। তাঁর রূপের ছটাতে চারিদিক উদ্ভাসিত। সেই চন্দ্রমুখী, শুদ্ধসত্তা, নিষ্কলঙ্ক চিত্তের অধিকারী কন্যার তেজপ্রভায় পর্বত-কন্দর আলোকিত।                 

     এদিকে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল বিজয়ী দশানন লঙ্কেশ্বর রাবণ একদিন কৈলাস পর্বত উত্তোলন করে সআবাসিক পিনাকপানি শঙ্করকে লঙ্কায় নিয়ে আসার নিমিত্তে কৈলাস পর্বতের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হল। রাবনের রথ কৈলাশ শিখরে যাবার উপক্রম করতে শিবের অনুচরগনের সাথে তার তুমুল যুদ্ধ হলো শিবের অনুচরগন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করলেন। যুদ্ধের পরে রাবন চিন্তা করলেন কৈলাস পর্বতকে সমূলে উৎপাটন করে লঙ্কায় নিয়ে যাবেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। রাবণ কৈলাস পর্বতকে নাড়া দিতে শিবজায়া মহেশ্বরী মহাদেবের কণ্ঠলগ্না হলেন। শিব ঈষৎ হাস্যে তাঁর বাম চরণ দিয়ে একটু চাপ দিতেই রাবণের হাত কৈলাস পর্বতের চাপে চাপা পড়ে গেল। তার আর্তনাদ শুনে ও কাতর প্রার্থনায় মহাদেব দয়াপরবশ হয়ে তাকে মুক্ত করেন। এইভাবে অপমানিত হয়ে রাবণ একাকী ভ্রমণ করতে করতে নির্জন অরণ্য মধ্যে তপস্যারত জ্বলন্ত অগ্নিশিখাসম রূপসী বেদবতীকে দেখে তার দিকে অগ্রসর হল। সুন্দরী কন্যাকে দেখে দুষ্ট দশানন কামতাড়িত হয়ে তাঁকে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করতে বেদবতী বললেন নারায়ন ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষকে তিনি বিবাহ করবেন না। এই কথা শুনে রাবণ অট্টহাস্য করে বললেন তার থেকে যোগ্য পুরুষ ত্রিজগতে আর কেহ নাই। স্বর্গের দেবতারা তার কাছে পরাজিত। এই বলে বলপূর্বক বেদবতীর কেশাকর্ষণ করে রথে তুলে তাঁর সম্ভ্রম নষ্ট করতে চাইলেন। বেদমন্ত্রের তপস্যায় প্রভাবিত সেই কন্যা রাবণের হাত থেকে ছাড়িয়ে কিছুদূরে পালিয়ে গিয়ে যখন জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড স্থাপন করে তাতে প্রবেশ করে তাঁর অপবিত্র দেহ বিসর্জন দিতে উদ্যত সেই সময়ে পুনরায় রাবনকে সন্মুখে উপস্থিত দেখে বেদবতী রাবণকে অভিশাপ দিয়ে বললেন 'ব্রহ্মার বরে তুমি দেব, মানব,যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্বের হাতে অবধ্য হলেও পুনর্বার কোন নারীর কেশ আকর্ষণ করে তার সম্ভ্রম নষ্ট করার চেষ্টা করলে তোমার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং অনিবার্য'এই কথাগুলি বলার পরে বেদবতী জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের পবিত্র দাহিকাশক্তিতে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিলেন। বেদবতীর এই অভিশাপ শুনে রাবণ সেই স্থান পরিত্যাগ করে পালিয়ে গেলেন।       

সময়ের বিবর্তনে ত্রেতাযুগে বেদবতী পুনর্জন্ম লাভ করে চন্দ্রবংশজাত রাজর্ষি জনকের লাঙ্গলের ফালের সম্মুখে জন্মগ্রহণ করলেন। বেদবতী যে স্থানে দেহত্যাগ করেছিলেন কালের বিবর্তনে ত্রেতাযুগে সেই স্থান মিথিলা নগরে পরিণত হয়। চন্দ্রবংশজাত মিথিলার রাজা জনক ও রানী সুনয়নার দীর্ঘদিন যাবৎ কোন সন্তানাদি না থাকায় মুনিদের নির্দেশমতো রাজা জনক পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার অভিপ্রায়ে যজ্ঞবেদী নির্মাণের জন্য ভূমিকর্ষণ কালীন আকাশ মার্গে ভ্রমণকারী স্বর্গের অপ্সরা উর্বশীকে দেখে মোহিত হয়ে ভূমির উপরে রাজার রেতঃস্খলন হয়। দৈবক্রমে সেই সময় বসুমতী ঋতুমতী ছিলেন। মা ধরিত্রী ও জনকের সংযোগে ডিম্বাকারে একটি শিশু কন্যা ভূমিতে শায়িত হলেন। দীর্ঘদিন পরে পুনরায় রাজা জনকের হলকর্ষণ কালে অসাবধানে সেই ডিমটি লাঙ্গলের ফলার আঘাতে ভেঙে যায়। ডিমটি ভেঙে যাওয়ার পরে জনক রাজা দেখেন ধরিত্রীর বুকে পদ্মের পাপড়ির উপরে এক শিশুকন্যা শায়িত। কন্যাকে জনক রাজা আনন্দিত হয়ে বুকে তুলে নিয়ে যেয়ে রাজ অন্তঃপুরে রানী সুনয়নার হাতে অর্পণ করেন। দিনে দিনে সেই কন্যা পরমা রূপবতী হলেন। কন্যার কুঞ্চিত কেশদাম, হরিণী নয়নে কজ্জ্বলশোভিত, ওষ্ঠ দুটি পক্ক দাড়িম্বের ন্যায় রক্তবর্ণ, ক্ষীণ কটিদেশ, নুপুরের নিক্কনে চরন শোভিত। কৃত্তিবাসী রামায়ণে সীতার রূপ লাবণ্য এইভাবে প্রকাশিত হয়েছে - “ঘন কেশপাশ তাঁর যেমন চামর। পাকা বিম্বফল তূল্য তাঁর ওষ্ঠাধর।। মুষ্টিতে ধরিতে পারি তাঁহার কাঁকালি। হিঙ্গুলে মণ্ডিত পাদপদ্মের অঙ্গুলি”।। জনক রাজা চিন্তিত হলেন কন্যা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে কার হাতে তাঁকে সমর্পন করবেন। হেনকালে একদিন দেবতাদের নির্বন্ধে মহাদেবের আদেশে শিষ্য পরশুরাম শিবের আশীর্বাদপূত একটি ধনুক এনে রাজর্ষিকে দিয়ে বললেন যে পুরুষ এই ধনুতে গুণ পরিয়ে টঙ্কার দিতে সমর্থ হবেন সেই হবে এই কন্যার স্বামী।                

     এদিকে দণ্ডকারণ্য মহারণ্যে মুনি-ঋষিরা যজ্ঞ করবেন বলে স্থির করেছেন। কিন্তু যখনই যজ্ঞের আগুন জ্বলে উঠছে সেই মুহূর্তে তাড়কা রাক্ষসীর অনুচরেরা এবং তার পুত্র মারীচ আকাশমার্গ থেকে শোনিত বৃষ্টি করায় যজ্ঞ পণ্ড হয়ে যাচ্ছে। রাক্ষসদের উপদ্রবে উপায়ান্তর না দেখে গাধির নন্দন বিশ্বামিত্র অযোধ্যায় গেলেন দশরথ নন্দন শ্রীরাম ও লক্ষণকে আনতে। বিশ্বামিত্র দুই রাজকুমারকে নিয়ে দণ্ডকারণ্যে ফিরে আসার পরে মুনি-ঋষিরা পুনরায় যজ্ঞ শুরু করলেন। রাক্ষসেরা যে মুহূর্তে যজ্ঞস্থলে পাথর, বৃক্ষ বর্ষন শুরু করলো সেই সময়ে শ্রীরাম ও লক্ষণ জ্বলন্ত অগ্নিশিখাসম বাণ বর্ষন করে তাড়কা রাক্ষসী ও তার তিন কোটি অনুচরকে হত্যা করলেন এবং তাড়কার পুত্র মারীচকে হত্যার উদ্দেশ্যে বজ্রবান নিক্ষেপ করলেন। দেবতাদের আশীর্বাদে অবশ্য মারীচ প্রাণে বেঁচে যেয়ে আকাশে ছেঁড়া ঘুড়ির মতো ঘুরপাক খেতে খেতে সাতদিন পরে লঙ্কায় যেয়ে ভূপাতিত হল। দেবতারা মারীচকে বাঁচিয়ে রাখলেন এই কারণে যে মারীচ মারা গেলে রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ হবে না এবং দশানন রাবণও নিহত হবে না। যজ্ঞস্থল নিষ্কণ্টক হওয়ার পরে দেবতাদের নির্দেশে বিশ্বামিত্র মুনি দুই ভাইকে নিয়ে মিথিলায় জনক রাজার কাছে গেলেন, উদ্দেশ্য হরধনু ভঙ্গ করে শ্রী রাম সীতাকে বধূরূপে গ্রহণ করবেন। ইতিপূর্বে সীতার স্বয়ম্বর সভার উদ্দেশ্যে জনকরাজা দেশ- দেশান্তরে বার্তা পাঠিয়েছেন। সমস্ত রাজন্যবর্গ, অসুরেরা উপস্থিত হলেন, কিন্তু কেহই হরধনুতে জ্যা রোপন করতে পারলেন না। রাক্ষসরাজ রাবন এসে অহঙ্কারে স্ফীত হয়ে ধনুকে জ্যা পরাতে গেলেন। কিন্তু জ্যা রোপন করাতো দূরের কথা, ধনুকটি তিনি তুলতেই পারলেন না। অধোবদন হয়ে তিনি লঙ্কায় পালিয়ে গেলেন। পরের ঘটনা হরধনু ভঙ্গ করে সীতাকে বিবাহ করে শ্রীরামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরে যাবার পরে তাঁর রাজ্যাভিষেকের সময় বিমাতা কৈকেয়ীর আদেশে চতুর্দশ বৎসর বনবাসে গমন, সীতা হরণ এবং শ্রীরাম কর্তৃক দশানন রাবন নিহত হওয়া। এই ঘটনা আমরা প্রায় সকলেই জানি। কিন্তু যে আলেখ্যটি অবতারণা করার জন্য আমার এই লেখা সেটি হল অদ্ভুত রামায়ণের ঘটনা উপস্থিত করা।                                         

     মিথিলা থেকে অযোধ্যায় ফেরার পথে ক্রুদ্ধ ভার্গব পর্বতের ন্যায় শ্রীরামচন্দ্রের যাত্রা পথ অবরোধ করে বললেন হে রাম, তুমি আমার গুরুর আশীর্বাদ পূত ধনুকটিতে জ্যা রোপন করে সীতাকে লাভ করেছ সত্য, কিন্তু আমার কাছে যে ধনুকটি দেখছো সেটিতে তুমি জ্যা রোপন করতে পারলে আমি তোমার বীরত্ব স্বীকার করব। দুটি ধনুকের বিবরন দিলে এই ধনুকটির ক্ষমতা তুমি অনুধাবন করতে পারবে। দুটি ধনুকই দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার নির্মিত। মহাকবি বাল্মিকী রামায়নে পরশুরামের যে উগ্রমূর্তির বিবরন দিয়েছেন সেটি এইরূপ। “দদর্শ ভীমসঙ্কাশং জটামণ্ডলধারিণম্। ভার্গবং জামদগ্নেয়ং রাজা রাজবিমর্দণম্। কৈলাসমিব দুর্ধষং কালাগ্নিমিব দুঃসহম্।”। প্রথম ধনুকটি যেটি তুমি ভেঙ্গেছ সেটি দেবতারা মহাদেবকে দিয়েছিলেন এবং মহাদেব সেই ধনুক দিয়ে ত্রিপুরাসুরকে বধ করেন। ত্রিপুরাসুরকে বধ করার পরে সেই ধনুকটিই মহাদেব পুনরায় দেবতাদের দান করেছিলেন এবং দেবতারা সেই ধনুকটি জনক রাজার কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন। আবার বিশ্বামিত্র মুনিকে জনক রাজা হরধনু বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন দক্ষযজ্ঞ ধ্বংসের পরে মহাদেব সেই ধনুকটি দেবতাদের দিয়েছিলেন এবং দেবগন জনক রাজার পূর্বপুরুষদের কাছে সেই ধনুকটিকে গচ্ছিত রেখেছিলেন। পরশুরামের এই কথাতে কিছু বিভ্রান্তি এসে যায়। কারণ মহাকবি বাল্মিকীর রামায়ণে উল্লেখ করেছেন - দ্বিতীয় ধনুকটির সম্বন্ধে পরশুরাম শ্রীরামচন্দ্রের কাছে বললেন ‘একদিন ব্রহ্মার কাছে দেবতারা এসে জিজ্ঞেস করলেন হরি ও হরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে? শ্রেষ্ঠত্বের অভিপ্রায়ে হরি ও হর নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করলেন। বিষ্ণুর হুঙ্কারে শিবের ধনুক হাত থেকে শিথিল হয়ে পড়ে যায়। শিবের হাত থেকে ধনুকটি শিথিল হয়ে পড়ে যেতে দেবতারা স্বীকার করলেন বিষ্ণুই শ্রেষ্ঠ। শিব হতাশ হয়ে সেই ধনুকটি চন্দ্র বংশের রাজা দেবারতকে দান করেন। সেই ধনুকটি ছিল বিষ্ণুর মন্ত্রপূত বৈষ্ণবধনু। কালক্রমে সেই ধনুকটি ভৃগু বংশীয় ঋচীক মুনির কাছে আসে এবং তিনি সেটি জমদগ্নিকে দান করেন। পিতার কাছ থেকে সেই ধনুকটি নিয়ে পরশুরাম পৃথিবীতে ক্ষত্রিয়বংশ নাশ করেন।সেই ধনুকটি এই দ্বিতীয় ধনু।’  পরশুরামের অহংকারকে চূর্ণ করার জন্য শ্রীরাম সেই ধনুকটিতে অবলীলায় জ্যা রোপন করে সুতীক্ষ্ণ টঙ্কার দিয়ে যখন শর যোজনা করে নিক্ষেপ করতে যাচ্ছেন সেই সময়ে পরশুরাম শ্রীরামকে বললেন শর নিক্ষেপের প্রয়োজন নেই। আমি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করছি তোমার মত বীর ও ধনুর্ধর ত্রিজগতে আর কেহ নাই। আশীর্বাদ করছি তুমিই একমাত্র দশানন রাবনকে বধ করতে পারবে। এই কথাগুলি বলার পরে পরশুরাম তাঁর সমস্ত শক্তি হারিয়ে মহেন্দ্র পর্বতে চলে গেলেন।         

      উপরের ঘটনায় আমরা লক্ষ্য করলাম আদি কবি বাল্মিকী রামায়ণে শ্রী রামচন্দ্রের শৌর্য-বীর্য এবং সীতা দেবীর জন্ম রহস্য বিবাহ সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। আবার সেই বাল্মিকীই যখন শিষ্য ভরদ্বাজের সাথে কথোপকথনে বলছেন সীতা রাবনজায়া মন্দোদরীর কন্যা। সেই ঘটনা তিনি বিবৃত করেছেন 'অদ্ভূত রামায়ণে'মূল রামায়ণে যেখানে সপ্তকাণ্ড, পাঁচশো সর্গ, চব্বিশ হাজার শ্লোক, অদ্ভূত রামায়নে সেখানে মাত্র সাতাশটি সর্গ, ১৩৫৩ শ্লোক। পণ্ডিতগন কিন্তু অদ্ভুত রামায়ণকে নস্যাৎ করতে পারেননি। তাঁরাও স্বীকার করে নিয়েছেন অদ্ভুত রামায়ণের কাহিনী। সেই অদ্ভুত রামায়ণ শুরু হয়েছে সীতাকে শ্রীরামচন্দ্র বিবাহ করে অযোধ্যায় যাবার পথে যেখানে পরশুরামের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটেছিল। সেখানে আমরা দেখতে পাই ব্রহ্মার বরে দশানন রাবণ দেব, দৈত্য, যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্ব সকলের কাছে অজেয়। রাবণ দণ্ডকারণ্য মহারণ্যে প্রবেশ করে দেখলেন শান্ত আরণ্যক পরিবেশে মুনি-ঋষিরা তপস্যা করছেন। তাঁরা সকলেই ধ্যানস্থ। বাতাসে স্বর্গীয় পরিবেশ। এই শান্ত ও স্বর্গীয় পরিবেশ বলদর্পী রনোন্মত্ত অসুরের অসহ্য। রাবন প্রচণ্ড হুঙ্কারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে মুনি-ঋষিদের তপস্যাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করলেন। তার সৈন্যরা জঙ্গলের শান্তি বিঘ্নিত করতে লাগলো। তাদের অস্ত্রের আঘাতে বনস্পতিরা ধরাশায়ী, প্রানভরে জীবকুল পলায়নরত। মুনি-ঋষিরা চোখ মেলে দেখলেন এক উদ্ধত, রণোন্মত্ত, রাক্ষসদের তাণ্ডব। রাবণ তাঁদের বললেন - আমি দশানন রাবণ স্বর্গ মর্ত পাতালের অধীশ্বর। আজ থেকে তোমরা বেদ মন্ত্রের পরিবর্তে আমার বিজয় ঘোষণা করবে। তোমরা আমার শাসনাধীন। মুনি-ঋষিরা সমস্বরে বললেন আমরা কারোরই শাসনাধীন নই। আমরা কেবলমাত্র ঈশ্বরের পুত্র। তাঁর নাম গান ছাড়া অন্য কোন নাম আমরা জানি না। রাবণ আরক্ত নয়নে তাঁদের বললেন তার কথার অমান্য যে করবে তার প্রাণ যাবে। রাবনের সেই কথা শুনে মুনি-ঋষিরা হাসতে লাগলেন। রাবণ স্থির করলেন এই সমস্ত অবাধ্য মুনি-ঋষিদের হত্যা করে তাদের তাজা রক্ত পান করবেন। এই ভেবে রাবণ তার সৈন্যসামন্তদের নির্দেশ দিল সমস্ত মুনি-ঋষিদের হত্যা করে সেই রক্ত নিয়ে আসার জন্য। একসময়ে রুধির পান করে রাবণ ক্লান্ত হয়ে পড়ল।                                     


    সেই গহন অরণ্যে মুনি-ঋষি তাপসেরা ছাড়াও এক ব্রাহ্মণ তাঁর পরিবার নিয়ে বাস করতেন। সেই ব্রাহ্মণের নাম ছিল গৃৎসমন্দ। তাঁর কয়েকটি পুত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁর স্ত্রীর মনে শান্তি ছিলনা। প্রায়ই তাঁর স্ত্রী বলতেন তাদের কোন কন্যা সন্তান না থাকায় সংসার যেন শ্রীহীন। ভগবান যদি মা লক্ষ্মীর মত সর্বসুলক্ষনাযুক্ত একটি কন্যারত্ন তাঁদের সংসারে পাঠাতেন তাহলে সংসারটি সম্পূর্ণ হত। তাঁরা উভয়েই নারায়ণের ধ্যান করতেন। ব্রাহ্মণ ধ্যান করার পরে কুশাগ্রে দুগ্ধ গ্রহণ করে সেই দুগ্ধ একটি কলসীতে জঙ্গলের মধ্যে রেখে গৃহে ফিরে আসতেন। এদিকে রাবণ জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে সেই কলসীটি দেখতে পেয়ে ভাবল ভালোই হলো, সব রক্ত একবারে পান করা যাবে না। এই কলসীর মধ্যে মুনি-ঋষিদের রুধির রেখে সেটিকে পূর্ণ করে লঙ্কায় নিয়ে যাব। ব্রাহ্মণের সঞ্চিত দুধের সাথে ঋষি শোনিতের মিশ্রণে বীর্যের সৃষ্টি হলো। লঙ্কায় যেয়ে রাবন তার স্ত্রী মন্দোদরীকে সেই কলসীটি রাখতে গিয়ে বললেন এতে ঋষি রক্ত আছে কেউ যেন ভুল করেও এটি পান না করে। কারণ এই রক্ত গরলের চেয়ে ও তীব্র।                                          

     এদিকে রাবণ পুনরায় যুদ্ধজয়ে বেরিয়ে পড়লো। স্বর্গ মর্ত্য পাতালে কোন সুন্দরী নারীর রেহাই নেই রাবণের কামার্ত দৃষ্টির সম্মুখে। এই সমস্ত কথা মাঝে মাঝে রানী মন্দোদরীর কানে আসতে একদিন রানী মন্দোদরী নিজের জীবনের উপরে ধিক্কার এসে গেল। তিনি ভাবলেন দানবকুলের শ্রেষ্ঠা সুন্দরী হয়েও স্বামীকে বশে রাখতে পারেননি। স্থির করলেন বিষপান করে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাবেন। মনে পড়ে গেল রাবণ তাঁকে একটি কলসী রাখতে দিয়ে বলেছিলেন তাতে গরলের থেকেও তীব্র বিষ আছে। মন্দোদরী ক্রোধে সেই কলসীর দুগ্ধ মিশ্রিত শোণিতের সামান্য অংশ পান করলেন। দৈবের বিধানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন না করে রানী মন্দোদরী গর্ভবতী হয়ে পড়লেন এবং রাবণের অনুপুস্থিতিতে কিভাবে তিনি গর্ভবতী হলেন এই চিন্তায় তিনি তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন। কুরুক্ষেত্রে গিয়ে তিনি এক কন্যার জন্ম দিলেন। কিন্তু কন্যাকে নিয়ে তিনি কোথায় যাবেন। চিন্তার সমুদ্র পার না হতে পেরে কুরুক্ষেত্রের ভূমিতে সেই কন্যাকে প্রোথিত করে সরস্বতীর জলে স্নান করে লঙ্কায় ফিরে গেলেন।                                

 

 

 

জনক রাজা কুরুক্ষেত্রে এলেন। যজ্ঞভূমি নির্মাণের জন্য হলকর্ষণ করতে যেয়ে দেখলেন লাঙ্গলের ফলা মাটি বিদীর্ণ হয়ে এক অপরূপা কন্যা ভূমিতে শায়িত। তিনি সেই কন্যাকে নিয়ে যেয়ে রাজ অন্তঃপুরে রাণী সুনয়নার হস্তে অর্পণ করলেন। বিধির বিধানে সেই কন্যাই যৌবনে বরমাল্য অর্পণ করলেন অযোধ্যার রাজকুমার শ্রীরামচন্দ্রের গলায়। ভূমিলক্ষ্মী সীতা ধরিত্রীর মতান্তরে মন্দোদরীর কন্যা। রাবণ যখন সীতাকে হরণ করে এনে অশোকবনে রেখেছিলেন তখন মন্দোদরী অপত্যস্নেহে সীতাকে রাবনের কামার্ত দৃষ্টির সামনে থেকে রক্ষা করেছিলেন। সীতার জন্মের আবার একটি অন্য আখ্যান আছে। মন্দোদরী রাজপ্রাসাদেই এক কন্যার জন্ম দেন। রাবণ কন্যাকে দেখে আনন্দিত। শাস্ত্রজ্ঞ জ্যোতিষী ভাই বিভীষণ সর্ববিধ বিচার করে বললেন 'দাদা এটি তোমার মৃত্যুবাণ, রাক্ষসকুল ধ্বংস করার জন্য এই কন্যার জন্ম। বিভীষনের ভবিষ্যৎ বাণী শুনে রাবন হতচকিত হয়ে গেলেন। সেই ভবিষ্যৎবাণী শুনে মন্দোদরীর গর্ভে জীবনের মৃত্যুরূপা শিশুকন্যাটিকে নদীতে নিক্ষেপ করলেন। শিশুকন্যাটি ভাসতে-ভাসতে কুরুক্ষেত্রের ভূমিতে যেয়ে উপস্থিত হলো। এর পরের ঘটনা জনক রাজার লাঙ্গলের ফালে ভূমি বিদীর্ণ হয়ে প্রাপ্ত সেই কন্যাকে জনক রাজা কন্যা স্নেহে পালন করেছিলেন।                

     মন্দোদরী ছিলেন শাপভ্রষ্টা অপ্সরা। যদিও তিনি এই জন্মে রাক্ষস শ্রেষ্ঠ দশাননের ঘরনী। কিভাবে তিনি রক্ষকুল অধিপতি দশাননের প্রধানা মহিষী হলেন সেই ঘটনা দেখতে যেয়ে আমরা ফিরে চলে যাই অতীতে। কাহিনীর শুরু কৈলাসে।                              

      কার্তিকেয়র জন্মতিথিতে ব্রাহ্মন ভোজন করাবার জন্য পার্বতী কয়েকদিনের জন্য কৈলাস থেকে পিতৃগৃহে চলে গেলেন। মহাদেব একা। এই সময় মধুরা নামে একজন অপ্সরা মহাদেবকে প্রণাম করতে এলেন। প্রণাম পরিণত হলো বিহারে। পার্বতী ফিরে এসে সব ঘটনা জানতে পারেন তার অবর্তমানে শিব ঠাকুর কি করেছেন। সেই দিনটি ছিল সোমবার। মধুরা সূর্য পূজা করে মহাদেবের কাছে এসেছিলেন এবং তারপর দুজনে রঙ্গ করেছেন মনের আনন্দে। ক্ষুব্ধ পার্বতী মধুরাকে শাপ দিলেন 'তুই ভেক হয়ে একটা কূপের মধ্যে পড়ে থাক'মধুরা শিব ঠাকুরের পা জড়িয়ে বললেন 'ঠাকুর সব অপরাধ কি আমার? আমিতো এসেছিলাম আপনাকে প্রণাম জানাতে'মহাদেব বললেন আমি তোমাকে বর দিচ্ছি 'বারো বৎসর ভেক  হয়ে থাকার পরে তুমি আবার তোমার নিজের দেহ ফিরে পাবে। আর ত্রিভুবন বিজয়ী এক বীরের সঙ্গে তোমার বিবাহ হবে'ঘটনার গতি এরপরে অন্যদিকে চলল। মহামুনি কশ্যপ এবং দনুর পুত্র স্বর্গ-মর্ত্ত্য বিখ্যাত স্থপতি ময়। হিমালয়ে ব্রহ্মার তপস্যা করে তিনি শ্রেষ্ঠ স্থপতির আশীর্বাদপ্রাপ্ত হলেন। অসাধারণ সব প্রাসাদ নির্মাণ করে দেবতাদের তাক লাগিয়ে দিতেন। একবার দেবলোকের নৃত্যসভায় আমন্ত্রিত হলেন। সেই সভাতে ময় হেমা নামে এক অপ্সরার প্রেমে পড়লেন। দেবতারা দুজনের বিবাহ দিয়ে দিলেন। ময় দানব হিমালয়ের দক্ষিণে হেমপুর নগর নির্মাণ করে দীর্ঘকাল বাস করতে লাগলেন। ময়ের কোন কন্যা ছিল না। ময় এবং হেমা দুজনেই শিবের আরাধনা শুরু করলেন 'ঠাকুর, আমাদের একটি কন্যা দাও'ময় ও হেমা তপস্যায় বসলেন। সেই তপস্যা স্থলের অদূরে একটি কূপ ছিল। সেই কূপের মধ্যে মধুরা ব্যাঙ হয়ে জীবন অতিবাহিত করছিল। এই সময়ে তার অভিশাপের দ্বাদশ বৎসর শেষ হয়ে সে একটি সুন্দরী কন্যায় পরিণত হল। ময় ও হেমা একদিন কূপের থেকে এক কন্যার ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পেলেন। তারা এগিয়ে যেয়ে দেখলেন সে কূপের মধ্যে এক সদ্যোজাত কন্যাকে। তারা মনে মনে ভাবলেন মহাদেবের কাছে তারা তো একটি অমৃতার জন্য প্রার্থনা করছিলেন। একটি কন্যার কান্না শোনা যাচ্ছে তাহলে হয়ত মহাদেবই এই কন্যা রত্ন পাঠিয়েছেন। অপরূপা সুন্দরী শিশুকন্যাকে তারা কূপ থেকে উদ্ধার করে কোলে তুলে নিলেন। তার নাম রাখলেন মন্দোদরী। অতি যত্নে পালন করে বড় করে তুললেন। এই সময় ময় হীরক, বৈদুর্য, ইন্দ্রনীল খচিত স্বর্ণময় একটি অপূর্ব প্রাসাদ নির্মাণ করে সেখানে তারা বাস করতে লাগলেন। অভিশপ্ত অপ্সরা মধুরা মন্দোদরীর রূপে ময়দানবের সেই মায়া মহল আলোকিত হয়ে উঠল। একদিন ময় আর মন্দোদরী অরণ্য পথে বিচরণ করছেন। বসন্তের বাতাসে হিল্লোলিত বনস্থলী। এমন সময়ে বনপথে বিশাল এক মেঘ ছায়ার মতো আবির্ভূত হলেন রাবণ। তিনি মৃগয়া করে ফিরছিলেন। রাবণের দৃষ্টি সেই সুন্দরীর দিকে নিবদ্ধ হলো। ময় পরিচয় জানতে চাইলে রাবন বললেন 'আমি লঙ্কেশ্বর রাবণ। ত্রিভুবনের অধিপতি। আমি আপনারে কন্যাকে বিবাহ করব'রাবণের সঙ্গে মন্দোদরীর বিবাহ হয়ে গেল। যৌতুক হিসাবে রাবণ ময়দানবের কাছে পেয়েছিলেন একটি মহার্ঘ তীর। এই অস্ত্রটি ময় তপস্যা করে পেয়েছিলেন। ভীষন তার শক্তি। লঙ্কার যুদ্ধে এই অস্ত্রের সাহায্যে লক্ষণের শক্তিশেল হয়েছিল। মন্দোদরী ছিলেন রাবনের বিপরীত। রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে আসার পরে মন্দোদরী রাবণকে রাজসভায় বলেছিলেন সীতাকে ফেরত দিয়ে আসার জন্য। এইসব ঘটনা অনেক পরের।   

    অদ্ভুত রামায়ণ থেকে আমরা এবারে ফিরে চললাম কূর্ম পুরাণে। কূর্ম পুরানে আমরা দেখতে পাই দণ্ডকবনে যখন রাবন সীতাকে হরণ করতে উদ্যত  হয়েছিলেন সেই সময়ে সীতাদেবী অগ্নির কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন তিনি যেন দুষ্ট রাবণের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করেন। তাঁর প্রার্থনায় অগ্নিদেব সেই সময় সীতার শরীর থেকে ছায়া বা মায়া সীতার সৃষ্টি করেন এবং আসল সীতাকে তিনি নিজের কাছে রেখে দেন। রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে যাবার পরে লঙ্কায় শ্রীরামচন্দ্রের হাতে যুদ্ধে নিহত হওয়ার পরে বিভীষণ মায়া সীতাকে অশোক বন থেকে শ্রী রামের কাছে নিয়ে আসেন। সেখানে শ্রী রামচন্দ্র সীতার সতীত্ব পরীক্ষার জন্য যখন সীতাকে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করে তার সতীত্ব পরীক্ষা দিতে বলেন সেই সময়ে অগ্নিদেব আসল সীতাকে শ্রীরামচন্দ্রের হস্তে অর্পণ করে বলেন ' সীতা অগ্নির মতো পবিত্র। সীতার প্রার্থনায় আমি মায়া সীতাকে তৈরি করেছিলাম এবং রাবণ সেই মায়া সীতার হাত ধরে রথে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। আসল সীতাকে রাবণ আদৌ স্পর্শ করে অপবিত্র করতে পারেনি'অগ্নিদেবের এই কথায় শ্রীরামচন্দ্র সীতাদেবীকে পবিত্র ও নির্মল জ্ঞানে গ্রহণ করেছিলেন। গোস্বামী কবি তুলসীদাসও কূর্মপুরাণের এই ঘটনা স্বীকার করে রামচরিত মানসে সেই ছবি এঁকেছেন। নেপালী কবি ভানুভক্ত রচিত রামায়ণেও মায়া সীতার উল্লেখ আছে। কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃতেও কূর্মপুরাণের এই ঘটনার উল্লেখ করা আছে। চৈতন্যচরিতামৃতে উল্লেখ আছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু দাক্ষিণাত্য ভ্রমনের সময় মাদুরাইয়ে এক রাম ভক্তের সাক্ষাৎ পান। সেই রামভক্ত দিবারাত্রি বিলাপ করতেন ' রাবণের হস্তে সীতা লাঞ্ছিতা' বলে। এইরূপ বিলাপ করতে করতে তিনি অন্নজল ত্যাগ করেছিলেন। মহাপ্রভু সেই রাম ভক্ত ব্রাহ্মণকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন 'জগৎ মাতা লক্ষী রূপী সীতাকে রাবণ স্পর্শ করা তো দূরের কথা তার ছায়াও দেখতে পায়নি। সে কেবল মাত্র মায়া সীতাকে স্পর্শ করেছিল'মহাপ্রভুর এই আশ্বাসবানীতে রামভক্ত সেই ব্রাহ্মণ অন্নজল গ্রহণ করেছিলেন। এরপরে মহাপ্রভু রামেশ্বরে যেয়ে কূর্মপুরানণের সবিশেষ ঘটনা শুনে কূর্মপুরাণ পুঁথিটি স্বহস্তে মাদুরাই এনে সেই ব্রাহ্মণকে দেখিয়ে তাঁর কথার সত্যতা প্রমান করেছিলেন।    

    ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ও দেবীভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে সীতার অগ্নিপরীক্ষার পরে মায়া সীতা তাঁর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে শ্রীরামচন্দ্র ও অগ্নি দেবতাকে জিজ্ঞেস করাতে তাঁরা উভয়েই তাঁকে পুষ্কর তীর্থে যেয়ে মহাদেবের তপস্যা করতে আদেশ দেন এবং তপস্যার শেষে তিনি স্বর্গ লক্ষ্মীরূপে স্বর্গলোকে গমন করবেন এই আশ্বাসবাণী দেন। তিন লক্ষ বৎসর পুষ্করতীর্থে তপস্যা করার পরে মহাদেব তাঁর প্রার্থনা অনুযায়ী তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন পরবর্তী যুগে অর্থাৎ দ্বাপর যুগে তিনি পঞ্চস্বামীর স্ত্রী দ্রৌপদী রূপে জন্ম গ্রহণ করবেন। কারন তিনি পাঁচবার মহাদেবের তপস্যা করে স্বামী লাভের প্রার্থনা করেছিলেন। পুরাণকারেরা যাই বলুন না কেন এ যুগের বহু ধর্ম সংস্কারক বলেছেন সীতা দ্বাপরে দ্রৌপদী রূপে নয়, তিনি রাধা রূপে জন্মগ্রহণ করে প্রেমের বিরহে দগ্ধ হয়েছিলেন। দ্রৌপদী যজ্ঞ থেকে উত্থিতা বলে তাঁর আরেক নাম যাজ্ঞসেনী। এই সমস্ত পুরাণে আরো বলা হয়েছে মায়া সীতাই পূর্ব জন্মে ছিলেন বেদবতী এবং এই ভাবে তিনযুগে তিনি ভূমন্ডলে দুষ্ট দমনের কারণ স্বরূপ অবতীর্ণ হয়েছেন। তামিল রামায়ণে অবশ্য বলা হয়েছে মায়াসীতা তাঁর পরবর্তী জন্মে কলিযুগে পদ্মাবতী রূপে আবির্ভূতা হয়ে শ্রী ভেঙ্কটেশ্বরকে স্বামী রূপে পাবেন।  

    রামায়ণের সমস্ত ঘটনাই পূর্ব্বনির্দিষ্ট। শ্রী রামচন্দ্রের জন্মের বহু পূর্বে আদি কবি বাল্মিকী সপ্তকাণ্ডে, পাচশো সর্গে, চব্বিশ হাজার শ্লোকে সমস্ত ঘটনা বিবরণ তাঁর পুঁথিতে লিখে রেখেছিলেন। সপ্তম খন্ডে উত্তরাকাণ্ডে তিনি লিখেছেন প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য প্রজানুরঞ্জক রাম সীতাকে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন যখন সীতাদেবী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। পদ্মপুরাণে এই ঘটনাটি অন্যভাবে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে শুক ও সারীর অভিশাপের কারণে মা জানকীকে বনবাসে যেতে হয়েছিল। সেই অভিশাপের ঘটনা বর্ণনা করতে যেয়ে আমরা সময়ের সারণিতে অতীতে ফিরে যাচ্ছি।    

      জনক রাজার গৃহে সীতাদেবী বিবাহের পূর্বে প্রাসাদ সংলগ্ন বাগিচাতে বসে ছিলেন। এমন সময় এক বৃক্ষে শুক পাখী রামায়ণের কথা আলোচনা প্রসঙ্গে সারীকে রাম সীতার কাহিনী বর্ণনা করছিল। সীতাদেবী পাখীদের সব কথা বুঝতে না পারলেও দুটি শব্দ অনবরত তাঁর কানে বাজতে লাগল - রাম ও সীতা। তিনি ভাবলেন তাঁর নাম তো সীতা, রাম তাহলে কার নাম। তিনি সখীদের আদেশ দিলেন পাখী দুটিকে ধরে তাঁর কাছে নিয়ে আসার জন্য। পাখী দুটিকে ধরে আনার পরে তারা বেরিয়ে যাবার জন্য ছটফট করতে লাগলো। তাদেরকে খাবার দিয়ে শান্ত করার পরে সীতাদেবী জিজ্ঞেস করলেন 'তোমরা যে অহরহ রাম সীতার নাম বলছো সেই প্রেমময় রাম কে? তাঁর নাম শুনতে আমার খুব ভালো লাগছে। কি তাঁর পরিচয়, কোথায় নিবাস এবং তোমরা তাঁর নাম কি করে জানলে সেই ঘটনা আমাকে তোমরা বলো। শুক পাখী শান্ত হয়ে বলল 'আমরা বাল্মীকির তপোবনে থাকি। তাঁর কাছে আমরা রাম সীতার সমস্ত ঘটনা শুনেছি। তিনি তাঁর শিষ্যদের বলেছেন সেই ঘটনা ঘটবে'সীতা বললেন 'আমাকে তোমরা সেই সমস্ত ঘটনা শোনাও। তোমরা যে সীতার নাম বলছ আমিই সেই জনক দুহিতা সীতা। কিন্তু সেই রাম দেখতে কেমন,তার গুণাগুণ সব আমাকে বলো। সীতার কথায় আশ্বস্ত হয়ে শুক পাখী বলতে শুরু করল 'সূর্য বংশের রাজা দশরথের চার পুত্র-  শ্রীরামচন্দ্র, ভরত, লক্ষণ ও শত্রুঘ্ন। সেই রামের কি বর্ণনা দেব। তিনি পদ্মপলাশ লোচন দূর্বাদল শ্যাম, আজানুলম্বিত বাহু, সুদীর্ঘ নয়নযুগল, উন্নত নাসিকা। সবাই তাঁর গুনগান গায়। রাজা দশরথের নয়নের মনি। তিনি ধনুকে শর যোজনা করলে পৃথিবী থরহরি কম্পমান। রাক্ষসদের অত্যাচারে মুনি ঋষিরা সেজন্যই রাজর্ষি বিশ্বমিত্রকে রাজা দশরথের কাছে পাঠালেন যাতে শ্রীরাম লক্ষণ এসে সমস্ত রাক্ষসদের বধ করে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। শ্রীরাম, লক্ষণ সমস্ত রাক্ষসদের নিধন করে মিথিলা নগরে আসবেন। শ্রীরাম হরধনু ভঙ্গ করে মা জানকীকে পত্নী রূপে লাভ করবেন'এই পর্যন্ত শুনে সীতাদেবী অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে পাখী দুটিকে আর ছাড়তে চাইলেন না। পাখী দুটি অনেক অনুনয় বিনয় করে বলল 'আমরা বনের পাখী, আমাদের তুমি আটক করে রেখো না'সীতা দেবী বললেন 'আমি তোমাদের কাছে শুধুমাত্র সেই মধুর রাম কথা শুনবো'শুক পাখী বলল 'দেখো সারী অন্তঃসত্ত্বা। এখন আমাদের ছেড়ে দাও, সন্তানের জন্মের পরে তোমাকে এসে রামায়ণ গান শোনাবো'সীতা বললেন 'শুক, তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি কিন্তু সারীকে আমি যত্ন করে রাখব, তার কোনো কষ্ট হতে দেবোনা'শুক বলল 'দেখো সাথীকে ছাড়া আমি একাকী যেমন থাকতে পারবো না তেমনি সারীও একাকী থাকতে পারবে না'কিন্তু সীতাদেবী নাছোড়বান্দা। তিনি সারীকে যেতে দিলেন না। বললেন 'আমি সারীর কাছেই রামের গুণ গান শুনবো'সারী তখন সীতাকে অভিশাপ দিয়ে বললে 'দেখো গর্ভাবস্থায় তুমি যেমন আমার পতির সাথে আমার বিচ্ছেদ ঘটালে ভবিষ্যতে গর্ভাবস্থায় তোমার সাথে শ্রীরামের বিচ্ছেদ ঘটবে'এই বলে সারী মনের কষ্টে সেই স্থানে মারা গেল। সারীকে মারা যেতে দেখে শুক সীতাকে অভিশাপ দিয়ে বলল 'আমার সাথীকে তুমি হত্যা করলে। আমিও আমার এই শরীর গঙ্গায় বিসর্জন দিতে চললাম। তবে তার আগে আমি তোমাকে বলে যাচ্ছি আমার মৃত্যুর পরে আমি অযোধ্যা নগরে পুনরায় জন্ম নিয়ে তোমার বনবাসের কারণ হবো। আমার কথাতে শ্রীরামচন্দ্র তোমাকে বিসর্জন দিবেন'এই বলে শুক পাখি আকাশে উড়ে চলে গেল। এই শুক পাখী এরপরে অযোধ্যা নগরে ক্রোধন নামে এক রজকরূপে জন্ম নেয় এবং শ্রীরামচন্দ্র রাজা হওয়ার পরে এই ক্রোধন রজক শ্রীরামচন্দ্রের সভায় সীতার সম্বন্ধে বলেছিল দশ মাস রাবণের ঘরে থাকায় তাঁর শুচিতা সম্বন্ধে প্রজাদের সন্দেহ হয়। তার কথাতেই শ্রীরামচন্দ্র পাত্র মিত্রদেরই কাছে এই কথার সত্যতা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে লোক অপবাদের ভয়ে পাঁচ মাস অন্তঃসত্ত্বা কালীন সীতাকে বনবাসে প্রেরণ করেন। 

      দশানন রাবন নিহত হবার পরে দেব, মানব যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্ব প্রত্যেকেই আনন্দিত। একদিন রামচন্দ্রের সভায় মুনি-ঋষিরা সমবেত হয়ে বললেন 'রাম, তুমি দশানন রাবণকে বধ করেছে সত্য কিন্তু সহস্রানন রাবন এখনো জীবিত'এর উত্তরে শ্রীরামচন্দ্র তাদের জিজ্ঞেস করলেন 'সহস্রানন রাবন কোথায় আছে - মর্ত্যে না পাতালে?' তার উত্তর মুনিরা বললেন 'সহস্রানন রাবন পুষ্করে আছে' এবং এই কথায় সীতাদেবী সম্মতি জানালেন।

       শ্রীরামচন্দ্র তখন সহস্রানন রাবনের জন্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করাতে সীতাদেবী পূর্বাপর সব ঘটনার উল্লেখ করে বললেন 'আমার বিবাহের পূর্বে এক ব্রাহ্মণ এসে আমার পিতাকে অনুরোধ করে বলেছিলেন তাঁর আপত্তি না থাকলে তাঁর আবাসে ব্রাহ্মণ বর্ষার চার মাস অবস্থান করবেন। জনক রাজা সন্তুষ্ট হয়ে ব্রাহ্মণকে রাজপ্রাসাদে অবস্থানের অনুমতি দিয়ে জানকীকে ব্রাহ্মণের সেবার দায়িত্ব দিলেন। সেই ব্রাহ্মণ অবস্থানকালে সীতাকে বলেছিলেন 'মা পৃথিবীতে দধি সমুদ্রের ওপারে ক্ষীর সমুদ্র নামে এক সমুদ্র আছে। তার নাম স্বাদুদক এবং সেই ক্ষীর সমুদ্র পুষ্কর দ্বীপকে বেষ্টন করে আছে যেখানে ব্রহ্মার পদ্মাসন আছে। সেই দ্বীপে মহাশক্তিধর বিশ্বশ্রবা মুনি এবং তার পত্নী, রাক্ষসরাজ সুমালীর কন্যা, নিকষা বাস করতেন। ব্রহ্মার বিধানে সেই নিকষার গর্ভে দুই রাবনের জন্ম হয়। তাদের জন্মের সময় ভূমন্ডল বিপদের আশঙ্কায় আলোড়িত হয় বলে তাদের নাম হয় রাবণ (বিকট রব বা শব্দ করে জন্মানোর জন্য)। প্রথমজন দশানন রাবণ স্বর্ণভূমি লঙ্কায় বাস করতে গেল এবং দ্বিতীয়জন সহস্রানন রাবণ পুষ্করে থেকে গেল।                                     

       সহস্রানন রাবন কিভাবে নিহত হবে জানতে চাওয়াতে মুনি-ঋষিরা বললেন প্রভু সহস্রানন রাবণকে একমাত্র বধ করতে পারবেন মা জানকী। এই কথা শুনে শ্রীরামের মনে অহংকার হল। তিনি ভাবলেন আমি ত্রিলোক জয়ী দশাননকে বধ করেছি। আমি যাকে বধ করতে পারব না তাকে সামান্য নারী সীতাদেবী কিভাবে বধ করবেন। তাঁর মনে অহংকারের উন্মেষ ঘটতে দেখে মুনি-ঋষিরা বললেন 'দেখ, রঘুকুলমনি রাম, যে হরধনুতে জ্যা রোপন করে সীতাদেবীকে স্বয়ংবর সভায় তুমি লাভ করেছে সেই হরধনু সীতাদেবী প্রত্যহ তুলে মার্জনা করে রাখতেন। এই কথার সত্যতা নিরূপণের জন্য শ্রী রামচন্দ্র সীতা দেবীর উত্তরের আশায় তাঁর মুখ পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।

  

     সীতা দেবী তখন বললেন দক্ষযজ্ঞ ধ্বংসের পরে মহেশ্বর এই ধনুকটি দেবতাদের দিয়েছিলেন এবং দেবতারা সেই ধনুক আমার পিতাকে গচ্ছিত রাখতে অনুরোধ করে বলেছিলেন যে এই ধনুতে গুণ পরাতে পারবে সীতা তাঁর গলাতেই বরমাল্য দিবে। প্রশস্ত একটি ঘরে একটি সিন্দুকের ভিতরে সেই ধনুকটি আমার পিতা রেখেছিলেন। একজন দাসী প্রত্যহ সেই সিন্দূকের ডালাটি খুলত এবং আমি ধনুকটি প্রত্যহ সিন্দূক থেকে বের করে মার্জনা করে পুনরায় সিন্দূকে রাখতাম। মহর্ষি বিশ্বামিত্র সীতাদেবীর এই কথায় স্বীকারোক্তি করলেন।

 

     এই কথা শুনে শ্রীরামচন্দ্র ভরত, লক্ষণ, শত্রুঘ্ন এবং বানর সৈন্যদের আদেশ দিলেন যুদ্ধযাত্রার জন্য। এমন সময়ে অকস্মাৎ দৈববাণী হলো ‘রাবণের নিবাস ছিল একশো যোজন দূরে কিন্তু সহস্ত্রানাম রাবণের আবাস এক হাজার যোজন দূরে।‘ এই কথা শুনে বীর হনুমান তাঁর লেজ বিস্তৃত করতে আরম্ভ করলেন সেই পুষ্কর দ্বীপ পর্যন্ত। তাঁর লেজের ওপর ভর করে সমস্ত বানর সৈন্য এবং অযোধ্যার সৈনদল সেখানে যেয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে যেয়ে তারা দেখলেন উল্লঘ্ন প্রাচীরবেষ্টিত সেই দ্বীপ। হনুমান সক্রোধে পদাঘাতে সেই প্রাচীর বিনষ্ট করে সৈন্যদের যাতায়াতের পথ সুগম করে দিলেন।                               

      সহস্রানন রাবনের সাথে যুদ্ধে শ্রীরাম, লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন এবং সমস্ত সৈনদল পরাজিত হয়ে সহস্রানন রাবনের বানে মূর্চ্ছা গেলেন। একমাত্র জীবিত ছিলেন বীর হনুমান। সেই সময়ে সীতাদেবী রণস্থলে পৌঁছে প্রাণাধিক শ্রীরাম, দেবরদের এবং বানর কুলের অবস্থা দেখে ক্রোধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন। সেই সমরাঙ্গনে গর্গ মুনি এসে মা সীতাকে উপদেশ দিয়ে বললেন হনুমানের দ্বাদশাক্ষর মন্ত্র জপ করতে। সেই মন্ত্র জপ করে সীতাদেবী চতুর্ভূজা মহা কালীর রুদ্ররূপ ধারণ করে হুংকার দিয়ে এক লাফে সহস্রানন রাবণের সম্মুখে হাজির হয়ে খড়্গ দিয়ে তার এক হাজার মাথা ক্রমান্বয়ে দ্বিখন্ডিত করে দিলেন। তাঁর দেহ হতে মাতৃকাগণ নিষ্ক্রান্ত হয়ে সমস্ত রাক্ষস সৈন্যদের মস্তক নখরাঘাতে ছিন্ন করে বধ করলেন। এই মাতৃকাগন হলেন - প্রভাবতী, বিশালাক্ষী, পালিতা, গোনসী, জয়াবতী, মালতিকা, ধ্রুবরত্না, বিশাকা, কমলাক্ষী, শোভনা, মাধবী, গীতপ্রিয়া, চিত্রসেনা, মেঘ বাহিনী, সুভগা, লুম্বিনী ও রোচমানা, সুরোচনা এবং বিশিরা।    

    তাঁর রুদ্ররূপে স্বর্গ মর্ত্য, পাতাল প্রকম্পিত। দেবতাদের প্রার্থনায় মহাদেব মহাকালীকে শান্ত করতে এলেন। তিনি ভয়ংকরী শক্তিকে শান্ত করতে রণাঙ্গনে মায়ের পদতলে নিজের বুক পেতে দিলেন। তাঁর বুকের উপরে নিজের পা দেখে মা শান্ত হয়ে লজ্জিত হলেন। তখন ব্রহ্মা স্তব শুরু করলেন - 'মা জগৎ জননী, তুমিই সকল সৃষ্টির আধার। তোমার শক্তিতেই সকলের তেজ। তুমি সনাতনী মায়া শক্তি, সকল শক্তির আধার। তুমি শান্ত হও মা, পৃথিবী শান্ত হোক'সেই উগ্র মূর্তি ভীষণা মহাকালী ব্রহ্মাকে বললেন 'আমি শান্ত কিছুতেই হবো না। এই প্রপঞ্চ জগতসংসারকে ধ্বংস করে তার উপরে আমি নৃত্য করব। আমার স্বামী, দেবরেরা, প্রাণাধিক বানর কুল সব রাক্ষসের প্রহারে অচৈতন্য, মৃতবৎ। তাঁর এই কথা শুনে ব্রহ্মা তাঁর কমণ্ডলু থেকে শান্তিবারি সকলের উপরে ছিটিয়ে দিতে সবাই চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলেন সীতার পরিবর্তে মহাকালীকে। পদ্মপলাশ লোচন রঘুবীর জিজ্ঞেস করলেন 'কে তুমি মা রনরঙ্গিনী। সীতাদেবী বললেন 'আমি সীতা, সাহস্রানন রাবনকে বধ করার নিমিত্তে  আমি মহেশজায়া পরমা শক্তি বিশ্বেশ্বরী। আমার মহিমা অনন্ত। সংসারের মায়া জাল থেকে জীবকে আমি উদ্ধার করি বলে আমার নাম মহাকালী। আমি তোমাকে আমার স্বরূপ প্রত্যক্ষ করাচ্ছি, তুমি নয়ন মেলে দেখ। শ্রী রামচন্দ্র সীতার প্রকৃত রূপ দর্শন করে ভাবে তন্ময় হয়ে তাঁর স্তব করতে শুরু করলেন - 'ওঁ অয়ি সীতা, মা, পরমা শক্তি, অনন্ত, নিষ্কলা, অমলা, শান্তা, মহেশ্বরী, নিত্যা, শাশ্বতী, পরমা, অক্ষরা জানকী'শ্রী রামের স্তবে তুষ্ট হয়ে সীতা নিজ রূপ ধারন করে বললেন 'রঘুবীর পৃথিবীতে একটিই সূর্য, তুমি উদয়াচলে আর আমি অস্তাচলে। তোমায় আমায় কোনো প্রভেদ নেই। তোমার সীমা অসীম আকাশে আমার সীমা ধরিত্রীর বুকে। তুমি পুরুষ, আমি প্রকৃতি। পুরুষ ও প্রকৃতির ক্রিয়াতেই জগৎ সংসার আবর্তিত। শক্তি না থাকলে শিব অচল। আমার শক্তিতেই তুমি ক্রিয়া করেছ। দেবের বিধানে তুমি দশাননকে বধ করেছ, কিন্তু পৃথিবী নিষ্কণ্টক হয়নি সহস্রানন রাবণের প্রতাপে। সেই সহস্রানন রাবন জগৎ শক্তির পদতলে প্রাণ দিয়েছে। তুমি আমি মিলে পৃথিবীতে রাক্ষস মুক্ত করেছি। এই পৃথিবী সকলের বাসযোগ্য হোক। বনে বনে কুসুম মঞ্জরিত হবে, পাখীদের কলতানে মুখরিত হবে, মুনি-ঋষিদের পবিত্র বেদধ্বনিতে আকাশ বাতাস অনুরণিত হবে। আমি এরপর এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেব। তুমি প্রভু আগে এসেছো, পরে যাবে। তোমার আগে ভ্রাতৃসম দেবর লক্ষণ সরযূর জলে প্রাণ বিসর্জন দিবে। তারপরে তুমি, ভরত, শত্রুঘ্ন একত্রে ধরাধাম ত্যাগ করে গোলোকে যাবে। এই কথাগুলি বলে তিনি বললেন 'আমার যাবার সময় হয়ে গেছে। ওই দেখো, ধরিত্রী মা আমাকে নিতে এসেছেন। সহসা সকলে দেখলেন এক আনন্দ নিন্দিত আওয়াজে সম্মুখের ভূমি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে সেখান থেকে মা বসুমতী রত্নসিংহাসন নিয়ে হাজির হয়েছেন তাঁর আদরের কন্যা জনমদুখিনী সীতাকে নিয়ে যাবেন বলে। সীতাদেবী রঘুবীরকে প্রণাম করে বললেন 'প্রভু আমি চির দুঃখী, কিন্তু আমার আসন মানবের অন্তরে। আর মানবের সেই অন্তরের অন্তঃপুর হলে তুমি। আমি থাকি অন্তরালে। আমি স্বধাম গোলোকে আগে যাচ্ছি, আমার পশ্চাতে তুমি এসে গোলকের রত্ন সিংহাসনে আরোহন করবে।' এই বলে সীতাদেবী পৃথিবীতে শ্রী রামচন্দ্রের বন্ধন কাটিয়ে স্বর্গলোকে চলে গেলেন।

 

 

 

আজ থেকে হাজার হাজার বৎসর পূর্বে আদি কবি বাল্মিকী রামায়ণ মহাকাব্য রচনা করে রাম সীতার যে সুনিপুণ চিত্র এঁকে গেছেন সেই ছবি আজকের যুগেও সমানভাবে সমাদৃত। এখনো পল্লীবাংলার বুকে গ্রীষ্মের দুপুরে কথক ঠাকুর সুর করে রামায়ণ পড়েন, মধ্য ভারতে নর্মদা তীরস্থ পাহাড় জঙ্গলের পথে এক গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যাবার সময় জনতা উচ্চৈঃস্বরে 'রামা হো রামা হো' বলে ঢোলোক বাজিয়ে চলে, উত্তর ভারতের গ্রামে-গঞ্জে তুলসীদাস রামায়ণের ব্যাপকতা, টিভির পর্দার সামনে লোকজনকে দেখেছি ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে রামায়ণের প্রত্যেকটি এপিসোড দেখতে। একি কোন আবেগ অথবা অন্তরের ব্যাকুলতা? রামায়ণের এই জনসমাদর রামায়ণকে পৃথিবীর আদি মহাকাব্যের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।                            

 

 তথ্যসূত্র - ১) বাল্মিকী রামায়ণ   ২) অদ্ভূত রামায়ন   ৩) কূর্মপুরাণ    ৪) ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ   ৫) দেবী ভাগবত

| বর্ষ বরণ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 29th Edition |

| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |

| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |

| Bengali New Year, 2022 | April-June 2022 | Fifth Year Third Issue |

© All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |

| a DISHA-The Dreamer Initiative |

No comments:

Post a Comment

Please put your comment here about this post

Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান