গল্প-শিহরণ
শেষ সংকেত
অভীক সাধু
আনিশার সাথে রাজেশের অল্প কিছুদিন হলো বিয়ে হয়েছে, জামশেদপুরের মেয়ে আনিশা, বিয়ের পর স্বামীর সাথে কিষাণগঞ্জে চলে আসে। আনিশা জানে তার স্বামী জৈন ট্রান্সপোর্টের একজন সিনিয়ার একাউন্ট্যান্ট, কারণ সম্বন্ধ হবার সময়, রাজেশের জীবিকা সম্পর্কে রাজেশের পরিবার আনিশার পরিবারকে সেটাই বলেছিলো, আসলে এটা রাজেশের পরিবারও জানতো না যে ট্রান্সপোর্টে কোম্পানির আড়ালে জৈন কোম্পানির আসল ব্যবসা হলো স্মাগলিং! কিষাণগঞ্জ ভারত নেপাল বর্ডারের কাছে হওয়ার জন্য জায়গাটা স্মাগলারদের বেসক্যাম্প ...
রাজেশ মাঝে মধ্যেই দুতিনরাত থাকে না,আসলে সে স্মাগলিং গুডস পাচার করতে যায় কিন্তু আনিশাকে বলে যায় কাজে যাচ্ছে, তাকে নাকি ক্লায়েন্টদের হিসাবপত্রের কাজও দেখতে হয়, আনিশা বলে -” তুমি তো জৈনদের কোম্পানিতে একাউন্টসে কাজ করো | তাহলে তোমাকে অন্য লোক , সে ক্লায়েন্ট হোক বা যেই হোক , তাদের হিসাবপত্র দেখতে হবে কেন ?” রাজেশ উত্তর দেয় -”দেখো এটা তো কোনো বড়ো শহর নয় যে কাজের জন্য তুমি লোক চাই বলে হাঁক পাড়লে, আর লোক পেয়ে গেলে ! এখানে কাজের লোক পাওয়াই যায় না, তাই আমি ক্লায়েন্টদের কিছু কাজ করে দি , আর এতে পয়সাও পাওয়া যায়।” এটা সত্যি; আনিশা দেখেছে ছোট শহরে থাকলেও তাদের অভাব তেমন নেই, ডাবল ডোর রেফ্রিজারেটর, এ.সি , টিভি সবই আছে। বাড়িটার বাইরে থেকে দেখে অবশ্য বোঝা যায় না যে তার মধ্যেকার বাসিন্দাদের আধুনিক জীবনযাপনের সব উপাদানই মজুত ! তবু আনিশা রাজেশকে অনুযোগ করে যে প্রতি মাসেই অন্তত দুবার দুতিন দিন করে রাজেশের এই বাইরে কাটানো তার মোটেই ভালো লাগে না। রাজেশ হেসে বলে টাকা না থাকলে প্রেম ট্রেম উড়ে যাবে !
কিষাণগঞ্জে ঠান্ডা ভালোই পড়ে, সেবার দিওয়ালির পরেই বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। পুজো আর দিওয়ালি আনিশার সাথে কাটিয়ে রাজেশ তার কাজে বেড়িয়ে যায়, এইবার অবশ্য বাইরে যাবার জন্য রাজেশের অনিশাকে বেশি মানাতে হয়নি , কারণ প্রথমতঃ, লম্বা ছুটিতে রাজেশ তাকে নিয়ে কার্শিয়াং বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলো, ঘোরাটা সত্যিই খুব আনন্দদায়ক ছিল আনিশার কাছে - কেননা এই ভ্রমণ তার কাছে ছিল একঝলক টাটকা বাতাসের মতো, যা তার রোজকার একঘেয়েমির থেকে তাকে মুক্তির স্বাদ দিয়েছিলো। বেড়িয়ে ফেরার পথে পুরো একসপ্তাহ রাজেশ ছিল আনিশার বাড়িতে; দিওয়ালি এবার তারা জামশেদপুরেই উদযাপন করে, তাই রাজেশের তথাকথিত ক্লায়েন্টের কাজে যাবার কথা শুনে আনিশা খালি বলেছিলো, এবার একটু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করো। রাজেশ তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলে -” সুন্দরী বৌকে ফেলে ক্লায়েন্টের কাছে যাবার যে কি কষ্ট , তা যদি বুঝতে ! কিন্তু সবই পেটের দায় !” আনিশা কপট রাগ দেখিয়ে বলে -”থাক থাক, আর আদিখ্যেতা করতে হবে না !”
একদিন দুদিন করে এবার সাতদিন কেটে গেলো, কিন্তু রাজেশের ফেরার নামই নেই। প্রথম কয়েকদিন যদিও বা রাজেশের সাথে আনিশার মোবাইলে কথা হয়েছিল , শেষ দুদিন থেকে রাজেশের মোবাইলে নট রিচেবল আসছে, এবার আনিশা সত্যিই খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো, শেষ যেদিন তার সাথে রাজেশের কথা হয়, রাজেশের গলার স্বরে উদ্বেগ লক্ষ্য করেছিল আনিশা। সে রাজেশকে জিজ্ঞেস করে তুমি কি কিছু নিয়ে চিন্তায় আছো ? রাজেশ “ও কিছু না “-বলে এড়িয়ে যায়। এই শহরে তার চেনা জানা বলতে কেউই প্রায় নেই, রাজেশ তাকে কোনোদিন নিজের অফিসের কোনো বন্ধুর সাথেও আলাপ করায় নি। তাই নিরুপায় হয়ে আনিশা গেলো তাদের বাড়িওয়ালির কাছে- বাড়িওয়ালি পুনামজী বিধবা বৃদ্ধা, সারাদিন জপতপ পুজোআর্চা নিয়েই থাকেন, উনি বললেন –“দেখো বেটি, রাজেশ মেরে মকান তুম আনেসে একমহিনে পেহেলে কিরায়া পে লিয়া থা, আইডেন্টিটি কে লিয়ে রাজেশকা ভোটার কার্ড তো মেরে পাস হ্যায়, লেকিন উসসে জ্যাদা মুঝে কুছ নেহি মালুম!”
এতটা বলে পুনামজী একটু থামলেন; তারপর বললেন –“কিষাণগঞ্জমে মেরা চালিস সাল হো গ্যয়া,কিষাণগঞ্জ পোলিশবালা হেল্পফুল হ্যায় - ম্যায়নে তো আজতক কাভি নেহি শুনি, লেকিন মেরে খেয়ালসে, ফিরভি কাল তুম একবার থানাসে ঘুমকে আও, পোলিশ কো তো ইনফর্ম করনা হি পড়েগা।”
সেদিন বিকেল থেকেই খুব বৃষ্টি, আর তার সঙ্গে ঝড়, সন্ধ্যে হলে কারেন্টও চলে গেলো। আনিশার ইনভার্টারটা পিঁপ পিঁপ করে দুবার আওয়াজ করে স্তব্ধ হয়ে গেলো। ও বুঝলো যে ব্যাটারিটা হয়তো গেছে। রাজেশ দিওয়ালির সময় একবার বলেছিলো ব্যাটারি চেঞ্জ করতে হবে, কিন্তু শেষ কদিন লোডশেডিং না হওয়াতে আর এইরকম মানসিক অবস্থাতে সে ব্যাটারি চেঞ্জ করার কথা সম্পূর্ণ ভুলে মেরে দিয়েছে, কি আর করা ! দিওয়ালির সময় কেনা পড়ে থাকা একটা ছোট মোমবাতি সে জ্বালালো - তাতে অবশ্য ঘরের অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি, হঠাৎ দরজাতে ধাক্কা ! আনিশা চেঁচিয়ে বলে -”কে?”
“আমি রাজেশ, দরজা খোলো।”
আনিশা খুলে দেখে রাজেশের একহাতে ছাতা ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এতো বৃষ্টিতেও খালি একটা ছাতা থাকলেও রাজেশ ভেজে নি !
রাজেশ দ্রুত দরজা বন্ধ করে অনিশাকে একটা খাম দিয়ে বলে –“আমাকে আরেকবার অফিসে যেতে হবে।”
আনিশা বললো -”এই দুর্যোগের রাতে কোথায় যাবে ?”
হটাৎ আনিশার মোবাইল বেজে উঠলো। সে মোবাইল রান্নাঘরে ফেলে এসেছিলো, রান্নাঘরে গিয়ে দ্রুত ফোন ধরে দেখে পার্সোনাল লোনের জন্য কল, বিরক্ত হয়ে ফোন রাখতে না রাখতেই কারেন্ট চলে এলো,বসার ঘরে এসে দেখে - দরজা হাট করে খোলা- রাজেশের চিহ্নমাত্র নেই ! সে বাইরে বেরিয়ে দেখে রাস্তা ফাঁকা। খামের মধ্যে একটা চিরকুট আরেকটা চিঠি। চিঠিতে লেখা আছে-“গিজারের মধ্যে একটা প্যাকেট আছে, ওটা নিয়ে এখান থেকে পালাও।” সে কিছু বুঝতে পারে না - তার মাথা কাজ করছে না যেন ! তবু সে গিজার খুলে দেখে ভালোভাবে প্যাক করা একটা ছোট বাক্স, বাক্সের মধ্যে সোনার বিস্কুট ! আনিশার বুক কাঁপতে থাকে - এসব কি ? চিরকুটে দেখে লেখা আছে -মনীশ - আর একটা মোবাইল নম্বর, সে ওইনম্বরে ফোন করে, কিন্তু যাকে আনিশা ফোন করে, সে ফোন না ধরে লাইন কেটে দেয় ! তারপর একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে তার মোবাইলে, সে ফোন ধরলে কোনো সম্বোধন না করে খুব দ্রুত একটা অচেনা কণ্ঠ বলতে থাকে –“ভাবি - আপনার সামনে বিপদ, তাড়াতাড়ি পালান - ওরা রাজেশকে মেরেছে , আপনাকেও ছাড়বে না !”
আনিশা চেঁচিয়ে ওঠে –“কি যাতা বলছেন ?”
ওকে থামিয়ে দিয়ে লোকটি বলতে থাকে -” আমিও পালিয়ে বাঁচছি। আপনাকে বোধহয় রাজেশ কিছু বলেনি, আসলে আমরা একটা স্মাগলিং গ্যাঙের হয়ে কাজ করতাম। রাজেশ আর আমি সুস্থভাবে বাঁচতে চাইছিলাম,আমরা একজন পুলিশ অফিসারের সোর্স হিসাবে কাজ শুরু করেছিলাম- কিন্তু সর্ষের মধ্যেই তো ভূত থাকে, থানা থেকে কেউ সেটা আমাদের স্মাগলিং গ্যাঙের লিডারকে জানিয়ে দিয়েছিলো- তাই ওরা রাজেশকে শেষ করে দেয়,আমিও পালাচ্ছি , আপনিও পালান।” বলে লাইনটা লোকটি কেটে দেয়।আনিশা হতভম্বের মতো মাটিতে বসে পড়ে, সে যেন কাঁদতেও ভুলে যায় ! তাহলে যে তাকে সাদা খামটা দিয়ে চলে গেলো - সে কে ছিল ?
| বর্ষ বরণ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 29th Edition |
| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Bengali New Year, 2022 | April-June 2022 | Fifth Year Third Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post