নব বরষে নবীন হরষে-গল্প
হৃদমাঝারে
পায়েল চট্টোপাধ্যায়
“আজ নববর্ষে শুনব আপনাদের মনের
কথা, হৃদমাঝারে
অনুষ্ঠানে, আপনাদের
সঙ্গে আমি অনিন্দিতা”। কথাগুলো শেষ করেই হেডফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাখল অনিন্দিতা।
পয়লা বৈশাখের ভ্যাপসা গরমেও স্টুডিওয় এসির হাওয়া কাঁপুনি ধরাচ্ছে। কম্পিউটারের সফটওয়্যার
থেকে গানটা চালিয়ে দিয়ে স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এলো আর জে অনিন্দিতা। ইঞ্জিনিয়ারদের
বলতেই হবে তাপমাত্রা বাড়ানোর কথা। প্রযুক্তিগত দিকগুলো ওরাই দেখে। পাঁচ মিনিট ছত্রিশ
সেকেন্ডের গান। ঝট করে স্টুডিও থেকে বেরিয়ে পড়ল অনিন্দিতা। কেউ কোথাও নেই।
ভোরবেলায় জনপ্রিয় রেডিও চ্যানেলের
এই অনুষ্ঠানটা অনিন্দিতার গলাতেই জনপ্রিয়। ‘হৃদমাঝারে’। পয়লা বৈশাখের বিশেষ অনুষ্ঠান
বলে প্রস্তুতিটাও তেমনভাবেই নিয়ে এসেছে ও। স্ক্রিপ্ট, অতিথির সঙ্গে
ফোনে কথা, শ্রোতাদের
অংশগ্রহণ আর মাঝে মাঝে গান,
মালা গাঁথার মত করেই অনুষ্ঠান সাজিয়েছে অনিন্দিতা।
ওর গলা নাকি সোজা শ্রোতাদের হৃদয়ের
অন্দরমহলে ঢোকে। মিঠে গলা,
স্মার্ট উপস্থাপনা। এসবের জন্যই নাকি অনিন্দিতা উন্নাসিক। তবে জনশ্রুতির তোয়াক্কা
করেনা ও। ও জানে ওকে এখনো অনেকটা উচ্চতা ছুঁতে হবে। “এসব গুঞ্জনকে পাত্তা দেওয়ার দরকার
নেই”। অনিন্দিতার ছিপছিপে কোমরে হাত রেখে এই হৃদমাঝারে অনুষ্ঠানের প্রযোজক সুমিত চৌধুরীও
এমনটাই বলে। অনিন্দিতারও তেমনটাই বিশ্বাস। আজ বাংলা নববর্ষের বিশেষ অনুষ্ঠানের গুরুদায়িত্ব
পেয়েছে অনিন্দিতা। সাধারণত অনুষ্ঠান করার আগে প্রযোজকদের সঙ্গে কথা বলার রেওয়াজ। তাদের
কথা মেনে তবেই অনুষ্ঠান সাজানোর অনুমতি মেলে। কিন্তু অনিন্দিতার ক্ষেত্রে এসব কোন নিয়ম
মানা হয় না। ও স্বনিয়ন্ত্রিত। বলা ভাল ওর অনুষ্ঠান ওই নিয়ন্ত্রন করে। আসলে রেডিও স্টেশনে
কান পাতলে সবচেয়ে বেশী যার গলা পাওয়া যায় সে হল অনিন্দিতা। মাখনের মত সাফল্য-পথ ওর।
শুরুর দিকে স্ট্রাগল থাকলেও বরফের মত সব বাধা গলিয়ে দিয়েছে অনিন্দিতা। তবুও মাঝে মাঝে
মনে পড়ে একটা চোখ। কেন যে কিছু স্মৃতির দরজা বন্ধ হয়ে যায় না?
অনিন্দিতার অনুষ্ঠানের আগে সাধারণত
স্বয়ং হেড-ইঞ্জিনিয়ার এসে চেক করে যান স্টুডিও। তবে আজ পয়লা বৈশাখের এই বিশেষ অনুষ্ঠানে
কি হলো?
নাহ! আজকের বিষয়টা নিয়ে অভিযোগ
জানাবে কর্তৃপক্ষের কাছে। কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় রেডিও অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকার প্রয়োজনে
পাশে কেউ নেই! এটা সহ্য করা যায় না! মোবাইলের বোতাম টিপে টুক করে সেলফিটা তুলে নেয়
ও। “ফিলিং চিলড”। সুমিত চৌধুরীকে পাঠিয়ে দেয়। সঙ্গে আদুরে ভয়েস মেসেজ। যা কাজ হওয়ার
এতেই হবে। পাঁচ মিনিটের গান চলতে চলতে শেষের পথে। পয়লা বৈশাখের বিশেষ অতিথিদের সঙ্গে
কথা শেষ। এখনো কোনো ইঞ্জিনিয়ারের দেখা নেই। স্টুডিওর ভেতরের তাপমাত্রা কাঁপুনি ধরাচ্ছে
এখনো। এবার অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের ফোন আসা শুরু হয়েছে। ফোনের সবুজ আলো জ্বলছে। “আমি
পাপড়ি সেনগুপ্ত কথা বলছি”। অনিন্দিতা পরের গানটা রেডি করছিল কম্পিউটারে।
বিশেষ স্যফটওয়ারে ক্লিক করে তবেই শ্রোতাদের পৌঁছে দিতে পারবে গান ও কথা। কিন্তু এ কার
গলার আওয়াজ? স্টুডিওর
থেকেও ঠান্ডা স্রোত বইছে ওর অন্তরে। হঠাৎ করে ওর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতি
বিদ্যুৎপৃষ্ট করে।
সে তো কবেকার কথা। পাপড়ি আর কুঁড়ি।
একইসঙ্গে অডিশন দিয়ে রেডিও অফিসে প্রবেশ। কর্মক্ষেত্রের সহজাত দাঁড়াশের বাইরে দুই
বান্ধবী। জনপ্রিয় অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্ব পড়ল দুই বান্ধবীর ‘গলা’র ওপর। পাপড়ির
গলা শুরুতেই হিট। কুঁড়ি তবে ফুটছে ধীরে ধীরে। শুরুর দিকে ভীরু গলা ছিল কুঁড়ির। পাপড়ি
যদিও বলতো এ গলা ভারি মিষ্টি। প্রশংসা, ইনক্রিমেন্ট, বোনাসে সবেতেই
তবে পাপড়ি আর কুঁড়ির তফাত ছিল স্পষ্ট।
কুঁড়ির বাইরেটা ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছিল, ভেতরে ছড়িয়ে
পড়ছিল গরল। হঠাৎ করেই বদল হল অনুষ্ঠানের প্রযোজক। সুমিত চৌধুরী। কুঁড়ি পথ বেছে নিয়েছিল।
মিষ্টি, ভীরু
একটা খোলস কেটে গুটি গুটি পায়ে বেরিয়েছিল একটা আদ্যোপান্ত অন্ধকার-মাখানো প্রতিযোগী
আর জে অনিন্দিতা। ভীরু গলার উপস্থাপনা হয়ে উঠেছিল স্মার্ট, আধুনিকতা আর
উচ্ছলতা মেশানো।
একদিন মিস্টার চৌধুরীর বুকের ঘন
লোম-এর ভেতর মুখ ডোবাতে ডোবাতে কুঁড়ি উগরে দিয়েছিল নিজের ভেতরের কাঁটা। রেডিও চ্যানেলের
ভোরের অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্ব পেল কুঁড়ি দাশগুপ্ত, সঙ্গে নিজের
মত করে অনুষ্ঠান সাজানোর স্বাধীনতা। পাপড়িকে দেওয়া হলো অন্য স্লট-এর অনুষ্ঠান। যেগুলোর
শ্রোতা কম। পয়লা বৈশাখের বিশেষ অনুষ্ঠান থেকেও বাদ পড়তে হয়েছিল পাপড়িকে, কুঁড়ির কারণে।
সে তো বছর পাঁচেক আগের কথা।
তার এক বছর পরে ছেড়ে দিয়েছিল পাপড়ি এই রেডিও স্টেশন।
সেদিনটা ছিল বাংলা নববর্ষ। যাওয়ার আগের দিন পাপড়ির চোখ দুটো হঠাৎ করেই যেন ধূসর রং-এ
বদলে যায়। কুঁড়ি অন্তত তাই দেখেছিল। অন্য
কেউ দেখতে পাচ্ছিল কিনা জিজ্ঞেস করেনি। মাঝেমাঝেই ওই চোখ দেখতে পায় আজকের অনিন্দিতা।
কোনদিন ভুল করে আয়নায় কুঁড়িকে দেখলে শিহরিত হয় আর জে অনিন্দিতা। নিজের চোখ-মুখে হাত
বুলিয়ে নেয়। মাঝে মাঝে পাপড়ির মুখটা ভেসে ওঠে। স্টুডিওয় ঢুকলেই তবে সবটা ভুলে যায়, হয়ে ওঠে আর জে
অনিন্দিতা। কিন্তু আজ এই নববর্ষে কে ফোন করেছে? মিষ্টি, ভীরু গলা। এ
তো অবিকল সেই কুঁড়ির গলা। অনিন্দিতা হয়ে ওঠার আগের কুঁড়ি। কিন্তু নাম বলছে পাপড়ি।
নিজের নামেই একসময় অনুষ্ঠান উপস্থাপনা
করত কুঁড়ি ও পাপড়ি। পরে অনেক কিছুই বদলেছে। কেরিয়ারের সিঁড়ি তরতরিয়ে উঠেছে। কুঁড়ি
থেকে আর জে অনিন্দিতা।
কিন্তু আজ কে ফোন করছে? পাপড়ির সঙ্গে অজস্র মুহূর্ত জমা ছিল কুঁড়ির। ঈর্ষাহীন সেই গলায় পাপড়ি সেনগুপ্ত নামে কে ফোন করেছে আরজে অনিন্দিতাকে? কুঁড়ি ওরফে আর জে অনিন্দিতার হাত-পা চলছেনা। ফোনের ওপ্রান্ত একটাই কথা বলে যাচ্ছে। পাপড়ির নামে। “আমি পাপড়ি সেনগুপ্ত বলছি, কুঁড়ির সঙ্গে কথা বলতে চাই”। কেউ যেন টেপ রেকর্ডার বাজাচ্ছে। এদিকে স্টুডিওর মধ্যে একটাই গান লুপে বাজছে। মাধুরী চট্টোপাধ্যায়। ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি'’। যে ডিউটি অফিসার রেডিওর অনুষ্ঠানটি শুনছিলেন, দৌড়ে এসেছেন তিনি। “আরে কি সব বাজছে রেডিওতে, আপনি স্টুডিওয় বসে করছেনটা কি! শ্রোতারা তো ফোন করছে”। আর জে অনিন্দিতা কিছু শুনতে পাচ্ছে না। ও দেখতে পাচ্ছে শুধু দুটো ধূসর চোখ আর একটা পচা, গলা ফুলের কুঁড়ি।
| বর্ষ বরণ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 29th Edition |
| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Bengali New Year, 2022 | April-June 2022 | Fifth Year Third Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |
খুব সুন্দর লাগলো..... তবে একটা না জানা রয়েই গেলো......
ReplyDeleteঅসাধারণ লেখা, পড়তে পড়তে কত কিছুই না মনে পড়ছে। আরও ভালো অনুভব করতে পারছি নিজে একজন রেডিও উপস্থাপক হিসেবে,অনেক কথাই বলতে ইচ্ছা করছে তবে সব সত্যি যে বলতে নেই। অসাধারণ লেখনী
ReplyDeleteভালো লাগলো।
ReplyDelete