অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



"অলীক পাতা নববর্ষ সংখ্যা ১৪৩১ প্রকাশিত, সমস্ত লেখক -লেখিকা এবং পাঠক -পাঠিকাদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা..."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Saturday, October 1, 2022

ভ্রমণ কাহিনী - একটি বিলুপ্ত বন্দর ও ক্যানিং সাহেবের বাড়ি -পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 

 ভ্রমণ কাহিনী 

একটি বিলুপ্ত বন্দর ও ক্যানিং সাহেবের বাড়ি
পায়েল চট্টোপাধ্যায়


পথ ডেকেছে...


শিয়ালদা থেকে ট্রেনে ক্যানিং স্টেশন। নীল আকাশ ঝাপটা মারে ট্রেনের জানলায়। ইতিহাস দেখার পথে পা বাড়ালেই মনে হয় টাইম-মেশিনে চেপে বসেছি। ট্রেন বা গাড়িকে তখন নিঃসন্দেহে টাইম মেশিন ভাবা চলে । আসলে ইতিহাস এমন বিলাসী ভাবনার জন্ম দেয়।ক্যানিং স্টেশনে যখন নামলাম একটা ঝিলিমিলি নীল রঙের আকাশ অপেক্ষা করেছিল। তবে নীল রঙের গায়ে লেগেছিল দুঃখের মতো কালো মেঘ । বিস্তৃত আকাশ দেখে মনে হচ্ছিল কালো মেঘ আলগাভাবে জড়িয়ে ধরেছে নীল আকাশকে। রবিবার বলে স্টেশন চত্বর ফাঁকা। তবে ঠিক শূন্য বলা চলে না। রোজগারের তাগিদে একটা রবিবারের গায়েও ব্যস্ততার গন্ধ লেগে যায়।

পথের শেষে অপেক্ষা করে থাকা অতীত

ক্যানিং স্টেশন থেকে খানিকটা এগোলেই একটা বাড়ি। রিক্সা, টোটো হাত বাড়িয়েই রয়েছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। বাড়িটায় পৌঁছলাম সহজেই। বাড়িটি ভগ্নপ্রায়, আগাছায় পূর্ণ। তবুও অতীতের রংমশালের মত জেগে রয়েছে সেই বাড়ি। একে বেমালুম স্মৃতি-ঘর বলা যায়। স্থানীয় মানুষের কাছে এই বাড়ি ক্যানিং হাউস বা ক্যানিং সাহেবের বাড়ি নামেই পরিচিত। ২০১৮সালে এই ক্যানিং হাউসকে ভারতীয় ঐতিহ্য কমিশন হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। খুব সম্প্রতি এই ভবনের সংস্কারের কাজ শুরুর কথাও শোনা যাচ্ছে। বাড়িটি দ্বিতল। আগাছা আর ফাটল অতীতের মতোই জাপটে ধরে রেখেছে ক্যানিং হাউসকে। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং-এর নামেই এই বাড়ি। বাড়িতে প্রবেশের আগে রয়েছে একটি সুবিশাল ফটকের ভগ্নাংশ। আগাছা ঘিরে রেখেছে প্রবেশদ্বারকেও । অতীত লাল ইটের মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে বর্তমানের ক্যানিং হাউসকে।

ইতিহাস-কথা

ক্যানিং হাউস নিয়ে নানান জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। শোনা যায় মাতলা নদীর তীরে বন্দর করে তোলার ইচ্ছে ছিল সেই সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের। কিন্তু বিঘ্ন ঘটায় খোদ নদী নিজেই। মাতলা ও বিদ্যাধরী নদীর এলোপাথাড়ি স্রোত, নাব্যতাও অভাব নষ্ট করে দেয় বন্দর। স্মৃতি হিসেবে থেকে যায় এই ভবন।কোনো ঐতিহাসিক বলেন ক্যানিং সাহেবের তৈরি এই অট্টালিকায় সাহেব নিজে থাকতেন। কেউ বলেন বন্দরের প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্যেও এই অট্টালিকা ব্যবহার করা হত।

১৮৫৬ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে যোগদান করেছিলেন লর্ড ক্যানিং। ১৮৬২ সালে উনি এই দেশ থেকে চলে গিয়েছিলেন। কথিত আছে এই ভগ্নপ্রায় বাড়ির অদূরেই নাকি আরেকটি বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে লেডি ক্যানিং ছবি আঁকার জন্য আসতেন। স্ত্রীকে সঙ্গ দিতে লর্ড ক্যানিংও এসে থাকতেন ওই বাড়িতে। যদিও বর্তমানে এই অন্য বাড়ির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

একটি বিলুপ্ত বন্দরের কথা


খিদিরপুর অঞ্চলে সেই সময় ইংরেজরা গড়ে তুলেছিল কলকাতা পোর্ট। কিন্তু পলি জমে যাওয়ার ফলে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ছিল সেই বন্দর। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটছিল। প্রযুক্তি তখন একেবারেই অনুন্নত। পলি সরিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ মসৃণ করার কোন উপায় সে সময় খুঁজে পায়নি ইংরেজ সরকার। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ সুগম করতেই ১৮৫৩ সালে ইংরেজ সরকার সুন্দরবন অঞ্চলে একটা বিকল্প বন্দরের কথা চিন্তা করতে শুরু করে। এই চিন্তা-ভাবনার মাঝেই ১৮৫৬ সালে ভারতের বড়লাট হয়ে আসেন লর্ড ক্যানিং। বিদ্যাধরী ও মাতলা নদীর সংযোগস্থলে একটি জায়গা পছন্দ করেছিল ইংরেজ সরকার। লর্ড ক্যানিং-এর নাম অনুসারে ওই অঞ্চলের নাম দেওয়া হয় ক্যানিং।

এদিকে বন্দর তৈরি করার জন্য প্রায় ৮০০ একর জমি আলাদা করে রাখা হয়েছিল। ২০টি জেটি তৈরি করা হয়েছিল। জেটি প্রতি ২টি জাহাজ নোঙর করা যেত। জেটি থেকে দূরের গুদামঘর পর্যন্ত ট্রাম লাইন পাতা হয়। আর এই গুদামঘর থেকে রেললাইন পেতে কলকাতা শহরের সঙ্গে যুক্ত করা হয় ক্যানিংকে। সেসময় শিয়ালদা স্টেশনের অস্তিত্ব ছিল না। বেলেঘাটা থেকে ক্যানিং পর্যন্ত রেল লাইনের কাজ শেষ হয়েছিল। ক্যানিং শহর গড়ে তোলার জন্যেও রাখা হয়েছিল প্রায় ৬৫০ একর জমি। ১৮৬২ সালে স্থাপিত হয় ক্যানিং পৌরসভা। ১৮৬৪ সালে মিস্টার ফার্ডিন‌্যান্ড শীলার মূলধনের যোগান-এর জন্য স্থাপন করেন পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড ইমপ্রুভমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। ১৮৬২ সাল থেকে ক্যানিং বন্দরে কাজ শুরু হয়। মূলত মাঝারি আকৃতির জাহাজ এই বন্দরের মাধ্যমে ভারত থেকে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক চালান করত।

১৮৬৫ সালে প্রথম দুর্ঘটনা ঘটে মাতলা নদীতে। শ্রমিকসমেত একটি জাহাজের সলিলসমাধি হয়। প্রতিবাদ শুরু করে কর্মচারীরা। পোর্ট ক্যানিং থেকে শ্রমিক চালান দেওয়া বন্ধ করা হয় অবশেষে। এদিকে মাতলা নদীর নাব্যতা কমতে থাকে। বড় জাহাজ বন্দরে আসার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হওয়া শুরু হয়।

এছাড়াও আরো কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছিল। স্থানীয় জেলেদের অসহযোগিতা, শ্রমিক অসন্তোষ পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড ইমপ্রুভমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডের শেয়ার-এর দাম অনেকটা কমিয়ে দেয়। কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি। ১৮৬৭ সালের ১লা নভেম্বর ভয়াবহ সাইক্লোন আছড়ে পড়ে ক্যানিং বন্দরে। প্রকৃতির রোষের মুখে পড়েছিল সুন্দরবন। আসলে ক্যানিং বন্দর তৈরির জন্য ম্যানগ্রোভ জঙ্গল কেটে ফেলা হয়েছিল। তাই কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থাই ছিল না প্রকৃতির কাছে। অসহায় বন্দর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় প্রকৃতির কাছে।

বেঙ্গল গভর্নমেন্টের ১৮৬৭-১৮৬৮ সালের বাৎসরিক রিপোর্ট অনুযায়ী '' দ্য স্টেশন হাউস, গুড শেডস অ্যান্ড দ্যা রেলওয়ে হোটেল ওয়্যার ব্লোন ডাউন।''পুরো এলাকাটি সমুদ্রের নুন এর একটি পুরু স্তরে ঢেকে গিয়েছিল। পানীয় জলের অভাব তৈরি হয়েছিল। বন্দর গড়ার স্বপ্ন তার অভিমুখ হারাতে থাকে সেই সময় থেকেই। তবুও ১৮৭০ সালে আবার বন্দর তৈরির একটা চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু পোর্ট ক্যানিং ইম্প্রুভমেন্ট প্রাইভেট
  লিমিটেডের লিকুইডেশনের ফলে বন্ধ হয়ে যায় ক্যানিং বন্দর। একটি নতুন কোম্পানি তৈরি হয়। 'দ্য পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড'। বর্তমানে স্মৃতি-চিহ্ন হিসেবে থাকা বাড়িটি কোন কোল ঐতিহাসিকের মতে আসলে পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড ইমপ্রুভমেন্ট লিমিটেড এর অফিস। কেউ বলেন লর্ড ক্যানিং এখানে থাকতেন। তবে ক্যানিং-এর স্থানীয় মানুষদের কাছে এই বাড়িটি ক্যানিং হাউস হিসেবেই পরিচিত। ‌পরবর্তীকালে এই বাড়িটি পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের থেকে কিনে নিয়েছিলেন ঈশ্বর জিতেন্দ্র মোহন ঘোষ। দোতলা বাড়িটিতে মোট ২৭টি ঘর রয়েছে, যার মধ্যে ব্যবহারযোগ্য ঘর ২টি। এখন বাড়ির অবস্থা ভগ্নপ্রায়, যদিও সংস্কারের কাজ শুরুর কথা শোনা যাচ্ছে। তবুও ক্যানিং অঞ্চলে আস্ত স্মৃতি হিসেবে জেগে রয়েছে এই ‘ক্যানিং হাউস’।

ফেরা

বাড়িটির মালিকানা যারই থাকুক, আপাতত অতীতের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেই আজও রয়েছে এই বাড়ির অস্তিত্ব। ইতিহাসের গন্ধ লেগে রয়েছে এই বাড়ি জুড়ে। সৌখিনভাবে বিদেশি ধাঁচে গড়ে তোলা হয়েছিল এই বাড়ি। আধুনিক যুগের মত হাতল দেওয়া ছিটকিনি ব্যবহার করা হত। প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাস জড়িয়ে থাকা এই বাড়িটির সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল পাকাপোক্ত। তাই ভগ্নপ্রায় দশা হলেও এই ছিটকিনি বা দরজার হাতল এখনো বেশ মজবুত।

পরিত্যক্ত এই বাড়ির চারিদিকে অচেনা মানুষের ভিড়। কেউ ইতিহাসের গন্ধের জন্য এসেছে, কেউ আবার নেহাতই কৌতূহল বশে ছুঁয়ে দিতে এসেছে একটা স্মৃতি-ঘরকে। অতীতের এই স্মৃতিচিহ্ন ঘুরে দেখতে তেমন সময় লাগে না, তবে এই ইতিহাসটুকু অন্তরে আত্তীকরণ করে নেওয়ার জন্য এই বাড়ি একেবারে আদর্শ স্থান। পরিত্যক্ত বাড়িটা থেকে যখন বেরোচ্ছি টুপটাপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অনেকটা দূর থেকে একটা আস্ত টাইম মেশিনের মতই দেখতে লাগছিল বাড়িটাকে। অতীতের গন্ধ লেগে থাকা ক্যানিং সাহেবের এই বাড়ির জন্যেই ওই অঞ্চল এখনো একটা পর্যটন স্থান। ইতিহাস শুষে নেওয়ার জন্যেই আজও মানুষ এখানে আসে, ছুঁয়ে দিয়ে যায় অতীত।


ক্যানিং সাহেবের বাড়ি...

ক্যানিং সাহেবের বাড়ি...


হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি



ক্যানিং সাহেবের বাড়ি সংক্রান্ত তথ্য

| শারদ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 30th Edition |

| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |

| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |

| Durga Puja , 2022 | July-Oct 2022 | Fifth Year Fourth Issue  |

© All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |

| a DISHA-The Dreamer Initiative |

 



 



No comments:

Post a Comment

Please put your comment here about this post

Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান