নব বরষে
নবীন হরষে-গল্প
নববর্ষের আলো
শ্রাবণী গুপ্ত সরকার
Image Courtesy: Google Image Gallery
একদম
ছোট্টবেলায় হিয়া পয়লা বৈশাখকে ‘কয়লা বৈশাখ’ বলতো ঠিকই, কিন্তু এখন তো অনেক বড়ো হয়ে গেছে,
ক্লাস থ্রি বলে কথা। তাই মোটেই বলেনা এমন, বরং
ওর চাইতে ছোট কেউ বললে না হেসে সুন্দর করে
শুধরে দেয়।
পয়লা বৈশাখে ওদের বাড়িতে বেশ একটা ছোটখাটো
উৎসব হয়। একটু দূরের কালীবাড়িতে মা আর ঠাম্মা পুজো দিয়ে আসেন। তারপর সারা বাড়ি
মাতিয়ে তোলেন অপূর্ব সব রান্নার গন্ধে। দাদু একটার পর একটা ভালো ভালো গান বাজাতে
থাকেন। বাবা অফিসে যান বটে, কিন্তু অন্যদিনের চেয়ে আগে ফিরে আসেন।
সন্ধ্যাবেলা দাদুর সঙ্গে হিয়া বেরোয় আশপাশের
দোকানগুলোয় হালখাতা করতে। অনেক ক্যালেন্ডার, মিষ্টির বাক্স নিয়ে আসে ওরা বাড়িতে। আর সকাল বিকেল নতুন
জামা পরা তো আছেই। একটা মা আর বাবা দেন, অন্যটা দাদু আর
ঠাম্মা, কোনো কোনো বছর পিসিও আসেন নতুন জামার প্যাকেট হাতে।
গত দু’বছর দাদুর সঙ্গে হালখাতা করতে যাওয়া
বন্ধ। কি যে বাজে অসুখ এসে দাপিয়ে গেল দুটো বছর! সব আনন্দ, স্কুল, আঁকার ক্লাস, নাচের
স্কুল বন্ধ। হাঁপিয়ে উঠছে হিয়া আর ওর মতো অজস্র বাচ্চা।
এই বার অবশ্য মুখে রঙিন মাস্ক পরে মায়ের
সঙ্গে দোকানে গিয়ে দুটো চমৎকার ফ্রক কিনে এনেছে হিয়া। একটা হলুদ, বুকের উপর তিনটে বিড়াল ছানা খেলছে। অন্যটা ঝিরঝিরে আকাশি রঙের তার উপরে
টেডি গাছে জল দিচ্ছে এমন সুতোর কাজ করা।
লক ডাউনের সময়টা বড্ড খারাপ কেটেছে হিয়ার।
পার্কে গিয়ে খেলাধূলা বন্ধ। মায়ের সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করে রানি মাসি। সেও
কত্তোদিন আসে নি। রানি মাসির মেয়ে মিষ্টুও আসত আগে। হিয়ার সঙ্গে ওর দিব্যি ভাব।
শ্যামলা, মিষ্টি মুখের মেয়েটার গলায় চমৎকার সুর। কি সুন্দর শুনে শুনে
গান শিখত হিয়ার কাছে। এখন অবশ্য মাঝে মধ্যে মাসি ওকে নিয়ে আসে। তবে, মিষ্টু বাইরের ঘরেই চুপ করে বসে থাকে।
এখন তো হিয়াদের স্কুলও শুরু হয়েছে। যদিও
খুব কড়া নিয়ম মেনে থাকতে হয়। আগের মতো গল্পটল্প করা যায় না, অনেকটা জায়গা ফাঁকা রেখে বসতে হয়। তবুও স্কুলটা তো খুলেছে। বন্ধুদের দেখতে
পাচ্ছে এটাই শান্তি। একদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে মিষ্টুর সঙ্গে কথা হলো। ওদের স্কুল
সেদিন কোনো কারণে ছুটি, তাই মায়ের সঙ্গে এসেছে এ বাড়িতে।
মিষ্টুটা বড্ড রোগা হয়ে গেছে তো!
রাতে ঘুমের ঘোরটা একটু কেটে গেল বাবা আর
মায়ের কথাবার্তায়। মিষ্টুর বাবার কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই রানিমাসির মাইনেটা
একটু বাড়িয়ে দেওয়া দরকার এটাই আলোচনা করছিলেন ওরা। হিয়ার মনটা কেমন যেন করে উঠলো।
আহা রে! সামনেই পয়লা বৈশাখ। প্রতি বছরে ওরা দুজনে নতুন জামা পরে পয়লা বৈশাখে গান
করে আনন্দ করে। এই বছর হয়তো মিষ্টুর নতুন জামাই হবে না। তাহলে কী আর অমন মিষ্টি
করে গান গাইতে পারবে মনে দুঃখ নিয়ে।
হিয়াদের পাড়ায় পয়লা বৈশাখে একটা সুন্দর
প্রদর্শনী হয়। ছোটো, বড়ো সবার আঁকা আর হাতের কাজ নিয়ে। দুবছর পর
এবার আবারও হচ্ছে। মা তো খুব সুন্দর ছবি আঁকেন আর ঠাম্মা দারুণ ‘নিডল ওয়ার্ক’
করে্ন ওই যে এম্ব্রয়ডারী না কি যেন বলে। সেই সব বার করা হয়েছে প্রদর্শনীতে দেওয়ার
জন্য। মা রানি মাসিকেও বলেছেন ওর হাতের সেলাই জমা দেওয়ার জন্য। ম্লান মুখে মাথা
নেড়েছে রানি মাসি। ওদের এবার কিছুই নেই এখানে দেওয়ার মতো। গত দু’বছর যদি বা
চালিয়েছে অনেক কষ্টে, এবার মিষ্টুর বাবার কাজ চলে যাওয়ায়
রানি মাসির আর কোনো দিকে মন নেই।
পরশু পয়লা বৈশাখ। মিষ্টুকে আজ বিকেলে নিয়ে
আসতে বলে দিয়েছে হিয়া রানি মাসিকে। একটা গান গাইবে তো মিষ্টু, অনেকদিন পর তাই হিয়া একটু প্র্যাকটিস করিয়ে নেবে ওকে। তারপর মায়ের সঙ্গে
একটা কথা বলতে হবে ওর।
মিষ্টুর গলাটা এই দু’বছরে আরও মিষ্টি আর
সুরেলা হয়ে উঠেছে। কি চমৎকার গাইলো “এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার”। হিয়া
নিজে গাইছে “বৈশাখের এই ভোরের হাওয়ায়”। গানের পালা শেষ হতেই মা এসে ওদের ফল, মিষ্টি খেতে দিলেন। আর তারপর ... মিষ্টু ওর জামার পকেট থেকে বার করলো একটা
ভারী সুন্দর কারুকার্য করা রুমাল।
“দিদিভাই, মায়ের তৈরী
এই রুমালটা আমার কাছে ছিল। এটা তুমি প্রদর্শনীতে দিও। নতুন কিছু বানানোর টাকা আমার
মায়ের কাছে নেই গো। মায়ের খুব মন খারাপ এবার আমায় তো পয়লা বৈশাখের জামা দিতে পারবে
না তাই ... আমি বলেছি একটা তোলা জামা পরবো। আমার কোনো কষ্ট হবে না।”
“মনমরা হয়ে বসে আছিস কেন? কী হয়েছে রে?”
“একটা কথা বলবো মা? রাগ করবে না তো?”
“রাগের মতো হলে তো করবোই সোনা?”
“আমার পয়লা বৈশাখের জন্য কেনা হলুদ জামাটা
মিষ্টুকে দেবে মা? ওর তো এবার নতুন জামা হয়নি গো।”
“এমা! তাই তো। চল তো আমার সঙ্গে দোকানে।
ওর জন্য একটা জামা নিয়ে আসি। তোর জামা দিতে হবে কেন? আমি কিনে
দেবো তো মিষ্টুকে।” আনন্দে লাফাতে লাফাতে গিয়ে একটা হাল্কা কমলা রঙের মিষ্টি দেখতে
ফ্রক নিয়ে ফিরল হিয়া মায়ের সঙ্গে। মায়ের হাতে রানি মাসির কাজ করা রুমালটাও দিয়ে
দিয়েছে আগেই। মা সেটা পেয়েও খুব খুশি।
পয়লা বৈশাখ রানি মাসি আর মিষ্টু আসতেই মা
জামার প্যাকেটটা মিষ্টুকে দিয়ে পরে নিতে বললেন। মুখে হাসি চোখে জল নিয়ে ওরা মা আর
মেয়ে মাকে প্রণাম করল। দাদু আর ঠাম্মাকেও।
বিকেল বেলা ওদের ফাংশন খুব জমে গেল নতুন
জামার গন্ধে আর গানের ছন্দে। আর প্রদর্শনীতে নিজের হাতের কাজটা দেখে রানি মাসি তো
হতবাক হয়ে গেল। তারপর বাবা বাড়ি ফিরে বললেন বাবাদের অফিসে মিষ্টুর বাবার একটা কাজ
হয়ে গেছে।
সারাদিন আনন্দ, হাসি, খাওয়া দাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে রাত্রিবেলা
হিয়ার মনে হলো প্রতিবছরই নববর্ষটা যেন
এমনই হয়। সবার মুখে হাসি ফুটলেই সবচেয়ে ভালো লাগে তাই না?
| বর্ষ বরণ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 29th Edition |
| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Bengali New Year, 2022 | April-June 2022 | Fifth Year Third Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |
অনেক খুশি আর আনন্দ ❤️❤️❤️ মেঘলা মনে রোদ্দুরের ঝলক ❤️❤️❤️
ReplyDelete